অন্টারিও প্রদেশে প্রথম নির্বাচিত নারী প্রিমিয়ার ক্যাথিলিন
জুলাই ২৭, ২০১৪
মোয়াজ্জেম খান মনসুর
গত ১২ জুন ২০১৪ অন্টারিওতে প্রভিন্সিয়াল ইলেকশন হয়ে গেল। ইলেকশনকে ঘিরে মিটিং মিছিল বোমা ককটেল ফাটানো হত্যা বা জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন ছিল না। রাস্তায় বাড়ি ঘরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রার্থীদের কোন পোষ্টার ছিলনা। নির্বাচনী প্রচার উপলক্ষে রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাইকিং করে ভোট চাওয়া কিংবা উচ্চস্বরে গানের উপদ্রুপে নাগরিকদের বিরক্ত করা হয়নি। বাংলাদেশের মত নির্বাচনী উৎসব উৎসব আমেজ এখানে ছিলনা। আসলে এখানকার নির্বাচন এভাবেই হয়। এদেশে যখন নির্বাচন হয়, যখন নির্বাচনী প্রস্তুতি চলতে থাকে তখন বাইরে থেকে খুব একটা বুঝা যায় না। নির্বাচনি প্রচারণা আলাপ আলোচনা জরীপের মাত্রা উঠা নামা সবই থাকে মিডিয়া ভিত্তিক। শুধুমাত্র টিভি রেডিও পত্রপত্রিকা বা ইন্টারনেটে নির্বাচনী ঝরের আভাস পাওয়া যায়। নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে রেডিও টিভি এবং পত্রিকা বিজ্ঞাপন সহ আর রাস্তার পাশে কিছু পোষ্টার দেখা যায়। এভাবেই পৃথিবীর এই প্রান্তে গণতান্ত্রিক কানাডাতে নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়।
এবছর মাইনরিটি লিবারেল দলের বাজেট পাশ করানো সম্ভব হয়নি। কারণ, এনডিপি দলের নেত্রী এনড্রিয়া হাওয়ার্থ এই বাজেট পাশে সম্মতি দেননি। ফলে লিবারেল সরকার ধরাশায়ী হয়ে যায়। লিবারেল প্রিমিয়ার ক্যাথলিন উইনী ৪০ দিন হাতে নিয়ে নির্বাচনের দিন ঘোষনা করেন ১২ জুন। গত অক্টোবর ২০১২ সালে অন্টারিও প্রিমিয়ার লিবারেল দলের ডল্টন ম্যাগগুইন্টি হঠাৎ করে রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার পর দলের নির্বাচনে ক্যাথলিন উইনীকে দলের নেত্রী নির্বাচন করে। মাত্র ১৬ মাস প্রিমিয়ারের দায়িত্ব পালনের পর এনডিপির অনাস্থা ভোটের কারণে ৯০ মিলিয়ন ডলার খরচের নির্বাচন ঘোষণা দিতে বাধ্য হন ক্যাথলিন উইনী। গত বাজেটে এনডিপি সাপোর্ট করলেও এবার বন্ধুত্বের হাত সরিয়ে নেন নেত্রী হাওয়ার্ড। এনডিপির বক্তব্য ছিল লিবারেল সরকার আগের কোন ওয়াদাই পুরণ করতে পারেনি। কিন্তু এবার বাজেটে আরো নতুন নুতন অঙ্গিকার করে দলটি। এই মিথ্যা ভাওতাবাজী প্রলোভনের সঙ্গে তার দল নেই। ফলে অন্টারিওবাসীদের আবার ভোটকেন্দ্রে যেতে হলো। অন্টারিও সরকার গঠনের দল খুঁজতে।
ভাগ্য বলে একটা কথা আছে না ? এবারে ইলেকশনে ক্যাথলিন উইনীর উপর ভাগ্যলক্ষির প্রসন্ন দৃষ্টি পড়েছিল। একথা খুব জোর গলায়ই বলা যায়। তা না হলে, নরবরে কমজোরী লিবারেল মাইনরিটি দলকে হাওয়ার্ড এক আচমকা আক্রমনে যে ভাবে আগাম নির্বাচনী যুদ্ধে নিয়ে এলো তার জন্য ক্যাথলিনের খুব বেশী প্রস্তুতি ছিল না। তার উপর ছিল সাবেক প্রিমিয়ার ডলটন ম্যাগগুইন্টির রেখে যাওয়া পাওয়ার প্লান্ট স্ক্যান্ডল। ম্যাগগুইন্টি পার্লামেন্টে দাড়িয়ে বলেছিল পাওয়ার প্লান্ট করতে সর্বমোট ৪০ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে। অথচ পরে দেখা গেল খরচ হলো বিলিয়ন ডলার শুধুমাত্র প্লান্ট কেন্সেল করার জন্য। এবং এই প্লান্ট সংক্রান্ত নথিপত্র ইমেইল সব গায়েব করা হলো। এতবড় স্ক্যান্ডেল মাথায় নিয়ে যখন তিন দলের নেতাদের টিভি বিতর্কে প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ দলের নেতা টিম হুডাকের আক্রমনের বিপর্যস্ত ছিলেন ক্যাথলিন। ক্যাথলিন তার দলের এই ঘটনার জন্য বার বার ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এবং এর সুষ্ঠু ইনভেস্টিগেশন করবেন বলে ওয়াদা করেন। নির্বাচন পূর্বে তিন নেতার টিভি বিতর্কে কনজারভেটিভ দলের ও এনডিপির যৌথ আক্রমনে লিবারেল প্রিমিয়ার ক্যাথলিন সম্পূর্ণ বিধস্ত হয়ে পড়েন। এই বিতর্কে টিম হুডাক জয়ী হন। সেটা জরীপে দেখানো হয়েছিল। নির্বাচন যতই এগুচ্ছিল আর নির্বাচনী জরীপগুলোতে দলগুলোর জনপ্রিয়তার টেম্পারেচার ততই উঠা নামা করছিল। প্রথম দিকে ধারণা করা হচ্ছিল লিবারেল আরেকটি মাইনরিটি সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। কিন্তু ১০ জুন সর্বশেষ দুই এজেন্সির জরীপে দেখানো হলো যে, একটিতে জনপ্রিয়তার শতাংশ সমান সামন, লিবারেল ৩৪ এবং কনজারভেটিভ ৩৪, এনডিপি ২১। ঠিক আরেকটি জরীপে দেখানো হলো, টিম হুডাক ৩৫ শাতাংশ। অর্থাৎ একশতাংশ এগিয়ে রয়েছে। ১২ জুন সন্ধ্যা, আমি আর আমার গিন্নি সন্ধ্যা আটটার দিকে তৈরী হলাম ভোট দিতে যাব বলে। উপর থেকে আমার ষোড়ষী কন্যা সারলিন এসে বললো, ড্যাডী নো ভোট ফর হুাডাক, কারণ জানতে চাইলে বললো, হুডাক প্রিমিয়ার হলে টিচার কাট করবে এবং স্কুলের একস্ট্রা কারিকুলাম বাদ পরবে। সো, ভোট এনিওয়ান বাট হুডাক। বাড়ির পাশে কমিউনিটি সেন্টারে ভোট কেন্দ্র। এক মিনিটের মধ্যেই ভোট কেন্দ্রে এসে তিন মিনিটে ভোট দেয়া শেষ। এবার সাপ্তাহিক বাজার সেরে ঘরে ফেরার পথে গাড়ির রেডিওতে ভোটের ফলাফল শুনছি। রাত সোয়া নয়টার দিকে লিবারেল দল এগিয়ে রয়েছে। রাত সাড়ে দশটায় সিটিভি ‘লিবারেল মেজরিটি’ ঘোষনা দেয়। লিবারেল ৫৯, কনজারভেটিভ ২৭ আর এনডিটি ২১ সিট। ক্যাথলিন উইনির হাসি আর দেখে কে। সম্পুর্ন অপ্রত্যাশিত এ বিজয় লিবারেলের। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো যে, এবার পিসি আর এনডিপি দুই দল মিলে পেল ৪৮ সিট। যেটা গতবার সিট সংখ্যা ছিল লিবারেল দলের। বরং এবার হুডাকের ১০ সিটও খেয়ে ফেললো ক্যাথলিন। গতবার পিসির ছিল ৩৭ সিট, এবার ্এটা নেমে এলো ২৭ সিটে। এনডিপির হাওয়ার্ড যে আশা করে নির্বাচন যুদ্ধে নেমেছিল সে আশা তার পুরণ হয়নি। তার দলকে আগের বারের মতন ২১টি সিট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। সর্বমোট ১০৭ সিটের ৫৯ সিটই দখল করে নিল ক্যাথলিন উইনি।
এবারের ইলেকশন বিসেচ ইস্ট ইয়র্ক রাইডিং টা ছিল বিশেষ উলেলখযোগ্য। এ রাইডিং এ এমপিপি মাইকেল প্রু পরপর চার বার জয়ী হবার পর এবার ৪৩১ ভোটে লিবারেল প্রতিদ্বন্দ্বি আর্থার পটস এর কাছে পরাজিত হন। মাইকেল প্রু ইস্ট ইয়র্কের মেয়র ছিলেন যখন টরন্টো ম্যাগাসিটিতে পরিনত হয়নি। গত ৪০ বছর ধরে এই রাইডিং ছিল এনডিপির কব্জায়। এবারের ক্যাথলিনের লিবারেল ঝড়ে আনারী লিবারেল আর্থার পটস এর হাতে এই দুর্গ বিধ্বস্ত হয়। এই রাইডিং এ ভোটার সংখ্যা ৭৩৫৯৬। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই রাইডিং এ কয়েক হাজার বাঙ্গালীর বসবাস রয়েছে। এবার ফেডারেল নির্বাচনে এমপি পদপ্রার্থী (লিবারেল দল) কয়েকজন বাঙ্গালী দৌড়ঝাপ চেষ্টা তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন । ধারনা করি কোন বাঙ্গালী যদি এই রাইডিং থেকে লিবারেল প্রার্থী হতে পারতেন তা হলে এ লিবারেল ঝড়ে একটা ছক্কা মারা যেত খুব সহজেই। এর প্রধান কারণ, বাঙ্গালী সহ এথনিক ভোটাররা লিবারেল এর ট্রাম কার্ড। বাঙ্গালীরা হয়তো পেয়ে যেত একজন এমপিপি প্রভিন্সিয়াল ক্যাবিনেট কুইন্স পার্কে।
রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অন্টারিও প্রভিন্সের গুরুত্ব অনেক। কানাডার দশটি প্রভিন্স এবং তিনটি টেরিটরির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশের বাস অন্টারিওতে। বর্তমান লোকসংখ্যা ১ কোটি ৩০ লক্ষ। আয়তন ৪ লক্ষ ১৫ হাজার ৫৯৮ বর্গমাইল। আয়তনের দিক থেকে কুইবেক প্রথম আর ওন্টারিও দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রভিন্স। জিডিপি ৬৫৫ বিলিয়ন ডলার। ফেডারেল নির্বাচনে ৩০৩ জন এমপির মধ্যে ১০৬ জন এমপি এই প্রভিন্স থেকে নির্বাচিত হয়। এবং কুইবেক থেকে নির্বাচিত হয় ৭৫ জন এমপি। রাজনীতির বিশ্বপট বদলে দিতে পারে এই প্রভিন্স। ইমিগ্রেন্টদের একটা বিরাট অংশ এই প্রভিন্সে বসবাসের ফলে এই প্রভিন্স লিবারেলের দুর্গ বলে পরিচিত। যদিও গত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হারপার (কনজারভেটিভ) এই প্রভিন্সে ধ্বস নামিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। এবার ক্যাথলিন উইনির নির্বাচনী এজেন্ডায় ছিল পেনশন প্লান, শিক্ষাখাত এবং ট্রান্সপোর্টেশনে বিনিয়োগ। এনডিপির হওয়ার্ড এর মেইন এজেন্ডা ছিল হাইড্রো ও গারির ইন্সুরেন্স কমানো। আর পিসি দলনেতা হুডাকের এজেন্ডা ছিল পাবলিক সেক্টরের একশ হাজার জব কাট এবং নতুন এক মিলিয়ন চাকরী সৃষ্টি। হুডাকের জব কাট ও জব ক্রিয়েশন ফরমূলা অংকের হিসেবে মিলেনি। এই এজেন্ডা এবং ভুল অংকের কারণে তাকে
পুরনো দশটি সিট ভূর্তকী দিতে হলো।
ক্যাথলিন উইনের এজেন্ডা প্লান ইউনিয়ন কানেকশন এবং তার সততা ও স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড কথার জন্য অন্টারিওরানরা তাকে এবার প্রিমিয়ার নির্বাচিত করেছে। সম্ভবত অন্টারিওরানরা আরেকবার মাইক হ্যারিস (পিসি) অথবা বব রে‘র (এনডিপি‘র) যুগে ফিরে যেতে চায়নি। ফলে ক্যাথলিন উইনি তার লাল ঘোড়া দাব্রিয়ে কুইন্স পার্কে নিয়ে যাবে তার মেজরিটি সরকার। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আগামী ৪ বছর ক্যাথলিন উইনের বাকি চমকের জন্য। হাওয়ার্থের ভাষায় করাপ্ট লিবারেল এবং বিলিয়ন ডলার পাওয়ার প্লান্ট স্কান্ডেলের কথা জেনে শুনেই অন্টারিওরানরা তাকে বিশ্বস্ত মনে করে এবার মেজরিিিট সরকার উপহার েিদয়েছে। আমরা আশা রাখি ক্যাথলিন উইনী তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা মেধা মনন ও প্রজ্ঞার সমন্বয় ঘটিয়ে ১৩০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের ১৫.২ বিলিয়ন ঘাটতির ঘর শূন্যে এনে একটা সাফল্যের ইতিহাস সৃষ্টি করবেন। এখানে আরেকটি কথা না বললেই নয় যে ক্যাথলিন উইন অন্টারিওর প্রথম নির্বাচিত নারী প্রিমিয়ার, শুধু এখানেই শেষ নয়, ক্যাথলিন উইনী একজন ওপেনলি ডিক্লার্ড লেজবিয়ান প্রিমিয়ার। বর্তমান পৃথিবীর বহু দেশে ধর্মীয় আইন শাসন অনুশাসন এবং মানুষের মনে ধর্মের প্রভাব থাকার ফলে সমকামী জনগোষ্ঠিভুক্ত লোকেরা এখনো সমাজে গ্রহনযোগ্য নয়। কোন কোন দেশে তা দন্ডনীয় অপরাধ বলেও বিবেচিত হয়।
পশ্চিমের পৃথিবী গে লেসবিয়ান জনগোষ্ঠির জন্যেও ধীরে ধীরে সদর দরজা খোলা শুরু করেছে। রাষ্ট্র তাদেরকে ধর্মের সামাজিক শৃংখল থেকে মুক্ত করে দিচ্ছে । টরন্টোতে এবার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইড উইক হতে যাচ্ছে। এতে ৫০ টি দেশে থেকে প্রায় ২ মিলিয়ন লোকের সমাগত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি হচ্ছে টরন্টোতে ৩৪তম প্রাইড ইউক। আর সে কারণেই টরন্টো সিটি হলে উঠছে প্রাইড রংধনূ পতাকা। রাষ্ট্র পাহাড়া দিচ্ছে ব্যাক্তি স্বাধীনতা। মানুষ মানুষকে সম্মান করছে- ‘হু ইউ আর।’ যেমনটি ইংরেজ রকস্টার স্টিং তার বিখ্যাত গান ‘ইংলিশ ম্যান ইন নিউয়র্ক’-এ বলেছেন ‘বি ইউরসেলফ নো ম্যাটার হোয়াট দে সে।’