সাবধান! কানাডায় প্রতারক চক্র আপনার চারপাশেই
হাতিয়ে নিতে পারে আপনার কষ্টার্জিত উপার্জন
ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৬
॥ খুরশিদ আলম ॥
কদিন আগে কানাডা রেভিনিউ এজেন্সির নাম করে এক ব্যক্তি ফোন দিয়েছিলেন আমাদের বাসায়। সকাল ৮টাও বাজেনি তখন। ফোনটি ধরেছিলেন আমার স্ত্রী। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে কেউ একজন আমার স্ত্রীকে কি সব পাওনা-দাওনার কথা বলে শাসাচ্ছিলেন। বলছিলেন- পাওনা পরিশোধ না করলে বিপদ হবে। তার ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে ইতিমধ্যেই। তার নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা রয়েছে। আরসিএমপি এসে ধরে নিয়ে যাবে। তারা ইতিমধ্যেই রওয়ানা দিয়েছে। যদি এখনি পাওনা শোধ করা না হয় তবে আরসিএমপিকে ঠেকানো যাবে না।
আমার বুঝতে দেরী হলো না যে এটি একটি জালিয়াত চক্রের কর্ম। সকাল ৯ টার আগে কোন সরকারী অফিস থেকে ফোন আসার কথা নয়। আর গত ২১ বছর ধরে কানাডায় বাস করছি, কোনদিন কানাডা রেভিনিউ এজেন্সি ফোন দেয়নি, আজ হঠাৎ কেন ফোন দিবে? আর যে ভাবে কথা বলা হচ্ছে এবং শাসানো হচ্ছে এটিতো কানাডিয়ান ভাষা নয়? তাছাড়া টেক্স রিটার্ন করা হয়েছে আরো প্রায় এক বছর আগে। কানাডা রেভিনিউ এজেন্সি থেকে এসেসমেন্ট এর চিঠিও এসেছে। সবই ঠিক আছে। আমি রাগ সামলাতে না পেরে টেলিফোন রিসিভারটি ধরতে গিয়েছিলাম আমার স্ত্রীর হাত থেকে। তার আগেই লাইনটি কেটে যায়। নম্বর চেক করে দেখি অটোয়ার এরিয়া কোড।
কনফার্ম হওয়ার জন্য গুগুল সার্চে গিয়ে নম্বরটি চেক করি। দেখি এই নম্বর থেকে আরো বহুজনে কল পেয়েছে এবং এটি একটি জালিয়াত চক্রের নম্বর।
কদিন পর আবারো সেই ফোন। আবারো সেই হুমকী-দামকী। দশ মিনিটের মধ্যে আরসিএমপি আসছে আমার স্ত্রীকে গ্রেফতার করার জন্য।
এবার আমার স্ত্রীর পালা। তিনিও উল্টো তাকে ধমক দিয়ে বললেন, তোমার আরসিএমপিকে আসতে বল। আমি দরজার সামনেই অপেক্ষা করছি।
এর পর কানাডা রেভিনিউ এজেন্সির নাম করে ঐ জালিয়াত চক্রের ফোন দেয়া বন্ধ হয়েছে। কিন্তু গত সপ্তাহে আরেকটি রহস্যজনক ফোন এসেছিল বাসায়। তখন আমি বাসায় ছিলাম না। ফোনে কেউ একজন আমার স্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিল তিনি অথবা আমাদের বাসায় গত এক বছরের মধ্যে অন্য কেউ গাড়ি চলাতে গিয়ে কোন এক্সিডেন্ট করেছেন কি না। আমার স্ত্রীর না সূচক জবাব পেয়ে লোকটি আর কথা বাড়াননি। আমার ধারণা- এটিও ছিল কোন প্রতারক দলের কাছ থেকে ফোন কল। আমাদের পরিবারে কেউ গাড়ি চালাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করেছেন এরকম তথ্য পেলে হয়তো প্রতারণার পরবর্তী কার্যধারা শুরু হতো।
মানুষ তার জীবন চলার পথে অনেক সময়েই প্রতারক জোচ্চোর আর ঠকবাজদের কবলে পড়েন । আর এই প্রতারক বা ঠকবাজদের অনেকেই আমাদের চারপাশেরই কেউ না কেউ হয়ে থাকেন। আগের দিনে প্রতারণা করতে হলে স্বশরীরে যোগাযোগ করতে হতো। কিন্তু যোগাযোগ মাধ্যম উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বশরীরে যোগাযোগ করার প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই ফুরিয়েছে। আজকের এই অনলাইন যুগে বিশ্বের যে কোন প্রান্তে বসেই যে কারো সঙ্গে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া যায়। বিশ্ব টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার যুগান্তকারী উন্নয়নের ফলেও এই প্রতারক চক্রের সুবিধা বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আগে যেখানে প্রতারক চক্র সীমাবদ্ধ ছিল নিজের পরিচিত গন্ডির মাঝে, সেটি এখন ছাড়িয়ে গেছে বিশ্বব্যাপী।
কানাডা রেভিনিউ এজেন্সির নাম করে এই প্রতারক চক্র ইতিমধ্যে বহু কানাডিয়ান নাগরিকের বাড়িতেই ফোন দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটির অনেক সদস্যদের বাড়িতেও এই কল এসেছে। অনলাইনে সার্চ করে দেখলাম, কানাডার বিভিন্ন আইনশৃংখলা বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত কানাডিয়ান এন্টি ফ্রড সেন্টার এর কর্মকর্তা ডেনিয়েল উইলিয়াম একজায়গায় বলেছেন, কানাডা রেভিনিউ এজেন্সির নাম করে প্রতারকদের এই ফোন কলের প্রায় সবগুলোই আসে ভারত থেকে। আগে এই প্রতারক চক্রের সদস্যরা দেশের বাইরে অবস্থিত ভারতীয়দের টার্গেট করে ফোন দিতেন। কিন্তুু এখন তারা প্রতারণায় আরো অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন এবং তাদের কলের সীমানা বাড়িয়ে খোদ কানাডিয়ানদেরকেও জ্বালাতন করছেন।
কানাডা রেভিনিউ এজেন্সি তাদের ওয়েবসাইটে প্রতারকদের একটি সেম্পল কল আপলোড করেছে জনগণকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য। ঐ কলের ভাষাটা এইরকম, “আমরা আপনার নামে একটি ক্রিমিনাল কেস রেজিস্ট্রি করেছি ফেডারেল কোর্টে। কারণ আপনি জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে টেক্স ফাঁকি দিয়েছেন।” এ কথা বলার পর তারা একটি ফোন নম্বর দেন যার এরিয়া কোড অটোরয়ার। এতে লোকজনের বিশ্বাস জন্মে যে কলটি হয়তো অটোয়ায় অবস্থিত কানাডা রেভিনিউ এসেন্সির অফিস থেকেই এসেছে। ফোনে তারা বলেন, “আপনি যদি কল ব্যাক না করেন তবে পরিনতির জন্য তৈরী হয়ে থাকবেন। কারণ এটি একটি সিরিয়াস এবং টাইম সেন্সেটিভ ইস্যু।
প্রতারকরা কি কি কৌশল অবলম্বন করে থাকেন তার আরো কিছু নমুনা তুলে ধরেছে কানাডিয়ান এন্টি ফ্রড সেন্টার। যেমন :
০ প্রতারকরা টার্গেটকে উদ্দেশ্য করে বলে থাকেন, “আমরা আপনার ২০০৮-২০০১৩ সালের টেক্স রিটার্নের ফাইল চেক করে দেখেছি। ফাইল চেক করে আমরা দেখতে পেয়েছি আপনি আপনার আসল ইনকাম গোপন করেছেন টেক্স ফাকি দেওয়ার জন্য। এ জন্য আপনাকে কম করে হলেও ৫০ হাজার ডলার জরিমানা গুনতে হতে পারে।
০ তারা কখনোই বলেন না যে কানাডা রেভিনিউ এজেন্সি কর্তৃক পাওনা অর্থ রিসিভার জেনারেল ফর কানাডা’র নামে পাঠাতে হবে। তার বদলে তারা দাবী করেন পাওনা ঐ অর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন বা মানিগ্রামের মাধ্যমে তাদের কাছে পাঠাতে। অথবা কোন কানাডিয়ান স্টোর থেকে প্রিপেইড কার্ড কিনে তাদের ঠিকানায় পাঠাতে। কখনো কখনো তাদের দেওয়া ব্যাংক একাউন্টেও জামা দিতে বলা হয় পাওনা অর্থ।
০ প্রতারক চক্রের এই সদস্যরা আরো হুশিয়ারী দেন এই বলে যে, এই বিষয়টি গোপনীয় এবং এটি যেন কারো কাছে প্রকাশ করা না হয়। এমনকি স্বামী বা স্ত্রীর কাছেও না। পরিবারের অন্যান্য সদস্য বা বন্ধুদের কাছে তো নয়-ই।
০ ভয় দেখানোর জন্য তারা আরো হুমকী দেন এই বলে যে, “কিছুক্ষনের মধ্যেই আরসিএমপি এসে আপনার দরজায় নক করবে। তাদের কাছে আপনাকে গ্রেফতার করার জন্য ওয়ারেন্ট রয়েছে।”
০ মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচারের কাল্পনিক অভিযোগ এনে বা অন্যকোন অপরাধমূলক কাজের কাল্পনিক অভিযোগ এনে তারা আরো ভয় দেখান এই বলে যে “আপনি কানাডা রেভিনিউ এজেন্সির প্রাপ্য অর্থ সম্পূর্ণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত আপনার বাড়ি অন্যের জিম্বায় রাখা হবে এবং আপনার পাসপোর্ট আটক করা হবে। আপনার এই অপকর্মের বিষয়টি আপনার ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানদেরকেও জানানো হবে। -সূত্র : টরন্টো স্টার।
কানাডা রেভিনিউ এজেন্সি তাদের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে কিছু তথ্য দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, কেউ যদি কানাডা রেভিনিউ এজেন্সির নাম করে ফোন, টেক্সট মেসেজ বা ইমেইলে যোগাযোগ করেন এবং কোন ব্যাক্তিগত তথ্য যেমন স্যোসাল ইন্সূরেন্স নাম্বার, ক্রেডিট কার্ড নাম্বার ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার অথবা পাসপোর্ট নাম্বার চান তবে সে ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
কানাডা রেভিনিউ এজেন্সি আরো জানায়, অনেক সময় প্রতারকরা কারো কারো ব্যক্তিগত তথ্য চান এই বলে যে, রিফান্ড বা বেনিফিট পেমেন্টের জন্য এগুলো প্রয়োজন। ব্যক্তিগত তথ্য যেমন স্যোসাল ইন্সুরেন্স নাম্বার বা ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার পেলে তারা টেক্সপেয়ারদেরকে রিফান্ড বা বেনিফিট পেমেন্ট দিতে পারবেন এমন কথা বলেন। কখনো কখনো প্রতারকরা টেক্সপেয়ারদেরকে কানাডা রেভিনিউ এজেন্সির নাম করে একটি ভূয়া ওয়েবসাটে যেতে বলেন এবং সেখানে তারা টেক্সপেয়ারদেরকে তাদের আইডেন্টি প্রমাণ করার জন্য কিছু ব্যক্তিগত তথ্য দিতে বলেন। এরকম পরিস্থিতিতেও কখনো কোন ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়া উচিৎ নয়।
টেক্সপেয়ারগণ যদি কখনো কোন ফোনকল পান এই মর্মে যে কানাডা রেভিনিউ এসেন্সি তার কাছে অর্থ পাওনা তবে তার উচিৎ হবে প্রথমেই সরাসরি কানাডা রেভিনিউ এসেন্সিকে ফোন করে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া। অথবা অনলাইনে কানাডা রেভিনিউ এসেন্সির My Account চেক করেও বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
কানাডা রেভিনিউ এজেন্সি কখনোই যে কাজটি করবে না সেটি হলো : তারা কোন অনলাইন লিংক পাঠিয়ে কখনো সেখানে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়ার অনুরোধ করবে না।
তবে আপনি যদি কানাডা রেভিনিউ এজেন্সিতে ফোন দেন এবং কোন বিশেষ তথ্য বা ফরম এর জন্য কোন অনলাইন লিং পাঠানোর অনুরোধ জানান তখন কানাডা রেভিনিউ এজেন্সির এজেন্ট আপনার প্রদত্ত ইমেইলে সেটি পাঠাবে আপনাকে টেলিফোনে অপেক্ষায় রেখেই।
প্রতারকদের হাত থেকে কিভাবে নিজেকে রক্ষা করবেন?
০ কখনোই ইন্টারনেট বা ইমেইলের মাধ্যমে পার্সোনাল ইনফরমেশন দিবেন না। কানাডা রেভিনিউ এজেন্সি কখনোই ইমেইলের মাধ্যমে পার্সোনাল ইনফরমেশন পাঠাতে বলে না।
০ আপনার এক্সেস কোড, ইউজার আইডি এবং পার্সওয়ার্ড গোপন রাখুন।
০ আপনার টেক্স রিটার্ন এর কাজ অন্যকে দিয়ে করানোর সময় নিশ্চিত হয়ে নিন যে ঐ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্ভরযোগ্য। প্রয়োজনে তাদের রেফারেন্স চেক করে নিন।
০ ইমেইলে আসা কোন লিং এ ক্লিক করার আগে সতর্ক থাকুন। প্রতারকরা অনেক সময় এমনসব লিং পাঠায় যেগুলোতে ক্লিক করলে আপনার পার্সোনাল ইনফরমেশন চুরি হয়ে যেতে পারে।
০ টেলিফোনে কলার আইডি দেখে কখানো শতভাগ নিশ্চিত হবে না যে এটি সত্যিই কোন সরকারী প্রতিষ্ঠান বা কোন আসল বা খাঁটি প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে। প্রতারকরা এখন ফলস ডিসপ্লেও করাতে পারে আপনার টেলিফোনের কলার আইডিতে।
০ ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কার্ড হরিয়ে গেলে বা চুরি হলে সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে তা অবহিত করুন ।
০ কোন প্রতারণাপূর্ণ টেলিমার্কেটিং বা ইমেইল পেলে তা কানাডিয়ান এন্টি ফ্রড সেন্টার কে অবহিত করুন তাদের অনলাইনের (www.antifraudcentre.ca) মাধ্যমে অথবা সরাসরি ১-৮৮৮-৪৯৫-৮৫০১ এই নাম্বারে ফোন করে। – সূত্র : কানাডা রেভিনিউ এজেন্সি।
প্রতারকদের মূল টার্গেট সাউথ এশিয়ান ইমিগ্রেন্ট :
বিভিন্ন তথ্য ঘেটে দেখা গেছে প্রতারকরা টার্গেট করে থাকেন সাউথ এশিয়ান ইমিগ্রেন্টদেরকেই বেশী। ইমিগ্রেন্ট কর্মকর্তা বা কানাডা রেভিনিউ এজেন্সির কর্মকর্তার পরিচয়ে প্রতারক বা ধোঁকাবাজরা এই বিশেষ অঞ্চলের লোকদের কাছ থেকে নানাভাবে চেষ্টা করেন অর্থ হাতিয়ে নিতে। আরসিএমপির মিডিয়া রিলেশন্স কর্মকর্তা সার্জেন্ট পেনি হারমেনের এক বক্তব্য থেকে জানা যায় – গত ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত এ ধরণের ১৪,৫০০ প্রতারণা বা জালিয়তির রিপোর্ট নথিবদ্ধ করা হয়েছে। আর এই ১৪,৫০০ টি প্রতারণার অর্ধেকই নথিবদ্ধ করা হয়েছে ২০১৫ সালের আগষ্ট থেকে ২০১৬ সালের জানুয়ারী মাসের মধ্যে। অর্থাৎ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই প্রতারকদের কার্মকান্ড প্রায় দ্বিগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং আরো শঙ্কার বিষয় হলো প্রতারণার সব ঘটনা পুলিশের খাতায় নথিবদ্ধ হয় না। কানাডিয়ান এন্টি ফ্রড সেন্টারের হিসাব মতে মাত্র ৫% প্রতারণার ঘটনা পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়। আর এই ৫% হলো উপরে উল্লেখিত ১৪,৫০০ টি প্রতারণার ঘটনা যা নথিবদ্ধ করা হয়েছে। তাহলে প্রকৃত সংখ্যা কত হতে পারে এবং এই প্রতারক চক্রের সদস্যদের সংখ্যাই বা কত হতে পারে একবার ভেবে দেখুন!
কানাডিয়ান এন্টি ফ্রড সেন্টার এর কর্মকর্তা ডেনিয়েল উইলিয়ামস এর প্রদত্ত এক বক্তব্য থেকে জানা যায় এই প্রতারকরা সাধারণত ইমিগ্রেশন, রিফিউজি এন্ড সিটিজেনশীপ কানাডা অথবা কানাডা রেভিনিউ এজেন্সীর কর্মকর্তা বা প্রতিনিধি সেজে নতুন আসা ইমিগ্রেন্টদেরকে ফোনগুলো দেন। ফোন দিয়ে এই প্রতারকরা যে সকল হুমকী দেন তার মধ্যে আছে, ইমিগ্রেশনের কাগজ পত্র ঠিকমত পূরণ করা হয়নি, আরো ফি দিতে হবে ইত্যাদি। এগুলো না করলে কানাডা থেকে বহিস্কার করা হবে এমন হুমকীও দেওয়া হয়। আর এ জন্য প্রতারকরা ১,৩০০ ডলার থেকে শুরু করে ৭ হাজার ডলার পর্যন্ত দাবী করেন। ব্যাংকের মাধ্যমে অথবা গিফ্ট কার্ডের মাধ্যমে ডলার পাঠানোর জন্য তারা চাপ দেন। যখন প্রতারকরা দেখেন তাদের টার্গেট দুর্বলচিত্তের কেউ এবং তারা ফোনে যা বলছেন তা তাদের টার্গেট বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছেন তখন শুরু হয় ফুল স্পীডের কার্যক্রম। এই প্রতারকদের আচরণও খুব আক্রমনাত্বক হয়ে থাকে। আক্রমনাত্বক আচরণ করে প্রথমে তারা তাদের টার্গেটকে মানসিকভাবে দূর্বল করে নিতে চান। এ জন্য তারা বেছে নেন সাউথ এশিয়ান ইমিগ্রেন্টদেরকে। কারণ এই অঞ্চলের মানুষরা মোটামুটি ভাবে সরকারের প্রতি অনুগত থাকেন। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট তারা তাদের নিজ নিজ দেশ থেকেই নিয়ে আসেন। তাছাড়া এরা কানাডিয়ান আইন সম্পর্কে ভাল করে অবহিতও থাকেন না। ফলে তাদেরকে টার্গেটে পরিনত করা প্রতারকদের পক্ষে সহজ হয়।
আরসিএমপি’র পক্ষ থেকে বলা হয় সাম্প্রতিক সময়ে তিন ধরণের প্রতারণা হতে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্য আছে কানাডা রেভিনিউ এজেন্সির নাম করে প্রতারণা, গ্র্যান্ডপ্যারেন্ট প্রতারণা এবং ব্যাংক ইন্সপেক্টর সেজে প্রতারণা।
কানাডা রেভিনিউ এজেন্সির নাম করে যে সকল প্রতারণা করা হচ্ছে তা উপরে আমরা দেখেছি। গ্র্যান্ডপ্যারেন্ট প্রতারণা হলো – প্রতারকরা পরিবারের একজন সদস্য সেজে বাড়িতে ফোন দেন। ফোন দিয়ে বলেন তিনি খুব বিপদের মধ্য পড়েছেন। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। তাকে বেরিয়ে আসতে হলে এখনি টাকা লাগবে। একটি ট্রাস্ট ফান্ডে এখনি টাকাটা পাঠিয়ে দিতে বলেন ঐ প্রতারক। এই কৌশলটি প্রয়োগ করা হয় প্রতারকরা যখন দেখেন ফোন রিসিভার একজন বয়স্ক ব্যক্তি। বয়স্ক ব্যক্তিটির হয়তো দীর্ঘদিন নাতি বা নাতনীর সঙ্গে যোগাযোগ নেই। ফলে সহজেই তার পক্ষে টেলিফোনে গলা চিনতে পারার কথা নয়। আর নাতি না নতনীর নাম? সেটাও হয়তো ভুলে গিয়ে থাকতে পারেন বৃদ্ধ দাদা বা নানা। বিষয়গুলো টের পেলে প্রতারকরা তখন তাদের অপারেশন খুব সহজেই চালাতে পারেন। কারণ কেউই চায় না তার পরিবারের কেউ বিপদের মধ্যে পড়ে থাকুক। যারা প্রতারণার বিষয়টি ধরতে পারেন না তারা দ্রুত টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আরসিএমপি সম্প্রতি মন্ট্রিয়ল থেকে এ ধরনের ১১ জন প্রতারককে গ্রেফতার করেছে।
আর ব্যাংক ইন্সপেক্টর সেজে যে প্রতারণাটা করা হয় সেটি এরকম – প্রতারকদের কেউ একজন টার্গেটকে ফোন দিয়ে বলেন, “আমি অমুক ব্যাংকের একজন সিকিউরিটি কর্মকর্তা। আমাদের ব্যাংক লক্ষ্য করেছে যে কেউ একজন অবৈধভাবে আপনার একাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। ”
আতংকিত হওয়ার জন্য এই একটি বাক্যই যথেষ্ট যদি কারো একাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা থেকে থাকে।
তখন আতংকিত টার্গেটকে সিকিউরিটি কর্মকর্তা সাজা ঐ লোকটি বলেন, “এ অপকর্মটি যে করছে তাকে আমরা দ্রুত সনাক্ত করার জন্য চেষ্টা করছি এবং আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কোথায় ত্রুটি রয়েছে সেটি বের করার চেষ্টা করছি। ”
এরপর ঐ সিকিউরিটি কর্মকর্তা আতংকিত টার্গেটকে কাছাকাছি কোন পার্কিং লটে দেখা করতে বলবেন এবং কিছু ডলার সাথে নিয়ে আসতে বলবেন। তিনি বলবেন, এই ডলার রি-ডিপোজিট করা হবে কোথায় ত্রুটি সেটা সনাক্ত করার জন্য।
যদি কেউ বিশ্বাস করে তাদের হাতে ডলার তুলে দেন সেই ডলার আর ব্যাংক একাউন্টে ডিপোজিট হয় না, সেটি যায় ব্যাংকের সিকিউরিটি কর্মকর্তা সাজা ঐ প্রতারকের পকেটে। আরসিএমপি’র সূত্রে জানা যায়, এরকম এক প্রতারণার ঘটনায় সেন্ট
আলবার্টের এক বাসিন্দা ৯ হাজার ডলার খুইয়েছেন।
প্রতারণার আরো বহু কৌশল আছে যা প্রয়োগ করে প্রতারকরা কানাডায় সহজ সরল মানুষদেরকে অহরহ ঠকাচ্ছেন। প্রতারণার নানান কৌশল সম্পর্কে জনগনকে সতর্ক করার জন্য কানাডিয়ান এন্টি ফ্রড সেন্টার এর ওয়েবসাইটে কিছু তথ্য দেওয়া আছে। সেখানে প্রতারকরা প্রতারণার জন্য কি কি কৌশল অবলম্বন করে থাকেন এবং কিভাবে ঐসব প্রতারকদের হাত থেকে মুক্ত থাকা যায় সে সম্পর্কে ব্রিফিং দেয়া আছে।
কানাডিয়ান এন্টি ফ্রড সেন্টার এর ওয়েবসাইটে প্রতারকদের যে সকল প্রতারণা সম্পর্কে জনগনকে সতর্ক থাকার উপদেশ দেওয়া হয়েছে সেগুলো মধ্যে আছে- ভূয়া পুরষ্কার প্রাপ্তির খবর দিয়ে প্রতারণা করার কৌশল, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, পিরামিড জালিয়াতি, রোমান্স জালিয়াতি, চ্যারিটি জালিয়াতিসহ মোট ১৬ রকম জালিয়াতি। প্রতারকরা একটি জালিয়াতির কৌশল পুরানো হয়ে গেলে আরো নতুন নতুন জালিয়াতির কৌশল বের করে নেন।
উপরে উল্লেখিত ভূয়া পুরষ্কার প্রাপ্তির খবর দিয়ে প্রতারণার প্রথম পদক্ষেপ শুরু হয় টার্গেটের বাড়িতে চিঠি পাঠানোর মধ্য দিয়ে। সেখানে ১-৯০০ সিরিজের একটি ফোন নাম্বার দেওয়া থাকে। চিঠিতে টার্গেটকে উদ্দেশ্য করে বলা হয় – আপনি বিরাট অংকের একটি পুরষ্কার পেয়েছেন। এটি হতে পারে গাড়ি অথবা প্রমোদ নৌকা কিংবা নগদ অর্থ। কিন্তু আপনি কোন পুরস্কারটি পেয়েছেন সেটি জানতে হলে অমুক নাম্বারে ফোন দিতে হবে। সরল বিশ্বাসে যারা ফোন দেন তাদের কেউ কেউ ধরা খান আবার কেউ কেউ প্রতারণার বিষয়টি টের পেয়ে পিছিয়ে আসেন।
ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি কানাডায় একটি বড় রকমের সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। শুধু কানাডায় নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এই সমস্যা বিরাজমান। কানাডায় ক্রেডিট কার্ড প্রতারকরা গত দুই বছরে এক বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে।
উপরে উল্লেখিত পিরামিড (মাল্টি লেভেল কোম্পানী) জালিয়াতি আরেকটি কৌশল যার মাধ্যমে সম্ভাব্য টার্গেটকে নানান প্রলোভন দেখানো হয়। টার্গেটদেরকে বলা হয় মাত্র দুই তিন শ ডলার বিনিয়োগ করে তারা অল্পদিনের মধ্যেই অনেক অর্থের মালিক হয়ে যাবেন। কোন শারীরিক পরিশ্রম নেই, কোন প্রোডাক্ট বিক্রি করতে হবে না, শুধু মাত্র নতুন ক্লায়েন্ট যোগার করতে হবে। যারা এই সমস্ত প্রস্তাব দেন নতুন টার্গেটদেরকে তারা নিজেদের সম্পর্কে রাজকীয় সব কাহিনী প্রচার করেন। তারা বলে বেড়ান, এই মাল্টিলেভেল কোম্পানীতে যোগ দিয়ে মাত্র দুই তিন বছরে তারা বিরাট ধনী ব্যক্তিতে পরিনত হয়েছেন এবং এখন তাদেরকে কোন কাজ করতে হয় না। বছরে দুই তিন বার তারা পরিবার নিয়ে প্রমোদ ভ্রমনে বের হন। একেকবারের ভ্রমণে তাদের খরচ হয়ে ২০/২৫ হাজার ডলার। এরকম আরো সব কল্পকাহিনী প্রচার করে বেড়ান নতুন নতুন ক্লায়েন্ট তথা টার্গেট শিকার করার জন্য।
এই পিরামিড জালিয়াতির ব্যবসাটা এরকম – দুই তিন শ ডলার দিয়ে একজন যখন এই ব্যবসায় ‘বিনিয়োগকারী’ হলেন তখন তিনি তার আন্ডারে আরো কিছু ‘বিনিয়োগকারী’ সংগ্রহ করবেন। যত বেশী ‘বিনিয়োগকারী’ তিনি সংগ্রহ করতে পারবেন তত বেশী তার লাভ। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের ‘বিনিয়োগকারীরা’ আবার তাদের আন্ডারে তৃতীয় স্তরের ‘বিনিয়োগকারী’ সংগ্রহ করবেন। এই ভাবে চলতে থাকে নতুন নতুন স্তরের ‘বিনিয়োগকারী’ সংগ্রহ। অনেকটা পিরামিড স্টাইলের গঠন। একেবারে উপরের স্তরে থাকে একজন বা কতিপয় লোক। তারপর যত নিচের স্তরে নামা হবে ততবেশী সংখ্যক ‘বিনিয়োগকারী’ থাকবে। এই ব্যবসায় কার্যত নতুন কোন বিনিয়োগ সৃষ্টি হয় না। অধিনস্ত স্তরের লোকদের প্রদত্ত অর্থ থেকে একটা অংশ তাদের একাউন্টে জমা হয়। প্রথম দিকে যারা যোগ দেন তারা লাভবান হন পরের স্তরে যারা যোগ দেন তাদের কাছ থেকে। এক পর্যায়ে নতুন কোন বিনিয়োগকারী পাওয়া যায় না। কারণ ততদিনে জানাজানি হয়ে যায় যে, সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই একটা জালিয়াতি। তখন যারা একেবারে নীচের স্তরে থাকেন তারা তাদের সবটাই হারান। এমনকি বিচারেরও সন্মুখীন হতে হয়। কারণ কানাডায় এটি বেআইনী ব্যবসা।
কানাডায় আরেক ধরণের প্রতারণা হয় রোমাঞ্চের নাম করে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রথমে প্রতারকরা প্রেমিক বা প্রেমিকা সেজে কাছে ভিড়ার চেষ্টা করেন টার্গেটের। নানান প্রলোভন দেখান এই প্রতারকরা। অর্থ-বিত্ত, বিয়ে, সন্তান ও সুখী জীবন ইত্যাদির প্রলোভন দেখিয়ে টার্গেটের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হলে পরে নানান জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে তার সর্বনাশ করা হয়। মহিলা টার্গেটকে অনেক সময় যৌনদাসী বানিয়ে ব্যবাসা শুরু করেন এই প্রতারকেরা। পথের ফকির বানিয়ে ছাড়ে কাউকে কাউকে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১১ সালে কানাডায় এই রোমাঞ্চ জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতারকরা প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেন ভিক্টিমদের কাছ থেকে। এরকম জালিয়াতির শিকার হয়ে কেউ কেউ পরে আত্মহত্যার পথও বেছে নেন।
কানাডা আইনের দেশ। সবকিছু এখানে নিয়মমাফিক চলে। অপরাধের মাত্রা এখানে তুলনামূলকভাবে অনেক কম। নর্থ আমেরিকায় সবচেয়ে কম অপরাধ হয় এরকম একটি শহর টরন্টো। দুর্নীতিও এদেশে অনেক কম। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এর চোখে এবার বিশ্বের কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে কানাডার অবস্থান নবম হয়েছে। একই সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিউজ এন্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট, প্যালসালভানিয়া ইউনিভারসিটি’র হোয়ার্টন স্কুল এবং গ্লোবাল ব্রান্ড কনসালটেন্টস বিএভি কনসাল্টিং এর সম্মিলিত জরীপে কানাডা বসবাসের জন্য বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা দেশ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি, এর পাশাপাশি দেশটিতে প্রতারকদেরও আনাগোনা রয়েছে। এই প্রতারকরা রয়েছে আমাদের চারপাশেই। কেউ স্বশরীরে কেউ অনলাইনে। কেউ দেশে কেউ বিদেশে। আবার কেউবা আমাদের নিজেদের কমিউনিতেই। সুতরাং আইনের দেশ কানাডায় বাস করলেও চারিদিকে চোখ-কান খোলা রেখে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
খুুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কন্ঠ