সাবেক কনজার্ভেটিভ সরকারের তুলনায় লিবারেল সরকার অধিক হারে দ্বৈত নাগরিকেদের নাগরিকত্ব বাতিল করছে

সরকারের দাবী – নাগরিকত্ব বালিত করা হচ্ছে তাদেরই যারা প্রতারণার মাধ্যমে নাগরিকত্ব নিয়েছেন, কিন্তু সমালোচকরা বলছেন একই পরিস্থিতিতে মন্ত্রী মরিয়ম মুনসেফ এর বেলায় সরকার হিপোক্রেটিক আচরণ করছে

নভেম্বর ৫, ২০১৬

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : লিবারেল সরকার ক্ষমতায় এসে সাবেক কনজার্ভেটিভ সরকারের করে যাওয়া বিতর্কিত ইমিগ্রেশন আইন (বিল সি-২৪) ব্যবহার করে গত আগস্ট পর্যন্ত ১৮৪ জন দ্বৈত নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে। যাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে তাদেরকে আদালতের আশ্রয় নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় লিবারেল সরকার সাবেক কনজার্ভেটিভ সরকারের তুলনায় অধিক আক্রমনাত্বকভাবে এই কাজটি করছে। খবর সিবিসি নিউজের।

গত ৭ অক্টোবর এ বিষয়ে ফেডারেল কোর্ট ফাইলিং এর সময় সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দেয় তারা নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়ে কোন স্থগিতাদেশ দিবে না। সরকার দাবী করে বিপুল সংখ্যক লোকের নাগরিকত্ব বাতিল করা হচ্ছে বলে যে দাবী করা হচ্ছে তা সঠিক নয়, এটি নিছকই অনুমানভিত্তিক দাবী।

উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে ইমিগ্রেশন মন্ত্রী জন ম্যাক্কুলাম সিনেট কমিটির সামনে বলেছিলেন তিনি নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়ে স্থগিতাদেশ দিতে রাজী আছেন। এই আইনের সংশোধনীকেও তিনি স্বাগত জানাবেন। তিনি এই কথা বলেছিলেন ব্রিটিশ কলম্বিয়া সিভিল লিবার্টিজ এসোসিয়েশন এবং কানাডিয়ান এসোসিয়েশন অব রিফিউজি লইয়ারস কর্তৃক এই বিষয়ে ফেডারেল কোর্টে একটি আইনী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার পর। ঐ দুটি সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় নাগরিকত্ব বাতিলের আইনটি স্থগিত করার জন্য যতক্ষণ না এ বিষয়ে আদালতে একটি মীমাংসা না হয়। বর্তমান আইন অনুযায়ী সরকার একক সিদ্ধান্তেই দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব বালিত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে যার নাগরিকত্ব বাতিল করা হলো তিনি আদালতের আশ্রয় নিতে পারবেন না।

উল্লেখ্য যে বিতর্কিত এই আইনটি নতুন করে আলোচনায় আসে যখন বর্তমান লিবারেল সরকারের ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউশনস মন্ত্রী মরিয়ম মুনসেফ এর পাসপোর্টে একটি ভুল তথ্য আবিস্কৃত হয়। তার আসল জন্মস্থান ইরানে। কিন্তু পাসপোর্টে লেখা আছে জন্মস্থান আফগানিস্তান। ইরানে তার জন্ম হয়েছে এই বিষয়টি মরিয়মের মা তাকে কখনো বলেনি। তারা কানাডায় আসেন আফগানিস্থান থেকেই। মরিয়মের জন্মস্থানের প্রকৃত তথ্যটি আবিস্কৃত হয় গ্লোব এন্ড মেইলের সাম্প্রতিক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। এই পরিস্থিতিতে আইন অনুযায়ী মন্ত্রী মরিয়ম তার নাগরিকত্ব হারাতে পারেন। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে এখনো কোন পদক্ষেপ নেয় নি। সমালোচকরা বলছেন ভুল তথ্য বা প্রতারণার মাধ্যমে যারা নাগরিকত্ব নিয়েছেন তাদের সাজা হচ্ছে কিন্তু মরিয়মের বেলায় সরকার হিপোক্রেসী করছে।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নাগরিকত্ব বিষয়ে তার সুষ্পষ্ট বক্তব্য পেশ করেছিলেন গত নির্বাচনের তিন সপ্তাহ আগে এক নির্বাচনী বিতর্ক অনুষ্ঠানে। তিনি বলেছিলেন, “ A Canadian is a Canadian is a Canadian”। তাঁর এই বক্তব্য ছিল তখনকার সরকারের করা ইমিগ্রেশন আইন (বিল সি-২৪) এর বিরোধীতা করার জন্য যে আইনে বলা আছে দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে যদি তারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে জরিত থাকার অভিযোগ অভিযুক্ত হন, কানাডার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা বা গুপ্তচরবৃত্তিতে অভিযুক্ত হন অথবা কানাডার বিরুদ্ধে অস্র হাতে নেন।

লিবারেল সরকার ক্ষমতায় এসে বিল সি-২৪ এর এই ধারাগুলো রদ করে। ফলে অভিযুক্তদের কানাডার বিদ্যমান আইনে বিচার করা যাবে কিন্তু নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে না। কিন্তু কেউ যদি ইমিগ্রেশন আবেদন পত্রে অথবা নাগিরকত্বের আবেদন পত্রে কোন মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকেন বা কোন কিছু গোপন করে থাকেন তবে তার নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে। এই আইন বিল সি-২৪ পাশ করার আগেও ছিল। তবে বিল সি-২৪ এ যা সংযোজন করা হয় তা হলো, এর বিরুদ্ধে আদলতে আপিল করা যাবে না।

উল্লেখ্য যে, কানাডায় দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিলের আইনটির (স্ট্রেংথেনিং কানাডিয়ান সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট, যা বিল সি -২৪ নামেও পরিচিত) সংশোধনের প্রস্তাব (অন্যান্য বিতর্কিত কিছু ধারা সহ) থার্ড রিডিং এর পর বিল  সি-৬ নামে পার্লামেন্টে পাস হয়েছে গত জুন মাসের ১৭ তারিখে। অবশ্য সিনেট কমিটি এখনো তাদের অনুমোদন দেয়নি। সিনেট কমিটির অনুমোদন পেলে রানীর সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে। রানীর সম্মতি পেলে বিল সি-৬ আইনে পরিনত হবে।

সাবেক কনজারভেটিভ সরকার কর্তৃক প্রণীত বিতর্কিত এই আইনটি সংশোধন করার জন্য গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টে বিল (বিল সি- ৬) তুলেছিল লিবারেল সরকার। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে লিবারেল পার্টির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও ছিল এটি। তারা বলেছিল, লিবারেল পার্টি ক্ষমতায় এলে দ্বৈত নাগরিকেদের নাগরিকত্ব হরণের আইনটি বাতিল করা হবে এবং সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট এর অন্যান্য বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধন করা হবে।

উল্লেখ্য যে, জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বাধীন লিবারেল সরকার গত ১০ মাসে (ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকে আগস্ট পর্যন্ত) ১৮৪ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে। আর বিগত সরকারগুলো (লিবারেল সহ) প্রায় একই সংখ্যক দ্বৈত নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে ২৭ বছর সময় নিয়ে।

ট্রুডো সরকার শপথ নেয় গত বছর ৪ নভেম্বর। ঐ মাসেই নাগরিকত্ব বাতিল করা হয় ২১ জনের। তার পরের মাসে নাগরিকত্ব বাতিল করা হয় ৫৯ জনের। আর এই বছর আগস্ট পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ১৩ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। সাবেক কনজার্ভেটিভ পার্টি ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রতি মাসে নাগরিকত্ব  বাতিল করেছে গড়ে ২.৪ জন করে।

ব্রিটিশ কলম্বিয়া সিভিল লিবার্টিস এসোসিয়েশনের প্রতিনিধি লরা ট্রাক বলেন, লিবারেল সরকার যখন বিরোধী দলে ছিল তখন তারা এই আইনের বিরোধীতা করেছে এবং বলেছে ক্ষমতায় এলে তারা এই আইনে সংশোধন আনবে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তারা সে কাজটি করেনি। বরং উল্টো কনজার্ভেটিভ সরকারের চেয়ে আরো বেশী মাত্রায় এই আইনটিকে ব্যবহার করছে দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিল করার জন্য।

লিবারেল সরকার বলছে তারা নাগরিকত্ব বাতিলের কাজটি করছে নাগরিকত্ব প্রদানের যে সিস্টেম তার বিশুদ্ধতা রক্ষা করার জন্য এবং যারা প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে তাদেরকেই টার্গেট করা হচ্ছে। ইমিগ্রেশন এন্ড সিটিজেনশীপ কানাডার কর্মকর্তা ন্যান্সী ক্যারন বলেন, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই নাগিরকত্ব বাতিল করা হয়েছে প্রতারণার ব্যাপারে বড় মাপের তদন্ত করার পর। এই তদন্তের ব্যাপারে আরসিএমপি ও বর্ডার এজেন্সীর সহায়তা নেয়া হয়েছে। যে সকল ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট এই সকল অবৈধ কাজে সহায়তা বা পরামর্শ দিয়েছে তাদেরকেও সাজা দেয়া হয়েছে। আর যে সকল বিষয়ে তদন্ত করা হয়েছে তার মধ্যে আছে আবেদনকারী আগের কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড গোপন করেছে কিনা বা আবেদন করার আগে নিয়ম অনুযায়ী কানাডায় যতদিন থাকার কথা ততদিন ছিল কিনা ইত্যাদি। তদন্তে দেখা গেছে হয় তারা আগের ক্রিমিনাল রেকর্ড গোপন করেছে অথবা কানাডায় শারীরিকভাবে অবস্থানের বিষয়ে মিথ্যা তথ্য প্রদান করেছে।

আইনজীবীদের দাবী, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোকের কেস প্রকৃতপক্ষে এই আইনের আওতায় পড়ে না। বি.সি. সিভিল লিবার্টিজ এসোসিয়েশন জানায় তারা এরকম দুটি কেস হ্যান্ডেল করছে। ঐ কেসে দেখা গেছে দুই জন তরুন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি কানাডায় এসেছিল শিশু অবস্থায় তাদের পিতা-মাতার সঙ্গে। তারা এই দেশেই বড় হয় এবং কোন আইন ভঙ্গ করেনি কখনো। কিন্তু তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে। আর নাগরিকত্ব বাতিলের কারণ হিসাবে যা বলা হয়েছে তা হলো, তাদের পিতা-মাতারা অনেক বছর আগে যখন আবেদন করেন তখন তাতে ভুল তথ্য দিয়েছিলেন।

নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে এমন একজন ব্যক্তি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সিবিসি নিউজের কাছে বলেন, তিনি কানাডায় আসেন তখন তার বয়স মাত্র ৯ মাস ছিল। কিন্তু তার বাবা দেশে থাকা অবস্থায় একটি ক্রিমিনাল কেসে জড়িয়েছিলেন যার তথ্য তিনি কানাডায় আসার পর গোপন করেছিলেন।

লিবারেল মন্ত্রী মরিয়ম মুন্সেফ এর বিষয়টিও এই তথ্য গোপন করার কেস। তিনি বলেন তার মা কানাডায় ইমিগ্রেন্ট হিসাবে আসার সময় মরিয়মের জন্মস্থানের বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারেননি। মরিয়মের একজন মুখপাত্র জানান, তিনি তার পাসপোর্টে এই তথ্যটি সংশোধন করবেন।

বি.সি. সিভিল লিবার্টিজ এসোসিয়েশন জানায় তারা আরেকটি কেস হ্যান্ডেল করছেন যাতে দেখা যায় এক মহিলা ইরান থেকে কানাডায় এসে পার্মানেন্ট রেসিডেন্সির আবেদন পত্রে নিজেকে সিঙ্গেল হিসাবে ঘোষণা দেন। কিন্তু পরে তদন্তে দেখা গেছে তিনি ইরানে তার স্বামীকে রেখে এসেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই মহিলা সিবিসিকে বলেন, তার বিয়ে হয়েছিল এক বৃদ্ধ ব্যক্তির সঙ্গে এবং তার ঐ স্বামী ছিল অত্যাচারী। এ কারণে তিনি ঐ ব্যক্তির অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে এসেছিলেন এবং নিজেকে তখন তিনি সিঙ্গেল হিসাবে বিবেচনা করেছেন।

সাবেক কনজারভেটিভ সরকার কর্তৃক প্রণীত বিতর্কিত বিল সি-২৪ আইনটি সংশোধন করার জন্য পার্লামেন্টে উঠানোর আগে এনডিপি’র এমপি জেনী কয়ান আহ্বান জানিয়েছিলেন এই বলে যে, নাগরিকত্ব বাতিলের আগে আদলতে হিয়ারিং এর সুযোগটা যাতে রাখা হয়। কিন্তু ইমিগ্রেশন কমিটির লিবারেল দলীয় চেয়ারম্যান তখন এই আহ্বানে সাড়া দেননি। ফলে এই বিল সি – ২৪ সংশোধন হয়ে বিল সি-৬ হিসাবে পার্লামেন্টে পাশ হলেও বিতর্কিত একটি ধারা রয়েই যায়। অর্থাৎ নাগরিকত্ব বাতিলের ব্যাপারে সরকারের একক সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। যার নাগরিকত্ব বাতিল হলো সে এর বিরুদ্ধে আদালতে আপিল করতে পারবে না।