লিবারেল পার্টির একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভের পিছনে মুসলিম ভোটারদের বড় ধরণের অবদান ছিল : নতুন জরীপ তথ্য
মে ৮, ২০১৬
প্রবাসী কন্ঠ ডেস্ক : গত বছর কানাডার ফেডারেল নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যক মুসলিম ভোটার ভোট দেন লিবারেল পার্টিকে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, মুসলিম ভোটারদের ৬৫% ভোট দেন জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বাধীন লিবারেলক পার্টিকে। এনডিপেকে ভোট দেন ১০%, কনজারভেটিভ পার্টিকে ভোট দেন ২%, গ্রীন পার্টিকে ভোট দেন ১%, অন্যান্যদেরকে ১%। ১৯% মুসলিম ভোটার কোন পার্টিকে ভোট দিয়েছেন তা বলেননি। এনভায়রনিকস ইনস্টিটিউটের নতুন এক জরীপের বরাত দিয়ে সিবিসি নিউজ এ তথ্য জানায়।
মুসলিম ভোটারগণ লিবারেল পার্টিকে ব্যাপকভাবে ভোট দেন এই আশা নিয়ে যে, দলটি ক্ষমতায় এলে কানাডায় মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এই ধারণা ৯০% মুসলিম ভোটারের।
জরীপে আরো দেখা গেছে, সিটিজেনশীপ সেরিমনিতে নিকাব পরার অধিকার বাস্তবায়িত করার জন্য এবং বিতর্কিত সন্ত্রাসবিরোধী বিল সি-৫১ এর বিরোধীতা করার জন্যও অনেক মুসলিম ভোটার লিবারেল পার্টিকে ভোট দিয়েছেন। নিকাব এবং বিল সি-৫১ বিষয়ে কনজারভেটিভ পার্টির বাড়াবাড়ি মুসলিম ভোটাদের মনকে বিক্ষুব্ধ করার পিছনে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। সেই সাথে ভূমিকা রেখেছে দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিলের বিল সি-২৪। সাবেক সরকার কর্তৃক “barbaric cultural practices” tip line প্রবর্তনের প্রচেষ্টাও অনেক মুসলিম ভোটারকে ক্ষুব্দ করেছে বলে মনে করা হয়। মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে মেয়েদেরকে জোর করে বিয়ে দেয়া, অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া ইত্যাদিকে বার্বারিক কালচার বলে আখ্যা দিয়েছিল সাবেক কনজারভেটিভ সরকার।
এনভায়রানিকস ইনস্টিটিউট এ জরীপটি চালায় গত জাতীয় নির্বাচনের পর নভেম্বর, ২০১৫ থেকে ২০১৬ এর জানুয়ারীর মধ্যে।
গত নির্বাচনে লিবারেল পার্টি কুইবেক প্রভিন্সের মুসলিম ভোটাদের মন জয় করতে পেরেছিল বেশ ভালভাবেই। কানাডায় জন্ম নেয়া মুসলিম ভোটাদেরও জোর সমর্থন পেয়েছিল দলটি। অন্যদিকে এনডিপি কুইবেকের যুবক ভোটারদের কাছ থেকে কিছুটা ভাল সমর্থন পেয়েছিল। কিন্তু বয়স্ক ভোটারগণের কাছ থেকে তেমন সমর্থন পায়নি দলটি। ২০১১ সালের জাতীয় নির্বাচনের চিত্রটি দেখলে আন্দাজ করা যায় কুইবেকের মুসলিম ভোটারগণ এনডিপি ও কনজারভেটিভ পার্টির দিক থেকে কতটা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।
রঢ়ংড়ং ৎবরফ এর এক জরীপ থেকে দেখা যায় ২০১১ সালে কুইবেকের ৪৬% মুসলিম ভোটার লিবারেল পার্টির পক্ষে ভোট দেন। এনডিপি’র পক্ষে ভোট দেন ৩৮% এবং কনজারভেটিভ পার্টির পক্ষে ভোট দেন ১২%। এনভায়রানিকস ইনস্টিটিউট এর পরিচালিত এবারে জরীপে ১৯% মুসলিম ভোটার খোলসা করে বলেননি তারা গত ২০১৫ সালের নির্বাচনে কাকে ভোট দিয়েছেন। তবে অনুমান করা যায় কনজারভেটিভ পার্টি মুসলিম ভোটারদের একটা উল্লেখযোগ্য সমর্থন হারিয়েছে কুইবেকে।
সিবিসি নিউজের সাংবাদিক এরিক গ্রেনিয়ার তার এক বিশ্লেষনে বলেন, সিটিজেনশীপ অনুষ্ঠানে শপথ নেওয়ার সময় মুসলিম নারীরা নিকাব পরতে পারবেন কি পারবেন না এই নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছিল নির্বাচনের আগে ও নির্বচনের সময়, সেটি কানাডায় একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল মুসলিম ভোটারদের জন্য।
এনভাইরনিকস ইনস্টিটিউটের এক পরিপূরক জরীপে দেখা যায়, কানাডায় ৫০% মুসলিম ভোটার মনে করেন সিটিজেনশীপ অনুষ্ঠানে শপথ নেওয়ার সময় মুসলিম নারীদের নেকাব পরার অধিকার থাকা উচিৎ। তবে ৪৫% মুসলিম ভোটার এর বিপক্ষে। তারা মনে করেন নিকাব পরার অধিকার থাকা উচিৎ নয় শপথ অনুষ্ঠানে।
অবশ্য কুইবেকের চিত্রটি একটু ভিন্ন। দেখা গেছে সেখানে ২৯% মুসলিম ভোটার মনে করেন নিকাব পরার অধিকার থাকা উচিৎ শপথ গ্রহনের অনুষ্ঠানে। আর ৬৬% মুলিম ভোটার মনে করেন নিকাব পরার অধিকার থাকা উচিৎ নয়।
তবে সাধারণভাবে দেখা গেছে কানাডার মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ৬০% মনে করেন মুসলিম নারীদের নিকাব পরার অধিকার থাকা উচিৎ শপথ গ্রহনের সময়। অন্যদিকে ২৪% মনে করেন নিকাব পরার অধিকার থাকা উচিৎ নয়।
আর নিকাবের পক্ষে সমর্থন সবচেয়ে বেশী দেখা গেছে যুবক বয়সী মুসলিমদের মধ্যে (৭৫%)। যাদের জন্ম কানাডায় সেই সকল মুসলিমও নিকাবের পক্ষে জোড়ালো সমর্থন দিয়েছন (৭১%)।
দুই তৃতীয়াংশ মুসলিম অবশ্য মনে করেন কানাডায় অন্যান্য পাবলিক সার্ভিসের সেবা নেয়ার সময়ও মুসলিম নারীদের নিকাব পরার অধিকার থাকা উচিৎ। কিন্তু ২১% মুসলিম মনে করেন নিকাব পরা উচিৎ নয় পাবলিক সার্ভিসের সেবা নেওয়ার সময়।
নির্বাচনের আগে মুসলিম ভোটারদের মন আরো বিগড়ে গিয়েছিল বিল সি-২৪ এর কারণে। উল্লেখ্য যে বিল সি-২৪ আইনের বলে সরকার যে কোন দ্বৈত নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিল করে তাকে তার নিজ দেশে (যেখান থেকে এসেছে) পাঠিয়ে দিতে পারবে যদি প্রমানিত হয় যে সেই ব্যক্তি কানাডায় বা কানাডার বাইরে যে কোন স্থানে সন্ত্রাসী কার্যক্রম, বিশ্বাসঘাতকতা বা গুপ্তচরবৃত্তিতে লিপ্ত রয়েছে। আর এই সিদ্ধান্ত নিবেন ইমিগ্রেশন মন্ত্রী বা তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। আদলতের মাধ্যমে এর সুরাহা করার কোন সুযোগ রাখা হয়নি।
বিল সি-২৪ কানাডার ‘চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডম’এর লঙ্ঘন এই অভিযোগ তুলে বিভিন্ন নাগরিক অধিকার গ্রুপের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়েছিল। এই বিলের কারণে মুসলমানগণ কনজারভেটিভ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্দ ছিলেন। বর্তমান সরকার সম্প্রতি সংসদে বিল তুলেছে এই বিল সি-২৪ বাতিল করার জন্য।
বিল সি-২৪ এবং নিকাবের পাশাপাশি বিতর্কিত সন্ত্রাস বিরোধী বিল সি-৫১ নিয়েও মুসলিম কমিউনিটিতে ব্যাপক বিতর্ক ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল মূলধারার কানাডিয়ানদের মধ্যেও। ফলে টরন্টোসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ফলে পাশ হওয়ার আগে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তেরও মুখোমুখি হতে হয় বিলটিকে । কিন্তু বিতর্ক, বিরোধিতা, বিক্ষোভ এবং তদন্ত এর কোন কিছুই বিলটিকে আইনে পরিনত করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি স্টিফেন হারপারের একগুঁয়েমীর কারনে। স্টিফেন হারপারের পরিকল্পনা ছিল নির্বাচনে জয়ী হতে হলে ইসলামোফোবিয়াকে কাজে লাগাতে হবে। অর্থাৎ ধর্মকে ব্যবহার করতে হবে। আর ঐ পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য তিনি এই আইনটি পাশ করান যাতে করে মূলধারার খ্রীস্টান ধর্মালম্বিদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থকদের মধ্যে বেশীরভাগই গোঁড়াপন্থি খ্রীস্টান। আরেক তথ্যে জানা যায়, যে যত বেশী গোঁড়া সে তত বেশী কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থক। স্টিফেন হারপার নিজেও একজন গোঁড়া খ্রীষ্টান।
নির্বাচনের আগে এনডিপি এই বিল সি-৫১ এর তীব্র বিরোধীতা করেছিল এবং অঙ্গিকার করেছিল নির্বাচনে জয়ী হলে এই আইন বাতিল করে দিবে। অন্যদিকে লিবারেল পার্টি বিলটির বিলটির বিরোধীতা করেনি সরাসরি। কারণ, সংসদে এই বিলটি পাশ করানোর সময় তারা এর পক্ষেই ভোট দিয়েছিল। তবে অঙ্গীকার করেছিল এই বিলটি সংশোধন করবে তারা ক্ষমতায় এলে। লিবারেল পার্টি ক্ষমতায় আসার পর ইতিমধ্যে ৬ মাস পার হয়ে গেছে। তবে এই বিল সংশোধনের কোন উদ্যোগ এখনো তারা গ্রহণ করেনি।
মুসলিমদের মধ্যে ৪৮% এই বিল সি-৫১ এর বিরোধীতা করেছিল ভোটের আগে। তারা বলেছিল এটি নাগরিক অধিকার হরনের বিল। তবে ১৭% মুলিমের অভিমত ছিল বিল সি-৫১ ভালোর জন্যই করা হয়েছে। এই বিল কানাডায় জঙ্গী সন্ত্রাসীদের দমনে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। অবশ্য মুসলিমদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ জানেন না বিল সি-৫১ কি এবং কি কারণে তা সংসদে পাশ করানো হয়েছে। অবশ্য ৭৯% কানাডিয়ান মুসলিম মনে করেন কানাডায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধে সরকারের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা করা প্রয়োজন।