মহান স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বাংলাদেশের গৌরবদীপ্ত লালসবুজ পতাকা উত্তলিত হলো অন্টারিও প্রদেশের পার্লামেন্ট ভবনে

মার্চ ২৬, ২০১৬

প্রবাসী কন্ঠ : বাংলাদেশের ৪৬তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে গত ২৩ মার্চ অন্টারিওর পার্লামেন্ট ভবনে বাংলাদেশের গৌরবদীপ্ত লালসবুজ পতাকা উত্তলিত হলো। বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী কানাডিয়ানের উপস্থিতিতে অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবনের সামনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তলনের সময় অনেকে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। আনন্দাশ্রু ধরে রাখতে পারেননি অনেকে।
টরন্টোর বাংলাদেশ সেন্টারের উদ্যোগে ও অন্টারিও পার্লামেন্ট এর সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত এই মহতি অনুষ্ঠানটি শুরু হয় দুপুর ১২টায়। বৃষ্টির পূর্বাভাষ থাকলেও শেষপর্যন্ত তা অনুকুলেই ছিল। মেঘলা আকাশের নিচে অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবনের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য নিদর্শন এর পটভূমিতে বাংলাদেশের লালসবুজ পতাকাটি যখন উড়ছিল তখন একটি নির্মল ও বিশুদ্ধ অনুভূতি কাজ করছিল সকলের মনে। বাংলাদেশের মূল ভুখন্ড থেকে কয়েক সহস্র মাইল দুরে অবস্থান করেও সকলের হৃদয়ই এক সঙ্গে গেয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।

উল্লেখ্য যে, ২৬ মার্চ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবস। বাঙ্গালীর রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে এই দিনটি। প্রতিবছর এই দিনটিতে মুক্তিযুদ্ধের চতনা হৃদয়ে ধারণ করে সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে দেশে বিদেশে ১৬ কোটি বাঙ্গালী দিবসটি পালন করে। গভীর শ্রদ্ধাভরে স্বরণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মদানকারী বীর সন্তানদের। আরো স্বরণ করে পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার শিকার সাধারণ মানুষকেও। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন অনেক মা-বোনও। জাতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাদের প্রতিও।
এই দিনে বাঙ্গালী শ্রদ্ধা জানাতে ভুলেনা স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিও।

অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবনের সামনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তলোন করা হচ্ছে : ছবি – মনির বাবু

একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বীর বাঙ্গালী। কিন্তু সেদিন সেই হানাদারদের সহযোগিতা করেছিল দেশেরই কিছু বাঙ্গালী। পাক বাহীনির পাশাপাশি তারাও নিরস্ত্র নিরীহ সাধারণ বাঙ্গালীর উপর অত্যাচার চালিয়েছে। নির্মমভাবে হত্যা করেছিল সাধারণ মানুষকে। আজ স্বাধীনতার চারদশক পরে হলেও সেই দিনের সেই রাজাকার আলবদরদের বিচার চলছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনের ফাঁসিও কার্যকর করা হয়েছে।
গত ২৩ মার্চ অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সেন্টারের সভাপতি হাসিনা কাদের। অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবনের সামনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তলনের অনুমতি প্রদানের জন্য হাসিনা কাদের স্পীকারের প্রতি বাংলাদেশী কানাডিয়ানদের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন একটি দেশের পতাকা সেই দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতীক।

উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ হলেও ঐ দিন অন্টারিওতে সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় ২৩ মার্চকে পতাকা উত্তলনের দিন হিসাবে জন্য বেছে নেয়া হয়।
হাসিনা কাদেরের পর পতাকা উত্তলন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন অন্টারিও পার্লামেন্ট এর স্পীকার ডেভ ল্যাভাক। তিনি শুরুতেই বাংলায় ‘শুভ দিন’ বলে সবাইকে স্বাগত জানান। এর পর ‘আসøামালাইকুম’ বলে তিনি তার বক্তব্য শুরু করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনাতা দিবসের প্রাক্কালে অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবনের সামনে জমায়েত হওয়ার জন্য স্পীকার উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ইউ আর হু উই আর। তিনি এই বাক্যটি একাধিকবার উচ্চারন করেন। এই সময় উপস্থিত সবাই করতালি দিয়ে স্পীকারের এই বক্তব্যকে স্বাগত জানান। স্পীকার বলেন, আমি খুবই সম্মানিত বোধ করছি আজকের এই মহতী অনুষ্ঠানে অন্টারিও পার্লামেন্ট এর পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়ে। আমি নির্দিষ্ট কোন দলের প্রতিনিধিত্ব করি না। আমি সকলের পক্ষ হয়ে কথা বলি। তিনি বলেন, আমরা এখানে বিভিন্ন সময় সমবেত হয়ে বিভিন্ন জাতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই তাদের পতাকা উত্তলন করে। আমরা সেইসব জাতির ইতিহাস শুনি যে ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস। শোষন নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইতিহাস।

সমাবেশে উপস্থিত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে স্পীকার বলেন, অন্যায় অত্যাচার আর শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার জন্য এরা মানবজাতির প্রতিনিধি।
পতাকা উত্তলন অনুষ্ঠানে উপস্থিত দ্বিতীয় প্রজন্মের তরুন কিছু সংখ্যক বাংলাদেশী কানাডিয়ানদের দেখে আনন্দিত হন স্পীকার। তিনি বলেন, তরুন এই প্রজন্মের মধ্যে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, মুক্তি সংগ্রাম ইতিহাস সঞ্চালিত হয়েছে দেখে আমি মুগ্ধ।
স্পীকার আরো বলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস এই পতাকার চেয়ে আরো অনেক বড় মাপের বিষয়। এই স্বাধীনতা দিবস অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবনের সামনে দাড়িয়ে উদযাপনের চেয়ে আরো অনেক বেশী কিছু। এটি এমন একটি বিষয় যা বাংলাদেশীদের স্বাধীন সত্বাকে প্রতিনিধিত্ব করে। অন্যায় অত্যাচার আর শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশীদের কঠিন সংগ্রামের ইতিহাসকে তুলে ধরে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি যখন বলি ‘উই আর হু ইউ আর’ একই সঙ্গে এটিও বলি যে ‘ইউ আর হু উই আর’।
স্পীকার বলেন, কানাডায় আমরা সাবাই মিলে একটি চমৎকার বাগানের মত বাস করছি। এখানে বহু ফুলের সমাহার রয়েছে। তবে কিছু আগাছাও রয়েছে যেমনটি থাকে বাগানে। আমরা সবাই মিলে সেই আগাছা পরিষ্কার করবো।

সবশেষে তিনি আবারো অন্টারিও পার্লামেন্টের পক্ষ থেকে উপস্থিত বাংলাদেশী কানাডিয়ানদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার বক্তব্য শেষ করেন।
স্পীকারের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবনের সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তলন করা হয়। স্পীকার ডেভ ল্যাভাককে পাশে রেখে বাংলাদেশীদের পক্ষে পতাকা উত্তলন করেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত দুই মুক্তিযোদ্ধা ড. অধ্যাপক মোজাম্মেল হক খান ও উদীচী কানাডার সাবেক সভাপতি আজিজুল মালিক। প্রথমে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ও পরে কানাডার জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয় পতাকা উত্তলনের সময়। এই সময় অনুষ্ঠানে এক ভাবগম্বীর এবং একই সঙ্গে আবেগের পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কয়েকজনকে আবেগাপ্লুত হয়ে কাঁদতে দেখা যায়। উল্লেখ্য যে, পতাকা উত্তলনকারী ঐ দুই মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও আরো বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।

অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবনের সামনে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা : ছবি – মনির বাবু

আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তলনের পর অনুষ্ঠানে এর পরের বক্তা ছিলেন অন্টারিও পর্লামেন্টে এর লিবারেল দলের সদস্য আর্থার পটস। তিনি বলেন, এরকম একটি মহতী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আর্থার পটস জানান তার রাইডিং এ (বিচেস ইস্ট ইয়র্ক) ইংলিশ স্পিকিং কমিউনিটির পর বাংলাদেশী কমিউনিটির সদস্যদের সংখ্যা দ্বিতীয় বৃহত্তম।
আর্থার পটস পতাকা উত্তলন অনুষ্ঠান উপলক্ষে পাঠানো অন্টারিও প্রভিন্সের প্রিমিয়ার ক্যাথেলিন উইনির পাঠানো একটি বার্তা উপস্থিত বাংলাদেশীদের পড়ে শুনান। বার্তায় প্রিমিয়ার ক্যাথেলিন উইনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আমি অন্টারিও সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশী কমিউনিটির সদস্যদের প্রতি আন্তরিক অভিবাদন জানাচ্ছি। বার্তায় তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিকভাবে অনেকদূর এগিয়েছে। বাংলাদেশ এখন কানাডার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অংশীদারও।

পতাকা উত্তলন অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির এমপিপি সিলভিয়া জোন্স। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে তিনি অন্টারিও প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির নেতা প্যাট্রিক ব্রাউনের পক্ষে বাংলাদেশী কমিউনিটির সদস্যদের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। সিলভিয়া জোন্স বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ বাংলাদেশ সেন্টার কর্তৃক অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবনের সামনে পতাকা উত্তলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করায় তাদের প্রশংসা করেন।
অনুষ্ঠানে এর পর বক্তব্য রাখেন এনডিপি দলের এমপিপি পার্সি হ্যাটফিল্ড। পার্সি হ্যাটফিল্ড অনুষ্ঠানে উপস্থি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান। অন্টারিও এনডিপি নেতা এ্যাড্রিয়া হাউয়ার্থ এর পক্ষে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশী কানাডিয়ানদের অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি শান্তিপ্রিয় দেশ হিসাবে পরিচিত। জাতিসংঘের অধিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি মিশনে সফলতার সঙ্গে বাংলাদেশী সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সঙ্গীত শিল্পী জর্জ হ্যরিসনের কনসার্টের কথাও তিনি স্বরণ করেন।

পার্সি আরো বলেন, বাংলাদেশী কানাডিয়ানরা এখন এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে। তারা আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে যাচ্ছে এদেশে। তিনি বলেন টরন্টোতে প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশীর বাস। আর সারা কানাডায় বাস করছে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশী। বাসবাসের জন্য বেশীরভাগ বাংলাদেশী কর্তৃক অন্টারিওকে পছন্দ করায় এবং এই প্রভিন্সের অগ্রগতিতে অবদান রাখায় তিনি তাদের ধন্যবাদ জানান।
সবশেষে বাংলাদেশী কমিউনিটির সদস্যদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন কমিউনিটির বিশিষ্ট সদস্য ও মেজর জেনারেল (অব.) সি.আর. দত্ত, বীর উত্তম এর কন্যা ব্যারিস্টার চয়নিকা দত্ত। সি. আর. দত্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একজন ওয়ার হিরো হিসাবে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। চয়নিকা দত্ত বলেন, অন্টারিতে এবারই প্রথম আনুষ্ঠানিভাবে বাংলাদেশী পতাকা উত্তলন করা হলো। টরন্টোতে বসবাসকারী বাংলাদেশী কমিউনিটির সদস্যদের জন্য এটি একটি বিরাট সম্মানের বিষয়। অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবনের সামনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এই পতাকা উত্তলনের অনুষ্ঠানটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তিনি এজন্য কৃতিত্ব দেন অন্টারিও পার্লামেন্ট ও বাংলাদেশ সেন্টারকে। চয়নিকা দত্ত বলেন, তাদের সহযোগিতা ছাড়া আজকের এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটি করা সম্ভব হতো না। এ প্রসঙ্গে তিনি বিশেষভাবে অভিনন্দন জানান বাংলাদেশ সেন্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহবুব রেজাকে। তিনি বলেন, অন্টারিও প্রভিন্সের পার্লামেন্ট ভবনে পতাকা উত্তলনের মূল পরিকল্পনাকারী মাহবুব রেজার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই আজ এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটি করা সম্ভব হয়েছে।
সবশেষে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন বাংলাদেশ সেন্টারের সভাপতি হাসিনা কাদের।