মুসলিম ইমিগ্রেন্টদেরকে সুনজরে দেখেন না সিংহভাগ রক্ষণশীল কানাডিয়ান

রেড ইন্ডিয়ান, সাউথ এশিয়ান, এশিয়ান, ইহুদী এবং কৃষ্ণাঙ্গরাও রয়েছেন রক্ষণশীল কানাডিয়ানদের সুনজরের বাইরে

জানুয়ারী ৭, ২৯১৭

প্রবাসী কণ্ঠ : মুসলিম ইমিগ্রেন্টদেরকে সুনজরে  দেখেন রক্ষণশীল কানাডিয়ানদের সিংহভাগ। আরো যাদেরকে সুনজরে দেখা হয় না তাদের মধ্যে আছেন – রেড ইন্ডিয়ান, সাউথ এশিয়ান, এশিয়ান, ইহুদী এবং কৃষ্ণাঙ্গ ইমিগ্রেন্টরা। ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত ফোরাম রিসার্স এর এক জরীপে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। জরীপে দেখা গেছে কুইবেক প্রভিন্সে শতকরা ৫৭ জন কোন না কোন এথনিক গ্রুপকে সুনজরে দেখেন না। আলবার্টায় এই হার ৪৫%, আটলান্টিক কানাডায় ৩৯%, ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ৩৫% এবং অন্টারিও, মেনিটোবা আর সাচকাচুয়ানে ৩৩%।

কানাডায় সবচেয়ে বেশী অপ্রসন্নতা লক্ষ্য করা গেছে মুসলিম ইমিগ্রেন্টদের বিরুদ্ধে। শতকরা ২৮ বলেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে তারা সুনজরে দেখেন না। কুইবেকের অধিবাসীদের মধ্যে এই হার শতকরা ৪৮। আর কানাডার অন্যান্য অঞ্চলে রক্ষণশীল ভোটারদের মধ্যে এই হার শতকরা ৪০%।

জরীপে যে তথ্যটি উঠে এসেছে তা হলো, আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে যে, কানাডায় কিছু লোক আছেন যাদের মধ্যে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি অপ্রসন্নতা বিরজমান। তবে এই অপ্রসন্নতা খুব খারাপ পর্যায়ে চলে গেছে তা বলা যাবে না। আবার এও স্বীকার করতে হবে যে, এটি উপেক্ষা করার মতও নয়। আর এই অপ্রসন্নতা সঠিক অর্থে বর্ণবাদের ভাষান্তরও নয়। টরস্টার নিউজ সার্ভিসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন ফোরাম রিসার্স এর প্রেসিডেন্ট লরনে বজিনফ।

যারা নিজেদেরকে রক্ষণশীল দলের সদস্য বলে বিবেচনা করেন তারাই সবচেয়ে বেশীমাত্রায় অপ্রসন্নতার মনোভাব প্রদর্শণ করেছেন এবং একই সাথে ধর্মীয় পক্ষপাতিত্বও দেখিয়েছেন জরীপের উত্তর দিতে গিয়ে। এর পরে অবস্থানে আছেন কুইবেকের ব্লক কুইবেকোর সমর্থকগণ। ব্লক কুইবেকোর সমর্থকদের মধ্যে শতকরা ৫৫ ভাগ বলেছেন এক বা একাধিক এথনিক বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের সুনজর নেই। তবে শুধু রক্ষণশীল দলের সমর্থকরাই যে এ রকম মনোভাব প্রকাশ করেছেন তা কিন্তু নয়। দেখা গেছে লিবারেল পার্টি, এনডিপি এমনকি গ্রীন পার্টির সমর্থকদের মধ্যেও বিভিন্ন এথনিক গ্রুপ ও ধর্র্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে সুনজরে না দেখার মনোভাব রয়েছে। এদের হার যথাক্রমে শতকরা ৩৩, ৩০ এবং ৩১ ভাগ।

লরনে বজিনফ মনে করেন কনজারভেটিভ দলের সদস্যদের মধ্যে বেশী মাত্রায় বিভিন্ন এথনিক বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে সুনজরে না দেখার পিছনে দলীয় নেতাদের কিছু কার্যক্রম ভূমিকা পালন করে থাকতে পারে। এর মধ্যে আছে ‘এন্টি কানাডিয়ান ভ্যালুউজ’ এর বিষয়টি এবং নিকাব ইস্যু।

উল্লেখ্য যে, কনজারভেটিভ পার্টি অব কানাডার লীডারশীপ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া মহিলা প্রার্থী ক্যালী লিচ সম্প্রতি প্রস্তাব রাখেন – “যারা কানাডায় আসতে চান নতুন ইমিগ্রেন্ট হয়ে তাদের মধ্যে ‘এন্টি কানাডিয়ান ভ্যালিউজ’ বা কানাডিয়ান মূল্যবোধ বিরোধী কোন প্রবণতা আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা উচিৎ তাদের আবেদন গ্রহণ করার আগে। পরীক্ষা পাশ করলে তারা ইমিগ্রেশন পাবেন, পাশ না করলে তাদেরকে কানাডায় আসার স্বপ্ন ত্যাগ করতে হবে।” এজাতীয় এক বক্তব্য দিয়ে ক্যালী লিচ বিতর্কের শীর্ষে এসেছেন। তিনি বিতর্কের মুখমুখি হয়েছেন নিজ দলের লোকদের কাছেও।

ক্যালী মূলত মুসলিম ইমিগ্রেন্টদেরকে উদ্দেশ্য করেই এই এন্টি কানাডিয়ান ভ্যালিউজ এর বিষয়টি উত্থাপন করেছেন বলে অনেকের ধারনা। কারণ, বর্তমানে বৃটেনসহ গোটা ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতে মুসলিম ইমিগ্রেন্ট বা সম্ভাব্য মুসলিম ইমিগ্রেন্টদের নিয়ে চলছে এক ধরণের ফোবিয়া বা ভীতি যাকে ইসলামোফোবিয়া বলে আখ্যায়িত করছেন অনেকে। এই ফোবিয়াকে কাজে লাগিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মার্কিন নির্বাচনে ভোটারদের পছন্দের তালিকায় ছিলেন এবং তার ফলাফলও এখন উপভোগ করছেন। ক্যালী সম্ভত ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই আদর্শেই অনুপ্রানিত হয়ে কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যদের মধ্যে এক ধরণের বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করছেন। স্মরণ করা যেতে পারে যে, বিগত কনজারভেটিভ সরকারের আমলে এই ক্যালী লিচই মুসলিমদের “বার্বারিক কালচারাল প্র্যাকটিস” বিষয়টিকে উস্কে দিয়েছিলেন। তিনি তখন ছিলেন স্টিফেন হারপারের কনজারভেটিভ সরকারের কেবিনেট মিনিষ্টার।

বার্বারিক কালচারাল প্র্যাকটিস বলতে ক্যালী লিচ যা বলতে চেয়েছিলেন তা হলো, মুসলিম সমাজে জোরপূর্বক মেয়েদের বিয়ে দেয়া, অনার কিলিং, পুরুষ কর্তৃক বহুবিবাহ, মেয়েদের খৎনা করানো বা লিঙ্গাগ্রচ্ছেদ করা ইত্যাদি কিছু বিষয় আছে যা কানাডিয়ান সমাজে করতে দেয়া হবে না। কারণ এগুলো বর্বরোচিত আচরণ।

উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো যে বার্বারিক প্র্যাকটিস বা বর্বরোচিত আচরণ তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন ছিল, ক্যালী কি সত্যিই তা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন? যদি সত্যিই তিন এই প্র্যাকটিসগুলো বন্ধ করতে চেয়েছিলেন তবে এখন এ বিষয়ে কোন কথা বলছেন না কেন?

সমালোচকরা বলছেন, ঐ উদ্যোগের পিছনে আসল উদ্দেশ্য ছিল ভোটের রাজনীতি। মূল সমস্যা সমাধানে তাদের কোন আন্তরিক ইচ্ছা ছিল না। তারা চেয়েছিলেন নির্বাচনের আগে মুসলমানদের এই ইস্যুগুলোকে সামনে এনে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা বা মুসলিমদের সম্পর্কে একট নেতিবাচক ধারণা তৈরী করে একটা বিভেদ সৃষ্টি করা যাতে ঐ সময়কার আসন্ন নির্বাচনে বেশী ভোট পেতে সুবিধা হয়।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, গত জাতীয় নির্বাচনের আগে মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বা ভাবমূর্তি তৈরী করার জন্য ঐ সময়কার কনজারভেটিভ সরকার আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল যার একটি ছিল নিকাব ইস্যু। এই নিকাব, মেয়েদেরকে জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া, অনার কিলিং, মেয়েদের খৎনা করানো এর কোনটাই কিন্তু ধর্মের অংশ নয় এবং খোদ মুসলিম সমাজেই এগুলোকে ভাল চোখে দেখা হয় না। মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও আফ্রিকার কোন কোন অঞ্চলের মানুষজন নিজেদের এই পশ্চাদপদ রীতিনীতিকে বৈধতা দেয়ার জন্য ধর্মের দোহাই দিয়ে থাকেন।

কুইবেক প্রভিন্সেও কোন না কোন এথনিক/ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি অপ্রন্নতার মনোভাব থাকার পিছনেও কম-বেশী একই কারণ নিহিত বলে ধারণা করা হয়। অর্থাৎ কোন কোন এথনিক বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দলীয় নেতাদের নেতিবাচক প্রচারণার কারণে সাধারণ লোকদের মধ্যে এক ধরণের ফোবিয়া বা ভীতি তৈরী হয়। আর সেটা থেকেই কুইবেকেও তৈরী হয়েছে অপ্রসন্নতা বা সুনজরে না দেখার এই মনোভাব।

সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় কুইবেক বরাবরই ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী এবং এই মতবাদকে প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় প্রভিন্সটি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ নিয়ে প্রশ্নও আছে। কারণ, দেখা গেছে পার্টি কুইবেকো কুইবেক প্রভিন্সের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় গত ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এমন এক বিতর্কিত বিল পার্লামেন্টে তুলেছিল যা পাশ হলে সরকারী অফিস-আদালতে কর্মরত শিখদের পাগড়ী পরা, মুসলমানদের হিজাব, বেরাখা, নেকাব পরা, খ্রিষ্টানদের ক্রশ চিহ্ন ব্যবহার ইত্যাদি সবই বন্ধ হয়ে যেতো। আসলে ঐ বিলের মূল টার্গেট ছিল মূলত মুসলমানরাই। কিন্তু বিলটি যাতে আপতদৃষ্টিতে পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট বলে মনে না হয় সেই জন্যই তাতে যোগ করা হয়েছিল পাগড়ী, ক্রসচিহ্ন ইত্যাদি। এর প্রমাণ মিলে যখন দেখা যায়, খোদ কুইবেক পার্লামেন্ট ভবনের অভ্যন্তরে স্পীকারের মাথার উপর অবস্থিত যিশু খৃষ্টের ক্রশবিদ্ধ বিশাল আকৃতির দেয়াল মূর্তিটি অপসারণের ব্যাপারে পার্টি কুইবেকো অস্বীকৃতি জানায়।

কানাডায় মুসলিম সম্প্রদায়ের পর অন্য যে সব সংখ্যালঘু ধর্ম বা এথনিক কমিউনিটিকে সুনজরে দেখা হয় না তাদের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন আদীবাসী সম্প্রদায়। শতকরা ১৬ ভাগ লোক আদিবাসীদের ব্যাপারে অপ্রসন্ন। সাউথ এশিয়ানদের প্রতি অপ্রসন্ন শতকরা ১১ ভাগ লোক। এশিয়ানদের ব্যাপারে অপ্রসন্ন শতকরা ১০ ভাগ লোক। ইহুদীদের ব্যাপারে অপ্রসন্ন শতকরা ৯ ভাগ লোক এবং কৃষ্ণাঙ্গদের ব্যাপারে অপ্রসন্ন শতকরা ৮ ভাগ লোক। সাধারণভাবে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, কৃষ্ণাঙ্গরা বেশী মাত্রাতায় অপছন্দের তালিকায় আছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তাদের অবস্থান অন্যান্য সংখ্যালঘুদের তুলনায় কিছুটা ভাল।