কানাডায় স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণের আইন
॥ খুরশিদ আলম ॥
মার্চ ১৩, ২০১৬
পৃথিবীতে আমরা কেউ নিজের ইচ্ছায় আসি না। আবার কেউ পৃথিবী থেকে নিজের ইচ্ছায় যেতেও চাই না। মায়া-মমতা আর ভালবাসায় এ পৃথিবীতে আমরা এমনভাবে জড়িয়ে পরি যে শত দুঃখ কষ্টের মাঝেও আমরা বেঁচে থাকতে চাই। এই বেঁচে থাকার আকুতি মানুষের চিরন্তন চাওয়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাণ কবিতায় আমরা সেইরকম আকুতিই ফুটে উঠতে দেখি –
“মরিতে চাহিনা আমি আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।”
কিন্তু সেই বেঁচে থাকার আকুতিও জীবনের এক পর্যায় এসে আর থাকে না কারো কারো ক্ষেত্রে। রোগ ব্যাধি বা কোন মানসিক যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে কেউ কেউ জীবনের হাল ছেড়ে দেন। বেঁচে থাকার ইচ্ছা পরিত্যাগ করেন। যেন মরতে পারলেই সকল ব্যাথা-বেদনা, দুঃখ-কষ্ট আর জ্বালা-যন্ত্রণার অবসান হবে। মুক্তি মিলবে সবকিছু থেকে। আর সে কারণেই বুঝি কেউ কেউ বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।
কিন্তু আত্মহত্যা যে মহা পাপ! ইসলাম ধর্মেতো সেরকমই বলা আছে। তাহলে কি কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য মরেও শান্তি নেই!
জগতে মানব জীবনের মতো এত বিচিত্র জীবন বোধ হয় আর কোন প্রাণীর নেই। মানুষের চাওয়া-পাওয়া, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির যে বিস্তর ব্যবধান লক্ষ্য করা যায় সেটি তাদের জীবনকে অনেক বেশী জটিল করে তুলে। মানুষের এই যে মৃত্যু কামনা – সেখানেও জটিলতার অভাব নেই। আর এই জটিলতার কারণে মানুষ ইচ্ছে করলেই মরতে পারে না। কষ্ট নিয়েই তাকে বেঁচে থাকতে হয়। অথবা বলা যায় তাকে ধুকে ধুকে মরতে হয়। এ যেন কোন পাপের শাস্তি।
তবে সেই শাস্তি বা ধুকে ধুকে মরার হাত থেকে অসুস্থ মানুষকে মুক্তি দেয়ার জন্য কানাডায় এখন বেশ তোড়জোড় চলছে। ডাক্তারের সহায়তায় চরমভাবে অসুস্থ কানাডিয়ানরা যাতে স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করে যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে পারেন তারই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
তবে এটিকে সরাসরি আত্মহত্যা না বলে স্বেচ্ছা মৃত্যু বলাই নিরাপদ। যারা আত্মহত্যা করেন তারা সে কাজটি হঠাৎই করে বসেন বা কাউকে না জানিয়ে গোপনে এ কাজটি করেন। কারণ, কাউকে জানিয়ে আত্মহত্যা করতে গেলে পদে পদে বাধা আসবে। প্রয়োজনে তাকে হাত-পা বেধে ঘরে বন্দী করে রাখা হবে। তাও মরতে দেওয়া হবে না।
স্বেচ্ছা মৃত্যুর বিষয়টি ঠিক আত্মহত্যার মত কোন বিষয় নয়। সকলকে জানিয়ে এবং রাষ্ট্রের আইন মেনেই মানুষ স্বেচ্ছা মৃত্যুর পথ বেছে নিতে পারবেন। যারা স্বেচ্ছা মৃত্যুর ব্যাপারে সাহায্য সহযোগিতা করবেন তাদের কারো জেল জরিমানা বা অন্য কোন শাস্তি হবে না।
তবে কানাডায় যে কেউ চাইলেই স্বেচ্ছা মৃত্যুর পথ বেছে নিতে পারবেন না। স্বেচ্ছা মৃত্যুর পথ বেছে নিতে চাইলে তার যথেষ্ট কারণ থাকতে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রিয় আইন মেনে না হয় কেউ স্বেচ্ছা মৃত্যুর পথ বেছে নিলেন কোন ঝুট-ঝামেলা ছাড়াই। কিন্তু ধর্মীয় আইন তো এই স্বেচ্ছা মৃত্যুকে সায় দেয় না। সে ক্ষেত্রে জীবন যন্ত্রণা লাঘবের উপায় কি? ইহ কালের সাময়িক যন্ত্রনা লাঘব করতে গিয়ে শেষে কি পরকালের সীমাহীন যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে? খুব কঠিন প্রশ্ন এটি। কোন সহজ উত্তর নেই। নেই কোন সহজ সমাধানও।
কানাডার সিনেট ও কমন্স কমিটির যৌথ এক রিপোর্টে সম্প্রতি বলা হয়েছে, “কোন মৃত্যুপথযাত্রী কানাডিয়ান রোগী যদি স্বেচ্ছায় আগাম মৃত্যুবরণ করতে চান তবে তার জন্য হাসপাতালের সহায়তা উন্মুক্ত রাখতে হবে। রোগী স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করতে চাইলে লিখিত আবেদন করতে হবে এবং সেই আবেদন পত্রে দুইজন সাক্ষীর প্রয়োজন হবে। আর মৃত্যুর আবেদনপত্রে দুইজন ডাক্তারের অনুমোদন লাগবে। মৃত্যুর প্রক্রিয়াটি হাসপাতালেও সম্পন্ন হতে পারে বা রোগীর বাসস্থানেও সম্পন্ন হতে পারে এবং বেধে দেওয়া একটি নির্ধারিত সময় পার করতে হবে মৃত্যু কার্যকর করার আগে। -সূত্র : টরন্টো স্টার।
ডাক্তারের সহায়তায় স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করতে চাইলে কোন রোগী অগ্রীম অনুমোদন বা সন্মতি দিতে পারবেন যখন তার রোগ দেখে ডাক্তার নিশ্চিত হবেন যে তিনি কর্মদক্ষতা বা সহজাত ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন কিংবা তার অবস্থা নিদারুন যন্ত্রণাদায়ক অথবা তার রোগটি নিরাময়ের অযোগ্য। তবে এই সন্মতি দিতে হবে রোগীর পীড়া বা ব্যাধি সহনাতীত হবার আগে।
আইন মন্ত্রী জডি উইলসন অবশ্য এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি কবে বা কখন সরকার এ বিষয়ে আইন প্রবর্তন করবে। তবে তিনি বলেন, এটি বাস্তবায়িত করতে কিছুটা সময়তো অবশ্যই লাগবে।
সিনেট ও কমন্স কমিটির যৌথ রিপোর্টে যে ফ্রেমওয়ার্ক তৈরী করা হয়েছে স্বেচ্ছা মৃত্যুর ব্যাপারে তা মূলত গতবছর ফেব্রুয়ারীতে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রুলিংয়েরই অনুসরণ। সুপ্রিম কোর্ট ঐ সময় ডাক্তারের সহায়তায় স্বেচ্ছা মৃত্যুর বিরুদ্ধে যে আইন ছিল কানাডায় তা বাতিল করে দিয়ে বলেন, যারা অনিরাময়যোগ্য রোগের কারণে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তারা চাইলে ডাক্তারের সহায়তায় স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করতে পারবেন।
উল্লেখ্য যে, ঐ সময় ব্রিটিশ কলম্বিয়ার এক মহিলা রোগী স্বেচ্ছা মৃত্যুর বিরুদ্ধে কানাডায় যে আইন ছিল তার বিরুদ্ধে অদালতে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।
এতো গেল স্বেচ্ছা মৃত্যুর ব্যাপারে কানাডার আইনী দিকটি। কিন্তু কানাডার সাধারণ মানুষ এই স্বেচ্ছা মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে কি ভাবছেন বা পক্ষে বিপক্ষে তাদের মতামতটি কি? এ বিষয়ে সম্প্রতি পরিচালিত এক জরীপে দেখা গেছে সিংহভাগ কানাডিয়ান স্বেচ্ছা মৃত্যুর পক্ষে।Ipsos পরিচালিত ঐ জরীপে দেখা যায় ডাক্তারের সহায়তায় স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পক্ষে মত দিয়েছেন ৮৫% কানাডিয়ান!
এই যদি হয় জনমত জরীপ তবে কানাডায় এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন করা মোটেও কোন কঠিন কাজ হবে না। কিন্তু কানাডায় সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক খ্রীষ্টান (৬৭%) এবং তাদের ধর্মগুরু যারা তারা এখনো এর বিরোধীতা করে আসছেন। কারণ, খ্রীষ্ট ধর্মে আত্মহত্যা বা স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণকে অনুমোদন দেয় না। ধর্মে বলা আছে হত্যা করা পাপ। নিজেকে হত্যা করা অন্যকে হত্যা করারই মতো। কানাডার ক্যাথলিক বিশপ ডগলাস ক্রশবি বলেন, আত্মহত্যা স্বাস্থ্য সেবার অংশ নয়।
ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা কানাডায় দ্বিতীয় বৃহত্তম (৩.২%)।
সেই ধর্মেও আত্মহত্যাকে মহাপাপ ও অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ইসলামী গবেষক ও লেখক ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান এ বিষয়ে এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, “আত্মহত্যা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে ইসলাম ধর্মে এবং কোরআনে এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ এই বলে যে, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমা লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব; এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯-৩০)।”
প্রবন্ধে ড. খান আরো উল্লেখ করেন, “ইসলামি বিধানে আত্মহত্যা নাজায়েজ; এর প্রতিফল চিরস্থায়ী জাহান্নাম। যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করে, সে শুধু তার নিজের ওপরই জুলুম করে না বরং এতে মা-বাবা, ভাইবোনসহ আত্মীয়-পরিজন সবাই খুব কষ্ট পায় এবং অত্যন্ত বিচলিতবোধ করে। যে পরিস্থিতিতেই হোক না কেন, ইসলামের দৃষ্টিতে এ এক বিরাট অন্যায়।”
হিন্দু ধর্মেও আত্মহত্যাকে অনুমোদন করেনা। হিন্দু ধর্মের দৃষ্টিকোন থেকে আত্মহত্যা অগ্রহণযোগ্য। আত্মহত্যাকে অন্যকে হত্যা করার মতোই পাপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
ইহুদী ধর্মালম্বীদের কেউ আত্মহত্যা করলে সেটাকে ভাল চোখে দেখা হয় না এবং আত্মহত্যাকরীদেরকে কবরস্থানে পৃথকভাবে দাফন করা হয়।
বৌদ্ধ ধর্মেও আত্মহত্যাকে নেতিবাচক কাজ হিসাবেই বিবেচনা করা হয়।
অর্থাৎ কোন ধর্মেই আত্মহত্যাকে অনুমোদন দেয় না। তবে অনিরাময়যোগ্য রোগের কারণে সৃষ্ট জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে কেউ যদি আত্মহত্যা করেন বা ডাক্তারের সাহায্য নিয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পথ বেছে নেন তবে সেক্ষেত্রে ধর্ম কি বলে সে বিষয়ে সুষ্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না সব ধর্মে। আদিযুগে সেরকম কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি বলে হয়তো এ বিষয়ে তেমন কোন ব্যাখ্যা নেই।
আমরা জানি কানাডা একটি মাল্টি কালচারের দেশ এবং একই সঙ্গে মাল্টি রিলিজিয়নেরও দেশ। উপরে আমরা দেখলাম সব ধর্মেই আত্মহত্যাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে একে অত্যন্ত কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরকম পরিস্থিতে রাষ্ট্র যদি বিশেষ কারণে কারো স্বেচ্ছা মৃত্যুকে অনুমোদন দেয় এবং একই সাথে মৃত্যু কার্যকর করার জন্য সহায়তা করে তবে তার বিরুপ প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে?
এখানে বলে রাখা ভাল যে, কানাডার কোন রাষ্ট্র ধর্ম নেই যেমনটি রয়েছে বাংলাদেশের বা পৃথিবীর আরো বেশ কিছু পশ্চাদপদ দেশের। এখানে রাষ্ট্র আর ধর্ম আলাদা। তাছাড়া আমরা আরো দেখেছি ডাক্তারের সহায়তায় স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করাকে কানাডার শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ সমর্থন করেন। ফলে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা সরকার কি সিদ্ধান্ত নিবে সে সম্পর্কে ধর্ম বা ধর্মীয় গুরুদের কোন কিছু করার নেই। তারা বড়জোড় তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারেন।
আরো একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কানাডার প্রায় এক চতুর্থাংশ মানুষ কোন ধর্মে বিশ্বাসী নন। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী দেখা যায় কানাডায় ২৩.৯% লোক স্বীকার করেছেন তারা ঐশ্বরিক কোন ধর্মে বিশ্বাস করেন না। অবশ্য কানাডায় জন্মসূত্রে যারা মুসলমান তাদের মধ্যে এই হার অত্যন্ত সীমিত। এবং ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যাকে মহাপাপ ও অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ফলে খুব সহজেই ধারণা করা যায় যে, কানাডার মুসলমান সম্প্রদায় জাগতিক রোগে শোকে ভুগে যতই যন্ত্রণার শিকার হন না কেন তারা কোন অবস্থাতেই ডাক্তারের সহায়তায় স্বেচছা মৃত্যুর পথে পা বাড়াবেন না।
ডাক্তারের সহায়তায় স্বেচ্ছা মৃত্যুর যে সুযোগ সৃষ্টি করতে যাচেছ কানাডার সরকার সে সুযোগ থেকে অনিরাময় যোগ্য রোগে আক্রান্ত মুসলমানগণ বঞ্চিতই থেকে যাবেন।
উল্লেখ্য যে, কানাডার কুইবেক প্রদেশে ডাক্তারের সহায়তায় এই স্বেচ্ছা মৃত্যুর আইন আরো আগেই কার্যকর করা হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের কয়েকটি দেশেই ডাক্তারের সহায়তায় এই স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ আইন কার্যকর রয়েছে। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে – নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, আয়ারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, কলম্বিয়া, সুইজারল্যান্ড, জার্মানী, জাপান ও আলবেনীয়া। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, ওরেগন, ভারমন্ট, নিউ মেক্সিকো, মনটানা ও কালিফোর্নিয়াতেও এই আইন কার্যকর রয়েছে।
ডাক্তারের সহায়তায় স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণ নিয়ে বর্তমানে যে সকল তর্ক-বিতর্ক বা পক্ষ-বিপক্ষের বাদানুবাদ রয়েছে সেগুলো এরকম : –
পক্ষের যুক্তি
-রোগীর প্রচন্ড মাত্রার ব্যাথা ও ভোগান্তির অবসান ঘটবে।
-রোগী সম্ভ্রমসহকারে মৃত্যুবরণ করতে পারবেন।
-হেলথ কেয়ার এর খরচ কমে আসবে।
-ডাক্তার ও নার্সগণ নিশ্চিত মৃত্যুপথযাত্রীর পিছনে সময় নষ্ট না করে অন্য রোগীর পিছনে প্রয়োজনীয় সময় ব্যয় করতে পারবেন।
-রোগীর আত্মীয়-স্বজনের মানসিক যন্ত্রণা ও পীড়া দীর্ঘায়িত হবে না।
-রোগীর অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হওয়ার আগেই তা রক্ষা করা যাবে অন্য রোগীর সেবায় ব্যবহার করার জন্য (যদি মৃত্যুর আগে তা দান করা হয়ে থাকে।)
-ডাক্তারের সহায়তায় স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণের সুযোগ না থাকলে রোগী নিজে নিজেই হয়তো ভয়ঙ্কর বা নোংরা উপায়ে আত্মহ্যার পথ বেছে নিতে পারেন যা আইনী জটিলতাসহ আরো নানান জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে এবং রোগীর স্বজনদের মধ্যে আতংকেরও সৃষ্টি করতে পারে।
বিপক্ষের যুক্তি
-রোগীকে বাচাঁতে সাহায্য না করে মরতে সাহায্য করাটা ডাক্তারের জন্য বিব্রতকর হতে পারে এবং ডাক্তার হওয়ার সময় তারা রোগীর জীবন বাচাঁনোর যে শপথ নিয়ে থাকেন তার সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক হতে পারে।
-ডাক্তারের সহায়তায় স্বেচছা মৃত্যুর এই প্রক্রিয়ায় মানুষের জীবনের মূল্য হ্রাস পেতে পারে।
-এই প্রক্রিয়া শুরু হলে জটিল নয় বা অনিরাময়যোগ্য রোগে ভুগছেন না এমন রোগীরাও এর প্রতি আকৃষ্ট হতে পারেন।
-ধর্মীয় বাধার কারণে রোগী বা রোগীর পরিবারের সদস্যরা এ পথে পা বাড়াবেন না।
– ডাক্তার বা রোগীর স্বজনরা হয়তো আগেভাগেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না করিয়ে হাল ছেড়ে দিতে পারেন।
-সরকার বা মেডিক্যাল ইন্সুরেন্স কোম্পানীগুলো হয়তো ডাক্তারদের উপর অযৌক্তিক বা অসঙ্গত চাপ সৃষ্টি করতে পারে রোগীর মৃত্যু ত্বরান্বিত করতে।
-মৃত্যুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ডাক্তারদেরকে অনেক বেশী ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হতে পারে।
সূত্র : physician-assisted-suicide.weebly.com
এবার আসা যাক প্রবাসে আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটির কথা। কোন রোগের কারণে কারো জীবন যদি অসহ্য হয়ে উঠে, বাচাঁর আর কোন পথ যদি খোলা না থাকে তবে এখানে বসবাসকারী বাংলাদেশীরা কি ডাক্তারের সহায়তায় স্বেচ্ছামৃত্যুর পথে পা বাড়াবেন? আমার ধারণা ও বিশ্বাস- প্রবাসীরা এ পথে পা বাড়াবেন না। প্রথমেই আসবে ধর্মের বিধিনিষেধের প্রসঙ্গটি। যারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী তারাতো একেবারেই ঐ পথে পা বাড়াবেন না। তাদের বিবেচনায় প্রথম যে বিষয়টি আসবে তা হলো, আত্মহত্যা বা স্বেচ্ছামৃত্যু ইসলামের দৃষ্টিতে মহা পাপ এবং এই পাপের কারণে নরকের আগুনে অনন্তকাল পোড়ার চেয়ে মর্ত্যরে সাময়িক জ্বালা-যন্ত্রণা লক্ষ-কোটি গুণে কম। অন্যান্য ধর্মালম্বী প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যেও কমবেশী এই ভয়ই কাজ করবে কারণ তাদের ধর্মেও আত্মহত্যা বা স্বেচ্ছামৃতুকে সমর্থন করে না।
আমরা জানি, বাংলাদেশীরা এমনিতেই ধর্মভীরু। প্রবাসে এসে তাদের মধ্যে এই ধর্মভীরুতা যেন আরেকটু বেশী মাত্রায় দেখা দেয়। সম্ভবত বিজাতীয় সংস্কৃতির ভয়ে অথবা বয়স বৃদ্ধির কারণেও এমনটি হতে পারে। কৈশর বা যুবক বয়সে মানুষ যতটা ধর্মভীরু হয় তার চেয়ে অনেক বেশী হয় বৃদ্ধ বয়সে এসে। প্রবাসে আমাদের প্রথম প্রজন্মের বেশীরভাগ লোকই ইতিমধ্যে মধ্য বয়স পার করে ফেলেছেন (যারা দশ বা বিশ বছর আগে এসেছেন)। ফলে তাদের মধ্যে ধর্মভীরুতা একটু বেশীই লক্ষ্য করা যায়। আর এই ধর্মভীরু গ্রুপের সদস্যরাই ক্রমে জটিলসব রোগে আক্রান্ত হবার দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছেন। এদের অধিকাংশেরই আছে ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ আরো কিছু বয়সজনিত রোগ। লক্ষ্য করা গেছে বাংলাদেশীদের অধিকাংশই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খুব একটা যত্মবান নন। মহিলাদের ক্ষেত্রে এই অযতেœর হার আরো বেশী। প্রবাসের ব্যস্ত জীবন এর একটি কারণ
হতে পারে। আরেকটি কারণ হতে পারে এখানকার আবহাওয়া। বছরের বেশীরভাগ সময় শীত থাকাতে লোকজনের মধ্যে শারীরিক ক্রিয়া বা কার্যকলাপ সীমিত থাকে। কিন্তু কারণ যেটিই হোক, এই নিষ্ক্রিয়তা ডায়াবেটিস রোগকে নিয়ন্ত্রণহীন করে তুলে যা ক্রমেই শারীরিক জটিলতা বৃদ্ধি করে এবং শরীরের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গগুলোকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয়। আর এর অর্থ হলো- একটি সময় এসে হাজির হবে যখন সত্যি সত্যি প্রবাসীরা কঠিন সিদ্ধান্তের মুখমুখি হবেন। সেদিন কার কি সিদ্ধান্ত হবে সেটা সময়ই বলে দিবে।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কন্ঠ