জনকল্যানমূলক কাজে নিবেদিতপ্রাণ এমপিপি আর্থার পট্স

অন্টারিওর সার্ভিস সেক্টরে কর্মরত এমপ্লয়ীদের জন্য বহুল প্রশংশিতটিপিং বিল (Tipping Bill ) পাশ করানোর নেপথ্য পুরুষ তিনি

জুলাই ৯, ২০১৬

খুরশিদ আলম : টরন্টোর বিচেস ইস্ট ইয়র্ক রাইডিং এর এমপিপি আর্থার পট্স। লিবারেল পার্টির এই এমপিপিকে বাঙ্গালীদের অনেক অনুষ্ঠানেই দেখা যায়। গেল বৈশাখী উৎসবেও তিনি এসেছিলেন এবং বাঙ্গালী সেজে বৈশাখী পোষাক পরে। একেতো সুদর্শণ তার উপর পরনে লাল পাঞ্জাবী। পাঞ্জাবীর উপর আবার হলুদ ও সাদা রঙের কারুকার্য। ড্যানফোর্থে অনুষ্ঠিত বৈশাখী উৎসবে সেদনি লাল পাঞ্জাবী পরা অর্থারের সহাস্য উপস্থিতি সকলেরই নজর কেড়েছিল। পাশের এক স্টল থেকে বাঙ্গালীদের প্রিয় মিষ্টান্ন জিলাপী খেতেও তিনি ভুলেন নি সেদিন। ঘুরে ঘুরে ছবি তুলেছেন বৈশাখী সাজে সাজা বাঙ্গালী নারী পুরুষ ও শিশুদের সঙ্গে।

আর্থার পট্স  সময় ও সুযোগ পেলেই যে কথাটি বলতে ভুলেন না তা হলো, জনসংখ্যার দিকে থেকে তার রাইডিং এ ইংলিশ স্পিকিং জনগোষ্ঠির পরেই বাঙ্গালীদের অবস্থান। বিপুল সংখ্যক বাঙ্গালী বাস করেন বিচেস ইস্ট ইয়র্ক এলাকায়।

বাংলাদেশের ৪৬তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে গত ২৩ মার্চ অন্টারিওর পার্লামেন্ট ভবনে বাংলাদেশের গৌরবদীপ্ত লালসবুজ পতাকা উত্তলন করা হয়েছিল। ঐ অনুষ্ঠানেও তিনি বক্তৃতা দিতে গিয়ে এ কথা সবাইকে স্বরণ করিয়ে দেন।

আর্থার পট্স কর্তৃক অন্টারিওর প্রভিন্সিয়াল পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পিছনে বাঙ্গালীদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল সন্দেহ নেই। গত নির্বাচনে অর্থার পট্সসুদীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা এমপিপি মাইকেল প্রু কে মাত্র ৪৩১ ভোটে হারিয়ে জয়ী হন।

কথা হচ্ছিল আর্থার পট্স এর সঙ্গে তার ড্যানফোর্থের অফিসে বসে। তেমন কোন গুরুগম্ভীর আনুষ্ঠানিক আলোচনাও নয়। অফিসে তার মাত্র জনাদুয়েক স্টাফ উপস্থিত ছিলেন। আর কোন ভিড় নেই, নেই কোন তদবীর পার্টি, নেই দলীয় লোকজনের উদ্দেশ্যমূলক আনাগোনা। আমি আর ড. মাহবুব রেজা পূর্ব নির্ধারিত সময়েই এসে উপস্থিত হয়েছিলাম। আগেই কথা ছিল তার একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের জন্য। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে জয়ী হবার পর তিনি গত কয়েক বছরে এলাকার লোকজনের কি কি করেছেন, তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি সে বিষয়েই মূলত কথা হয় তার সঙ্গে।

আর্থার প্রভিন্সিয়াল এমপি নির্বাচিত হন ২০১৪ সালের জুন মাসে। ইতিমধ্যে দুই বছর পার হয়ে গেছে। এই দুই বছরের মধ্যে আর্থার পটের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো ব্যক্তিগত উদ্যোগে

(বাঁ থেকে) এমপিপি আর্থার পট, বাংলাদেশ সেন্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. মাহবুব রেজা ও প্রবাসী কন্ঠের সম্পাদক খুরশিদ আলম

অন্টারিওর সার্ভিস সেক্টরে কর্মরত এমপ্লয়ীদের জন্য টিপিং বিল (Tipping Bill  )পাশ করানো। এই বিলটি পাশ হওয়াতে অন্টারিওতে সার্ভিস সেক্টরে কর্মরত এমপ্লয়ীদের টিপস বা বকশিসে এখন থেকে আর মালিকেরা ভাগ বসাতে পারবেন না বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া। এই বিলটি আইনে পরিনত হওয়ার পর গত ১০ জুন থেকে কার্যকর করা হয়।

এই আইনের কারণে এমপ্লয়ারগণ বকশিস থেকে কোন ডিডাকশনও করতে পারবেন না স্পিলেজ, ব্রেকেজ, লসেস বা ড্যামেজেজ এর কারণ দেখিয়ে। নতুন এই আইন অন্টারিওর এমপ্লয়মেন্ট স্ট্যান্ডার্ডস এক্ট, ২০০০ কে প্রভাবিত করবে। অন্টারিওতে বকশিস প্রদানের রীতি আছে রেস্টুরেন্ট, বার, সেলুন, ক্যাটারিং ফার্ম ও টেক্সি সার্ভিসে।

আর্থার পট্স নির্বাচিত হওয়ার পর অন্টারিও পার্লামেন্টে এই বিলটি তুলেন প্রাইভেট মেম্বারর্স বিল হিসাবে। তার আগে তিনি রেস্টুরেন্ট ও সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিজ এর সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজনের সঙ্গে ব্যাপকভাবে এর ভাল-মন্দ দিক নিয়ে আলোচনা করেন।

নতুন এই আইন বলবৎ হওয়ার পর এমপ্লয়ারগণ এখন টিপস বা বকশিস আটকাতে বা কর্তন করতে পারবেন যদি তারা ঐ অর্থ সংগ্রহ করে তা পুণরায় কিছু বা সব এমপ্লয়ীদের মাঝে বিতরণ করেন যে প্র্যাক্টিসটা আগেও প্রচলিত ছিল টিপস পুলিং নামে। বিশেষ ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি থাকলেও এমপ্লয়ারগণ টিপস বা বকশিস আটকাতে বা কর্তন করতে পারবেন।

নতুন এই আইনটি কার্যকর হওয়াতে তার কি অনুভূতি তা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমি খুবই খুশী যে আমার উত্থাপিত প্রাইভেট মেম্বারর্স বিলটি আইনে পরিনত হয়েছে। আমি মনে করি যখন কেউ একজন বকশিক প্রদান করেন তখন সেটি যৌক্তিকভাবেই যারা সার্ভিস প্রদান করে গ্রাহকদের খুশী করেন তাদের পকেটেই যাওয়া উচিৎ। মালিকের পকেটে নয়। আমি আরো মনে করি নতুন এই আইন অন্টারিওতে যারা অরক্ষিত এমúøয়ী তাদের জন্য খুবই উপকারী হবে।

আর্থার পট্স তার ক্যারিয়ার শুরু করেন লেবার রিলেশনস কনসালটেন্ট হিসাবে। তখন থেকেই তিনি শ্রমিক অধিকার আদায়ের বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেন।

উল্লেখ্য যে, গ্রেটার টরন্টোতে রেস্টুরেন্ট ও টেক্সি সার্ভিসে প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশী কাজ করেন। আর্থার পটের উদ্যোগে কার্যকরী হওয়া এই নুতন আইনে তারাও উপকৃত হবেন।

আলোচনার এক পর্যায়ে উঠে আসে কানাডায় প্রফেশনাল ইমিগ্রেন্টদের প্রফেশনাল জব না পাওয়ার বিষয়টিও। একই সাথে তথাকথিত ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’ এর প্রসঙ্গটিও। আর্থার পট্স বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমিও অবগত। বিভিন্ন কমিউনিটিতে যারা প্রফেশনাল ইমিগ্রেন্ট হিসাবে এদেশে এসেছেন তাদের কাছ থেকেও আমি এই ধরনের অভিযোগ অনুযোগ শুনে আসছি। বিষয়টি অবশ্যই বিশেষভাবে বিবেচনার দাবী রাখে।

আর্থার জানান, খুব শীঘ্রই তিনি প্রফেশনাল ইমিগ্রেন্টদের জন্য একটি জব ফেয়ারের আয়োজন করবেন। আলোচনার এই পর্যায়ে অর্থারকে অবহিত করা হয় যে, কানাডায় বাংলাদেশ থেকে আসা প্রচুর সংখ্যক কৃষি বিজ্ঞানী আছেন যারা নিজ নিজ ফিল্ডে কোন জব পাননি। বলতে গেলে প্রায় কেউই নয়। সিটি অব টরন্টোর পার্ক এন্ড রিক্রিয়েশন বিভাগে জনা কয়েক বাংলাদেশী কাজ করেন কৃষিবিদ হিসাবে। এদের সংখ্যা সব মিলিয়ে দশজনের বেশী হবে না হয়তো। তাও তারা আবার মৌসুমী ওয়ার্কার। অথচ কানাডায় প্রায় হাজার খানেক তা তারো বেশী কৃষিবিদ আছেন যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন।

এই সময় ড. মাহবুব রেজা আর্থার পটের কাছে প্রস্তাব রাখেন কৃষিবিদদের জন্য আলাদাভাবে একটি জব ফেয়ার করার জন্য। আর্থার এই প্রস্তাবে রাজী হন এবং খুব শীঘ্রই এ ব্যপারে একটি উদ্যোগ নিবেন বলে জানান।

উল্লেখ্য যে, ড. মাহবুব রেজা নিজেও একজন কৃষি বিজ্ঞানী। অন্যদিকে জুনের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অন্টারিও’র মিনিস্টার অব এগ্রিকালচার, ফুড এন্ড রুরাল এ্যাফেয়ার্সের পার্লামেন্টারী এসিস্টেন্ট ছিলেন আর্থার পট। ২৪ জুন, ২০১৬ সাল থেকে তিনি যোগ দেন এনভায়রনমেন্ট এন্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ মন্ত্রণালয়ের পার্লামেন্টারী এসিস্টেন্ট হিসাবে।

আলোচনায় আর্থার পট্স আরো জানান দলীয়ভাবে তার সরকার অন্টারিওতে নানান ধরণের জনকল্যানমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যা থেকে স্থানীয় লোকজন নানানভাবে উপকৃত হবেন বলে তিনি মনে করেন।

আর্থার পট্স বলেন, সরকার কর্তৃক গৃহীত ‘অন্টারিও’স ক্লাইমেট চেঞ্জ এ্যাকশন প্লান’ ৮.৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে অন্টারিওর পরিবেশ উন্নয়নে। এর মধ্যে আছে এই প্রভিন্সের জনগনকে অধিকতর এনার্জি এফিসিয়েন্ট হিটিং সিস্টেম ব্যবহারে উৎসাহিত করা, ইলেক্ট্রিক বা হাইব্রিড গাড়ী ক্রয় করতে উৎসাহিত করা, এগ্রিকালচার ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে লো-কার্বন টেকনলজী এডপ্ট করা সহ আরো কিছু উদ্যোগ।

এছাড়াও সরকার অন্টারিও’র বিভিন্ন স্কুল ভবনের উন্নয়নে ১.১ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। প্রধানত সংস্কার ও পুনরাম্ভ করার জন্য এই অর্থ ব্যয় করা হবে। ইতিপূর্বেও এই খাতে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে যার পরিমান ১.৬ বিলিয়ন। সব মিলিয়ে ২.৭ বিলিয়ন ডলারের অর্থ বরাদ্দ দিয়ে স্কুলগুলোর সংস্কারসহ অন্যান্য কাজ করা হবে। এই অর্থ বরাদ্দ অন্টারিওর ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ অর্থ বরাদ্দেরই অংশ যার মোট পরিমান ১৬০ বিলিয়ন। স্কুলসহ অন্টারিওর অন্যান্য অবকাঠামো যেমন হাসপাতাল, রাস্তা, সেতু, ট্রানজিট সিস্টেম ইত্যাদি নির্মান ও সংস্কার কাজে ১২ বছর সময়কালের মধ্যে এই অর্থ ব্যয় করা হবে। আর্থার জানান, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অন্টারিওতে প্রতি বছর লক্ষাধিক ব্যক্তির কর্ম সৃষ্টি হবে।

অন্টারিওর সার্ভিস সেক্টরে কর্মরত এমপ্লয়ীদের জন্য বহুল প্রশংশিত  টিপিং বিল (Tipping Bill  ) পাশ করানো ছাড়া আর্থার পট্স ব্যক্তিগত উদ্যোগে জনস্বার্থে আরেকটি কাজ করছেন যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই উদ্যোগটি হলো, অন্টারিওতে চাইল্ড কেয়ার ওয়েট লিস্ট ফি নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া।

গত ১৭ মে অন্টারিওর এডুকেশন মিনিস্ট্রি একটি রেগুলেটরী পরিবর্তন এর কথা ঘোষণা করে যার মাধ্যমে অফেরৎযোগ্য চাইল্ড কেয়ার ওয়েট লিস্ট ফি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রাখা হয়। এই ঘোষণাটি আসার জন্য আর্থর পট্স গত ৭ মাস ধরে অক্লান্ত প্ররিশ্রম করে আসছেন। এটি বাস্তবায়িত হলে অনেক অন্টারিও ফ্যামিলি বাড়তি কিছু অর্থ ব্যয় থেকে রক্ষা পাবেন।

প্রক্রিয়াটি শুরু হয় ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে যখন বিচেস ইস্ট ইয়র্ক রাইডিং এর দুই বাসিন্দা নাদিন ব্লাম ও ক্যালি ডক্টর বিষয়টি আর্থার পটের নজরে আনেন। পরে কয়েক মাসের নানান আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আর্থার পট্স সংসদে বিষয়টি প্রাইভেট মেম্বার বিল হিসাবে উত্থাপন করেন যার ফলশ্রুতিতে গত গত ১৭ মে অন্টারিওর এডুকেশন মিনিস্ট্রি চাইল্ড কেয়ারের এই অফেরতযোগ্য ফি বিষয়ে একটি রেগুলেটরী পরিবর্তন এর কথা ঘোষণা করে। বিষয়টি নিয়ে এখন শলাপরামর্শ হচ্ছে।

এমপিপি আর্থার পট্স বরাবরই একজন উদ্যোগী মানুষ। পেশাজীবনের  শুরুতেই তিনি লেবার রিলেশনস কনসালটেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন। পরে সেনেকা কলেজে এই বিষয় নিয়ে পড়িয়েছেনও। একসময় টরন্টোর একজন কাউন্সিলর এর এক্সিকিউটিভ এসিস্টেন্ট হিসাবেও কাজ করেছেন। রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন তখন থেকেই।

আর্থার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো থেকে পলিটিক্যাল ফিলশপীর উপর ব্যাচেলর ডিগ্রি নেন। পরে কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন্স এর উপর।

দেখা গেছে অধিকাংশ এমপি বা এমপিপি নিজ নিজ দলের যৌথ উদ্যোগের সঙ্গে কাজ করতে ভালবাসেন বেশী। কিন্তু আর্থর পট্স দলীয় উদ্যোগের পাশাপাশি নিজ উদ্যোগেও জনকল্যানমূলক বিভিন্ন কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন যা তার জনপ্রিয়তাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।