কানাডায় জঙ্গীবাদ নির্মূল করতে হলে নজর দিতে হবে ব্লাইন্ড স্পটের দিকে
অনেকের মতে, জঙ্গীবাদ নির্মূলের চেষ্টায় ধর্ম ও সামাজিক বিষয়ের উপর অত্যধিক দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হচ্ছে, রাজনীতির বিষয়টি থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত যার ফলে সমস্যার কাঙ্খিত সমাধান হয়ে উঠছে না
জুলাই ৯, ২০১৬
প্রবাসী কন্ঠ ডেস্ক : কানাডায় মুসলমান তরুনদের মধ্যে জঙ্গীবাদের প্রতি ঝোঁক দূরীকরনের যে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে তার মধ্যে একটি ব্লাইন্ড স্পট রয়ে গেছে। এই ব্লাইন্ড স্পটের দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছেন না কেউ। কোন কোন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এমনই অভিমত প্রকাশ করেছেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, কি সেই ব্লাইন্ড স্পট? আর এর দিকে কর্তৃপক্ষ নজরই বা দিচ্ছেন না কেন?
এ বিষয়ে সম্প্রতি কানাডার জাতীয় টিভি চ্যানেল সিবিসি নিউজ সানিফা নাসেরের একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে। প্রবন্ধে লেখিকা সানিফা নাসের কানাডায় হোমগ্রোন টেররিস্ট উত্থানের পিছনে মূল কারণ কি সে বিষয়টির উপর সকলের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করেন। মূল সেই কারণটি হলো রাজনীতি এবং কানাডার পররাষ্ট্র নীতি। কানাডার যারা নীতিনির্ধারক তারা এই বিষয়টিকে এড়িয়ে যাচ্ছেন অথবা বিষয়টি তাদের নজরে আসছে না। এই নজরে না আসার বিষয়টিকেই লেখিকা ব্লাইন্ড স্পট হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
তিনি আরো লিখেন, কানাডায় যে সকল তরুন মুসলমান জঙ্গীবাদের দিকে ঝুঁকছেন তাদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি কাজ করে আসছে। এ অভিমত নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের। এমনই একজন বিশেষজ্ঞ কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা ফিল গুরুস্কি। তিনি হামগ্রোন টেররিস্ট বিষয়েও একজন বিশেষজ্ঞ। প্রায় ১৫ বছর তিনি এই হোমগ্রোন টেররিস্ট ও সহিংস চরমপন্থা বিষয়ের উপর কাজ করেছেন। তার মতে কানাডার পররাষ্ট্র নীতি এই হোমগ্রোন টেররিস্টদের উত্থানের পিছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ফিল গুরুস্কি বলেন, “সরকারের পররাষ্ট্র নীতিতে ত্রুটি রয়েছে এ কথা সরকারকে বলাও কঠিন কাজ। সরকার বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনা। কারণ এতে সরকারকে আত্মসমালোচান করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিষয়টিকে অবজ্ঞাও করা যাবে না।”
ফিল গুরুস্কি’র মতে কানাডায় জঙ্গীবাদ প্রতিহতের জন্য কিছু ভাল পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেমন, ক্যালগারী পুলিশের ReDirect নামের একটি প্রকল্প এবং মন্ট্রিয়লের anti-radicalization centre এর কার্যক্রম। তবে তিনি বলেন, “এই প্রকল্প বা প্রচেষ্টাগুলো মূলত মুসলমান তরুনদের সামাজিক ও মানসিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার জন্য করা হয়েছে। কিন্তু এখানে অধিকতর অস্বস্তিকর যে বিষয়টির প্রতি নজর দেওয়া হয়নি তা হলো, কানাডার পররাষ্ট্র নীতি।”
ফিল গুরুস্কি’র মতে হোমগ্রোন টেররিস্টদেরকে সফল ভাবে দমন করার জন্য কানাডার পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ে একটি স্পষ্ট ও খোলাখুলি আলোচনা দরকার।
ফিল গুরুস্কি বলেন, “হোমগ্রোন টেররিস্টরা মনে করেন কানাডার পররাষ্ট্র নীতি হলো ইসলাম বিরোধী অথবা মুলমানদের হত্যা করার নীতি। তারা তাদের বক্তব্যে এ ধরনের কথাই বলেছেন বিভিন্ন সময়ে। ২০১৪ সালের অক্টোবরে কানাডার হোমগ্রোন টেররিস্ট ও কনভার্টেড মুসলমান মাইকেল জেহাফ বিভিও ঐ একই ধারনা থেকে উদ্ধুব্ধ হয়েই কানাডার পার্লামেন্ট ভবনে হামলা চালিয়েছিল। তার সেল ফোন থেকে যে তথ্য উদ্ধার করা হয় তাতে দেখা যায় সে ঐ হামলা চালিয়েছিল তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার কর্তৃক ইরাকে সৈন্য পাঠানোর প্রতিবাদ হিসাবে এবং আফগানিস্তান ইস্যুতে সরকারের ভূমিকার কারণে। ”
“আমি এবং আমার মত যারা আছেন তারা তাদের মনের অভিপ্রায় প্রকাশ করেন না ”
সানিফা নাসের তার প্রবন্ধ উল্লেখ করেন, টরন্টোতে বাস করেন এমন এক ব্যক্তি সিবিসি নিউজের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একবার বলেন, “৯/১১ এর ঘটনার পর আমি ইরাকে যাওয়ার কথা চিন্তা করেছিলাম মার্কনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য।” সিবিসি ঐ ব্যক্তির নাম প্রকাশ করবে না এই শর্তে সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল। নাম প্রকাশ করলে তাকে জঙ্গী হিসাবে চিহ্নিত করা হতে পারে এই ভয় ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিরিশোর্ধ বয়সী ঐ ব্যক্তি আরো বলেন, আমি ইরাকে যাওয়ার ব্যাপারে ঐকান্তিক ছিলাম। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি এবং ইরাকে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখি।”
ঐ ব্যক্তি আরো বলেন, “আমি এবং আমার মত যারা আছেন তারা তাদের মনের অভিপ্রায় প্রকাশ করি না জঙ্গী হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে। আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই জঙ্গী তথা হোমগ্রোন টেররিস্টদের দমন করার বিষয়ে কিছু করতে চাই তবে সরকারের ভূমিকা নিয়ে কথা বলতে হবে।”
উল্লেখ্য যে, কানাডার ফেডারেল সরকার ইতিমধ্যে জঙ্গীবাদ দমনের জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার গত বাজেটে ৩৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্ধ করেছে এই খাতে। অন্যদিকে গত এপ্রিলে কানাডিয়ান কাউন্সিল অব ইমামস ঘোষণা করে যে তারা আগামী শরৎ ঋতুতে টরন্টোতে দুই থেকে তিনটি ‘ডিরেডিক্যালাইজেশন ক্লিনিক’ খুলবে জঙ্গীবাদ দমনে সহায়তা করার জন্য। কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হামিদ সিøমি বলেন, “এই ক্লিনিক ধর্মীয় পরামর্শ প্রদানসহ সার্বিক পদক্ষেপ নিবে এ ব্যাপারে।” হামিদ সিøমি আরো বলেন, কিছু লোক আছে যারা তাদের কর্মকান্ডকে বৈধতা প্রদান করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেন। এরাই চরমপন্থী। সুতরাং জঙ্গীবাদ দমনের জন্য সমাজের ঐ সকল লোকদের সহায়তা নিতে হবে যারা কমিউনিটিকে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
স্পর্শকাতর বিষয়:
সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা ফিল গুরুস্কি বলেন, ডিরেডিক্যালাইজেশন সেন্টার এর আইডিয়া একেবারে নতুন তা নয়। তবে টরন্টোর ক্ষেত্রে যে বিষয়টি ব্যতিক্রম তা হলো, এই উদ্যোগটা সরকার বা বিচার ব্যবস্থা থেকে না এসে এসেছে মুসলমান সম্প্রদায়ের ভিতর থেকে।
উল্লেখ্য যে, জঙ্গী সন্দেহে বা জঙ্গীবাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন কাউকে গ্রেফতারের পর তাকে কাউন্সিলিং প্রদানের জন্য ইমাম ডাকার উদ্যোগ ইতিপূর্বে সরকার কর্তৃক নিতে দেখা গেছে। যেমন গত জানুয়ারীতে সাদ গায়া নামের এক মুসলমান যুবকের বেলায় এই উদ্যোগ নেয়া হয়। সাদ গায়া টরন্টোর আলোচিত সেই ১৮ যুবকের একজন যারা দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। অ্যারোন ড্রাইভার নামে উইনিপেগের আরেক যুবকের বেলায়ও একই উদ্যোগ নিতে দেখা যায়। সে আইএস এর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে টুইট করেছিল ছদ্মনামে।
তবে টরন্টোতে ইমামদের কর্তৃক ডিরেডিক্যালাইজেশন সেন্টার খোলার উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে পারেননি সিবিসি নিউজের সঙ্গে বেনামীতে কথা বলা সেই মুসলমান ব্যক্তিটি। তিনি বলেন, “ইমামগণ গতানুগতিক ধারাতেই কথা বলে যাবেন। জঙ্গীবাদের পিছনে যে রাজনৈতিক ক্ষোভ বা অসন্তোষ রয়েছে সে বিষয়ে তারা কোন কথা বলবে বলে মনে হয় না। তবে আমি ইমামদের বিষয়ে কোন পরোয়া করি না। আমার সাফ কথা, আমরা যদি জঙ্গীবাদ দমনে আন্তরিকভাবে কিছু করতে চাই তবে আমাদেরকে সরকারের পররাষ্ট্র নীতি নিয়েও কথা বলতে হবে।”
ওয়াটারলু ইউনিভার্সিটির পোস্ট ডক্টরাল ফেলো (রিলিজিয়াস স্টাডি) অমরনাথ অমরাসিক্সম বলেন, “কানাডায় অধিকাংশ ইমাম স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন না রাজনীতি বিষয়ে কথা বলার জন্য। মাত্র কয়েক বছর আগেও দেখা গেছে, কোন ইমাম যদি জিহাদ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বা প্যালেস্টাইন অথবা সিরিয়া প্রসঙ্গে কোন কথা বলেছেন তাহলেই তিনি গোয়েন্দা সংস্থার লোকদের নজরে চলে এসেছেন। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাড়িয়েছে যে ধর্ম প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রাজনীতিকে টানলে বা রাজনীতি সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে ধর্মকে টানলেই সেই ব্যক্তি যেন জঙ্গী কানেকশনের কেউ এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।”
অমরনাথ অমরাসিক্সম বলেন আরো বলেন, “অনেক তরুন মুসলমান আছেন যারা ধর্মীয় নেতাদের কাছে আসেন মৌলিক কিছু প্রশ্ন নিয়ে। তারা এই সকল প্রশ্নের সঠিক উত্তর চান। তাদের এই সকল প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়া প্রয়োজন। আর এর জন্য প্রয়োজন সঠিক ব্যক্তি। তা না হলে উৎসুক এই তরুনেরা অনোয়ার আল আলাকী’র মত জঙ্গীদের পাল্লায় পড়তে পারেন।”
আলাকী এমন এক জঙ্গী যিনি আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং তার অনুসারীদেরকে নির্দেশ দেন কোনরকম ইসলামী আইনের মতামতের অপেক্ষা না করেই আমেরিকানদের হত্যা করতে। আলাকীর জন্ম আমেরিকাতেই। একসময় তিনি সানডিয়াগো এবং ভার্জিনিয়াতে একজন বিশিষ্ট ইমাম হিসাবে পরিচিত ছিলেন।
সহিংসতা ছাড়া মৌখিক প্রতিবাদ:
অমরনাথ অমরাসিক্সম দেশের বাইরে কয়েক ডজন জঙ্গী ও হবু চরমপন্থীর সাক্ষাৎকার নিয়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন তা হলো, এই তরুনেরা সামাজে একটি অর্থবহ পরিবর্তন আনতে চায় এবং আলোচনার টেবিলেও বসতে চায় যখন পররাষ্ট্র নীতি প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে।
অমরনাথ আরো বলেন, “এধরণের কথা বলা খুবই অর্থহীন বা মূর্খতা যে, সিরিয়াতে যখন আড়াই লক্ষ লোক নিহত হন এবং সত্তর লক্ষ মানুষ দেশ ছাড়া হন তখন আপনি আপনার স্থানীয় এমপি’কে একটি চিঠি লিখুন এর প্রতিবাদ করার জন্য।”
অমরনাথ মনে করেন যতক্ষণ পর্যন্ত জঙ্গীবাদকে শুধুমাত্র ধর্মীয় বা মানসিক সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সমস্যা থেকেই যাবে। তিনি মনে করেন মোহমুক্ত তরুনদেরকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভূক্ত করার মধ্যেই সমস্যা সমাধানের মূল পথ নিহিত।