দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব হরণের আইন বাতিল করা হচ্ছে

সংশোধন আসছে কনজারভেটিভ সরকার প্রণীত বিতকির্ত অন্যান্য ইমিগ্রেশন আইনেও

মার্চ ১৩, ২০১৬

প্রবাসী কন্ঠ : সাবেক কনজারভেটিভ সরকার কর্তৃক প্রণীত দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব হরণের বিতর্কিত আইনটি বাতিল করার জন্য গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টে বিল তুলেছে লিবারেল সরকার। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে লিবারেল পার্টির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল এটি। তারা বলেছিল, লিবারেল পার্টি ক্ষমতায় এলে এই আইনটি বাতিল করা হবে।

লিবারেল সরকার সাবেক কনজারভেটিভ সরকারের করে যাওয়া আরো কিছু বিতর্কিত ইমিগ্রেশন আইনও সংশোধন করতে যাচ্ছে যার মধ্যে আছে:

-প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যারা কানাডিয়ান সিটিজেনশীপের জন্য আবেদন করবেন তাদেরকে এখন থেকে এই মর্মে কোন ঘোষণা দিতে হবে না যে, সিটিজেনশীপ পাওয়ার পর তারা কানাডায় অব্যাহতভাবে বাস করবেন। উল্লেখ্য যে, সাবেক কনজারভেটিভ সরকার  এ ব্যাপারে এমন এক নিয়ম করে গিয়েছিল যার মাধ্যমে দ্বৈত নাগরিকরা নাগরিত্ব হারাবার ঝুঁকিতে ছিলেন।

-সাবেক কনজারভেটিভ সরকার আরো আইন করে গিয়েছিল কানাডার নাগরিকত্ব লাভ করতে হলে ইমিগ্রেন্টদেরকে ৬ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৪ বছর কানাডায় বাস করতে হবে। আগে নিয়ম ছিল ৪ বছরের মধ্যে তিন বছর কানাডায় থাকতে হবে। লিবারেল সরকার এখন নিয়ম করেছে ৫ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৩ বছর কানাডায় বাস করতে হবে সিটিজেনশীপের জন্য আবেদন করার আগে।

-সাবেক কনজারভেটিভ সরকার নিয়ম করে গিয়েছিল সিটিজেনশীপের জন্য আবেদন করতে হলে যেদিন থেকে আবেদনকারী পার্মানেন্ট রেসিডেন্সী লাভ করেছেন সেদিন থেকে দিন গণনা শুরু হবে। কিন্তু লিবারেল সরকারের হালনাগাদ করা সিটিজেনশীপ আইনে বলা হয়েছে, আবেদনকারী যেদিন থেকে কানাডায় স্বশরীরে উপস্থিত হয়েছেন সেদিন থেকে দিন গননা শুরু হবে। অর্থাৎ পার্মানেন্ট রেসিডেন্সী পাওয়ার আগের দিনগুলোও হিসাবের মধ্য পড়বে। তবে আগের দিনগুলো গননা হবে অর্ধেক দিন হিসাবে। অর্থাৎ এক বছর অবস্থান করে থাকলে তা ৬ মাস হিসেবে গন্য হবে। আর আগের অবস্থান থেকে ক্রেডিট পাওয়া যাবে সর্বোচ্চ এক বছর। অর্থাৎ দুই বছর অবস্থান করে থাকলে এক বছরের ক্রেডিট, আর তিন বছর অবস্থান করে থাকলেও ঐ এক বছরেরই ক্রেডিট পাওয়া যাবে।

-নাগরিকত্ব লাভের জন্য ল্যাংগুয়েজ টেস্টকেও কঠিন করে গিয়েছিল সাবেক কনজারভেটিভ সরকার। বয়স্ক ব্যক্তিদের পক্ষে ল্যাংগুয়েজ টেস্ট পাস করা এমনিতেই কঠিন। তা জানা সত্বেও কর্তৃপক্ষ বয়সের মাত্রা আরো বৃদ্ধি করেছিল। আগে নিয়ম ছিল ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত ব্যক্তিদেরকে ল্যাংগুয়েজ টেস্ট পাস করতে হবে। কনজারভেট্ভি সরকার নিয়ম করেছিল ১৪ থেকে ৬৪ বছর বয়স পর্যন্ত ব্যক্তিদেরকে ল্যাংগুয়েজ টেস্ট পাস করতে হবে। এবার লিবারেল সরকার নতুন নিয়ম করেছে যাতে বলা হয়েছে ১৮ থেকে ৫৪ বয়স পর্যন্ত ব্যক্তিদেরকে ল্যাংগুয়েজ টেস্ট পাস করতে হবে।

বিতর্কিত বিল সি-২৪ এ নাগরিকত্ব বাতিল করার যে নতুন আইনটি বিগত সরকার করে গিয়েছিল তাতে বলা ছিল- দ্বৈত নাগরিকদের কানাডিয়ান নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে যখন:

-কেউ নাগরিকত্ব লাভের জন্য আবেদনপত্রে মিথ্যা তথ্য দিবেন।

-কেউ যদি এমন কোন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য হয়ে থাকেন বা কোন সংগঠিত সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য হয়ে থাকেন যেটি কানাডার সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িত।

-কেউ যদি বিশ্বাসঘাতকতার জন্য সাজা প্রাপ্ত হয়ে থাকেন, গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধে অপরাধী হয়ে থাকেন এবং জাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে থাকেন।

-কেউ যদি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন অথবা সমজাতীয় অপরাধে বিদেশে অভিযুক্ত হয়ে থাকেন এবং সেই সাজার পরিমান যদি ৫ বছর বা তারো বেশী হয়ে থকে। তবে সেই দ্বৈত নাগরিকের যদি দ্বিতীয় কোন দেশে যাওয়ার উপায় না থাকে তবে তার নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে না। কারণ, কানাডা জাতিসংঘের “কনভেনশন অন দি রিডাকশন অব স্টেটলেসনেস (১৯৬১)” সনদে স্বাক্ষরকারীদের একটি দেশ। ঐ সনদ অনুযায়ী কাউকে রাষ্ট্রহীন করা যাবে না।

সমালোচকদের বক্তব্য ছিল, কানাডা ইমিগ্রেশন আইনে কনজারভেটিভ  সরকার যেসব পরিবর্তন এনেছে তার অধিকাংশই অগনতান্ত্রিক। কানাডার ইমিগ্রেশন এন্ড রিফুজি অইনজীবীগণ এবং এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কানাডারও বক্তব্য ছিল – কনজারভেটিভ সরকার কর্তৃক ইমিগ্রেশন আইন পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। তারা সকলেই বিল সি-২৪ এর বিরুদ্ধে তখন মত প্রকাশ করেছিল। বিশেষ করে দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়টি নিয়ে তারা ছিল উদ্বিগ্ন।

সিভিল রাইটস গ্রুপস এবং এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছিল, নতুন এই আইন দ্বৈত নাগরিকদের জন্য বৈষম্যমূলক। এর মাধ্যমে দ্বৈত নাগরিকদেরকে এক অর্থে ‘লেস কানাডিয়ান’ কাতারে ফেলা হয়েছে এবং কানাডায় জন্ম নেয়া নাগরিকদের চেয়ে কম অধিকারসম্পন্ন করে তোলা হয়েছে। বৃটিশ কলম্বিয়ার সিভিল লিবার্টিজ এসোসিয়েশন এর ভাষ্য ছিল এরকম “ দ্বৈত নাগরিকরা এখন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে গেল।”

আগের নিয়মে কানাডার নাগরিকত্ব সবসময়ই ছিল নিরাপদ। কার জন্ম কানাডায় বা কার জন্ম বিদেশের মাটিতে সেগুলো বিবেচ্য বিষয় ছিল না। কানাডার নাগরিকত্ব বাতিল করা যেতে শুধুমাত্র তখনই যখন প্রমানিত হতো যে, নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার সময় কেউ কোন ভূয়া তথ্য দিয়েছেন।

কানাডার ইমিগ্রেশন বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন এমন একজন বিশেষজ্ঞ সাইমন ফ্রেসার ইউনিভারসিটির গ্রাজুয়েট সুমায়েয়া বাহরামী তার এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, যে সকল কানাডিয়ান নাগরিকের জন্ম বিদেশের মাটিতে অর্থাৎ যারা দ্বৈত নাগরিক তারা তাদের নাগরিত্ব হারাতে পারেন যদি ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা মনে করেন সেই ব্যক্তিটি কানাডায় বাস করতে আগ্রহী নন অথবা সেই ব্যক্তি তৃতীয় কোন দেশে পড়াশুনা করতে বা চাকুরী করার জন্য গিয়ে থাকেন। সুমায়েয়া বাহরামী আরো উল্লেখ করেন, দ্বৈত নাগরিকেরা অন্য দেশে গিয়ে গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হলেও কানাডার নাগরিকত্ব হারাতে পারেন। তৃতীয় সে দেশটি যদি অগণতান্ত্রিক হয়, বিচারবিভাগ যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তবু সেই দেশ ও বিচার বিভাগের রায়কে গুরুত্ব দিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির কানাডীয় নাগরিকত্ব বাতিল করা হতে পারে। সুমায়েয়ার মতে কানাডার প্রথম শ্রেণী ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্বের যে বিভক্তি তৈরী করা হয়েছে এবং নাগরিকত্ব লাভের জন্য অন্যান্য যে সকল  নতুন আইন তৈরী করা হয়েছে তা নতুন ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।

উল্লেখ্য যে, সাবেক কনজারভেটিভ সরকারের ইমিগ্রেশন মন্ত্রী ক্রিস আলেকজান্ডার ক্ষমতায় থাকা কালে বলেছিলেন, “কানাডার সিটিজেনশীপ কোন অধিকারের বিষয় নয়, এটি একটি সুযোগ বা সুবিধা।”

লিবারেল কর্তৃক পার্লামেন্টে উত্থাপিত নাগরিকত্ব বিষয়ক এই বিলটি পাশ হলে এর প্রথম বেনিফিশিয়ারী হবেন জাকারিয়া আমারা যিনি গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে কানাডার নাগরিকত্ব হারিয়েছেন। জাকারিয়া আমারা হলেন টরন্টোর সেই ১৮ সন্ত্রাসী গ্রুপের নেতা। এই গ্রুপটি কয়েক বছর আগে পার্লামেন্ট ভবন সহ আরো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। গত ২০১০ সালে আদালতের এক রায়ে জাকারিয়ার যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। এ বিষয়ে সাংবাদিকরা ইমিগ্রেশন মন্ত্রী জন ম্যাক্কালামকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন,

আমাদের একটি ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম রয়েছে, আমাদের কোর্ট রয়েছে, আমাদের জেলখানা রয়েছে যেখানে অপরাধীদের পাঠানো হয়। আমরা এই সিস্টেমের মাধ্যমেই অপরাধীদেরকে সাজা দিয়ে থাকি। অপরাধীদের সাজা দেওয়ার জন্য কানাডায় দুই স্তরের নাগরিকত্ব সৃষ্টির প্রয়োজন নেই । আমরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি কানাডায় এক স্তরের নাগিরকত্বই বহাল থাকবে। আমরা আরো মনে করি একজন কানাডিয়ান সবসময়ই কানাডিয়ান। সব কানাডিয়ানের সমান অধিকারে আমরা বিশ্বাস করি।

উল্লেখ্য যে, যারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে কানাডার নাগরিকত্ব গ্রহনের চেষ্টা করেন বা করেছেন তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করার ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকবে আগের মতই। দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব হরণের বিতর্কিত আইন প্রবর্তনসহ ইমিগ্রেশনের অন্যান্য আইনে সাবেক কনজারভেটিভ সরকার যে সকল পরিবর্তন এনেছিল সেগুলো বাতিল করার জন্য লিবারেল সরকারকে মোটেও বেগ পেতে হবে না। কারণ, পার্লামেন্টে তাদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হতে পারে সিনেট কমিটিতে যেখানে কনজারভেটিভদের প্রাধান্য রয়েছে। অপরদিকে পার্লামেন্টে বিলটি পাশ হলেও গভর্ণর জেনারেলের অনুমোদন লাগবে। নয়তো এটি আইনে পরিনত হবে না।