দরিদ্র মানুষের আয়বৃদ্ধির জন্য বেসিক ইনকাম গ্যারান্টি প্রকল্প চালু হতে যাচ্ছে অন্টারিওতে

এপ্রিল ৯, ২০১৬

প্রবাসী কন্ঠ ডেস্ক : অবশেষে চালু হতে যাচ্ছে ‘বেসিক ইনকাম গ্যারান্টি’ প্রকল্প। অন্টারিতে যারা দারিদ্রতার মধ্যে বাস করছেন তাদের আয়বৃদ্ধির জন্য এই বেসিক ইনকাম গ্যারান্টি প্রকল্প আগামী শরৎ ঋৃতু থেকে চালু হবে। প্রথম দিকে এটি পাইলট প্রকল্প হিসাবে চালু করা হবে। ফলাফল ভাল হলে পরবর্তীতে তা আরো বিস্তৃত হতে পারে।

এই বেসিক ইনকাম গ্যারান্টি খুবই সহজ এবং সরল একটি পদ্ধতি যা স্বল্প আয়ের বা দরিদ্র মানুষের দারিদ্রতা দুরীকরণে বর্তমানে চালু স্যোসাল এসিস্টেন্ট বা ওয়েলফেয়ার এর চেয়ে অধিক কার্যকর। গত ফেব্রুয়ারী মাসে অন্টারিও প্রভিন্সের বাজেটে এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে প্রভিন্সিয়াল সরকার। অন্যদিকে ফেডারেল সরকারও এই প্রকল্পটি চালু করার বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। লিবারেল এর একটি পার্লামেন্টারী কমিটি ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সরকারের কাছে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব রেখেছে। খবর দ্যিা কানাডিয়ান প্রেস এর।

অন্টারিও প্রভিন্সের অর্থ মন্ত্রী চার্লস সোসা বলেন কোন কমিউনিটি থেকে এই পাইলট প্রকল্পটির পরীক্ষা শুরু করা হবে তা এখনো চুড়ান্ত করা হয়নি।

বেসিক ইনকাম গ্যারান্টির প্রবক্তারা বলেন, এটি চালু হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠি উপকৃত হবে এবং বর্তমানে চালু ওয়েলফেয়ার সিস্টেমসহ অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে কম খরচে তা নির্বাহ করা সম্ভব হবে। তারা আরো বলেন, দারিদ্রতা মানুষের স্বাস্থ্যের উপর বড়রকমের বিরুপ প্রভাব ফেলে। বেসিক ইনকাম গ্যারান্টির প্রকল্প চালু করা হলে অন্টারিওর হেলথ সিস্টেমের খরচও অনেক কমে যাবে।

প্রাপ্ত তথ্যে আরো দেখা যায়, কানাডায় প্রতিদিন প্রায় এক মিলিয়ন লোককে ফুড ব্যাংকের স্মরনাপন্ন হতে হয় অভাবের তারনায়। ইউনিভারসিটি অব টরন্টোর সোস্যাল ওয়ার্ক ফেকাল্টির অধ্যাপক লিওনার্ড এডওয়ার্ডের মতে কানাডায় প্রতি তিনজন দরিদ্র লোকের মধ্যে একজন হলেন ইমিগ্রেন্ট যারা এখানে মাইনরিটি গ্রুপের সদস্য হিসেবে বিবেচিতে হয়। অথচ কানাডা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ধনী দেশগুলোর একটি। বহু  সংখ্যক সেরা ধনীরও বসবাস রয়েছে এই কানাডায়। প্রথম সারির ১০০ জন ধনী কানাডিয়ানের মোট সম্পত্তির পরিমান ২০০ বিলিয়ন ডলার।

কোন সমাজে বা রাষ্ট্রে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠি বা সম্প্রদায়ের দারিদ্রতা সত্যিকার অর্থে সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতিটি সদস্যকেই ভোগায়। কারণ, ঐ নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠি দারিদ্রতার কারণে নানান রোগ-শোকে ভোগে, মানসিক রোগ তাদের নিত্য সাথী হয়ে দাড়ায়, আইশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেশী সময় ব্যয় করতে হয় তাদের জন্য। ফলে হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় ও আইন-শৃংখলা বজায় রাখার খরচ বৃদ্ধি পায়। দারিদ্রতার কারণে শারীরিক ও মানসিক রোগ লেগে থাকে বলে কর্মস্থলে তাদের উপস্থিতি কমে যায়। ফলে জাতীয় উৎপাদন ব্যহত হয়। স্কুল কলেজেও উপস্থিতির হার কমে যায় দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের। ড্রপআউট বেড়ে যায়। ফলে ভবিষ্যতে দক্ষ কর্মীবাহিনীর স্বল্পতা দেখা দেয়। এভাবে আরো নানাভাবে এই দারিদ্রতা সামজ ও রাষ্ট্রকে পিছিয়ে দেয়।

হিসাবে দেখা গেছে কানাডায় শতকরা ৯ জন দরিদ্রসীমার নিচে বাস করেন। সিঙ্গেল মাদার ও আদীবাসীদের মধ্যে এই হার আরো বেশী।

অন্য আরেক হিসেবে আমরা দেখতে পাই কানাডায় বসবাসরত শতকরা প্রায় ২০ ভাগ বাংলাদেশীর আয় দারিদ্রসীমার নিচে। এদের আয়ের সবটুকুই ব্যয় হয়ে যায় থাকা ও খাওয়ার পিছনে। সঞ্চয় বলতে কিছুই থাকে না। সম্প্রতি কানাডা সরকারের এক অভ্যন্তরীন জরীপে এই তথ্য উঠে এসেছে। জরীপে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় নতুন ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে আয়ের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছেন যারা চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান থেকে এসেছেন। স্বল্প আয়ের এই ইমিগ্রেন্টদের কেউ কেউ বাধ্য হচ্ছেন সরকারী ভাতা গ্রহণ করতে।

উল্লেখ্য যে, কানাডার দুইজন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ড্যানিয়েল মারটিন এবং রায়ান মেইলি যৌথভাবে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন টরন্টো স্টার পত্রিকায় যেখানে তাঁরা উল্লেখ করেন, “মানুষকে অসুস্থ করে তোলার পিছনে ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির যেমন ভূমিকা থাকে তেমনি থাকে তাদের ব্যক্তিগত অভ্যাস যেমন ধূমপান, খাবার ঠিকমত না খাওয়া বা অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া অথবা অলস জীবন যাপন ইত্যাদিরও ভূমিকা। তবে এগুলোর চেয়েও অনেক বেশী ভূমিকা রাখে মানুষের দারিদ্রতা। দরিদ্র এই মানুষদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানোর জন্য শুধু ঔষধ প্রেস্ক্রাইব করলেই হবে না বা তাদের ব্যক্তিগত অভ্যাস বদল করতে বললেও কোন ফয়দা হবে না। প্রয়োজন তাদের আয় বৃদ্ধি করা যেটাকে বলা যেতে পারে বেসিক ইনকাম গ্যারান্টি বা হেলদি ইনকাম।”

বেসিক ইনকাম গ্যারান্টির প্রবক্তাদের একজন সিনেটর আর্ট এ্যাগলিটন বলেন, এই প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়িত করা গেলে সমাজে দারিদ্রতা কমবে এবং চিকিৎসা ব্যয়ও কমবে।

দেখা গেছে দেশে এবং বিদেশে যেখানেই গুরুত্বের সঙ্গে এই বেসিক ইনকাম প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে সেখানেই তা ইম্প্রেসিভ রিজাল্ট এনে দিয়েছে।

টরন্টোর ওমেন্স কলেজ হসপিটালের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেনিয়েল মার্টিন বলেন, আমরা যদি এই বেসিক ইনকাম এর ব্যাপারটি ঠিকমত কাজে লাগাতে পারি তবে তা একদিকে যেমন দারিদ্রতা দূরীকরণ সাহায়তা করবে অন্যদিকে কাজের প্রতি মানুষের অনিহাও দূর করবে। আর এটি অলীক কোন ধারণা নয়। এটি বাস্তবিকভাবেই করা সম্ভব। এতে করে আমাদের হেলথ কেয়ার সিস্টেমের ব্যয়ভারও বিপুল ভাবে হ্রাস পাবে।

ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ড্যানিয়েল মারটিন এবং রায়ান মেইলি টরন্টো স্টার পত্রিকায় তাদের একটি প্রবন্ধে এর একটি হিসেব তুলে ধরেন যেখানে দেখানো হয়েছে দেশের নাগরিকদের একটি অংশের দারিদ্রতা অব্যাহত থাকলে ঐ দেশের জাতীয় অর্থনীতির যে পরিমান ক্ষতি সাধিত হয় তার চেয়ে অনেক কম ক্ষতি হয় দারিদ্রতা দূর করার বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিলে। তারা বলেন, বর্তমানে সাচকাচুয়ানে প্রতি বছর ৩.৮ বিলিয়ন ডলার (জিডিপি’র ৫%) ক্ষতি হয় দারিদ্রতা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা ব্যয় ও অন্যান্য সামাজিক ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে। অন্টারিও প্রভিন্সে এই ব্যয় বহুগুণ বেশী। বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার। বেসিক ইনকাম প্রকল্প বাস্তবায়নে এর চেয়ে অনেক কম অর্থ ব্যয় করতে হবে।

ডাক্তারদের দৃষ্টিতে মানুষের স্বাস্থ্য ও আয়ুর উপর সবচেয়ে বড় মাপের দুটি প্রভাব বিস্তারকারী  বিষয় হলো, দারিদ্রতা ও বৈষম্যতা। তাদের মতে দরিদ্র নাগরিকদের আয় বৃদ্ধিই এই সমস্যা সমাধানের প্রধান উপায়।

উল্লেখ্য যে, কানাডায় এই গ্যারান্টিড মিনিমাম ইনকাম এর প্রকল্প আগেও চালু করা হয়েছিল। সেটি করা হয়েছিল ১৯৭০ সালের দিকে। ঐ সময় মেনিটোবার ডাউফিনে প্রকল্পটি চালু করার পর দেখা গিয়েছিল লোকজন কাজ থেকে সরে আসেনি। উপরন্তু দেখা গিয়েছিল হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা ৮.৫% হ্রাস পেয়েছিল। সরকার গৃহীত বিভিন্ন স্যোসাল প্রগ্রাম জনগনকে দরিদ্রতার মধ্যে জিইয়ে রাখার জন্য নয়। কিন্তু এই প্রগ্রামসমূহ তাই করে আসছে। ফলে সময় এসেছে নতুন কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করার। বেসিক ইনকাম গ্যারান্টি সেই ধরণেরই একটি প্রগ্রাম বা প্রকল্প। বেসিক ইনকাম মানুষের আত্মসম্মান বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, মানুষের অর্থনৈতিক অস্থিরতা দূর করে, সেই সাথে দূর করে মানসিক চাপ ও হীনমন্যতা যা নানান রোগবালাইয়ের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত।