ধর্ম ও রাজনীতি : কানাডিয়ান স্টাইল
নভেম্বর ১০, ২০১৫
খুরশিদ আলম
পৃথিবীতে ধর্মের আবির্ভাবের পর থেকেই সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য এর রাজনৈতিক ব্যবহার (বা অপব্যবহার) হয়ে আসছে। কেউ কেউ অবশ্য বলে থাকেন যে মর্ত্যে ধর্মের আবির্ভাব ঘটেনি, একে সৃষ্টি করা হয়েছে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। ক্ষমতাসীন মানুষ যাতে করে সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ করতে পারেন নির্বিঘেœ সেই উদ্দেশ্যেই এই ধর্মের সৃষ্টি।
ধর্মের আবির্ভাব বা সৃষ্টি কি ভাবে হলো সেই বিতর্কে না গিয়েও এ কথা স্পষ্টভাবেই বলা যায় যে, যুগে যুগে ধর্মের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ করেছে স্বার্থন্বেষী মহল। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, যে সকল দেশ বা সমাজ শিক্ষায়, মননশীলতায় ও চিন্তাধারায় যতটা পশ্চাদপদ, সেই দেশ বা সমাজে ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহার ততটা বেশী। এশিয়া অথবা আফ্রিকার পশ্চাদপদ দেশগুলোই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ঐ সব দেশে সমাজপতি বা রাষ্ট্রের ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা নানান কূটকৌশল অবলম্বন করে থাকেন সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ করার জন্য। আর এ ক্ষেত্রে তাদের প্রধান অবলম্বন হলো ধর্ম ও রাজনীতির যুগপৎ অপব্যবহার।
কিন্তু কানাডার মতো একটি উচ্চ শিক্ষিত, আধুনিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়ও যে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার (বা অপব্যবহার) হতে পারে তা দেখে এবার অনেকেই আশ্চর্য হয়েছেন। নাগরিকগণ অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন অশোভন এই প্রক্রিয়াটিই এবারের সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনে অবাধে এবং অসঙ্কোচে ব্যবহার করা হয়েছে। বেদনাহতরা প্রশ্ন তুলেছেন- এ-ই কি কানাডা? রাজনীতির নামে কানাডার মতো একটি দেশে এ কি আচরণ?
স্বরণ করা যেতে পারে যে, গত জুন মাসে কনজারভেটিভ পার্টির এক এমপি ভেঙ্গুভারের একটি চার্চে বক্তব্য রাখার সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারকে যীশু খ্রীস্টের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন! রাজনীতির নামে এই জাতীয় নোংরামী তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে হয়তো মানানসই কিন্তু তাই বলে কানাডায়ও? একজন কানাডিয়ান এমপি’র মুখ থেকে এ জাতীয় কথা অনেকেই সেদিন স্তম্ভিত হয়েছিলেন। আলোচিত ঐ এমপি’র নাম ওয়াই ইয়াং। তিনি ভেঙ্গুভার সাউথ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০১১ সালের নির্বাচনে। হংকং বংশোদ্ভূত এই এমপি বিসি’র সাবেক প্রিমিয়ার উজ্জল দোসানকে হারিয়ে ঐ আসনটি দখল করেছিলেন। এবার অবশ্য পরাজিত হন আরেক ভারতীয় বংশোদ্ভূত (পাঞ্জাবী ) ব্যক্তির কাছে যার নাম হারজিত সাজ্জন। হারজিত লিবারেল পার্টির হয়ে এবার ঐ আসনটি দখল করে নেন।
ওয়াই ইয়াং কানাডার রাজনীতিতে নতুন কেউ ছিলেন না। গত প্রায় ৩ দশক ধরেই তিনি এ দেশের রাজনীতিতে সক্রিয়। শৈশবেই চলে এসেছিলেন কানাডায়। তার লেখাপড়া কানাডাতেই। সুতরাং তাকে অশিক্ষিত বা পশ্চাদপদ কোন সমাজের লোক বলা যাবে না। অথচ তার মুখ থেকেই শুনতে হয়েছে এ জাতীয় উক্তি। আরো আশ্চার্যের ব্যাপার হলো, স্টিফেন হারপার তাকে দল থেকে বহিস্কার করেননি। বোধহয় মনে মনে তিনি খুশিই হয়েছিলেন ওয়াই ইয়াং এর ঐ উক্তি শুনে।
ওয়াই ইয়াং গত ২৮ জুন ভেঙ্গুভারের হারভেস্ট সিটি চার্চে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে স্টিফেন হারপারের উদ্যোগে গৃহিত সন্ত্রাস বিরোধী আইন বিল সি-৫১ প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, ১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়ায় যে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল তা ঘটতো না যদি সেই সময় বিল সি-৫১ এর মতো আইন থাকতো। তিনি দাবী করেন কানাডার গোয়েন্দা সংস্থা বোমা হামলার পরিকল্পনার কথাটি আগে থেকেই জানতো। কিন্তু আইনী কারণে তাদের হাত-পা বাঁধা ছিল। তাই তারা বিষয়টি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকদেরকে জানাতে পারেনি। তিনি হারপার ও তার প্রবর্তিত আইনের প্রশংসায় এতটাই পঞ্চমুখ হয়ে উঠেন যে একপর্যায়ে বলেই ফেলেন, “অপরাধ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে স্টিফেন হারপার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা খ্রীস্ট ধর্মের প্রবর্তক যীশু খ্রিস্টের গৃহীত পদক্ষেপের সঙ্গে তুলনীয়।”
পরে অবশ্য ওয়াই ইয়াং স্বীকার করেন এয়ার ইন্ডিয়ায় বোমা হামলার প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছেন সেটা ভুল ছিল। তবে তিনি যীশু খ্রীস্টের গৃহীত পদক্ষেপের সঙ্গে স্টিফেন হারপারের গৃহীত পদক্ষেপ সমূহের তুলনা করে যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি প্রত্যাহার করেননি।
উল্লেখ্য যে, ১৯৮৫ সালের ২৩ জুন মন্ট্রিয়ল-দিল্লী রুটের একটি ভরতীয় বিমানে ভারতীয় শিখ জঙ্গী গ্রুপের সদস্যরা বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে ৩২৯ আরোহী নিহত হন। এদের মধ্যে ২৬৮জনই ছিলেন কানাডার নাগরিক যাদের বেশীরভাগই ভারতীয় বংশোদ্ভূত। বিমানটিতে যখন বোমা বিস্ফোরণ ঘটে তখন সেটি আটলান্টিক মহাসাগরের (আয়ারল্যান্ডের উপকূলে) উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল।
ওয়াই ইয়াং স্টিফেন হারপার প্রবর্তিত বিল সি-৫১ এর প্রশংসা করতে গিয়ে যে বিতর্কিত বক্তব্য রেখেছেন সেই বিলটিও কিন্তু চরম বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল কানাডায় নির্বাচনের আগে। আর এই বিল সি-৫১ মূলত কানাডার একটি নির্দিষ্ট ধর্মসম্প্রদায়কে টার্গেট করেই করা হয়েছিল সন্ত্রাসবাদ প্রতিহতের নাম করে।
আমরা দেখেছি সি-৫১ বিলটি পাশ হওয়ার আগেই কানাডার মূলধারায় এর বিরুদ্ধে প্রচন্ড বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়ে এটি। টরন্টোসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ফলে পাশ হওয়ার আগে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তেরও মুখোমুখি হতে হয় বিলটিকে । কিন্তু বিতর্ক, বিরোধিতা, বিক্ষোভ এবং তদন্ত এর কোন কিছুই বিলটিকে আইনে পরিনত করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি স্টিফেন হারপারের একগুঁয়েমীর কারনে। স্টিফেন হারপারের পরিকল্পনা ছিল নির্বাচনে জয়ী হতে হলে ইসলামোফোবিয়াকে কাজে লাগাতে হবে। অর্থাৎ ধর্মকে ব্যবহার করতে হবে। আর ঐ পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য তিনি এই আইনটি পাশ করান যাতে করে মূলধারার খ্রীস্টান ধর্মালম্বিদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থকদের মধ্যে বেশীরভাগই গোঁড়াপন্থি খ্রীস্টান। আরেক তথ্যে জানা যায়, যে যত বেশী গোঁড়া সে তত বেশী কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থক। স্টিফেন হারপার নিজেও একজন গোঁড়া খ্রীষ্টান।
কানাডিয়ান আইনজীবী ড্যানিস এ্যাডনি’র মতে স্টিফেন হারপার একজন মুসলিম বিদ্বেষী ধর্মান্ধ ব্যক্তি। গুয়ান্তনামার বন্দি ওমর খাদারের কেসটি নিয়ে লড়েছেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন হারপার যে মুসলিম বিদ্বেষী এটি প্রমাণ করার যথেষ্ট প্রমানাদিও রয়েছে তার কাছে।
উল্লেখ্য যে, মধ্যপ্রাচ্যে ‘আই এস’এর সাম্প্রতিক কর্মকান্ড, গত বছর কানাডার পার্লামেন্টে মানসিক বিকারগ্রস্থ এক ফেঞ্চ কানাডিয়ান যুবকের হামলা এবং তারো আগে কুইবেকে আরেক হতোদ্যম ও বিষন্নতায় ভোগা যুবক কর্তৃক একজন কানাডীয় সৈন্যকে হত্যা করার বিষয়টিকে জঙ্গীপনার ইস্যু বানিয়ে স্টিফেন হারপার সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে পুনঃনির্বাচিত হওয়ার জন্য এই সন্ত্রাস বিরোধী আইনটি পাস করিয়েছেন। হরপারের সমালোকচকরা এমন অভিযোগই করে আসছেন আইনটি পাশ করানোর পর থেকে। তারা আরো বলছেন এই আইনে অতিমাত্রায় কিছু অস্পষ্ট বাক্য রয়েছে যা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে এর অপব্যবহারের মাধ্যমে। তাদের আরো অভিযোগ, এই আইন সন্ত্রাস এর বিরুদ্ধে কোন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে না। বরং কানাডিয়ানদের নাগরিক অধিকারকে খর্ব করবে। এই আইন উপকারের চেয়ে অপকার করবে বেশী। মোদ্দা কথা, এটি সবার জন্যই একটি হুমকী হয়ে দেখা দিবে।
কিন্তু এই আইন কানাডায় সন্ত্রাস বিরোধী কার্যক্রমকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বা আদৌও পারবে কি না সে প্রশ্ন যেমন উঠছে তেমনি প্রশ্ন উঠছিল আইন প্রনয়ণকারীদের উদ্দেশ্য নিয়েও। নির্বাচনের আগে টরন্টো স্টার পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের এই সন্ত্রাস বিরোধী আইনটি একটি পোষা-প্রকল্প। তিনি আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন আসন্ন নির্বাচনের আগেই বিলটি পাস করাতে হবে যাতে জনগন ভাবে তার দল দেশের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থানে রয়েছে।”
অর্থাৎ এই বিল সি-৫১ নিয়ে স্টিফেন হারপার যে সম্পূর্ণভাবেই রাজনীতি শুরু করেছিলেন তা নিয়ে কারো দ্বিমত ছিল না। এবং এ ক্ষেত্রেও তিনি রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়েছেন। সোজা কথায় নির্বাচনে জয়ী হবার জন্য ইসলাম ধর্মালম্বীদেরকে বলির পাঁঠা বানিয়েছিলেন তিনি।
কানাডার রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বা ব্যবহার অবশ্য আগেও ছিল। কিন্তু মুসলমানদেরকে টার্গেট করে এরকম ব্যাপক প্রচারণা বা রটনা অথবা জিগির আগে কখনো করতে দেখা যায়নি। কারণ, আগে কানাডায় মুসলমানদের উপস্থিতি এত বেশী ছিল না। তাছাড়া মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো মতো তেমন কোন ইস্যুও ছিল না। সাম্প্রতিককালে হোমগ্রোন টেররিস্টদের আবির্ভব ঘটার পর একটা ইস্যু পেয়ে যায় রক্ষণশীল কনজারভেটিভ পার্টি। সেই সাথে গত বছর পার্লামেন্ট ভবনে ঐ হোমগ্রোন টেররিস্টদের একজনের আক্রমন এবং তারো আগে কুইবেকে এক সেনা সদস্যের উপর আরেক হোমগ্রোন টেররিস্টের আক্রমন কনজারভেটিভ পার্টির জন্য মুসলিম বিদ্বেষী প্রচার প্রচারনা চালানোর পথ সুগম করে দেয়। এর সাথে সর্বশেষ যোগ হয় নিকাব ইস্যু। যদিও এর কোনটার সঙ্গেই এখানকার সাধারণ মুসলমান নাগরিকদের কোন সম্পৃক্ততা ছিল না।
এরিখ ম্যাং নামের এক ব্লগার (যিনি একসময় অন্টারিওতে হ্যারিস সরকারের এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে ক্যাম্ববেল সরকারের রাজনৈতিক সহায়তাকারী ছিলেন) তার এক লিখনিতে উল্লেখ করেন, কানাডায় যারা প্রোটেস্টান তাদের মধ্যে রক্ষণশীল কনজারভেটিভ পার্টির প্রতি সমর্থন বেশী দেখা যায়। ক্যাথলিকদের মধ্যে মধ্যপন্থি লিবারেল পার্টির প্রতি সমর্থন বেশী দেখা যায় এবং যারা ধর্মে বিশ্বাস করে না বা যারা বামপন্থী তাদের মধ্যে নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) প্রতি সমর্থন বেশী দেখা যায়। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, স্টিফেন হারপারের দলীয় কমিটিতে এবং অফিসের কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রোটেস্টানদের সংখ্যা বেশী।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে স্টিফেন হারপার ক্ষমতায় থাকাকালীন সবসময়ই ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের একটা পরিমন্ডলের মধ্যেই থাকতেন। আর এরিখ ম্যাং যে তথ্য দিয়েছেন তার সমর্থন পাওয়া যায় ওঢ়ংড়ং-জবরফ এর এক জরীপেও। তাদের তথ্য মতে দেখা যায় ‘যে যত বেশী ধর্মপ্রাণ সে তত বেশী কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থক’।
স্টিফেন হারপার রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার কি ভাবে করতে হয় সেটি বেশ ভাল করেই রপ্ত করেছিলেন। খ্রীষ্ট ধর্মের প্রোটেস্টানদের সমর্থন ছাড়াও তিনি ইহুদী ধর্মালম্বীদের সমর্থন পেয়ে আসছিলেন বেশ ভাল মাত্রায়ই। রয়টারের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০১১ সালের নির্বাচনে তিনি ইহুদীদের অনেক ভোট পেয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের প্রতি স্টিফেন হারপারে অতিমাত্রায় সমর্থন ছিল এ কথা সবারই জানা। আর ঐ সমর্থনের কারণেই তিনি কানাডায় বসবাসরত ইহুদী সম্প্রদায়ের ব্যাপক সমর্থন পেয়ে আসছিলেন।
Ipsos-Reid এর জরীপে আরো দেখা যায় যারা নিয়মিত চার্চে বা মন্দিরে যান তাদের মধ্য থেকে ৫০% ভোট পেয়েছিলেন স্টিফেন হারপার গত ২০১১ সালের নির্বাচনে। যারা নিয়মিত না হলেও একটা ধর্মীয় পরিচয় বহন করতেন তাদের মধ্য থেকে ৪২% ভোট পেয়েছিলেন হারপার।
স্টিফেন হারপার কানাডার প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় বিভিন্ন খ্রীস্টান ননপ্রফিট ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সরকারী চাঁদা প্রদানের হার বৃদ্ধি পেয়েছিল বেশ ভাল মাত্রায়ই। ইউনিভারসিটি অব কুইবেক এর পলিটিক্যাল সাইন্স ডিপার্টমেন্টের এক অধ্যাপকের হিসাব অনুযায়ী দেখা যায় ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এই চাঁদার পরিমান ৪২% বৃদ্ধি পেয়েছিল। অন্যদিকে সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ এনজিও গুলোতে চাঁদার পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছিল মাত্র ৫%। ঐ একই সময়কালে দেখা গেছে ফেডারেল সরকারের তহবিল থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়া হয়েছে প্রাইভেট খ্রীস্টান কলেজ ও ইউনিভারসিটিগুলোকে।
প্রকাশ্যে না হোক প্রচ্ছন্নভাবে যে কানাডায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসার ঘটানোর চেষ্টা একটা চলছে এবং এ প্রসার ঘটানোর চেষ্টায়
সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের প্রধান ভূমিকা রয়েছে সে কথাটি আজ অনেকেই সন্দেহ করছেন। আর এ তথ্য উঠে এসেছে সাংবাদিক মারসি ম্যাগডোনাল্ড এর লেখা ‘The Armageddon Factor: The Rise of Christian Nationalism in Canada’ শীর্ষক একটি গবেষণা গ্রন্থেও যেটি প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। ঐ গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন কি করে কানাডার রাজনীতিতে বিশেষ করে স্টিফেন হারপারের তৎকালীন অটোয়া সার্কেলের উপরে স্তরে রক্ষণশীল খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের প্রভাব ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে গোপনে গোপনে। রক্ষণশীলদের কেউ কেউ অবশ্য ম্যাগডনাল্ড এর এই বইয়ের বিরুপ সমালোচনা করেছেন। কিন্তু সিবিসি’র সাংবাদিক ইরা বেসিন সম্প্রতি তার এক প্রতিবেদনে লিখেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি ২০১১ সালে নিরঙ্কুশ আসন পেয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পর পরবর্তী দুই বছরে ধর্ম ভিত্তিক নীতিমালা ও রাজনীতির বর্ধিত প্রভাব সুষ্পষ্টভাবেই বিরাজ করছে অটোয়াতে যেটি আগে এত অধিক মাত্রায় ছিল না।
স্টিফেন হারপার যে শুধু খ্রীস্ট ধর্ম ও ইহুদী সম্প্রদায়ের লোকদেরকেই টার্গেট করেছিলেন ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার জন্য তা নয়। তিনি হিন্দু, শিখ, মুসলমান, আহমেদীয়া মুসলমান প্রভৃতি সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের চেষ্টাও করেছেন নিজের স্বার্থে। আর তারই চেষ্টা আমরা দেখতে পেয়েছিলাম নির্বাচনের কিছু দিন আগে নিজ সরকারী বাসভবনে ইফতার পার্টির আয়োজনের মধ্য। কানাডার ইতিহাসে যে কাজটি কেউ করেননি ইতিপূর্বে সেই কাজটিই তিনি করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবনে মুসলমানদেরকে ইফতার পার্টিতে দাওয়াত করে। প্রায় জনা চল্লিশেক মুসলমান নেতৃবৃন্দকে দাওয়াত করে তিনি ইফতার খাইয়েছেন।
উল্লেখ্য যে, গত নির্বাচনের আগে মুসলমান ভোটারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে টরন্টো এলাকার ২১ জন ইমাম তাদের নিজ নিজ মসজিদে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা যেন তাদের ভোটাধিকার অবশ্যই প্রয়োগ করেন। কাকে ভোট দিতে হবে সে ব্যাপারে অবশ্য কোন কথা বলা হয়নি।
বিষয়টি টের পেয়ে স্টিফেন হারপার তার সরকারী বাসভবনে মুসলমান নেতৃবৃন্দের কয়েকজনকে ইফতারীর দাওয়াত দিয়েছিলেন গত ২২ জুন। উদ্দেশ্য- মুসলমানদের সঙ্গে ‘সম্পর্ক উন্নয়ন’। অর্থাৎ গোড়া কেটি আগায় পানি ঢালার মতো বিষয়।
ইফতার পার্টিতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে স্টিফেন হারপার ঐ দিন বলেছিলেন, “এই ভবন পরমভাবে সকল কানাডিয়ানের সঙ্গেই সম্পৃক্ত।”তিনি আরো বলেছিলেন, “রমজান মাসের ঐতিহ্য হলো, যারা ইফতারের আয়োজন করেন তারা নিজেদের মধ্যে ন্যায়পরায়নতা, ধার্মিকতা ইত্যাদি আনয়ন করেন।”
তিনি ইফতার পার্টিতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কানাডার মুসলমান সম্প্রদায়ের অবদানকে ‘সপ্রশংস স্বীকৃতি’ দিয়েছিলেন। ইফতার পার্টিতে তিনি আরো বলেছিলেন, “অন্যান্য ইমিগ্রেন্টদের মতো মুসলমান সম্প্রাদায়ের ইমিগ্রেন্টরাও স্বাধীনতা, সুযোগ এবং সহনশীলতার খোঁজ করেছেন কানাডায় এসে।”
বলাই বাহুল্য, স্টিফেন হারপার একদিকে মুসলমান সম্প্রদায়কে কোনঠাসা করার জন্য বিল সি-৫১ ও বিল সি-২৪সহ আরো নানারকম আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন। আবার সেই বিষয়টি যেন সাধারণ মুসলমান ভোটারগন টের না পান তার জন্য নিজ বাসভবনে ইফতার পার্টির আয়োজনও করেছিলেন। সম্পূর্ণ ব্যাপারটিই ছিল হিপোক্রেটিক আচরণ ও লোকদেখানো প্রচার। তাছাড়া ইফতার পার্টিতে মুসলমান কমিউনিটির উল্লেখযোগ্য কোন নেতৃবৃন্দও ছিলেন না।
অন্যদিকে স্টিফেন হারপার নিকাব ইস্যুতে যে নাটক দেখিয়েছেন তা ছিল নজিরবিহীন। অতি নগন্য একটি বিষয়কে তিনি এবং তার দলের সদস্যরা কি করে যে জাতীয় নির্বাচনের একটি প্রধান ইস্যুতে দাঁড় করিয়েছিলেন তা ভাবতেও অবাক লাগে। প্রথম দিকে তিনি নিকাব ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছিলেন। জরীপ তথ্যে দেখা যায় নির্বাচনের আগে যখন তিনি জনপ্রিয়তার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছিলেন তিনি তখন এই নিকাব ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে দলের জনপ্রিয়তার ১০% বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কানাডায় ইসলামোফোবিয়ার পাশাপাশি নিকাবোফোবিয়া নামে আরেকটি শব্দের প্রচলন হয়ে যায় স্টিফেন হারপার ও তার দলের লোকদের এন্টি ইসলাম প্রচারণার কারণে।
নিকাব বিষয়টি আসলে ইসলামের অংশ নয়। এ কথা অনেক পন্ডিত ব্যক্তিই বলে আসছেন বারবার। তাছাড়া কানাডায় আগেও নিকাব পরা অবস্থায় নাগরিকত্ব লাভের জন্য শপথ পাঠ করতে দেয়া হয়েছে। তাহলে হঠাৎ করে এবারের নির্বাচনের আগে কেন এই নিকাবকে জাতীয় ইস্যুতে পরিনত করা হলো?
কারণ একটাই। নিকাবের মতো চরম কুসংস্কারাপন্ন একটি বিষয়কে ধর্মীয় ইস্যুতে পরিনত করে কানাডায় মুসলিম বিদ্ধেষ তৈরী করা। এ কাজটি স্টিফেন হারপার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করে আসছিলেন। আর তাতে নিজের অজান্তেই সহায়তা করে আসছিলেন জুনেরা ইসহাক নামের সেই পাকিস্তানী মহিলা যিনি সরকারে বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন নাগরিকত্ব লাভের সময় নিকাব পরতে না দেয়ায়। তিনি নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে রাজী কিন্তু নিকাব নয়।
উল্লেখ্য যে, কানাডার ‘চার্টর অব রাইটস এন্ড ফ্রিডম’ এ ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্বসহকারে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। জুনেরা ইসহাক সেই স্বীকৃতির দোহাই দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ফেডারেল আপিল কোর্ট কনজারভেটিভ সরকারের করা আপিলকে আমলে না নিয়ে ফেডারেল কোর্টের রায়কেই বহাল রেখে বলেন, সরকার কর্তৃক নিকাব নিষিদ্ধ করার আইন বেআইনী। ঐ রায়ের পর হারপার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল তারা কানাডার সর্বোচ্চ আদালতে যাবে বিষয়টি নিয়ে। কিন্তু তার আগেই তাদের সেই স্বপ্ন চুড়মার হয়ে যায় গত ১৯ অক্টোবরের নির্বাচনে। জুনেরা ইসহাক নেকাব পরেই নাগরিকত্বের শপথ নেন এবং গত নির্বাচনে ভোটাধিকারও প্রয়োগ করেন।
নিকাব নামের এই ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে শুধু যে স্টিফেন হারপারের দলই রাজনীতি করেছিলেন তা নয়, এ নিয়ে লিবারেল পার্টির জাস্টিন ট্রুডো এবং এনডিপি’র টম মুলকেয়ারও কম যাননি। নিকাব কি এবং কেন তা ভাল করে না জেনেই এর প্রতি সমর্থন দিয়ে বসেছিলেন তারা।
নির্বাচনের আগে লিবারেল পার্টির প্রধান নতো জাস্টনি ট্রুডো বলেছিলেন সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করার সময় যথষ্টে সর্তকতা অবলম্বন করা উচিৎ। তিনি আরো বলেছিলেন, সরকার বা অন্য যে কোন নেতা যখন সংখ্যালঘুদের কোন অধিকারকে নিয়ন্ত্রিত বা সীমিত করতে চাইবে তখন তার পিছনে জোড়ালো কারণ বা যৌক্তিকতা থাকতে হবে।
এনডিপি নেতা টম মুলকেয়ারও নিকারে বিরুদ্ধে নন। নির্বাচনের আগে তার ভাষ্য ছিলো, নাগরকিত্ব লাভের সময় পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য নিকাব উন্মোচন করার পক্ষে তিনি। তবে শপথগ্রহন অনুষ্ঠানের সময় নিকাব উন্মোচন করার কোন প্রয়োজনীয়তা তিনি দেখেন না।
ফেডারেল কনজারভেটিভ পার্টি কর্তৃক নিকাব নিষিদ্ধের অনুপ্রেরণাটি আসে মূলত কুইবেক প্রভিন্সের তথাকথিত “চার্টার অব ভ্যালুস” থেকে। এই চার্টার অব ভ্যালুস কুইবেক প্রভিন্সে প্রবর্তন করতে চেয়েছিল পার্টি কুইবেকো যাতে বলা হয়েছিল- সরকারী অফিস আদালতে কেউ ধর্মীয় পোষাক, প্রতীক বা চিহ্ন পরিধান করতে পারবে না। এটি স্পষ্টতই মুসলমান সম্প্রদায়কে টার্গেট করে করা হয়েছিল। বিষয়টি তখন ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয় এবং ২০১৪ সালে প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনে পার্টি কুইবেকোর পরাজয়ের জন্য এই চার্টার অব ভ্যালুসকেই কারণ হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু পরাজিত হলেও নিকাবসহ মুসলমানদের হিজাব ও অন্যান্য ধর্মীয় পোষাকের বিরুদ্ধে পার্টি কুইবেকোর সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ এখনো রয়ে গেছে। বিশ্লেষকদের মতে ঐ ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েই ফেডারেল কানজারভেটিভ পার্টি নিকাব ইস্যুতে নির্বাচনের অগে স্বপ্ন দেখেছিল কুইবেকের বেশীরভাগ আসন দখল করার জন্য।
উল্লেখ্য যে, যে নিকাব নিয়ে কানায় রাজনীতিবিদগন রাজনীতি শুরু করেছিলেন সেই নিকাব কিন্তু খোদ ইসলামী রাষ্ট্রসমূহেই সকল স্থানে বৈধ নয়। মুসলিম নন প্রফিট অর্গানাইজেশন ‘কানাডিয়ান থিংকার্স ফোরাম’ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তাহির গোরা বলেন, নিকাব ইসলামের আবশ্যিক কোন পরিধেয় বস্ত্র নয় এবং সিংহভাগ কানাডিয়ান মুসলিম নারীরা এটি পরেন না। কানাডার প্রায় অর্ধলক্ষ মুসলিম নারীর মধ্যে মাত্র কয়েকশত মহিলা হয়তো এটি পরিধান করে থাকেন। তাহলে কেন কানাডার রাজনীতিবিদগণ এবং মিডিয়াগুলো এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম ইস্যু হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন? তাহির গোরা আরো বলেন, নিকাব হজের সময়ও অনুমোদিত নয়।
হজ হলো মুসলমানদের পাঁচটি মৌলিক আদর্শের একটি। তাছাড়া নিকাব একটি ড্রেসও নয়। এটি এক ধরণের মাস্ক বা মুখোশ। কানাডার গুটি কয়েক মুসলিম মহিলা এটি পরে থাকলেও বাকি সকল মুসলিম মহিলা এটি ছাড়াই ধর্ম পালন করে আসছেন। তাহির গোরা বলেন, কোন মহিলা যদি নিকাব পরেন তবে তার পরিচয় নিশ্চিত করার অধিকারও সমাজ ও রাষ্ট্রকে দিতে হবে। গুটি কয়েক মুসলিম মহিলা নেকাব পরে অযথা একটি উত্তেজনা সৃষ্টি করছেন।
“কাউন্সিল ফর মুসলিমস ফেসিং টুমোরো” এর প্রেসিডেন্ট এবং লেখিকা রাহেল রেজা বলেন, নিকাব বা বোরখা কোনটার সঙ্গেই ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। এটি মুসলিম ব্রাদাহুড, ইসলামিক স্টেট, তালেবান, আল-কায়দা ও সৌদী আরবের রাজনৈতিক পতাকা।
রাহেল রেজা জুনেরা ইসহাকের মতোই পাকিস্তান থেকে কানাডায় এসেছেন। তিনি আরো বলেন, “কানাডার বিচার ব্যবস্থার প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক একটি ঘটনার উল্লেখ করছি- ঘটনাটি ২০০৪ সালের। ঘটনাস্থল পাকিস্তানের পেশোয়ার। পেশোয়ার হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি তারিক পারভেজ খান একজন মহিলা আইনজীবীকে আদালতে অবস্থানকালে নিকাব পরা থেকে বিরত থাকার আদেশ দেন। কারণ, নিকাব পরা থাকলে কাউকে আইডেন্টিফাই বা চিহ্নিত করা যায় না। নিকাব পরা অবস্থায় তারা আদালতের কাজও ঠিক ভাবে করতে পারবে না।”
এখন প্রশ্ন হলো পাকিস্তানের মতো একটি কট্টরপন্থি ইসলামী রাষ্ট্রেও যদি কর্মস্থলে নিকাব পরার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়ে থাকে এবং হজের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও নিকাব পরার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকে তবে কানাডায় কেন নিকাব নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে? আর নিকাবের অন্তরালে যারা বাস করছেন তাদেরই বা আসল উদ্দেশ্য কি? জুনেরা ইসহাক কি নিকাব নিকাব করে কানাডায় ইসলামোফোবিয়া তৈরীতে ইন্ধন যোগাননি? মুসলমান হয়ে মুসলমানদের ভাবমূর্তি নষ্টের পিছনে ইন্ধন যোগননি?
কানাডায় সার্বিকভাবে ধর্মে বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা কমে এসেছে। সে হিসেবে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারও কমে আসার কথা। কিন্তু তা না হয়ে দেখা যাচ্ছে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কানাডায় ২০০১ সালের আদম সুমারীর হিসেব অনুযায়ী দেখা যায় প্রায় এক চতুর্থাংশ (২৩.৯%) লোক বা ৭.৯ মিলিয়ন লোক কোন ধর্মে বিশ্বাস করেন না। ঐ সময় থেকে আরো এক দশক আগে এই অবিশ্বাসীদের হার ছিল ১৬.৫%। কানাডায় খ্রীস্ট ধর্মে বিশ্বাসী লোকদের সংখ্যা এখনো বেশী। দুই তৃতীয়াংশ লোকের বেশী জানান তারা খ্রীস্ট ধর্মে বিশ্বাসী। এদের মধ্যে রোমান ক্যাথলিক সবচেয়ে বেশী। তাদের সংখ্যা ৩৮%। এর পরের অবস্থানে আছেন ইউনাইটেট চার্চ এর অনুসারীরা যাদের সংখ্যা ৬%। তৃতীয় স্থানে আছেন এংলিকানরা যাদের সংখ্যা ৫%।
তবে কানাডায় ইমিগ্রেন্টদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় এই চেহারা পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ২০১১ সালের ন্যাশনাল হাউজহোল্ড সার্ভে অনুযায়ী দেখা যায় খ্রীস্ট ধর্মের লোকদের যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তা ক্রমেই চ্যালেঞ্জের মুখমুখী হচ্ছে কানাডায় ইমিগ্রেন্টদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। ২০১১ সালে কানাডায় মুসমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে এক মিলিয়নেরও বেশী দাড়িয়েছে। আর হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাড়িয়েছে প্রায় অর্ধ মিলিয়নে। বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের সংখ্যা ৩৬৭,০০০ এবং ইহুদীদের সংখ্যা ৩৩০,০০০। আর আদিবাসী যারা বিভিন্ন আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করেন তাদের সংখ্যা ৬৫,০০০।
কানাডার রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব সত্যিকার অর্থে অনেক আগে থেকেই ছিল। আমরা দেখেছি যারা গোঁড়াপন্থী ধার্মীক তাদের পছন্দের দল রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলগুলো। মধ্যপন্থী ধার্মীকদের পছন্দের দল মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল আর নাস্তিক বা যারা ধর্মে বিশ্বাস করেন না তাদের পছন্দ হলো বামপন্থী রাজনৈতিক দল। তবে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব থাকলেও দৃষ্টিকটুভাবে ধর্মের সরাসরি ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে সাম্প্রতিক কালের ঘটনাপ্রবাহে। উপরে আমরা দেখেছি সদ্য ক্ষমতাচ্যুত স্টিফেন হারপার ও তার দল এবারের নির্বাচনে ধর্মকে কিরকম নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করেছেন। তবে শুধু স্টিফেন হারপাকে একা দায়ী করলে হবে না। লিবারেল পার্টির প্রধান ও সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও গত নির্বাচনের আগে ধর্মকে ব্যবহার করেছেন যদিও তা স্টিফেন হারপারের মতো ন্যক্কারজনকভাবে নয়। জাস্টিন ট্রুডোকে প্রায়ই দেখা গেছে বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির আর গির্জায় গিয়ে লোকজনের সঙ্গে প্রার্থনায় যোগ দিতে। বিভিন্ন রাইডিং এর এমপি প্রার্থীদেরকেও দেখা গেছে নিজ নিজ এলাকায় বিভিন্ন ধর্মীয় উপশনালয়ে গিয়ে যোগ দিতে। ঐ সময় তাদের পরনে থাকতো সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠির পোষাক।
রাজনীতিকদের এ জাতীয় আচরণ ক্ষেত্র বিশেষ হয়তো কাজে দেয়। কাজে না দিলে তারা ঐ ভাবে উপশনালয়গুলোতে ঢু মারতে যেতেন না ভোটের আগ দিয়ে। তবে সবসময় যে কাজে দেয় তা হয়তো জোর দিয়ে বলা যাবে না। যেমন এবার স্টিফেন হারপারের ক্ষেত্রে তা হয়নি। বরং উল্টোটি হয়েছে। কানাডার মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্যাপারে নেগেটিভ এটিচ্যুড নিয়ে অগ্রসর হওয়াটা ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত যেটি তার পরাজয়ের পক্ষে কাজ করেছে অন্যান্য কয়েকটি ফ্যাক্টরের সঙ্গে। সম্ভবত তার একটি বড় মাপের শিক্ষাও হয়েছে এ থেকে। নেগেটিভ এটিচ্যুড নিয়ে কোন কিছু আদায় করতে গেলে তার ফলাফল ভাল হয় না। এই শিক্ষাটি স্টিফেন হারপার এবার তার নির্বাচনী বিজ্ঞাপন থেকেও পেয়েছেন আশা করি। কারণ তিনি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে নেগেটিভ বিজ্ঞাপন প্রচার করে আসছিলেন। আগেও তিনি এ কাজটি করেছেন। তবে এবার ফলাফল তার পক্ষে আসেনি। বরং বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে।
তবে এটিও সত্যি যে আগামী দিনের নির্বাচনেও ধর্মের প্রভাব থাকবে, থাকবে ধর্মকে ব্যবহারের প্রবনতাও। তবে এটি করতে গিয়ে নির্দিষ্ট কোন ধর্মগোষ্ঠিকে হেয় প্রতিপন্ন করতে গেলে বা তাদের দুর্বল অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে বলির পাঁঠা বানানোর চেষ্টা থাকলে সেটা গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির লঙ্ঘন হিসেবেই বিবেচিত হবে কানাডার সাধারণ জনগনের কাছে। মনে রাখতে হবে যে ভোটের দিনে এই সাধারণ জনগনের ক্ষমতা কিন্তু অসাধারণ হয়ে উঠে।
আর এই সাধারণ জনগণের মধ্যে ভিজিবল মাইনরিটি বা দৃশ্যমান সংখ্যালঘুদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা এখন নির্বাচনে একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাড়িয়েছেন। গত ২০১১ সালের আদমসুমারীতে দেখা যায় প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন নিজেদেরকে ঐ দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য বলে চিহ্নিত করেছেন। সুতরাং এদেরকে অবজ্ঞা করার দিন ফুরিয়ে এসেছে। এদের অনুভূতিতে আঘাত করার দিনও ফুরিয়ে এসেছে। এদের ধর্মকে নিয়ে কেউ রাজনীতি করুক এটাও তারা পছন্দ করছেন না। আর এই ট্রেন্ড বা ঝোঁক খোদ কানাডিয়ান মূলশ্রোতের জনগনের মধ্যেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা এখন রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সম্পৃক্ততা বা ধর্মের ব্যবহার পছন্দ করছেন না আগের মতো। জরীপ প্রতিষ্ঠান Ipsos-Reid এর এক জরীপেও এই তথ্যই প্রকাশ পেয়েছে। অটোয়া সিটিজেন প্রত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে এই তথ্য জানা যায়। সেই জরীপে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় কানাডিয়ানরা বরং এমন কোন রাজনৈতিক দলকে ভোট দিবেন যে দলের নেতৃত্বে আছেন এভানজিক্যাল খ্রীস্টানের বদলে কোন নিরীশ্বরবাদী। অথবা মুসলিম প্রার্থী হলেও তারা পিছ পা হবেনা না। এই জরীপটি প্রকাশিত হয়েছিল গত ২০১১ সালে যখন স্টিফেন হারপার ক্ষমতায় আসেন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। স্টিফেন হারপার নিজেও একজন এভানজিক্যাল খ্রীস্টান এবং গত কয়েক দশকে তার মতো এমন কট্টর ধার্মিক আর কেউ কানাডার ক্ষমতায় আসেননি। গত প্রায় এক দশক সময়ে তার কট্টরবাদী শাসনামলে কানাডার গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি দেশে এবং বিদেশে অনেকটাই ম্লান হয়েছে।