জীবনে সাফল্য পেতে হলে প্রথমে স্বপ্ন দেখতে হয়
জুন ১৪, ২০১৬
শহীদ খোন্দকার টুকু একজন স্বপ্নদর্শী। তবে শুধু স্বপ্ন দেখেই তিনি ক্ষান্ত হয়ে যান না। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করতেও ভালবাসেন। স্বপ্ন এবং কাজ এই দুয়ের যথাযথ সম্মিলন ঘটিয়ে কানাডায় আজ তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। স্বপ্নকে দিতে পেরেছেন বাস্তব রূপ। পাশাপাশি তিনি একজন শিল্পীও। সঙ্গীত চর্চা ও নাটকেও ছিল তার পারদর্শীতা। খেলাধূলাও করেছেন দেশে। প্রথম বিভাগে ক্রিকেট খেলতেন ঢাকায়। এক কথায় ভার্সেটাইল জিনিয়াস শহীদ খোন্দকার টুকু।
ছাত্রজীবন থেকেই শহীদ খোন্দকার স্বপ্ন দেখতেন নতুন কিছু করার যা আগে কেউ করেনি। ছাত্রজীবন শেষে চাকরীর সুবাদে তিনি ঘুরেছেন পৃথিবীর অনেক দেশে। তবে তার সেই নতুন কিছু করার স্বপ্নটা বাস্তবতার মুখ দেখেছে কানাডায় আসার পর। তাই তিনি বিশ্বাস করেন কানাডা ইজ এ ল্যান্ড অব অপরচ্যুনিটি। তবে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে হবে এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে।
শহীদ খোন্দকার কানাডায় প্রতিষ্ঠা করছেন KNS Canada Inc. নামের একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে তিনি কানাডায় নিয়ে এসেছেন জটিল কিছু রোগ নির্নয় করার জন্য নতুন নতুন মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট। লিভার সিরোসিস এবং গ্যাস্ট্রোইনটেসটাইন জাতীয় জটিল রোগসমূহ নির্নয় করার জন্য এই ইকুইপমেন্টগুলোর জুরি নেই। কানাডার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে এখন এই ইকুইপমেন্টগুলোর ব্যবহার শুরু হয়েছে। ২০০৪ সালে KNS এর মাধ্যমে শহীদ খোন্দকারই প্রথমবারের মত কানাডায় লিভার ডায়ালিসিস করার জন্য মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট নিয়ে আসেন।
আমরা স্বপ্নদর্শী ও ভার্সেটাইল জিনিয়াস সফল এই ব্যক্তির মুখমুখি হয়েছিলাম সম্প্রতি প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে। আসুন তার নিজের মুখ থেকেই শুনি তার সাফল্যের ইতিহাস।
আমি ফার্মেসীতে মাস্টার্স করি ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে। পরে লন্ডন থেকে এমবিএ করি। যদিও আমার ব্যাকগ্রাউন্ড ফার্মেসীতে কিন্তু আমার ঝোঁকটা ছিল মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টের দিকে। ঢাকায় আমার চাকরী জীবন শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ অক্সিজেন লিঃ এ। সেখানে কয়েক বছর চাকরী করার পর তারা আমাকে ব্রিটেনে পাঠাল ট্রান্সফার করে। পরবর্তীতে আমি বৃটেনে অন্য একটি কোম্পানীতে চাকরী করি। তারা আবার আমাকে পাঠায় সিঙ্গাপুরে। এভাবে চাকরী জীবনের শুরুতেই বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানীতে কাজ করার সুযোগ পাওয়াতে আমার একটা ভাল নেটওয়ার্ক তৈরী হয়ে যায়। আর আমি যে কাজটা করতাম তার প্রতি আমার বরাবরই একটা ফেসিনেশন ছিল।
আমি কানাডায় আসি ২০০১ সালে। আর আমি ইনফ্যাক্ট চাকরী নিয়েই এসেছিলাম এখানে। ফলে শুরুটাও হয়েছিল ভাল। আমি জানতাম কিছুটা যে, এদেশে চাকরীর সমস্যা আছে প্রফেশনাল ইমিগ্রেন্টদের। তবে এদেশে সুযোগও আছে। সুযোগ না থাকলে আমিই বা কি করে এতদূর এগুলাম। যতটুকুই করতে পেরেছি সেটাতো ঐ সুযোগ আছে বলেই করতে পেরেছি। তবে সুযোগটাকে ব্যবহার করতে জানতে হবে। আমার মতে বাঙ্গালীরা অনেক বুদ্ধিমান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজন হলেও এটি সত্যি যে এদেশে এসে অনেকই তেমন কিছু করতে পারেন না। এর অনেকগুরো কারণ রয়েছে। তার মধ্যে ভাষা একটি প্রধান সমস্যা। ইংরেজী ভাষাটা ভাল করে না জানার কারণে অনেককেই দেখা যায় সাফল্য অর্জন করতে ব্যার্থ হন। যে দেশে যাদের সঙ্গে কাজ করবো তাদের ভাষা যদি ভাল করে না জানি তবে সমস্যাতো তৈরী হবেই। এই ভাষা সমস্যার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে আমরা যে প্রত্যাশা নিয়ে এদেশে আসি দেখা যায় সে প্রত্যাশা পূরণ হয় না।
কানাডায় আসার প্রায় নয় মাস পর আমি আরেকটা কোম্পানীতে চাকরীর অফার পেলাম। তখন আমি ঐ নতুন কোম্পানিতে যোগ দেই। তবে সবসময় আমার একটা স্বপ্ন ছিল যে আমি নিজে একটা ব্যবসা দাঁড় করাবো। তবে সেটা হবে নতুন কিছু যা আগে কেউ করেনি। আমি সবসময়ই খুঁজতাম নতুন কি করা যায়। আমি যখন সিঙ্গাপুরে ছিলাম তখন আমার এক জার্মান বন্ধু ছিল। আমরা এক কোম্পানীতেই কাজ করতাম। আমি কানাডায় চলে আসার পর সেও ওখান থেকে চলে আসে তার নিজ দেশে। সেও জানতো আমি কি স্বপ্ন দেখি। একদিন সে জার্মানী থেকে ফোন দিল আমাকে। সে জানালো, সে যে কোম্পানীতে কাজ করে সে কোম্পানী সম্পূর্ণ নতুন একটি মেডিক্যাল ডিভাইস তৈরী করেছে যা আগে কেউ করেনি। ঐ ডিভাইসটি ছিল লিভার ডায়ালিসিসের। আমরা অনেকেই জানি যে কিডনী ডায়ালিসিসের মেশিন আছে। কিন্তু লিভার ডায়ালিসিসের মেশিন আগে কোথাও ছিল না। আমার বন্ধুটি জানালো আমি যদি আগ্রহী হই তবে এই নতুন মেশিনটি নিয়ে কাজ করতে পারি।
তখন আমার খুব ভাল একটি জবও ছিল কানাডায়। এটি ২০০৪ সালের কথা। ভাবলাম জবটির পাশাপাশি এই নতুন মেশিনের বিপননের ব্যবসাটা শুরু করি। কিন্তু পরে ভাবলাম আসলে দুই কাজ এক সাথে করতে গেলে কোনটাই ভালভাবে করা যাবে না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম চাকরীটি ছেড়ে দিব। এ কথা শুনার পর অনেকেই আশ্চর্য হয়েছিলেন। কারণ আমি তখন সিক্স ফিগারের জব করতাম। এত ভাল বেতনের একটি জব ছেড়ে দিব এটি অনেকেই মেনে নিতে পারেন নি। কিন্তু আমি রিস্কটা নিলাম। চাকরী জীবনে যা কিছু সঞ্চয় করেছিলাম তা বিনিয়োগ করলাম নতুন ব্যবসায়। নতুন এ ব্যবসার জন্য হেলথ কানাডা থেকে লাইসেন্স নিতে হয়েছিল। সবমিলিয়ে শুরুতে আমার ইনভেন্টরী ছিল হাফ মিলিয়নের মত। কিন্তু তখনো কোন মেশিন আমি কানাডায় বিক্রি করতে পারিনি। ব্যবসার মাত্র নতুন অবস্থা। আর ঠিক এমন সময়ই ঘটলো একটি বড় ধরণের বিপর্যয়। লিভার ডায়ালিসিসের মেশিন তৈরী করতো যে কোম্পানীটি সেই কোম্পানী দেউয়ালিয়া হয়ে যায়। শুরুতেই এমন একটি ধাক্কা খাব তা কখনো চিন্তাও করিনি। হাফ মিলিয়নের পুঁজি। তার উপর চাকরিটিও ছেড়ে দিয়েছিলাম।
এ অবস্থায় মাথা ঠিক রাখা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমি ভেঙ্গে পরিনি। উপরওয়ালার উপর আমার যথেষ্ট আস্থা আছে। আমি মনে করলাম এটি আমরা জন্য একটি পরীক্ষা। এদেশে আমার কোন আত্মীয় ছিল না। অর্থকড়ি যা ছিল সবই ইনভেস্ট করে ফেলেছি।
এমনি যখন অনিশ্চিত অবস্থা, তখনই একদিন জানতে পারলাম দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ঐ কোম্পানীটি কিনে নিয়েছে আরেকটি কোম্পানী। তারা দেখলো যে এরকম একটি নতুন প্রোডাক্ট বাজারে ভালই ব্যবসা করতে পারবে। পরে তারা আমার সঙ্গেও যোগাযোগ করে এবং দুই বছরের জন্য তাদের কনসালটেন্ট হয়ে কাজ করার অফার দেয় আমাকে। অফারটি ভালই ছিল। আমি পরে তাদের হয়ে কাজ করি। তারা আমার পুরো ইনভেস্টমেন্টটা ফেরত দেয়নি তবে মেশিনগুলোতে যে খরচ হয়েছিল সেটা তারা শেয়ার করে। ফলে আমি অনেটাই রিলিফ পাই এবং এদের সঙ্গে দুই বছর কাজ করি।
এর মধ্যে আমার সেই জার্মান বন্ধুটি আরেকটি কোম্পানীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। সেই কোম্পানীরও কিছু ভাল প্রোডাক্ট তৈরী হচ্ছিল। সে পুনরায় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং নতুন কোম্পানীর প্রোডাক্ট সম্পর্কে আমাকে ব্রিফিং করে। আমি দেখলাম প্রোডাক্টগুলো ভালই। এরপর তাদের সঙ্গে কাজ করতেও রাজী হয়ে গেলাম। এর পর থেকে ওদের সঙ্গেই আছি। আল্লাহর রহমতে এখন ভালই ব্যবসা করছি। মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট সাপ্লাইয়ের কাজ করে এমন বিখ্যাত কোম্পানী যেমন সীম্যান্স ওদের নাম হয়তো শুনেছেন। ওদের যেমন বাজারে রেপুটেশন আছে আমাদেরও তেমন রেপুটেশন আছে। আমাদের কোম্পানী ওদের মত এত বড় নয়। তবে কোয়ালিটি ও রেপুটেশনের দিক থেকে আমরা তাদের সমকক্ষই বলতে পারেন।
আমার এখানে স্টাফদের মধ্যে বেশীরভাগই বাঙ্গালী। অন্যান্য এথনিক ব্যাকগ্রাউন্ডের লোকও আছেন। এরা কেউ ফিজিশিয়ান, কেউ বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কেউ বা ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার। সবাই মোটামুটি হাইলি কোয়ালিফাইড লোক।
আমরা আমাদের কাজের জন্য এওয়ার্ডও পেয়েছি। আমরা Echosens নামের যে
কোম্পানীকে রিপ্রেজেন্ট করি সেই প্রতিষ্ঠানটি গত বছর আমাদেরকে এওয়ার্ড প্রদান করে বেস্ট ডিস্ট্রিবিউটর হিসাবে। সারা বিশ্বে এদের অনেক ডিস্ট্রিবিউটর আছে। তাদের মধ্যে আমরা বেস্ট ডিস্ট্রিবিউটর নির্বাচিত হয়েছিলাম। এটি একটি গর্বের বিষয়।
কানাডায় আমার যে কোম্পানী রয়েছে তার একটি শাখা বাংলাদেশেও রয়েছে। সেখানেও অনেক লোক কাজ করে।
আসলে বলতে আমি পারেন একজন ড্রিমার। আমি স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি এবং সেই স্বপ্ন পুরণের জন্য কাজ করতেও ভালবাসি। ড্রিম ছাড়া কেউ কোন কাজে সফল হতে পারে না। যে কোন বড় কাজ করতে গেলেই প্রথমে ড্রিমার হতে হয়। যেমন আগের দিনে যারা রাজনীতি করতেন তারা প্রত্যেকেই ছিলেন একেকজন ড্রিমার। দেশের জন্য সমাজের জন্য তারা কিছু একটা করার স্বপ্ন নিয়েই রাজনীতিতে এসেছিলেন।
আমি আগেই বলেছি আমি নতুন কিছু করতে চাই। যেটা আগে কেউ করেনি। আমি যে মেশিনগুলো কানাডায় এবং বাংলাদেশে ডিস্ট্রিবিউট করেছি তা সম্পূর্ণ নতুন। আমার আগে ঐ মেশিন অন্য কেউ ডিস্ট্রিবিউট করতে পারেনি। কানাডা একটি উন্নত দেশ। এখানে সবকিছু রেগুলেটেড। মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টেও এর বাইরে নয়। বরং এক্ষেত্রে রেগুলেশনটা আরো বেশী কড়াকড়ি ভাবে আরোপ করা হয়। তো এগুলো মোকাবেলা করে আমাদেরকে এই দেশে ব্যবসা করতে হচ্ছে। আর আমরা যে সকল মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট এখানে আনছি সেগুলোতো পৃথিবীর অন্য কোন দেশে তৈরী হয় না। আর নতুন জিনিষের মার্কেটিং করতে গিলে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। আমাদের প্রায় তিন বছর সময় লেগেছে এই প্রোডাক্টগুলো এখানে বাজারজাত করতে। হেলথ কানাডা দুই বছর পর পর আডিটে আসে। তারা দেখে আমরা ঠিক মত আইন মেনে কাজ করছি কি না। এগুলো মেইনটেনন করে এ দেশে ব্যবসা করা সত্যিই খুব কঠিন কাজ। এর পর আছে ব্রাউন স্কিনের একটি সমস্যা। আমাদের বিজনেজটা বলতে পারেন ৯৫ পার্সেন্টই শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে। শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমাদের মত বাদামী চামড়ার লোকেরা যে সফলভাবে এখানে ব্যবসা করতে পারছি এটি কম কথা নয়। এখানেই শেষ নয়। আরো আছে মুসলিম ব্যাকগ্রাউন্ড। সবমিলিয়ে বেশ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আমাদেরকে কানাডায় ব্যবসা করতে হচ্ছে। এখানে যারা কমিউনিটি বেজড ব্যবসা করেন তাদেরকে এ সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয় না।
২০০৯ সালে বর্তমান ব্যবসাটা শুরু করে এ পর্যন্ত আমরা বেশ ভালই করেছি। এর মধ্যে আরো নতুন কিছু মেশিন বাজারজাত করতে যাচ্ছি কানাডায়।
কানাডার মেইনস্ট্রিমে ব্যবসা করে সাফল্য অর্জন করতে পারার অনুভূতিটা আমি বলবো অবশ্যই চমৎকার। আমি আগেই বলেছি যে আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড, আর্থাৎ আমাদের ব্রাউন স্কিন, আমাদের ধর্মীয় পরিচয় এগুলো নিয়েই আমরা প্রতিযোগিতা করছি অত্যন্ত হাই কোয়ালিটি ও বিশাল আকারের কোম্পানীগুলো সাথে। যেমন সীমেন্সের কথা আগেই বলেছি। তারা এতই বিশাল যে আমার কোম্পানীর মত লাখ দুই কোম্পানীকে তারা যে কোন সময় কিনে নেয়ার ক্ষমতা রাখে। তো এরকম বিশাল কোম্পানীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যাচ্ছি এটা কম কথা নয়।
এদেশে আসলেই সুযোগ আছে। অনেকে বলেন, কানাডা ইজ এ ল্যান্ড অব অপরচ্যুনিটি। কথাটা মিথ্যে নয়। কিন্তু কথা হলো আপনাকে রাইট টাইমে রাইট থিং চুজ করতে হবে এবং সেই মত কাজ করতে হবে। আর কিছুটা রিস্ক নেয়ার সাহসও থাকতে হবে। এগুলো থাকলে আমার মনে হয় এ দেশে অনেক কিছু করার আছে। বিশেষ করে এই টরন্টোতে। আমি বৃটেনে ছিলাম ৬ বছর। সিঙ্গাপুরেও ছিলাম। সিঙ্গাপুরকে তো বলা হয় খুবই হাইলি বিজনেস ওরিয়েন্টেট দেশ। কিন্তু তারপরও আমার কাছে মনে হয়েছে কানাডায় সুযোগটা আরো বেশী।
আর ডেস্টিনেশন হিসাবে কানাডাকে কেন বেছে নিলাম সেই প্রশ্নের জবাবে বলতে পারি – আসলে কানাডার প্রতি আমার একটা ফেসিনেশন ছিল সেই শৈশব থেকেই। ‘কানাডা’ নামটাই আমার কাছে কেন জানি ভাল লাগতো। নামের আগে পিছে কিছু নেই। আর এই দেশটার পতাকাও আমার কাছে খুবই সুন্দর লাগে। তখন থেকেই কানাডার প্রতি আমার ভাললাগা শুরু। তারপর বড় হয়ে জানলাম এ দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে ভাল দেশগুলোর একটি থাকার জন্য। আমি যখন এ দেশটিতে আসি তখন চারদিকে ৯/১১ এর পরবর্তী অস্থির অবস্থা। আমাকে অনেকেই তখন বলেছিলেন কানাডায় না আসতে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ঐ অস্থির সময়টাতে কানাডায় ল্যান্ড করেও আমি ৯/১১ এর কোন উত্তাপ এদেশটিতে টের পাইনি। হয়তো সামান্য কিছু ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু একজন নতুন ইমিগ্রেন্ট হিসাবে তখন আমি কিছুই টের পাইনি। এই দেশটিতে আন্ডারকারেন্ট কিছু থাকলেও আমার দৃষ্টিতে কানাডা অনেক ওপেন এবং একমডেটিভ। এসব কারনেই আমি আসলে কানাডাকে আমার ডেস্টিনেশন হিসাবে বেছে নিয়েছি। তাছাড়া আগেই উল্লেখ করেছি, কানাডা ইজ এ ল্যান্ড অব অপরচ্যুনিটি। থাকার জন্য কানাডাকে বেছে নেয়ার পিছনে সেটাও একটা কারণ ।
আমাদের এক ছেলে। টরন্টো ইউনিভার্সিটিতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ছে থার্ড ইয়ারে। স্ত্রী ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করতেন। তার বিষয় ছিল পরিসংখ্যান। পরে তিনি বৃটেন থেকে এই বিষয়ের উপর পিএইচডি করেছেন। বর্তমানে কোন কিছু করছেন না তিনি। তবে আমার ব্যবসাতে মাঝে মধ্যে সাহায্য করেন।
আমি ঢাকার ছায়ানট থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতে ডিপ্লোমা করেছিলাম। ওয়াহিদুল হকের খুব প্রিয় একজন ছাত্র ছিলাম। আমি গানও শিখাতাম ছায়ানটে যখন আমি থার্ড ইয়ারে পড়ি। গানের বিষয়ে আমার একটা স্বপ্ন ছিল। হয়তো এই লাইনে একটা ক্যারিয়াও গড়তে পারতাম। কিন্তু পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিড়ি ডিঙ্গিয়ে চাকরী জীবনে প্রবেশ করে আর কিছুই করা হয়ে উঠেনি ব্যস্ততার কারণে।
আমি মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীতই গাইতাম। তবে এখন সব ধরনের গানই করি। কিন্তু আমার পছন্দ রবীন্দ্রসঙ্গীতই। বছর দুই আগে টরন্টোতে একটা বড় প্রোগ্রাম করেছি। বাংলাদেশ সেন্টারেও প্রোগ্রাম করেছি। তবে বাইরে খুব একটা প্রোগ্রাম আমার করা হয় না। বাসায় করি প্রায়ই। আর আমি গান করি মূলত ভাল লাগার কারনেই।
গান ছাড়া এক সময় নাটকও করতাম দেশে থাকতে। ঢাকা ড্রামা নামে একটা গ্রুপ ছিল। আমি সেটার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। খেলার বিষয়েও উৎসাহ ছিল। প্রথম বিভাগে ক্রিকেট খেলেছি ঢাকায় থাকতে। উদীতি নামে একটা ক্লাব ছিল। সেখানে খেলেছি। তবে এগুলো উল্লেখ করার মতো কিছু নয়। মূলত গানটাই করতাম বেশী।
টরন্টোতে আমি কমিউনিটি একটিভিটির সঙ্গে কিছুটা জড়িত। সম্প্রতি আমরা একটা সংগঠন করেছি যার নাম হলো ‘ভিশন ইনফিনিট ফাউন্ডেশন’। এর মূল উদ্যোগটা আমারই ছিল। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য হলো কানাডার মেইনস্ট্রিমে কি করে আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মকে ইনভলভ করানো যায়। আমরা চাই তারা এখানকার ইকনমিক, স্যোসাল এন্ড পলিটিক্যাল ফিল্ডে বেশী করে আসুক। বেশী করে সম্পর্কিত হোক। আপনি দেখুন এবারের জাতীয় নির্বাচনে আফগানিস্তান থেকে আসা এক ব্যক্তি এমপি হয়েছেন। পাকিস্তান থেকে আসা ব্যক্তি এমপি হয়েছেন, শ্রীলংকা থেকে এসে এদেশে এমপি হয়েছেন। ভারত থেকে আসা বেশ কয়েকজন এখানে এমপি হয়েছেন। হয়েছেন ডিফেন্স মিনিস্টার পর্যন্ত। কিন্তু কোথাও কোন বাংলাদেশী নেই। এটি কিন্তু আমাদের জন্য একটি আই ওপেনিং এর বিষয়। আমাদের এখন ভাবতে হবে আমরা কেন পিছিয়ে আছি? আমরা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে এখানে মারামারি করি। কিন্তু মেইনস্ট্রিমের ব্যাপারে আমাদের উৎসাহটা নেই। এই সমস্ত চিন্তা-ভাবনা থেকেই আমাদের এই নতুন সংগঠন ভিশন ইনফিনিট ফাউন্ডেশন। আমরা এখন থেকে চেষ্টা করে যাব কি করে মেইনস্ট্রিমে আমাদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো যায়।
কিছু দিন আগে আমরা টরন্টোতে হেলথ নিয়ে একটা সেমিনার করেছি এই সংগঠনের পক্ষ থেকে। প্রচুর সাড়াও পেয়েছি আমরা ঐ সেমিনার করে। এডুকেশন নিয়েও অচিরেই একটি সেমিনার করার পরিকল্পনা রয়েছে। এগুলো আমরা নিয়মিতই করে যাব এখন থেকে যাতে করে মেইনস্ট্রিমে আমাদের সম্পৃক্ততা বাড়ে। আর আমি যা দেখেছি, আসলে বাংলাদেশের মানুষ শুধু যে গানবাজনা নিয়েই থাকতে চান তা কিন্তু নয়। তারা চান মেইনস্ট্রিমে আলাদাভাবে কিছু করতে। কিন্তু সুযোগটা ঠিকমত পাচ্ছেন না কেউ। আমরা সেই সুযোগটাই ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। যদিও আমরা শুরু করেছি খুবই ছোট আকারে। আর সবার সহযোগিতা পেলে আমাদের এই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।