কানাডার রাজনীতি রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে ইমিগ্রেন্টদের প্রভাবে
জুলাই ৯, ২০১৬
ভিক্টর চোই
সম্প্রতি আমি জাস্টিন ট্রুডোর লিবারেল সরকারের কার্যক্রম নিয়ে একটি পর্যালোচনা করছিলাম। ঠিক ঐ সময়ই আমার মনে পড়ে গেল বহু বছর আগের একটি বক্তৃতার কথা। বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগে একজন অতিথি অধ্যাপক যিনি একসময় উচ্চ মর্যাদার কেবিনেট মন্ত্রীও ছিলেন কানাডায়। তিনি বলেছিলেন, “আমি যখন মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলাম তখন কেবিনেট মিটিং এ দিনের যে কোন ইস্যু নিয়ে কথা ও পর্যালোচনার পর প্রধানমন্ত্রীর প্রায় প্রতিদিনকার প্রশ্ন ছিল যে, আলোচিত ইস্যুটি কুইবেক প্রভিন্সকে কিভাবে প্রভাবিত করবে?
এই প্রশ্নটি বস্তুত দীর্ঘ সময় ধরে বজায় ছিল কানাডার ফেডারেল রাজনীতিতে। ফেডারেল কনজারভেটিভ পার্টি এবং লিবারেল পার্টি বরাবরই চেষ্টা করতো কুইবেককে কি ভাবে শান্ত ও খুশী রাখা যায় যাতে করে মেজরিটি ভোট পেয়ে ক্ষমতায় থাকার পথ পরিষ্কার থাকে।
তবে সেই দিন এখন আর নেই। পরিস্থিতি বদলেছে। অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও মিডিয়া ব্যক্তত্বদের এরকমই অভিমত। পরিস্থিতি দেখে-শুনে মনে হচ্ছে এখন নতুন এক ‘কুইবেক’ জন্ম নিয়েছে। কানাডার মাল্টিকালচারাল কমিউনিটি বা ইমিগ্রেন্টরা সেই নতুন কুইবেক যারা এখন কানাডার রাজনীতিকে দারুণভাবে প্রভাবান্বিত করছে। আমি এর সঙ্গে যোগ করতে চাই যে, আমরা রাজনীতির নতুন এক যুগে প্রবেশ করছি এবং সেখানে মাল্টিকালচারাল কমিউনিটি নতুন এক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাদের শক্তির অবস্থান এখন আগের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশী। ফলে কানাডার সব রাজনৈতিক দলই এখন এই মাল্টিকালচারাল কমিউিনিটিকে খাতির করার চেষ্টা করছে।
স্ট্যাটিসটিক্স কানাডার হিসাব অনুযায়ী দেখা যায় বর্তমানে কানাডার জনসংখ্যার শতকরা ২০ ভাগের জন্ম কানাডার বাইরে। অর্থাৎ প্রতি ৫ জনের ১ জন কানাডায় এসেছেন ইমিগ্রেন্ট বা উদ্বাস্তু হয়ে। আবার টরন্টোতে দেখা গেছে বিদেশে জন্মগ্রহণকারীদের সংখ্যা শতকরা ৫০ ভাগ। প্রতিবছর কানাডার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ১.২% এবং এর প্রধান কারণ এই ইমিগ্রেন্টদের আগমন। কানাডায় আমরা বছরে আড়াই লাখেরও বেশী ইমিগ্রেন্টকে স্বাগত জানাই। এই ধারা চলতে থাকলে আগামী ২০৩০ সালে কানাডার মোট জনসংখ্যার ৩০% হবে বিদেশে জন্মগ্রহণকারী। আর এই মাল্টিকালচারাল কমিউনিটির যে প্রবণতা তা হলো তারা প্রধানত মেট্রোপলিটান সিটিতে বসবাস করতে চায় বা করে আসছে। এ কারণেই টরন্টো, মন্ট্রিয়ল ও ভেঙ্কুভারে এদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং এই সকল অঞ্চলে রাইডিং বা আসনের সংখ্যাও বেশী। এই সকল এলাকায় মাল্টিকালচারাল কমিউনিটির লোকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে রাজনীতির পাওয়ার অব ব্যালেন্সে তারা একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাড়িয়েছে। আগামীতে কানাডার জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতিতে এই মাল্টিকালচারাল ইমিগ্রেন্টদের প্রভাব প্রতিপত্তি আরো বৃদ্ধি পাবে সন্দেহ নেই যা অব্যাহত থাকবে আগামী শতাব্দীতেও।
কানাডার পররাষ্ট্র নীতির কথাই বলা যাক। বর্তমান লিবারেল সরকার ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনস্থাপনের কথাও ভাবছে। এর কারণ? কানাডায় ইরানী বংশোদ্ভূত ইমিগ্রেন্টদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেই সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে ভোটারের সংখ্যা। কানাডায় অবস্থানকারী চাইনীজদেরকেও বিচ্ছিন্ন বা শত্রুভাবাপন্ন করে তুলতে চায় না কানাডা। কারণ কানাডার যে কোন রাজনৈতিক দলের জন্যই এই কমিউনিটি একটি বিশাল ভোট ব্যাংক। এ কারণে কানাডা পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার বিরুদ্ধে কোন সমালোচনা না করার পলিসি নিয়েছে। সম্প্রতি চিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এক কানাডীয় সাংবাদিকের সঙ্গে কঠোর ভর্ৎসনার সুরে কথা বলার পরেও কানাডা তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় নি।
প্রধান মন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর ফেসবুকে প্রদত্ত বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষন করলেও দেখা যাবে এই ইমিগ্রেন্ট কমিউনিটিকে নানাভাবে খুশি বা তুষ্ট করার একটা প্রচেষ্টা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার ফেসবুকে প্রায় ৬০টি ভিডিও প্রকাশ করেছেন যার ১৩% হলো ইমিগ্রেন্ট কমিউনিটিকে নিয়ে। ঐ ভিডিওগুলো পর্যবেক্ষন করলে দেখা যায় সেখানে এংলোফোন বা ফ্রাঙ্গোফোনদের ঐতিহ্য উদযাপন নিয়ে কোন ভিডিও নেই। যা আছে তা হলো মুসলমানদের রমজান নিয়ে ভিডিও, ইহুদীদের হনুকা নিয়ে ভিডিও ইত্যাদি।
লিবারেল পার্টির প্রচার কার্যক্রমের দিকে নজর দিলেও বিষয়টি কিছুটা অনুধাবন করা যেতে পারে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রায় প্রতি সপ্তাহে বা সপ্তাহান্তে কয়েক ডজন লিবারেল এমপি বিভিন্ন মাল্টিকালচারাল অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন, বক্তৃতা দেন, বিবৃতি দেন এবং সেগুলো প্রচারের ব্যবস্থা নেন।
এভাবেই আমরা দেখতে পাচ্ছি ইমিগ্রেন্টদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে কানাডার রাজনীতি রূপান্তরিত হচ্ছে। তবে পুরোপুরি রূপান্তরিত হয়নি এখনো। হয়তো এটি হতে আরো কিছু সময় লাগবে। তবে দ্রুতই তা হবে। আমার বিশ্বাস অদূর ভবিষ্যতে মাল্টিকালচারাল কমিউনিটির সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব আরো বেশী হবে এবং তখন যে পার্টিই ক্ষমতায় থাকুক এই মাল্টিকালচারাল কমিউনিটিকে গুরুত্ব দিতে হবে কারণ তারা তখন সরকারী নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবে। কুইবেকের প্রভাব যেমন বিশ শতকে কানাডার রাজনীতিকে প্রভাবান্বিত করেছিল তেমনি মাল্টিকালচারাল কমিউনিটি প্রভাবান্বিত করবে কানাডার একুশ শতকের রাজনীতিকে।
ভিক্টর চোই কানাডার প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা।
সৌজন্যে : হাফিংটন পোস্ট