কানাডায় জঙ্গীবাদের সূতিকাগৃহ ইমিগ্রেন্ট কমিউনিটি নয়

মুসলিম বিদ্ধেষী হিসাবে পরিচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের নির্দেশে ২০১৪ সালে গঠিত গবেষণা কমিটির রিপোর্ট

জুন ১৪, ২০১৬

প্রবাসী কন্ঠ ডেস্ক : কানাডায় জঙ্গীবাদের প্রসার ও জঙ্গী হামলার পিছনে ইমিগ্রেন্ট কমিউনিটি বিশেষ করে মুসলিম ইমিগ্রেন্ট কমিউনিটি সূতিকাগার হিসাবে কাজ করছে সাবেক সরকারের এমন ধারণাকে পাল্টে দিল নতুন এক গবেষণা পত্র। গবেষণা পত্রে বলা হয়, কানাডায় জঙ্গীবাদের সূতিকাগার ইমিগ্রেন্ট কমিউনিটি নয়। আর এই গবেষণার কাজটি পরিচালনার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন মুসলিম বিদ্ধেষী হিসাবে পরিচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার ২০১৪ সালে যখন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন এবং ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনের জন্য জোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। গত ৩০ মার্চের ঐ গবেষনা রিপোর্টটি সিবিসি নিউজ প্রকাশ করে ৬ জুন।

উল্লেখ্য যে কানাডায় গত জাতীয় নির্বাচনের আগের মাসগুলোতে সেই সময়ের ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল সরকার ক্রমাগত মুসলিম বিদ্ধেষী প্রচারণা চালিয়ে আসছিল। উপরে উল্লেখিত গবেষণা কাজটির নির্দেশ দানের পিছনেও একই উদ্দেশ্য কাজ করছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে সদ্য প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য কনজারভেটিভ পার্টির অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি।

গত জাতীয় নির্বাচনের আগে অব্যাহত মুসলিম বিরোধী প্রচারণায় অতিষ্ঠ ও ক্ষুব্ধ মুসলিম কমিউনিটি ব্যাপকহারে কনজারভেটিভ পার্টির প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠে। আর সেই বিতৃষ্ণার জবাব তারা দেয় ব্যালট বক্সের মাধ্যমে। পরাজয় ঘটে কনজারভেটিভ পার্টির। বিশ্লেষকদের অভিমত, নির্বাচনে লিবারেল পার্টির নিরঙ্কুশ বিজয়ের পিছনে মুসলিমদের ভোট বিশেষভাবে অবদান রেখেছে।

গবেষণার কাজটি যারা ছিলেন তারা কানাডার চারটি ইমিগ্রেন্ট সম্প্রদায়কে বেছে নিয়েছিলেন তাদের টার্গেট হিসাবে। এই চারটি ইমিগ্রেন্ট সম্প্রদায় হলো আফগানী, সোমালী, সিরিয়ান ও তামিল। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে এই সম্প্রদায়ের লোকেরা বরং কানাডা থেকে জঙ্গীবাদকে নির্মূল করার জন্য সদা প্রস্তুত।

কানাডার বিভিন্ন ফোরামে জঙ্গীবাদ নিয়ে আলোচনার সময় সাধারণভাবে যা লক্ষ্য করা যায় তা হলো, ইঙ্গিতটা থাকে প্রধানত মুসলিম ইমিগ্রেন্টদের প্রতি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই মুসলিম ইমিগ্রেন্টারই কানাডায় জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সবচেয়ে মূল্যবান জনগোষ্ঠি। গবেষণায় এই তথ্যও উঠে এসেছে।

গবেষকগণ আরো দেখতে পান, কানাডার বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা এবং মুসলিম ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে পারষ্পরিক অনাস্থা সৃষ্টির পিছনে মূলত কাজ করেছে কিছু জাতীয় সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল। এর সাথে আছেন একদল বুদ্ধিজীবীও যারা মুসলিম ইমিগ্রেন্টদেরকে বরাবরই কানাডার জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকী হিসাবে চিহ্নিত করে আসছেন। জাতীয় সংবাদপত্র, টিভি ও এই বুদ্ধিজীবীদের অতিকথনের কারণে কানাডায় মুসলিম জনগোষ্ঠির প্রতি সাধারণ মানুষের ব্যাপক সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে এবং একই সাথে বৈষম্যের মনোভাবও তৈরী হয়েছে।

গবেষণা পত্রে বলা হয়েছে, কানাডার নিরাপত্তা এজেন্সী রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এবং কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের উচিৎ স্থানীয় মুসলিম ইমিগ্রেন্টদের সঙ্গে একটি সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। কারণ এই ইমিগ্রেন্ট সম্প্রদায়ের সদস্যরাই অনেক সময় নিরাপত্তা এজেন্সীকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে।

অন্টারিওর কিচেনারে অবস্থিত একটি সিকিউরিটি গভার্নেস গ্রুপ এই গবেষণা কার্যটি পরিচালনা করে পাবলিক সেফটি কানাডা’র হয়ে। এতে ব্যয় হয় ১৮০,০০০ ডলার।

সিবিসি নিউজের খবর থেকে আরো জানা যায়, কানাডার সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের সাবেক বিশ্লেষক ও হোমগ্রোন টেররিস্ট বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ ফিল গুরস্কি গবেষণায় প্রাপ্ত নতুন এই তথ্যকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন নতুন এই তথ্য এথনিক কমিউনিটির মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়কে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। ফিল গুরস্কি বলেন, ইতিপূর্বে মোটামুটি ভাবে একটি ভাল সম্পর্ক ছিল মুসলিম কমিউনিটির সঙ্গে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের শাসনামলের শেষের দিকে কানাডায় মুসলিম বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায় যা আমাদেরকে কিছুটা পিছনের দিকে ঠেলে দেয়।

ফিল গুরস্কি বলেন, হারপার সকারের আমলে ন্যাশলান সিকিউরিটি বিষয়ক একটি ক্রস কালচারাল গোলটেবিল বৈঠকে (এপ্রিল ২০১৫) মুসলিম নেতা হোসেন হামদানীকে অন্তভূক্ত না করাটা ছিল একটি ভুল। কুইবেকের জনৈক ব্লগারের অভিযোগের ভিত্তিতে হামদানীকে ঐ বৈঠকে অংশগ্রহন করতে দেওয়া হয়নি। ঐ ব্লাগারের অভিযোগ ছিল জঙ্গীদের ব্যাপারে হামদানীর সহানুভূতি রয়েছে। অথচ এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন একটি অভিযোগ এবং এই ভিত্তিহীন অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার মুসলিম কমিউনিটির সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে।

উল্লেখ্য যে, হোসেন হামদানী ফিল গুরস্কির কলিগ ছিলেন এবং তারা পরস্পরের বন্ধু। গুরস্কি ২০০১ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। পরে গত বছর চাকরী থেকে অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত কানাডার পাবলিক সেফটি ডিপার্টমেন্টে কর্মরত ছিলেন। তিনি বলেন, কানাডায় মুসলিম জনগোষ্ঠির আস্থা পুণনির্মাণের সময় ফুরিয়ে যায় নি। হারপার সরকারের আমলের শেষ দিকে মুসলিমদের প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে তা ছিল হতাশাজনক। কিন্তু তা সত্বেও এই জনগোষ্ঠি আবারো সরকারের সঙ্গে সুম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়।

টরন্টোর রায়ারসন ইউনিভারসিটির অধ্যাপিকা সারা থম্পসন বলেন, এই জঙ্গীবাদ বিষয়ে আমি যে গবেষণা চালিয়েছি তার সঙ্গে সদ্য প্রকাশিত গবেষনায় প্রাপ্ত তথ্যের হুবহু মিল দেখতে পাচ্ছি। উল্লেখ্য যে, সারা থম্পসন কানাডিয়ান নেটওয়ার্ক ফর রিসার্স অন টেররিজম, সিকিউরিটি এন্ড সোসাইটি সঙ্গে এ বিষয়ে ইতিপূর্বে গবেষণা চালিয়েছিলেন।

উল্লেখ্য যে, অতি সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরীপেও দেখা গেছে কানাডার ৭৯% মুসলিম মনে করেন সন্ত্রাসবাদ দমন করার জন্য কানাডার সরকারী এজেন্সীগুলোর সঙ্গে স্থানীয় মুসলিমদের সহযোগিতা করা উচিৎ।

কানাডার ব্যাপক সংখ্যক মুসলমান মনে করেন দেশটির সঙ্গে তাদের শক্তিশালী সংযুক্তি রয়েছে। নিজেদেরকে তারা একাট্রা মনে করেন কানাডার সঙ্গে। গত ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে শুরু করে এবছর জানুয়ারী পর্যন্ত ৬০০ মুসলমান কানাডিয়ানের উপর পরিচালিত এক জরীপ থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। জরীপটি চালিয়েছে এনভাইরনিকস ইন্সিটিউট নামের একটি সংস্থা। জরীপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৯৪% জানিয়েছেন কানাডার প্রতি তাদের একাত্মতার অনুভূতি খুবই অথবা মোটের উপর শক্তিশালী। ৫৮% জানিয়েছেন কানাডার প্রতি তাদের একাত্মতার অনুভূতি গত ৫ বছরে আরো শক্তিশালী হয়েছে।

উপরের তথ্য থেকে যে বিষয়টি সুষ্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো, কানাডায় বসবাসরত মুসলিম জনগোষ্ঠি নিজেদেরকে কানাডা থেকে বিচ্ছিন্ন কেউ মনে করেন না। কিন্তু কনজারভেটিভ পার্টি তাদের রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে মুসলিমদের সম্পর্কে এটি জুজুর ভয় তৈরী করে আসছিল অনেক অগে থেকেই। আর সে কারণেই দেখা গেছে গত তিন বছরে কানাডায় মুসিলম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে দুই গুন। এ তথ্য পুলিশের।

হাফিংটন পোস্টের এক খবরে জানা যায় গত ২০১৪ সালে কানাডায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে মোট ৯৯ টি বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা নথিবদ্ধ করা হয়েছে পুলিশের খাতায়। ২০১২ সালে এরকম ঘটনা ঘটে ৪৫ টি। ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিম এর কমিউনিকেশন  ডিরেক্টর আমীরা এলফাবাবী হাফিংটন পোস্টকে বলেন, কানাডায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী এই বৃদ্ধির হার দ্বিগুন। কিন্তু আমাদের ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিম এর হিসাব অনুযায়ী এই বৃদ্ধির হার তিনগুণ। তিনি বলেন, বহুল আলোচিত জঙ্গী হামলাসমূহ এবং এর পাশাপাশি জঙ্গী সংগঠনগুলো কর্তৃক বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তি এই বিদ্বেষ ছড়ানোর পিছনে হয়তো আংশিকভাবে কাজ করছে।

উপরে উল্লেখিত এনভাইরনিকস ইনস্টিটিউস এর জরীপটি মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার পর স্থানীয় মুসলিমদের নিয়ে কানাডার মূলধারাতে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল। এবার পাবলিক সেফটি কানাডা’র পক্ষে তৈরী নতুন যে গবেষণা পত্রটি প্রকাশিত হয়েছে সেটি নিয়েও আলোচনার সূত্রপাত হবে সন্দেহ নেই। মূলত মুসলমানদের নিয়ে এতদিন কানাডায় যে নেতিবাচক মনোভাব ছিল বা এখনো আছে সেটি নিয়ে এখন অনেকেই নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। কারণ, দেখা যাচ্ছে কানাডায় বসবাসরত মুসলিম জনগোষ্ঠির চিন্তা ভাবনা কম-বেশী অন্যসব কানাডিয়ানদেরই মত। কানাডিয়ান মুসলিমরা কানাডাকে যথেষ্ট সম্মান করেন। তারা নিজেদেরকে কানাডার অংশই মনে করেন এবং নিজেদেরকে কানাডিয়ান ভেবে বেশ গর্বও বোধ করেন। বরং অন্যান্য কানাডিয়ানের চেয়ে মুসলমান কানাডিয়ানদের এই গর্ববোধ আরো বেশী। বিষয়টি সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার ও তার কনজারভেটিভ পার্টি অনুধাবন করতে পারেনি।