কুইবেকে মুসলিম হত্যাযজ্ঞ
কানাডাব্যাপী মুসলিমদের প্রতি ব্যাপক সহানুভূতি প্রকাশ : ভীত না হওয়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৭
প্রবাসী কণ্ঠ : সম্প্রতি ইসলামিক কালচারাল সেন্টার অব কুইবেক এর মসজিদে যে বর্বরোচিত হত্যাকান্ড ঘটে গেল তার নিন্দা জানানোর ভাষাও যেন ভুলে গেছেন কানাডার মুসলমান সম্প্রদায়। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্বিত সবাই। সবার মনেই প্রশ্ন এই নৃশংতার জন্য দায়ী কে? মসজিদে হামলাকারী আলেকজান্ডার বিসোনেট নামের ঐ যুবক কি এককভাবে দায়ী? নাকি তার পিছনে আরো কোন ইন্দনদাতা বা প্রেরণাদাতা রয়েছেন? সেই ইন্দনদাতা বা প্রেরণাদাতা কে বা কারা? এরকম আরো অনেক প্রশ্ন চলে আসছে সামনে। কিন্তু কেউ ষ্পষ্ট করে কোন উত্তর দিচ্ছেন না। উত্তর দিচেছন না এই হামলার পিছনে রাজনৈতিকভাবে বা মতাদর্শগতভাবে কোন প্রেরণা কাজ করেছে কি না।
গত ২৯ জানুয়ারী ইসলামিক কালচারাল সেন্টার অব কুইবেকে মাগরিব নামাজ আদায়কালে আলেকজান্ডার বিসোনেট নামের এক যুবক অতর্কিতে স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হামলা চালায়। বন্দুক হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ৬ জন মুসল্লি। হামলার ঘটনায় আহত হন আরো ১৯ জন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আহত ৮ জন। এদের কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর।
মসজিদে মাগরিব নামাজ আদায়রত মুসল্লিদের উপর হামলা চালানোর পর গাড়িতে করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন আলেকজান্ডার। ঘটনাস্থল থেকে কিছু দুর গিয়ে ২৭ বছর বয়সী ঐ যুবক নিজেই ৯১১ এ কল করে পুলিশ ডাকেন এবং গুলিবর্ষণের ব্যাপারে পুলিশকে সহযোগিতার কথা বলেন। পুলিশ কর্মকর্তারা তার গাড়িতে তল্লাসী চালিয়ে দুটি রাইফেল এবং একটি একে-৪৭ রাইফেল উদ্বার করেন।
কুইবেক সিটি পুলিশ মসজিদে হামলাকারী আলেকজান্ডার বিসোনেটের বিরুদ্ধে ছয়জনকে হত্যার অভিযোগ আনেন এবং পাঁচজনকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগ আনেন। বর্তমানে তিনি পুলিশ হেফাজতে আছেন। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারী তাকে আবার আদালতে হাজির করা হবে।
হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন :
অধ্যাপক খালেদ বেলকাসেমি : কুইবেকের লাভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খালেদ বেলকাসেমি (৬০)। তিনি ১৯৮৩ সালে আলজিয়ার্সের একটি পলিটেকনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। পরে তিনি শেরব্রুক ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স ও ডক্টরেট ডিগ্রি নেন।
আজেদ্দিন সুফিয়ান : স্থানীয় এক গ্রোসারীর মালিক তিন সন্তানের পিতা আজেদ্দিন সুফিয়ান (৫৭)। তিনি মরোক্কো থেকে কানাডায় আসেন তিন দশক আগে লাভাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র হিসাবে। পরে তিনি স্থানীয় মুসলিম কমিউনিটিতে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে উঠেন নতুন আসা মুসলিম ইমিগ্রেন্টদের একজন স্বার্থহীন সাহায্যকারী হিসাবে।
আব্দেল করিম হাসান : সরকারের তথ্য প্রযুক্তি কর্মী তিন সন্তানের পিতা আব্দেল করিম হাসান (৪১) কানাডায় এসেছিলেন আলজেরিয়া থেকে।
আবু বকর থাবতি: ৪৪ বছর বয়সী আবু বকর থাবতির বাসা কুইবেক ইসলামী সেন্টার থেকে মাত্র ৫ মিনিটের হাটার দুরত্বে। তিনি একটি ফার্মেসীতে কাজ করতেন। দুই সন্তানের জনক ছিলেন। বড়টির বয়স ১০ এবং ছোটটির বয়স ৩।
মামাদু তানৌ ব্যারি : গিনি থেকে আসা মামাদু তানৌ ব্যারি (৪২) দুই সন্তানের পিতা। তিনি কাজ করতেন স্থানীয় একটি কসমেটিক কোম্পানীর টেকনিশিয়ান হিসাবে।
ইব্রাহিম ব্যারি : ইব্রাহিমও (৩৯)এসেছিলেন গিনি থেকে। কাজ করতেন কুইবেক হেলথ ইন্সুরেন্স বোর্ডে।
অভিযুক্ত বিসোনেট কুইবেকের অভিজাত শহরতলী ক্যাপ-রুজের বাসিন্দা ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি স্থানীয় লাভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়েন্স ও নৃবিজ্ঞানের ছাত্র। আক্রান্ত কুইবেক ইসলামিক কালচারাল সেন্টার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার। বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্ররা বিসোনেটকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক নিঃসঙ্গ তরুণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তবে তাকে এমন ভীতু দেখাতো যে তার পক্ষে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করা সম্ভব বলে মনে হয়নি বলে জানান তারা। একজন ছাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকালে তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তাতে সত্যি এটি মনে হয়েছে তিনি একজন ট্রাম্পপন্থী।
কুইবেক শহর এলাকায় শরণার্থীদের স্বাগত জানাতে কাজ করে এমন ফেসবুক গ্রুপ ‘বিয়েনভেন্যু অক্স রিফিউজি-ভিলে ডি কুইবেক’ দাবি করেছে, বিসোনেট ‘লে পেন’ পন্থী (লে পেন ফ্রান্সের কট্টরপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্ট পার্টির নেতা। এই দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তারা নারী বিদ্বেষী এবং চরমভাবে ইমিগ্রেন্ট বিরোধী) এবং নারীবাদ বিরোধী অবস্থানের জন্য লাভাল ইউনিভার্সিটি এবং সামাজিক মাধ্যমে পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও ইসরাইলী প্রতিরক্ষা বাহিনী, ডোনাল্ড ট্রাম্প, কট্টর ইসলাম বিদ্বেষী সমালোচক রিচার্ড ডাউকিনস এবং ক্রিস্টোফার হিচেন্সের পেইজেও তার পেইজ থেকে ‘লাইক’ করা হয়েছে বলে জানা যায়।
উল্লেখ্য যে, কুইবেক ইসলামিক সেন্টারে হামলা পরিচালনার মাত্র দুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলিমপ্রধান সাত দেশের নাগরিকদের জন্য তাঁর দেশের দরজা সাময়িকভাবে বন্ধের ঘোষণা দিয়ে একটি নির্বাহী আদেশে সই করেন। এর প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ চলছে। এ সময় কানাডা ঘোষণা দেয়, ট্রাম্পের বিধিনিষেধে আটকে পড়া মুসলিম ও শরণার্থীদের সাময়িকভাবে কানাডায় আশ্রয় দেয়া হবে। আর ঠিক ঐ সময়টাতেই কানাডায় মুসলিমদের ওপর এ হামলার ঘটনা ঘটল।
ঘটনার পরপরই কানাডার শোকার্ত প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, কানাডা এই ঘৃণ্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসবে খোলা হৃদয়ে এবং ঐক্যের ডাক নিয়ে। কানাডার পার্লামেন্টে দাড়িয়ে তিনি বলেন, কুইবেক সিটির ইসলামিক সেন্টারে পরিচালিত হামলায় যে ৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে তা সন্ত্রাসী ঘটনা। এই সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটানো হয়েছে কানাডার বিরুদ্ধে, কানাডিয়ানদের বিরুদ্ধে। তিনি কানাডায় বসবাসরত ১০ লাখ মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। কানাডার ৩৬ মিলিয়ন হৃদয় আপনাদের সঙ্গে সহমর্মী। আপনারা জেনে রাখুন আমরা আপনাদেরকে মূল্যায়ন করি। আপনারা কানাডার সমৃদ্ধিতে অবদান রেখেছেন অপরিমেয় ভাবে। আপনরা এ দেশেরই অংশ।
প্রধানমন্ত্রী কানাডিয়ানদেরকে ভীত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সন্ত্রাসবাদীদের উদ্দেশ্য আমাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা, তারা চায় অনৈক্য সৃষ্টি করতে এবং বিদ্বেষের বীজ রোপন করতে। আমরা তা হতে দিব না, আমরা আমাদের হৃদয় বন্ধ রাখবো না, খোলা রাখবো।
নিহতদের স্বরণে সংসদে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এর আগে অন্যান্য দলের পক্ষ থেকে বক্তব্য প্রদান করা হয়।
কনজারভেটিভ পার্টির অন্তর্বর্তীকালীন দলীয় প্রধান রোনা এমব্রোস বলেন, কুইবেক সিটির এই হামলা আমাদেরকে স্বরণ করিয়ে দিচ্ছে যে আমরা সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে মুক্ত নই। আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। এই হামলা কানাডার মৌলিক স্বাধীনতার অন্তরে আঘাত হেনেছে, নিরাপদে ধর্ম পালনের বিরুদ্ধে আঘাত হেনেছে। কানাডা যে নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত সেই নীতিকে অবজ্ঞা করেছে।
এনডিপি নেতা টম মূলকেয়ার বলেন, গুলিবর্ষনের এই ঘটনা কানাডার একেবারে মর্মস্থলে আঘাত হেনেছে। তিনি বিদ্বেষ, ধর্মান্ধতা এবং ইলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর জন্য সকল কানাডিয়ান নাগরিকের প্রতি আহ্বান জানান। হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, আমরা এই ধরণের কানাডায় বিশ্বাসী নই, আমরা এ ধরণের সমাজে বাস করতে চাই না। কানাডা একটি বৈচিত্রের দেশ। আমরা এই দেশে বিদ্বেষ ও হিংস্রতাকে বরদাস্ত করি না করবোও না।
নিহতদের স্বরণে পরের দিন সোমবার কানাডার জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করে রাখা হয় ।
কুইবেক সিটির ইসলামিক সেন্টারে হত্যাকান্ডের ঘটনার পর বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অনেকেই তাৎক্ষনিকভাবে তাদের সহানুভূতি প্রকাশ করেন। এদের মধ্যে যারা উল্লেখযোগ্য তারা হলেন, খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলো মার্কেল, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সোঁয়া অল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে। এছাড়াও নিউয়র্ক সিটি মেয়র বিল ডি ব্লাসিও ও লন্ডনের মেয়র সাদিক খান তাদের সমবেদনা জানান।
এদিকে কুইবেকের ঘটনার পর কানাডায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এখন নতুন করে আতঙ্ক বিরাজ করছে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে। এ কথা বলেন হ্যালিফেক্সের সেন্টার ফর ইসলামিক ডেভলাপমেন্ট এর ইমাম জিয়া খান। তিনি বলেন, কমিউনিটির অনেকেই মনে করছেন এটি বর্ধিত সহিংসতার শুরু মাত্র। তারা নিরাপত্তা আরো জোরদার করার দাবী জানান।
জিয়া খান বলেন, কুইবেকের ঘটনা এমন নয় যে তা শুধু মাত্র আমাদেরকে বিচলিত করছে, এটি এমন একটি ঘটনা যা রীতিমত আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে কানাডার মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে। তারা এখন ভাবছেন এর পরের টার্গেট কোন মসজিদ? তিনি বলেন এ ধরণের ভাবনা বা অনুভূতির মধ্যে থেকে কেউ স্বস্তি অনুভব করতে পারেন না। জিয়া খান আরো বলেন, কমিউনিটির কেউ কেউ ভীত হয়ে আছেন ভবিষ্যতে আরো আক্রমণ ঘটতে পারে এই আশংকায়।
জিয়া খান আরো বলেন, সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় এই ঘটনায় বিস্মিত এবং ভীত। তারা আগে থেকেই কিছুটা ভীতির মধ্যে ছিলেন। তিনি বলেন, ইতিপূর্বে হ্যালিফেক্সে তাদের মসজিদের দেয়ালে আপত্তিকর গ্রাফিটি (দেয়াল চিত্র) অংকন করা হয়েছে। তারা বিদ্বেষী ইমেইলও পেয়েছেন। স্থানীয় মুসলিমদেরকে কানাডা ছেড়ে চলে যাওয়ার কাথা বলা হয় ঐ সব ইমেইলে।
কুইবেকের পুলিশ কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলেছেন প্রভিন্সের অন্যান্য মসজিদের আশপাশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। অন্যদিকে টরন্টোর মেয়র জন টরিও স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন যাতে করে এখানকার নাগরিকেরা নিরাপদে থাকেন।
উল্লেখ্য যে, গত বছর জুন মাসে রমজান চলা কালে কুইবেক সিটির ইসলামিক সেন্টারের প্রধান দরজার সামনে কে বা করা শুকরের একটি কাটা মাথা র্যাপিং পেপার দিয়ে মুড়িয়ে রেখে যান। তাতে একটি স্টিকারও সংযুক্ত ছিল যাতে লেখা ছিল, Bon appétit যার ইংরেজী অর্থ হলো Enjoy your meal. তার কিছুদিন পর ঐ এলাকায় একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয় যাতে লেখা ছিল এই ইসলামিক সেন্টারটি জঙ্গীবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ঐ সব ঘটনার পর ইসলামিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ তাদের ভবনের চারপাশে ও ভিতরে সিকিউরিটি ক্যামেরা বসান। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। ভয়াবহ এক হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে হলো স্থানীয় মুসল্লিদেরকে। ইসলামিক সেন্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ লাবিদি বলেন, নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের অতিব প্রধান উদ্বেগের বিষয় ছিল। কিন্তু কি হলো শেষ পর্যন্ত?
কুইবেক প্রভিন্সে কট্টরপন্থী বা রক্ষণশীলদের তৎপরতা
কানাডার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কুইবেকে রক্ষণশীলদের তৎপরতা অনেক বেশী। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি রক্ষণশীল গ্রুপের অতিতৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে সেখানে। এর মধ্যে আছে Soldiers of Odin এবং La Meute। এরা কট্টরভাবে ইমিগ্রেন্ট বিরোধী। এবং একই সাথে মুসলিম বিরোধী। অবশ্য প্রকাশ্যে তারা এ অভিযোগ স্বীকার করেন না। কিন্তু তাদের কার্যক্রমই প্রমাণ করে তারা মুখে বলেন এক কথা আর কাজে করেন তার উল্টোটা। Soldiers of Odin এর মূল উৎপত্তি হলো ফিনল্যান্ডে। ফিনল্যান্ডের Soldiers of Odin এর কার্যকলাপে অনুপ্রাণিত হয়ে কুইবেকের রক্ষণশীলদের একটি গ্রুপ এখানে একটি চ্যাপ্টার খুলেছেন। কানাডায় Soldiers of Odin এর সদস্য সংখ্যা রয়েছে বর্তমানে প্রায় ৩৫০০।
Soldiers of Odin এর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তারা হোয়াইট সুপ্রিমেসী গ্রুপের কেউ নন। Soldiers of Odin ইমিগ্রেন্ট বিরোধী অথবা মুসলিম ইমিগ্রেন্ট বিরোধী এ জাতীয় অভিযোগও অস্বীকার করেন তারা। কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে সরকার কর্তৃক মুসলিম দেশ থেকে ইমিগ্রেন্ট গ্রহণ করায় তারা বেজায় অখুশী। হ্যামিলটনের সিটি কাউন্সিলর ম্যাথিও গ্রিন বলেন, এই গ্রুপটি এন্টি মুসলিম বা এন্টি ইমিগ্রেন্ট সেন্টিমেন্ট এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
রয়টার্স এর এক প্রতিবেদনেও বলা হয় Soldiers of Odin এর ওয়েবসাইটে একসময় এরকম বক্তব্য লেখা ছিল যাতে বলা হয়, ইসলামিস্ট অনুপ্রবেশকারীরা এ দেশে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে এবং তাদের কারণে অপরাধের মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘মাইগ্রেন্টস নট ওয়েলকাম’ লেখা প্লেকার্ডেও দেখা গেছে তাদের মিছিলে।
আমেরিকার এন্টি ডিফেমেশন লীগ এর বার্ষিক প্রতিবেদনেও বলা হয়, হোয়াইট সুপ্রিমেসী গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে এই Soldiers of Odin এর সম্পর্ক রয়েছে।
Soldiers of Odin এর মত এরকম আরেকটি গোষ্ঠি আছে যার নাম La Meute। সিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কানাডায় ইসলামী মৌলবাদ বিকাশের ব্যাপারে La Meute এর সদস্যরা আতংকিত। ফেসবুকে তাদের সদস্যের সংখ্যা এখন ৪৩ হাজারেরও বেশী। কুইবেকে তাদের উপস্থিতি ও তাদের রক্ষণশীল অভিব্যক্তি এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। ফেসবুকে তারা যে সকল তথ্য ও পোস্ট আদান প্রদান করছেন তার মধ্যে আছে হালাল পণ্য বর্জন করার আহ্বান, সরকারের মাল্টিকালচারালইজম পলিসির বিরুদ্ধে পিটিশন দাখিল করা, কুইবেকে ইসলামী ব্রাদারহুডের প্রভাব সম্পর্কে ফেসবুকে পোস্ট দেয়া ইত্যাদি।
La Meute এর প্রতিষ্ঠাতাগণ মনে করেন কুইবেক হলো উত্তর আমেরিকায় ইউরোপীয় সভ্যতার প্রধান কেন্দ্রস্থল। কিন্তু সেই কুইবেক এখন ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাস থেকে সংযোগহীন হয়ে গেছে। আর এ কারণেই এখানে ইসলামী মৌলবাদ তার কালো হাত প্রসারের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।
কুইবেক সিটির ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে চালানো হত্যাযজ্ঞের পর হয়তো এই জাতীয় রক্ষণশীল সংগঠনের উপর কর্তৃপক্ষ নজরদারী বৃদ্ধি করবেন। অবশ্য হত্যাকারী আলেকজান্ডার বিসোনেটের সঙ্গে এরকম সংগঠনের সরাসরি সম্পৃক্ততা এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। La Meute এর পক্ষ থেকেও বলা হয় আলেকজান্ডার কখনো তাদের সদস্য ছিল না।
এদিকে কুইবেক সিটির ইসলামিক সেন্টারে বন্দুক হামলার পর এই প্রভিন্সের প্রিমিয়ার নিজেই স্বীকার করেন যে কুইবেকে জেনোফোবিয়া এবং রেসিজমে বিশ্বাসী অপদেবতারাও বাস করেন। তিনি বলেন কুইবেকের খোলা এবং সহনশীল সোসাইটি নিয়ে আমাদের প্রসন্ন থাকলে চলবে না।
কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসেস এর সাবেক কর্মকর্তা ও হোমগ্রোন টেররিস্ট এক্সপার্ট ফিল গুরস্কি বলেন এই মুহুর্তে ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন অনেক, কিন্তু উত্তর কম। সিটিভি নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সামনের সপ্তাহগুলোতে তদন্ত কর্মকর্তারা দেখবেন হামলাকারীর সঙ্গে আরো কেউ জড়িত আছেন কি না এবং হামলার পিছনে কি উদ্দেশ্য কাজ করেছে তাও খতিয়ে দেখবেন তারা। এর পিছনে কি উদ্দেশ্য ছিল তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না এই হামলা সন্ত্রাসী হামলা কি না।
উল্লেখ্য যে, কুইবেকে মুসলিম বিরোধী একটা বাতিক বা প্রবণতা অনেক আগে থেকেই ছিল। সেখানে রক্ষণশীল রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেককেই মুসলিম বিরোধী অবস্থান নিতে দেখা গেছে ইতিপূর্বে। এমনকি আদালতেও দেখা গেছে হিজাব পরা মুসলিম মহিলাদের প্রতি অশোভন আচরণ করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে রানিয়া এলাউল নামের এক মুসলিম মহিলা কোর্টে গিয়েছিলেন তার গাড়িটি পুলিশের হেফাজত থেকে ছাড়িয়ে আনার আবেদন নিয়ে। কিন্তু কুইবেক কোর্টের বিচারক এলিনা মারেঙ্গো তার আবেদন শুনতে রাজী হননি। কারণ ঐ মহিলার মাথায় হিজাব পরা ছিল। বিচারকের যুক্তি ছিল- কোর্ট রূমে কোন ধর্মীয় পোষাক পরা যাবে না।
‘পার্টি কুইবেকো’ কুইবেক প্রভিন্সের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় গত ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এমন এক বিতর্কিত বিল পার্লামেন্টে তুলেছিল যা পাশ হলে সরকারী অফিস-আদালতে কর্মরত শিখদের পাগড়ী পরা, মুসলমানদের হিজাব, বেরাখা ও নেকাব পরা, খ্রিষ্টানদের ক্রশ চিহ্ন ব্যবহার ইত্যাদি সবই বন্ধ হয়ে যেতো। ঐ বিলের মূল টার্গেট ছিল মূলত মুসলমানরাই। কিন্তু বিলটি যাতে আপতদৃষ্টিতে পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্টু বলে মনে না হয় সেই জন্যই তাতে যোগ করা হয়েছিল পাগড়ী, ক্রসচিহ্ন ইত্যাদি। এর প্রমাণ মিলে যখন দেখা যায়, খোদ কুইবেক পার্লামেন্ট ভবনের অভ্যন্তরে স্পীকারের মাথার উপর অবস্থিত যিশু খৃষ্টের ক্রশবিদ্ধ বিশাল আকৃতির দেয়াল মূর্তিটি অপসারণের ব্যাপারে পার্টি কুইবেকো অস্বীকৃতি জানায়।
কুইবেকে কিছু রক্ষণশীল রেডিও স্টেশন আছে যারা মুসলিম বিরোধী প্রচার চালায়। এরকম রেডিও স্টেশনকে Radio poubelle বা ট্রাস (ডাস্টবিন) রেডিও বলা হয় কখানো কখনো। এরা প্রায়ই মুসলিম বিরোধী প্রচার প্রচারণা চালায়। স্থানীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করে বলেন, এই রেডিও স্টেশনটিতে যখন মুসলিম বিরোধী প্রচারণা চলে তখন সিটির বাস ড্রাইভাদের কেউ কেউ হাই ভ্যলিউমে রেডিও বাজিয়ে অন্যদের তা শুনাতে থাকেন।
বছর খানেক আগে যখন প্যারিসে এক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছিল তখন মন্ট্রিয়লে এক মুখোশধারী যুবক তার বদলা নিতে কানাডায় প্রতি সপ্তাহে একজন করে মুসলমান বা আরবীয় ইমিগ্রেন্টকে হত্যা করবে এই মর্মে ইউটিউবে এক ভিডিও বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। যুবকটি দাবী করেন তিনি একা নয়, তাকে সহায়তা করার জন্য আরো লোক আছে।
পুলিশ অবশ্য তাকে গ্রেফতার করেছে। তবে তার নাম প্রকাশ করা হয়নি। আর ইউটিউব থেকে ঐ ভিডিও বার্তাটিও অপসারণ করা হয়।
গ্রেফতারকৃত ঐ যুবকটি তার ভিডিও বার্তায় আরো বলেছিলেন, তিনি কুইবেকে বসবাসকারী মুসলিম অভিবাসীদের ব্যাপারে হতাশ। সরকার যদি এই মুসলিম অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তবে তিনি নিজেই এগিয়ে আসবেন।
কুইবেকের নারকীয় ঐ হত্যাযজ্ঞের পর অন্টারিও প্রিমিয়ার ক্যাথেলিন উইন টরন্টোর ডাউনটাউনে অবস্থিত একটি মসজিদে মুসল্লিদের সঙ্গে দেখা করে তাদের সান্ত¡নার বাণী শোনান। তিনি বলেন, কুইবেক সিটিতে অবস্থিত মসজিদের অভ্যন্তরে যে হত্যাকান্ড চালানো হয়েছে তা কাপুরুষোচিত সন্ত্রাসী হামলা। বিষন্নবদনে ক্যাথেলিন উইন বলেন, প্রার্থনা করার সময় আমরা অন্টারিওতে বা কানাডায় যে যেই ধর্মেরই অনুসারী হই না কেন কারো কোন ভয় থাকা উচিত নয়। এখানে ধর্মীয় উপসনালয়ে যাবার ব্যাপারে হিংস্রতার কোন স্থান নেই। কুইবেকের ঘটনায় আমরা সকলেই মর্মাহত।
ক্যাথেলিন আরো বলেন, কানাডায় আমরা কেউই ভিন্ন নই। আমরা সবাই এক। এ দেশে আদীবাসী জনগোষ্ঠি ছাড়া বাকি সবাই অন্য কোন দেশ থেকে এসেছি এই দেশটিকে গড়ে তোলার জন্য।
মসজিদের ইমাম জনাব শিহাব বলেন, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আমাদেরকে অনুধাবন করতে হবে আমরা কানাডিয়ানরা সবাই বিদ্বেষ ও হিংস্রতার বিরুদ্ধে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। একজন ব্যক্তিবিশেষের অপরাধের জন্য গোটা কমিউনিটিকে দোষারোপ করা শোভন নয়। হিংস্রতার কোন ধর্ম নেই, সন্ত্রাসেরও কোন ধর্ম নেই।
কুইবেক সিটিতে অবস্থিত ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে নৃশংস হামলার পরের দিন সোমবার কানাডাব্যাপী জাগরণ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ ব্যাপক সংখ্যক কানাডিয়ান নাগরিক। তারা সকলেই কানাডার মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করেন।
কুইবেকে অনুষ্ঠিত জাগরণ মিছিল ও সমাবেশে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, এনডিপি নেতা টম মুলকেয়ার, কুইবেক সিটির মেয়র রেজিস লেবুমসহ আরো অনেকে। এই সময় অনেকের হাতে ছিল জলন্ত মোমবাতি। কেউ কেউ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন নিহতদের কথা স্বরণ করে। চোখের পানি মুছতে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকেও।
প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জাগরণ মঞ্চে উঠে বলেন, মুসলিম সম্প্রদায় কানাডার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি নিহত ছয় জনের নাম উচ্চারণ করেন এবং বলেন যারা নিহত হয়েছেন আর যারা আহত হয়েছেন তারা কেউই কানাডার জন্য হুমকী ছিল না, তারা সকলেই আপনার আমার মত কানাডিয় নাগরিক। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি, আমরা আপনাদের ভালবাসি এবং আমরা আপানদের সমর্থন করি।
সমাবেশে অংশগ্রহনকারী একজন মুসলিম বলেন, আমি খুবই মর্মাহত হামলার ঘটনায়। কিন্তু একই সাথে আমি আশান্বিত যখন দেখতে পাচ্ছি যে কানাডায় আমাদের সহনাগরিকগণ আমাদের পাশে এসে দাড়িয়েছেন, আমাদের প্রতি সহানুভূতি জানাচ্ছেন, আমাদের বেদনাকে শেয়ার করছেন।
পার্লামেন্ট হিলে অনুষ্ঠিত জাগরণ অনুষ্ঠানে কানাডার গভর্নর জেনারেল ডেভিড জনস্টোন বলেন, কানাডিয়ানদের এক কাতারে এসে দাড়াতে হবে।
নিহতদের স্বরণে ক্যালগারীর সিটি হলেও জাগরণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সময় সিটি হলে অন্যান্যস্থানের মত কানাডার জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত ছিল। ঐ সমাবেশে বিশিষ্ট ইমাম ও ইসলামিক সুপ্রীম কাউন্সিল অব কানাডার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট সৈয়দ সোহরাওয়ার্দী বলেন, আমি কানাডায় অবস্থিত মুসলিমদের মঙ্গল নিয়ে খুবই আতংকিত এবং বেশ উদ্বিগ্ন। আমি এখানকার মসজিদগুলোর নিরাপত্তা নিয়েও বেশ উদ্বিগ্ন। আমি উদ্বিগ্ন আমাদের নারী-পুরুষ ও শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে।
উল্লেখ্য যে, কানাডায় মুসলমান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা আগের তুলনায় অধিক হারে ঘৃণা ও বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের শিকার হচ্ছেন। এই রিপোর্ট স্ট্যাটিসটিক্স কানাডার। রিপোর্টে দেখা যায় ২০১৩ সালে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ৬৫ টি ঘৃণা ও বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। আর ২০১২ সালে এরকম ঘটনা ঘটেছে ৪৫ টি।
রিপোর্টে আরো বলা হয়, কানাডায় বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষপ্রসূত যে অপরাধের ঘটনা ঘটে থাকে সেগুলো বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকদের বিরুদ্ধে অপরাধ বেশী মাত্রায় (৩৩%) সহিংস হয়ে থাকে। আর এই মাত্রা মুসলমান মহিলাদের বেলায় আরো বেশী (৪৭%)। কারণ হিসেবে বলা হয়, মুসলমান মহিলারা ঘরের বাইরে হিজাব ও বোরখা ব্যবহার করে বিধায় তারা খুব সহজেই চিহ্নিত হন এবং আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন।
দৈনিক ন্যাশনাল পোস্টের সঙ্গে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিম এর হিউম্যান রাইটস কো-অর্ডিনেটর আমীরা এলগাওয়েবী বলেন, বিষয়টি অপ্রীতিকর এবং এটি প্রমাণ করছে যে, কানাডায় মুসলমানের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের নিজস্ব তথ্য-উপাত্ত বলছে ২০১৪ সালে এই পরিস্থিরি আরো অবনতি ঘটেছে। সুতরাং বিষয়টির প্রতি আরো বেশী করে নজর দেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে।
ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিম এর মতে মুসলমান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকদের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের সব খবর মিডিয়াতে আসে না। সে কারণে স্ট্যাটিসটিক্স কানাডা যে হিসেব দেখিয়েছে তা বাস্তব অবস্থার সামগ্রিক চিত্র নাও হতে পারে।
কানাডার হাফিংটন পোস্ট এর কলামিস্ট আবু বকর কাশিম সম্প্রতি তার এক কলামে লিখেছেন, “কানাডায় মুসলমান ইমিগ্রেন্টরা অতিমাত্রায় অবজ্ঞার শিকার হচ্ছেন। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্নস্থানে জঙ্গী হামলার কারণে মুসলমান ইমিগ্রেন্টদের জীবন বেশ চ্যালেঞ্জের মুখমুখি হয়ে পড়েছে।” আবু বকর তার কলামে ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর এলিমিনেশন অব রেসিয়াল ডিসক্রিমিনেশন উদযাপনের কয়েকদিন আগে প্রকাশিত এক জরীপের তথ্য তুলে ধরেন যাতে দেখা যায়- “কানাডার অর্ধেকেরও বেশী লোক মনে করেন মুসলমানদেরকে বিশ্বাস করা যায় না। তারা আরো মনে করেন, মুসলমানদের এই অবস্থার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। ঐ জরীপে আরো দেখা যায় কুইবেকের ৭০% ফারাসী ভাষাভাষীর লোকেরা মুসলমানদেরকে বিশ্বাস করেন না। অপরদিকে কানাডার অন্যান্য অঞ্চলের ৪৩% ইংরেজী ভাষাভাষীর লোকেরাও মুসলমানদেরকে বিশ্বাস করেন না। আর মুসলমানদের এই পরিণতির জন্য কারা দায়ী এমন প্রশ্নের উত্তরে ৪২% কানাডিয়ান মনে করেন, এ জন্য মুসলমানদের কর্মকান্ডই দায়ী।”
কানাডায় সাধারণ মানুষের মধ্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে রোষানল বৃদ্ধির জন্য সাবেক কনজারর্ভেটিভ সরকার ও তার প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারও চেষ্টা চালিয়েছেন বলে কেউ কেউ অভিযোগ তুলেন। কানাডীয় আইনজীবী ডেনিস এ্যাডনি স্টিফেন হারপারকে প্রকাশ্যে মুসলমান বিরোধী এক ধর্মান্ধ ব্যক্তি বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, “এটি প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট প্রমাণাদিও রয়েছে।” গত জাতীয় নির্বাচনের আগে স্টিফেন হারপার নিকাব ইস্যু নিয়ে যে ভূমিকা পালন করেছেন তার মধ্য দিয়েও কানাডায় মুসলিম বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। অভিযোগ রয়েছে যে, মুসলিম বিরোধী মনোভাব তৈরী করে নির্বাচনে জয় লাভ করতে চেয়েছিলেন হারপার।
ইতিপূর্বে কানাডার অন্যান্য মহল থেকেও নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছে মুসলমান বিরোধী মনোভাবকে চাঙ্গা করার জন্য। ‘ইমিগ্রেশন ওয়াচ কানাডা’ নামের একটি সংস্থার ওয়েবসাইটে প্যাট্রিক গ্রেডি নামের একজন এক লেখা লিখেছেন যার শিরোনাম ছিলো, “মুসলিম ইমিগ্রেন্টরা কানাডায় জঙ্গী হুমকী সৃষ্টিতে ইন্ধন যোগাচ্ছে”।
প্যাট্রিক লিখেছেন, “ইমিগ্রেশন পলিসির মাধ্যমে কানাডার সরকারগুলো দেশটিকে ইসলামী জঙ্গীদের কাছে ক্রমবর্ধমানভাবে অরক্ষিত করে তুলেছে।” তিনি আরো লিখেছেন, “৯/১১ এর ঘটনার পর এটি খুবই সুষ্পষ্ট ছিল যে উত্তর আমেরিকাকে ইসলামী জঙ্গীদের কাছ থেকে আরো বেশী মাত্রায় হুমকী মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু তা জানা সত্বেও কানাডার বিভিন্ন সময়কার সরকার প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫৬ হাজার মুসলিম ইমিগ্রেন্টকে এ দেশে আসার অনুমতি দিয়েছে। ২০০২ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সরকার ৬ লক্ষ ২৩ হাজার মুসলিম ইমিগ্রেন্ট এনেছে কানাডায়। এদের মধ্যে এক লাখ এক হাজার এসেছে পাকিস্তান থেকে এবং ৭১ হাজার এসেছে ইরান থেকে। আর এই দুটি দেশই আন্তর্জাতিক জঙ্গী তৎপরতায় সরকারীভাবেই সহায়তা করে থাকে।”
প্যাট্রিক অবশ্য বলেছেন, “সব মুসলমানই জঙ্গী তা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই মুসলিম কমিউনিটিই কানাডায় জঙ্গীদের জন্ম ও আশ্রয় দিচ্ছে।”
এ প্রসঙ্গে কনজারভেটিভ পার্টি অব কানাডার লীডারশীপ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া মহিলা প্রার্থী ক্যালী লিচ এর সাম্প্রতিক এক প্রস্তাবের কথাও স্বরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, “যারা কানাডায় আসতে চান নতুন ইমিগ্রেন্ট হয়ে তাদের মধ্যে ‘এন্টি কানাডিয়ান ভ্যালিউজ’ বা কানাডিয়ান মূল্যবোধ বিরোধী কোন প্রবণতা আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা উচিৎ তাদের আবেদন গ্রহণ করার আগে। পরীক্ষা পাশ করলে তারা ইমিগ্রেশন পাবেন, পাশ না করলে তাদেরকে কানাডায় আসার স্বপ্ন ত্যাগ করতে হবে।” ক্যালী লিচ সম্প্রতি এই বক্তব্য দিয়ে বিতর্কের শীর্ষে এসেছেন। তিনি বিতর্কের মুখমুখি হয়েছেন নিজ দলের লোকদের কাছেও। তার এই বক্তব্য বা প্রস্তাবকে অনেকেই বর্ণবাদী আচরণ বলে মন্তব্য করেছেন।
ক্যালী লিচ এর এ বক্তব্য থেকে এটা খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে তিনি মূলত সম্ভাব্য মুসলিম ইমিগ্রেন্টদেরকে উদ্দেশ্য করেই এই এন্টি কানাডিয়ান ভ্যালিউজ এর বিষয়টি উত্থাপন করেছেন। কারণ, বর্তমানে বৃটেনসহ গোটা ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতে মুসলিম ইমিগ্রেন্ট বা সম্ভাব্য মুসলিম ইমিগ্রেন্টদের নিয়ে চলছে এক ধরণের ফোবিয়া বা ভীতি যাকে ইসলামোফোবিয়া বলে আখ্যায়িত করছেন অনেকে। অন্যান্য কয়েকটি বিষয়সহ এই ফোবিয়াকে কাজে লাগিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
আজকে কুইবেকে যে হামলার ঘটনা ঘটলো তার পিছনে অতীতের এসব ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রবণতা কতটা দায়ী সে বিষয়টিও বিবেচনার দাবী রাখে।
আমরা দেখেছি কানাডায় মুসলমানদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা থাকলেও ২০০৬ সালে Environics Institute পরিচালিত জরীপে দেখা গেছে কানাডায় মুসলমানরা এখানকার মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চায় এবং কানাডায় আসতে পেরে তারা খুশী।
অন্য একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকেও দেখা যাচ্ছে কানাডায় জঙ্গীবাদের প্রসার ও জঙ্গী হামলার পিছনে ইমিগ্রেন্ট কমিউনিটি বিশেষ করে মুসলিম ইমিগ্রেন্ট কমিউনিটি সূতিকাগার হিসাবে কাজ করছে
সাবেক সরকারের এমন ধারণাকে পাল্টে দেয়। গবেষণা পত্রে বলা হয়, কানাডায় জঙ্গীবাদের সূতিকাগার ইমিগ্রেন্ট কমিউনিটি নয়। আর এই গবেষণার কাজটি পরিচালনার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন মুসলিম বিদ্বেষী হিসাবে পরিচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার ২০১৪ সালে যখন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন এবং ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনের জন্য জোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
ঐ গবেষণা রিপোর্টের তথ্য সিবিসি নিউজ প্রকাশ করে গত বছর ৬ জুন।
গবেষকগণ আরো দেখতে পান, কানাডার বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা এবং মুসলিম ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে পারষ্পরিক অনাস্থা সৃষ্টির পিছনে মূলত কাজ করেছে কিছু জাতীয় সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল। এর সাথে আছেন একদল বুদ্ধিজীবীও যারা মুসলিম ইমিগ্রেন্টদেরকে বরাবরই কানাডার জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকী হিসাবে চিহ্নিত করে আসছেন। জাতীয় সংবাদপত্র, টিভি ও এই বুদ্ধিজীবীদের অতিকথনের কারণে কানাডায় মুসলিম জনগোষ্ঠির প্রতি সাধারণ মানুষের ব্যাপক সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে এবং একই সাথে বৈষম্যের মনোভাবও তৈরী হয়েছে।
আমরা দেখেছি কানাডার ব্যাপক সংখ্যক মুসলমান মনে করেন দেশটির সঙ্গে তাদের শক্তিশালী সংযুক্তি রয়েছে। নিজেদেরকে তারা একাট্রা মনে করেন কানাডার সঙ্গে। নতুন এক জরীপ রিপোর্ট থেকে এই তথ্য জানা যায়। জরীপটি চালিয়েছে এনভাইরনিকস ইন্সিটিউট নামের একটি সংস্থা।
জরীপে দেখা যায় কানাডায় বসবাসরত ৮৩% মুসলমান নিজেদেরকে কানাডিয়ান ভেবে খুবই গর্ববোধ করেন। ২০০৬ সালের তুলনায় এই গর্ববোধের অনুভূতি বৃদ্ধি পেয়েছে ১০%। কৌতুহলের বিষয় হলো, অমুসলিম জনগোষ্ঠির মধ্যে এই অনুভূতি মুসলমানদের তুলনা কম! মাত্র ৭৩% অমুসলিম খুবই গর্ববোধ করেন নিজেদের কানাডিয়ান পরিচয় নিয়ে।
সন্দেহ নেই বিশ্বব্যাপী ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে একদল লোক সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে যার সঙ্গে পাশ্চাত্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলামোফোবিয়া সৃষ্টির একটি যোগসূত্র রয়েছে। তবে কানাডার কথাই যদি ধরা হয় তবে দেখা যাবে এখানকার একশ্রেণীর রক্ষণশীল রাজনীতিক, মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীও এই ইসলাম বিদ্বেষ তৈরীতে ইন্ধন যোগাচ্ছেন যারা সাধারণভাবে ইমিগ্রেন্টদের পছন্দ করেন না, যারা বিশেষভাবে মুসলিমদের পছন্দ করেন না। পর্যবেক্ষ মহলের মতে, এসকল কারণেই মুসলিম সম্প্রদায় এখানে অধিক হারে ঘৃণা বা বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের শিকার হচ্ছেন। ফলে এ কথা সম্ভবত বলা যাবে না যে, কুইবেকের এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ অচমকা ঘটে গেছে। আর এ কথা বলে পার পাওয়ারও কোন সুযোগ নেই যে এটি একটি লোন ওলফের অর্থাৎ একক ব্যক্তির কাজ।
প্রচ্ছদ পরিচিতি : কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তার স্ত্রী সোফি গ্রোগওয়ার কুইবেক সিটিতে বন্দুক হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন পুষ্পস্তবক অপর্ণ করে। দুই পাশে নিহত ৬ জনের ছবি। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবি সমূহ নেয়া হয়েছে কানাডিয়ান প্রেস ও সিবিসি নিউজ থেকে।