প্রবাসে পরহিতকর্ম (২)

জুলািই ২৮, ২০১৪

রীনা গুলশান

পরহিতকর্ম নানা ভাবে করা যায় এই প্রবাসে। ১. ছেলে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া। এটা খুবই জরুরী এবং অত্যন্ত পূন্যের একটা কাজ। ২. বিবাহিত জীবনের ক্রমাগত ভাঙ্গনকে ঠেকিয়ে রাখা। অন্তত ডিভোর্স পর্যন্ত গড়াতে না দেওয়া। ৩. ১০ থেকে ১৮ বছরের ছেলে এবং মেয়েদেরকে নানাভাবে সাহায্য করা। বিশেষত আমাদের কৃষ্টি, সভ্যতা, ধর্ম (যার যার) এগুলোকে তাদের হৃদয়ের ভিতরে জাগ্রত রাখা। ৪. একটা মারাত্মক অসুস্থ মানুষ হাসপাতালে অথবা ঘরে, ঐ পরিবারটাকে নানাভাবে সাহায্য করা। ৫. দুটো পরিবারের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদ অথবা তাদের পারষ্পরিক বিদ্বেষকে মিটিয়ে ফেলতে সাহায্য করা। ৬. এবং অবশ্যই নতুন আসা ইমিগ্রেন্টদের সর্বতভাবে সাহায্য করা। ৭. কোন বৃদ্ধ পরিবারকে সাহায্য করা।

(১) এই বিয়ে দেবার কাজটা আমি খুব ছোট বেলা থেকে করছি। জীবনের প্রথম বিয়েটাই করিয়েছিলাম আমার অনেক প্রিয় একজন বান্ধবীর সাথে আমার বড় ভাইয়ের বন্ধুর বিয়ে দিয়ে। মূলতঃ আমি তখন তেমন কিছু বুঝি না এই ব্যাপারগুলি। তুব কিভাবে জানি আল্লাহপাকই আমার হাত দিয়ে এটা করিয়ে দিয়েছিলেন। এবং তারা খুবই সুখী হয়েছিল। পরবর্তীতে অসংখ্য বিয়ে আমি দিয়েছি। এই কাজটি করে আমি মনের ভিতর থেকেই খুব আনন্দ পাই। আর এই প্রবাসে তো এটি খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। মোটামুটি প্রত্যেকেরই যার যার বন্ধুত্বের পরিমন্ডলে এই কাজে সাহায্যের হাত বাড়ানো উচিৎ। কারণ অনেকেই জানেনা কোন জায়গাতে একটা উপযুক্ত পাত্র বা পাত্রী আছে। অনেকেই আজকাল বাংলাদেশে গিয়ে বিয়ে দেবার ব্যাপারে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে নানা কারনে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক কারণে ব্যাপারটি দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করেছে। তারপর থাকে পরবর্তীতে নববিবাহিত পাত্র বা পাত্রীদের আনার ধাক্কা। এবং এটা দিন দিন এতটা দীর্ঘায়িত হয়ে পড়েছে যে, বরবধূ দুজনের জন্যই অসম্ভব সমস্যা। বিশেষ করে বাংলাদেশে যাকে বিয়ে করে রেখে আসা হয় তারা নানাবিধ কারনে মানসিক টানা পড়েনে থাকে। অনিশ্চয়তা অথবা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে। তারপরও যখন তারা কানাডায় আসে তখন সমস্যা হয় দুই তরফেরই এডজাস্টমেন্ট এর প্রব্লেম। প্রথমতঃ আবহাওয়ার ধাক্কা। দ্বিতীয়ত: ইংরেজীর (সবার ক্ষেত্রে অবশ্য নয়) ঝামেলা। তৃতীয়ত: নবদম্পত্রি জানাজানির ব্যাপারটিতে আছেই। চতুর্থত: শিক্ষাগত এবং প্রফেশনাল জবের (এটাই মূলত প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দেয় বহু ক্ষেত্রে) হতাশা। যেটা কিনা পরবর্তীতে দাম্পত্য জীবনের উপরে দারুন প্রভাব ফেলে। এইসব ক্ষেত্রে হতাশা মাঝে মধ্যে এমন চরম আকার ধারণ করে যে, সংসার দ্র্রুত ভাঙ্গনের দিকে এগিয়ে যায়।

তো, এসব নানাবিধ কারণে, পুত্র/পুত্রীর বাবা-মায়েরা ক্রমশই দেশে গিয়ে বিয়ে করানোর ব্যাপারে খুবই অনীহা প্রকাশ করছেন। আমিও এ ব্যাপারে কোন দোষ দেখছি না। উত্তর আমেরিকাতেই যদি দুই পরিবারের মধ্যে জানাশোনার মাধ্যমে বিয়ে হয় তাহলে এসব ঝামেলা অন্তত এড়ানো যায়। তারপরও পরিচিতদের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিয়ে দেশ থেকেও করিয়েছি। সেসব ক্ষেত্রে ডাইরেক্ট ইনভলব না থাকলেও ইনডাইরেক্ট ইনভলব থেকেছি। আমি নিজেও দেখেছি, মূলত: দেশে গিয়ে ছেলে -মেয়ের বিয়ে করানো শুধু যে ঝামেলা তাই নয়, প্রচুর খরচ সাপেক্ষও বটে। বিশেষত আমাদের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য তো মারাত্মক কষ্টের। আমাদের যা মাসিক আয়, তাতে করে গোটা মাস মোটামুটিভাবে চালিয়েও ২০০ ডলার পর্যন্ত জমানো দুষ্কর। আরো যদি কাউকে দেশেও টাকা (ডলার) পাঠানোর ব্যাপার থাকে তাহলে তো ‘গোদের উপর বিষ ফোড়া’। কঠিন অবস্থা। ৩ জনের পরিবারও দেশে শুধু যাওয়া আসাতেই ৬ হজার ডলার। উপরন্তু, দেশে গিয়ে চলবার টাকা, সবার জন্য উপহার ইত্যাকার খরচা, চিন্তারও অতীত!! আর দেশের বিয়ের অনুষ্ঠান আর আগের মত নেই। এখন দেশের বিয়ে হয় পুরো হিন্দী সিনেমার স্টাইলে। বছর ২/৩ এর মধ্যে যাদের এই অভিজ্ঞতা হয়েছে আশা করছি তারা আমার সাথে একমত হবেন।

যা/তা করে তবুও বিয়েটা তো হলো। এবার নববধূ আসার পালা। এবারেই দেখা দেয় মূল নাটক। ৮০ ভাগ অভিযোগ যেটা   শুনা যায় তা হলো, নববধূ এসেই নানান বায়না করছে। এসেই পারলোনা … ‘আবার দেশে যাবো যাবো করছে।’ কান ঝালা পালা করে দিচ্ছে স্বামী প্রবরের। ‘জানু, ও সরংং ঃযবস ’ ( নববধূ আর বাংলাও বলে না)। অতএব ‘জানু’ কে দেখা যাচ্ছে মাথার ঘাম হাতে নিয়ে টিকেটের জন্য ছুটাছুটি করছে। কার কাছে একটু কমে পাওয়া যায়। এই কিছু দিন আগেই এরকম একটি ঘটনা দেখা গেল। সেই নববধূ (এখন আর নববধূ অবশ্যই নেই) কানটেনে ‘জানু’কেও দেশে নিয়ে গেল। দেশে গিয়ে প্রায় ১৫ লক্ষ বাংলাদেশী টাকা খরচ করে এসেছে। কারন দেশে যাবার আগে নববধূ ঠোট ফুলিয়ে, চোখ মটকে বরকে বলেছে, ‘জানু আমার প্রেস্টিস কা সাওয়াল’, দেশে গিয়ে একটা পার্টি দিতে হবে। আর নতুন ধরনের একটা আকবরী নেকলেস যদি কিনে না দাও… তাহলে তো তোমারও প্রেস্টিস থাকে না। Ñ তাই বলির পাঠা Ñ বেচারা কানাডা থেকে যাবার আগে ক্রেডিট লাইন এ চড়া সূদে মোটা অংকের ডলার নিয়ে গেছে। মান ইজ্জত কা বাত বলে কথা!! অতএব, আশে পাশে আরো যে সব পুত্র কন্যাদের বাবা মা আছেন তারা আতঙ্কিত ভাবে অবলোকন

করে বলে, ‘‘না বাপু দেশের কন্যা নয়, এখানেই দ্যাখো।”

তো এরকমই একজন কন্যাদায় (!) গ্রস্থ মাতা একদা আমাকে বললেন, (উনি আমাদেরই এলাকার মেয়ে। বহুদিন ধরে কনাডাতে আয়ে, দুই কন্যা, একটি পুত্র সন্তানের জননী উনি)

দেখিস তো – বড় মেয়েটির জন্য একটি ভাল ছেলে।

কিরকম ছেলে চাই?

এই বেশী কিছু না… (লাঞ্চচন লেডীর কায়দায়, অথবা সমারসেট মমের বর্ণিত লেডীর কায়দায়) অবশ্যই হ্যান্ডসাম হতে হবে, মাস্ট বি ইঞ্জিনিয়ার (!) (কেনরে বাবা অন্য ডিগ্রিধারীরা কি দোষ করলো?), বাড়ি না থাকলেও অসুবিধা নেই (যেন হবু জামাইকে দয়া করলেন, নাকি ঘর-জামাই করার বাসনা!)। তবে বুঝলি রীনা, ছেলেকে নর্থ আমেরিকার নাগরিক হতে হবে এবং অবশ্যই অবশ্যই বিলং টু গুড ফ্যামিলি….(আচ্ছা- কিছু বাদ গেল কি? পুত্র দায়গ্রস্ত মাতা, পিতাগন সাবধান!)। অতএব পরোপকারী হৃদয় আবার মাথাচড়া দিয়ে উঠলো। বেশ ২/৩ মাসের অপরিসীম প্রচেষ্টায় সত্যি সত্যিই ঐ লাঞ্চচন লেডীর কথিত বর্ণনা অনুযায়ী একটি সুযোগ্য পাত্রের সন্ধান পেলাম। (পেলাম আর কোথায়?) পাত্র পাওয়া কি এত সোজা? ইস্ এই ম্যাস মেকারদের ফরজ কাজ করতে গিয়ে কত যে মিথ্যা বলা লাগে! অর্থাৎ জান্নাতের দরজায় ঢুকতে যেয়ে হয়তো দোজখে ঢুকে যাচিছ। যেমন, মেয়ে যা লম্বা, যা ফিগার! দেখতে একেবারে শিল্পাশেঠী! মুখটাতো এত্ত মিষ্টি যে প্রিমিয়াম সুইটস এ যাবার কোনই দরকার নেই (যা এক্সপেন্সিভ!)। এরকম হাজারো ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মতো অবস্থা। অতি কষ্টে ছেলেকে আমেরিকা থেকে টরন্টোতে আসতে রাজী করানো গেল। (১৬ ঘন্টার মতো ড্রাইভ)। এবার আবার লাঞ্চয়ন লেডীর দারস্থ।

আপু, আপনার কথিত বয়ান অনুযায়ী একটি পাত্র অবেশেষে পাওয়া গেছে।

ওমা, তাই… কোথাকার।

এই তো কাছেই, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে।

ওহ! গুড!

মজার ব্যাপার … এবারে পাত্র কি করে বা ইত্যাকার সেইসব নরমাল প্রশ্নগুলি না করে সরাসরি এমনি একটি প্রশ্ন করে বসলো যে আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার উপক্রম (এমনিতেই আমি হৃদয়ের ব্যামোতে ভূগছি দীর্ঘ দিবস ধীর্ঘ রজনী।)

পাত্রের বাবা-মা আছে? (প্রশ্নটা ঠিক বুঝলাম না। আজকাল এমনিতেই একটু কম বুঝি। মানুষ এত বেশী বুঝে ফেলেছে যে আর বুঝতেই ইচ্ছে করে না!) ভাবলাম, ওহ! এতিম কিনা, তাই জানতে চাচ্ছে। আমি বেশ সোৎসাহে বললাম: না না, পাত্র এতিম (বাবা মারা গেলে!) ও নয়, মিসকিন (মা মারা গেলে) ও নয়।

হু। তারা থাকে কোথায়? দেশে?

না না, পাত্রের বাবা বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের চাকুরী সূত্রেই আমেরিকাতে এসেছিল। পরে এখানেই সেটেল করে গেছে। পাত্র তখন ছোট।

তার মানে পাত্র তার বাবা-মায়ের সাথেই থাকে?

অবশ্যই।

বুুঝলে রীনা-তাহলে বিয়েটা দেওয়া যাচ্ছে না।

কেন?

না মানে বাবা-মায়ের সাথে থাকা কোন পাত্রের সাথে আমার কন্যার বিয়ে দিব না।

আমার তখন এমন বেহাল অবস্থা (কারণ, এই কথাটি প্রথম উনার কাছেই শুনেছিলাম। অবশ্য পরবর্তীতে আরো দুইবার শুনতে হয়েছিল। আমার মনে হলো যেন কয়েক হাজার ভোল্টের শক খেলাম। অনেক্ষণ …কতক্ষণ জানিনা..স্থবির থেকে অবশেষে বেশ মিনমিনে এবং দুঃখী কন্ঠে বললাম:

তাহলে আপু এই বাবা-মা গুলো যাবে কোথায়?

তা আমি কি জানি। ও সব বড়ই হ্যাপা-যাই বল।

কি আর করা। স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে অনেকটা হতাশাময় (বেশ দুঃখিতও) কন্ঠে বললাম:

তাহলে আপু আপনার ছেলের (তাও বুড়া কালের) বিয়ের পর কোথায় যাবেন? সেটা কি একবার ভেবেছেন?

হুম।

তার ‘হুম’ শুনার আগেই বোধহয় ফোনটা রেখে দিয়েছিলাম। নিজেকে বড়ই দুঃখি এবং ছিবড়ে মনে হচ্ছিল। একই সাথে মারাত্মক ক্রোধান্বিত হয়ে পরলাম। আজকাল আবার খুব রেগে গেলে অনেক্ষন কথা বলি না। তাতে করে দেখা যায় রাগ বেশ কিছুটা প্রশমিত হয়।

পরহিত কর্ম করতে গিয়ে অনেক রকম বিড়ম্বিত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। এটা বড়ই মারাত্মাক! কিন্তু এই আপুটি মুখের উপর কটু ভাবে বলে দিল। কিন্তু মেয়ের মায়েরা মনে মনে বলে, বাবা-মা ছাড়া পুত্র! ছেলের মায়েরা তাহলে কি ভাবে, ‘‘বাপের বাড়ি ছাড়া’’ কন্যা!!

হা! হতোষ্মি!! একটি জামানা ছিল, যখন কোন পক্ষই এসব ভাববার কথা ভাবতো না। বাবা-মাকে পুত্র কন্যারা জান্নাতের সমপর্যায়ের দরজা দিয়ে রাখতো। আর এ কোন সময়কে আমরা অতিবাহিত করছি??

এবং চিন্তার বিষয়:

কোন সময়টা সত্যিই ভাল ছিল??

গতকাল? এখন? নাকি আরো সামনের???