দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিত্ব বাতিলের আইনটি এক ধরণের পরিহাস

মধ্যযুগে প্রচলিত ছিল নাগরিক বহিস্কারের আইন : গণতান্ত্রিক কানাডায় এর যৌক্তিকতা কোথায়?

বিদ্যমান ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমই অপরাধীদের বিচার কার্য পরিচালনার জন্য যথেষ্ট

সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৫

খুরশিদ আলম : কানাডায় যারা দ্বৈত নাগরিক তারা তাদের নাগরিকত্ব হারাতে পারেন এমন একটি ভীতি এখন অনেকের মনে কাজ করছে। বিল সি-২৪ নামের এক নতুন আইন পাশ হওয়াতেই এই ভীতির সঞ্চার হয়েছে। বিল সি-২৪ এর আরেক নাম হলো- ‘কানাডিয়ান নাগরিকত্ব আইন শক্তিশালীকরণ’। বিলটি গত জুন মাসে রাজ সম্মতি লাভ করে। রানীর পক্ষে বিলটিতে সই করেন কানাডার গভর্ণর জেনারেল ডেভিড জনস্টন।

কানাডায় যারা দ্বৈত নাগরিক তাদের কেউ যদি এখন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অভিযুক্ত হন বা কানাডার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন অথবা অন্যকোন গুরুতর অপরাধ করে অভিযুক্ত হন তবে সরকার নতুন এই আইনের মাধ্যমে তাকে কানাডা থেকে বহিস্কার করতে পারবে।

নাগরিকত্ব বাতিল করার যে নতুন আইনটি করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে দ্বৈত নাগরিকদের কানাডিয়ান নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে যখন:

কেউ নাগরিকত্ব লাভের জন্য আবেদনপত্রে মিথ্যা তথ্য দিবেন।

কেউ যদি এমন কোন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য হয়ে থাকেন বা কোন সংগঠিত সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য হয়ে থাকেন যেটি কানাডার সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িত।

কেউ যদি বিশ্বাসঘাতকতার জন্য সাজা প্রাপ্ত হয়ে থাকেন, গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধে অপরাধী হয়ে থাকেন এবং জাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে থাকেন।

কেউ যদি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন অথবা সমজাতীয় অপরাধে বিদেশে অভিযুক্ত হয়ে থাকেন এবং সেই সাজার পরিমান যদি ৫ বছর বা তারো বেশী হয়ে থকে। তবে সেই দ্বৈত নাগরিকের যদি দ্বিতীয় কোন দেশে যাওয়ার উপায় না থাকে তবে তার নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে না। কারণ, কানাডা জাতিসংঘের “কনভেনশন অন দি রিডাকশন অব স্টেটলেসনেস (১৯৬১)” সনদে স্বাক্ষরকারীদের একটি দেশ। ঐ সনদ অনুযায়ী কাউকে রাষ্ট্রহীন করা যাবে না।

নতুন এই আইনের কার্যকারিতা শুরু হওয়ার পর নাগরিকত্ব হারানোর আশংকা ছাড়াও আরো যে সকল আশংকা দেখা দিয়েছে দ্বৈত নাগরিকদের মধ্য তা হলো, বাড়ি ক্রয়সহ অন্যান্য কাজে তারা ব্যাংক ঋণের জন্য আবেদন জানালে তা পাওয়া দুরুহ হয়ে উঠতে পারে। কারণ, অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ভাবতে পারে এই দ্বৈত নাগরিকেরা কানাডার নাগরিত্ব হারালে তাদের কাছে থেকে পাওনা অর্থ আদায় করা কঠিন কিংবা জটিল হয়ে উঠতে পারে। ফলে অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আইন পরিবর্তন করতে পারে।

বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনেও জটিলতা দেখা দিতে পারে। যারা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কস্থাপনে আগ্রহী নাও হতে পারেন। কারণ কোন কারণে দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে এমন স্বামী বা স্ত্রী কানাডার নাগরিকত্ব হারালে দাম্পত্য জীবন হয়ে উঠবে চরম দুর্বিসহ। স্বামী থাকবেন এক দেশে আর স্ত্রী থাকবেন অন্য দেশে। এভাবে চলতে থাকলে সম্পর্ক বিচ্ছেদের সম্ভাবনা শতকরা প্রায় একশতভাগ। বিপদ আরো আছে। বৈবাহিক সূত্রে একজন কানাডিয়ান (যিনি দ্বৈত নাগরিক নন) তার স্বামী বা স্ত্রী যে দেশ থেকে এসেছেন সে দেশের নাগরিক হয়ে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তাকেও কানাডা থেকে বহিস্কার করা হতে পারে যদি তিনি কোন গুরতর অপরাধে অভিযুক্ত হন। ফলে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিককে বিয়ে করার রিস্ক প্রথম শ্রেণীর নাগরিকরা না-ও নিতে পারেন।

দ্বৈত নাগরিকেরা বিভিন্ন ট্রেডে মোটা অংকের পুঁজি লগ্নি করা থেকে বিরত থাকতে পারেন। তাছাড়া বড়মাপের কোন ব্যবসা শুরু করা থেকেও তারা বিরত থাকতে পারেন এই ভয়ে যে নাগরিকত্ব হারালে আম-ছালা দুটোই যাবে। নাগরিকত্ব হারালে লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে হয়তো শূন্যহাতে নিজ নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে হতে পারে।

দ্বৈত নাগরিকেরা কারো সাথে কোন বিরোধে জড়াতে যাবেন না। কেউ আন্যায় করলেও তা নীরবে মেনে নিবেন। কারণ, প্রতিবাদ করতে গেলে মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক, সেখানে অর্থের দাপট থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনকে নিজের পক্ষে কাজে লাগানো যায়। অথবা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আত্মীয়তা থাকলেও তা করা যায়। ফলে মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে ৫ বছরের বেশী সাজাপ্রাপ্ত হলে কানাডার ইমিগ্রেশন মন্ত্রী বা তার প্রতিনিধি উক্ত দ্বৈত নাগরিকের কানাডিয় নাগরিকত্ব বাতিল করে দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কোন আপিলও চলবে না।

এরকম আরো কিছু সমস্যা তৈরী হতে পারে যা দ্বৈত নাগরিকদের জন্য বিব্রতকর হিসেবে বিবেচিত হবে।

উল্লেখ্য যে, ইমিগ্রেশন মন্ত্রী ক্রিস আলেকজান্ডার ইতিপূর্বে বলেছিলেন, “কানাডার সিটিজেনশীপ কোন অধিকারের বিষয় নয়, এটি একটি সুযোগ বা সুবিধা।”

আসলে দ্বৈত নাগরিকদের মনে সন্দেহের বীজ বপন শুরু হয় তখন থেকেই। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত নতুন নতুন আইন প্রণয়ন ও বিধিনিষেধ আরোপের ফলে সে সন্দেহের বিষয়গুলো এখন বাস্তবে রূপ নেয়। দ্বৈত নাগরিকেরা এখন বাস্তবেই দেখতে পাচ্ছেন ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলের আসল রূপটা কি। সমালোচকরা বলছেন কানাডা ইমিগ্রেশন আইনে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার

সাম্প্রতিককালে যেসব পরিবর্তন এনেছে তার অধিকাংশই অগনতান্ত্রিক। কানাডার ইমিগ্রেশন এন্ড রিফুজি অইনজীবীগণ এবং এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কানাডাও মনে করে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। তারা সকলেই এই বিল সি-২৪ এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়টি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।

সিভিল রাইটস গ্রুপস এবং এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মনে করে নতুন এই আইন দ্বৈত নাগরিকদের জন্য বৈষম্যমূলক। এর মাধ্যমে দ্বৈত নাগরিকদেরকে এক অর্থে ‘লেস কানাডিয়ান’ কাতারে ফেলা হয়েছে এবং কানাডায় জন্ম নেয়া নাগরিকদের চেয়ে কম অধিকারসম্পন্ন করে তোলা হয়েছে। বৃটিশ কলম্বিয়ার সিভিল লিবার্টিজ এসোসিয়েশন এর ভাষ্য মতে দ্বৈত নাগরিকরা এখন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে গেল।

আগের নিয়মে কানাডার নাগরিকত্ব সবসময়ই ছিল নিরাপদ। কার জন্ম কানাডায় বা কার জন্ম বিদেশের মাটিতে সেগুলো বিবেচ্য বিষয় ছিল না। কানাডার নাগরিকত্ব বাতিল করা যেতে শুধুমাত্র তখনই যখন প্রমানিত হতো যে, নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার সময় কেউ কোন ভূয়া তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু এখন এই নিয়মের সঙ্গে আরো বেশ কয়েকটি নতুন নিয়ম যোগ করা হয়েছে যা আমরা উপরে দেখেছি।

বৃটিশ কলম্বিয়া সিভিল লিবার্টিস এসোসিয়েশন এর নির্বাহী পরিচালক জোস পিটারসন ইয়াহু কানাডার কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, নাগরিত্ব বাতিলের এই আইনটি এক ধরণের পরিহাস। তিনি বলেন, বৃটেনে আজ থেকে ৮শত বছর আগে একটি আইন ছিল যে আইনের বলে দেশ থেকে নাগরিকদেরকে বহিস্কার করা যেত। আজ ৮শত বছর পর সেই আইন আবার আমরা কানাডায় ফিরিয়ে এনেছি।

তিনি বলেন, দেশ থেকে কোন নাগরিককে বহিস্কার করার প্রথাটি ছিল মধ্যযুগীয় কালচার। এটা করা হতো কারণ সে সময় বৃটেনে সঠিক ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম ছিল না। ছিল না আইনের শাসন। কিন্তু ৮ শ বছর পর সেই মধ্যযুগীয় আইনকে আবার ফিরিয়ে আনা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয় বলে আমরা মনে করি। দেশের কোন নাগরিক যদি কোন অপরাধ করে থাকে তবে কানাডার যে ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম বিদ্যমান রয়েছে সেটিই এ ক্ষেত্রে বিচার কার্য পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত বলে আমরা মনে করি।

পিটারসন আরো বলেন, এটি এমনই এক আইন যা একই অপরাধের জন্য একজনকে দেশ থেকে বহিস্কার করা যাবে অন্যজনকে বহিস্কার করা যাবে না। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কারো যদি জন্ম হয় কানাডায় এবং তার দাদা যদি এসে থাকে এমন একটি দেশ থেকে যেখানে দ্বৈত নাগরিকত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় তবে কানাডায় জন্ম নেওয়া সেই ব্যক্তি অপরাধ করে থাকলে তাকে বহিস্কার করা যাবে নতুন এই আইনে। কিন্তু অন্য একজন যদি একই অপরাধ করে থাকে এবং সে নিজে যদি এমন একটি দেশ থেকে এসে থাকে যেখানে দ্বৈত নাগরিকত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না তবে সেই ব্যক্তিকে বহিস্কার করা যাবে না। এই আইনটি কানাডায় এক অদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। একই অপরাধের কারণে একজনকে দেশ থেকে বহিস্কার করা হবে আরেকজনকে করা হবে না।

অতীতে যারা কানাডায় ইমিগ্রেন্ট হয়ে এসেছেন বা এখনো যারা আসছেন তারা সকলেই একটি স্বপ্ন নিয়ে আসেন। স্বপ্নটি আর কিছুই নয়, সুন্দর করে একটি সুন্দর গণতান্ত্রিক পরিবেশে বসবাস করার স্বপ্ন যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা থাকবে, থাকবে সকলের জন্য সমান অধিকার। কিন্তু বিল সি-২৪ কি সেই অধিকারকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়নি? একই দেশে একই আইনে মানুষের মধ্যে কেন বিভেদ সৃষ্টি করা হলো? তাহলে গণতান্ত্রিক কানাডার মর্যাদা রইল কোথায়? বিশ্বে মানবাধিকার রক্ষায় যে কানাডা বরাবরই সোচ্চার থাকে সেই কানাডা তার নিজের নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে পালন করলো কোথায়? এই প্রশ্ন এখন অনেক ইমিগ্রেন্টের।

কানাডায় ইমিগ্রেন্ট থেকে নাগরিক হওয়া একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াটা শুরু হয় কানাডায় আসার অনেক আগে থেকেই। বিষয়টি এমন নয় যে হঠাৎ করে কেউ সিদ্ধান্ত নিয়ে কানাডায় চলে এলো এবং নাগরিকত্ব পেয়ে গেল। এক দেশ ছেড়ে আরেক দেশে স্থায়ীভাবে চলে আসার পিছনে থাকে নাড়ি ছেড়া ধন হারানোর বেদনা অথবা রক্তের বাঁধনে গড়া একটি জীবনকে পিছনে ফেলে আসার করুন বেদনা। এই যে বেদনা , মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে আসা, বাবা-মা ভাই-বোনসহ অন্যান্য আত্মীয় পরিজনদেরকে ছেড়ে আসার যে বেদনা তার পিছনে জড়িয়ে থাকে অনেক লম্বা ইতিহাস। কিন্তু নতুন আইনে কানাডার দ্বৈত নাগরিকদের সেই বেদনার ইতিহাসকে অবমাননা করা হয়েছে অত্যন্ত অমানবিকভাবে। তারা এখন পরিনত হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে। মধ্যযুগীয় আইন ফিরিয়ে এনে তাদেরকে করা হয়েছে অরক্ষিত। এরকমই অভিযোগ সাধারণ ইমিগ্রেন্টদের।

কানাডার হ্যালিফেক্সে অবস্থিত ডালহৌসী ইউনিভারসিটির আইন বিভাগের অধ্যাপক জনাথন স্যাপ্রিয় বলেন, কানাডার নাগরিকত্ব পেতে গেলে নানান বাধা ও নিয়ম-কানুনের পথ অতিক্রম করতে হয়। কিন্তু একবার সেই নাগরিত্ব পেয়ে গেলে সেটি অধিকার বলেই মনে হয়। এমন মনে হয় না যে এটি একটি সুবিধা মাত্র। তিনি বলেন, এই নাগরিকত্বের বিষয়টি সবার ক্ষেত্রেই অভিন্ন ধরণা হওয়া উচিৎ। একেক জনের জন্য একেক নিয়ম বা আইন হবে তা বাঞ্ছনীয় নয়।

কানাডার ইমিগ্রেশন বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন এমন একজন বিশেষজ্ঞ সাইমন ফ্রেসার ইউনিভারসিটির গ্রাজুয়েট সুমায়েয়া বাহরামী তার এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, যে সকল কানাডিয়ান নাগরিকের জন্ম বিদেশের মাটিতে অর্থাৎ যারা দ্বৈত নাগরিক তারা তাদের নাগরিত্ব হারাতে পারেন যদি ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা মনে করেন সেই ব্যক্তিটি কানাডায় বাস করতে আগ্রহী নন অথবা সেই ব্যক্তি তৃতীয় কোন দেশে পড়াশুনা করতে বা চাকুরী করার জন্য গিয়ে থাকেন।  সুমায়েয়া বাহরামী আরো উল্লেখ করেন, দ্বৈত নাগরিকেরা অন্য দেশে গিয়ে গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হলেও কানাডার নাগরিকত্ব হারাতে পারেন। তৃতীয় সে দেশটি যদি অগণতান্ত্রিক হয়, বিচারবিভাগ যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তবু সেই দেশ ও বিচার বিভাগের রায়কে গুরুত্ব দিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির কানাডীয় নাগরিকত্ব বাতিল করা হতে পারে। সুমায়েয়ার মতে কানাডার প্রথম শ্রেণী ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্বের যে বিভক্তি তৈরী করা হয়েছে এবং নাগরিকত্ব লাভের জন্য অন্যান্য যে সকল  নতুন আইন তৈরী করা হয়েছে তা নতুন ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।

নতুন যে আইন করা হয়েছে তাতে বলা আছে, নাগরিকত্ব লাভের জন্য এখন থেকে ইমিগ্রেন্টদেরকে ৬ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৪ বছর কানাডায় বাস করতে হবে। আগে নিয়ম ছিল ৪ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৩ বছর কানাডায় বাস করতে হবে। নতুন এই নিয়মের ফলে ইমিগ্রেন্টরা এখন জরুরী প্রয়োজনেও কানাডার বাইরে যেতে চাইবেন না বা গেলেও তাড়াহুড়া করে চলে আসবেন। দেশে নিকটআত্মীয় কেউ মারা গেলেও একই সিদ্ধান্ত নিতে হবে ইমিগ্রেন্টদেরকে এই ভয়ে যে তারা হয়তো নাগরিত্ব লাভের আবেদন করার যোগ্যতা হারাবেন। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট বা ফরেইন ওয়ার্কারদের বেলায়ও আইন কঠোর করা হয়েছে নতুন এই আইনে। আগে যেখানে ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদন করার আগে কানাডায় অবস্থানের মেয়াদকে ক্রেডিট দেওয়া হতো এখন সেটি আর দেওয়া হবে না নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার সময়।

নাগরিকত্ব লাভের জন্য ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্টকেও কঠিন করা হয়েছে আগের তুলনায়। বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্ট পাস করা কঠিন। তা জানা সত্বেও কর্তৃপক্ষ বয়সের মাত্রা আরো বৃদ্ধি করেছে। আগে নিয়ম ছিল ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত ব্যক্তিদেরকে ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্ট পাস করতে হবে। এখন নিয়ম হয়েছে ১৪ থেকে ৬৪ বছর বয়স পর্যন্ত ব্যক্তিদেরকে ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্ট পাস করতে হবে।

বিল সি-২৪ সম্পর্কে টরন্টো ইউনিভারসিটির আইন বিভাগের অধ্যাপক এন্ড্রু ম্যাকলিনের বক্তব্য এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন, “নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টিকে অধিকার হিসেবে না দেখে সুবিধা হিসেবে দেখার যে কথা বলছেন ইমিগ্রেশন মন্ত্রি সেটি নাগরিকত্বের ধারণা বা অর্থকে পরিবর্তন করে দিয়েছে নতুন ইমিগ্রেন্টদের কাছে এবং যারা দ্বৈত নাগরিক তাদের কাছে। ব্যাপারটি এখন এমন হয়ে দাড়িয়েছে যে, সরকার ইমিগ্রেন্টদেরকে নাগরিকত্ব দিবে তাদের ‘ভাল ব্যবহার’ দেখে এবং প্রদত্ত সেই নাগরিকত্ব আবার ছিনিয়ে নিবে তাদের ‘খারাপ ব্যবহার’ দেখে।

এটি এক ধরণের শাস্তি প্রদান এবং সত্যিকার অর্থে অপ্রয়োজনীয় শাস্তি প্রদান যখন প্রচলিত অন্যান্য আইন বা সুযোগ রয়েছে তথাকথিত ‘খারাপ ব্যবহারে’ শাস্তি প্রদান করার জন্য।

অধ্যাপক এন্ড্রু ম্যাকলিন আরো বলেন, “নাগরিকত্ব অধিকার নয় একটি সুযোগ এই বক্তব্যের প্রবর্তণ করা হয়েছে ইমিগ্রেন্টদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা থেকে। নেতিবাচক এই ধারণাটি হলো-ইমিগ্রেন্টরা প্রতারক। আর এই ধারণা থেকেই এরকম একটি মনোভাব তৈরী হয়েছে যে, রিফুজি, ফরেন ওয়ার্কার এবং দ্বৈত নাগরিকরা সন্ত্রাসী অথবা ক্রিমিনাল। সুতরাং তাদেরকে তাদের নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিতে হবে।”

ইমিগ্রেন্টদের সম্পর্কে এরকম নেতিবাচক ধারণা কানাডায় একেবারে নতুন তা নয়। তবে বর্তমান ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দল এই নেতিবাচক ধরণাকে আরো উস্কে দিলো নতুন এই বিল সি-২৪ পাস করিয়ে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর পরিনতিতে কানাডায় ইমিগ্রেন্ট বিরোধী মনোভাব আগামীতে আরো শক্তিশালী ও চাঙ্গা হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। এতে ফলাফল যা হবার তাই হবে। অর্থাৎ ইমিগ্রেন্ট আসা কমে যাবে। বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে ইমিগ্রেন্ট আসার মাত্রা অনেক কমে যাবে। কারণ জেনেশুনে কেউ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হতে আসবে না এই দেশে। দক্ষ ইমিগ্রেন্টদের বিকল্প দেশে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

তবে আগামী অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে এই বিল সি-২৪ একটি ইস্যু হিসেবে দাড়াতে পারে। শুধু বিল সি-২৪ নয়, সন্ত্রাস বিরোধী বিল সি-৫১ও নির্বাচনী ইস্যু হয়ে দাড়াবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বিরোধী দল লিবারেল ও এনডিপি’র পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে তারা ক্ষমতাসীন দলের ইমিগ্রেশন পলিসিকে নির্বাচনী ইস্যু হিসেবে দাড় করাবে।

লিবারেল দলের ইমিগ্রেশন সমালোচক জন ম্যাককুলিন বলেন, “ক্ষমতায় গেলে আমরা রক্ষণশীল দলের প্রবর্তিত বেশ কিছু ইমিগ্রেশন আইন বাতিল করে দিব যেগুলো নাগরিকত্ব লাভের জন্য কঠিন বাধা হিসেবে দাড়িয়েছে। নতুন নাগরিকরা কানাডায় বাস করবে এই মর্মে স্বাক্ষর করার যে নতুন বিধান তৈরী করা হয়েছে তাও বাতিল করা হবে।” তিনি আরো বলেন, “ইমিগ্রেন্টদের প্রতি দুইজনের মধ্যে একজন অপরাধী এ জাতীয় মনোভাবও পরিত্যাগ করতে হবে।”

ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) মাল্টিকালচারালইজম সমালোচক এন্ড্রু কেস বলেন, “ ক্ষমতাসীন দল ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ায় রুঢ়ভাবে যে পরিবর্তন এনেছে তা সংশোধন করবো আমরা যদি ক্ষমতায় যাই।”

এদিকে সন্ত্রাস বিরোধী বিল সি-৫১ এ কানাডার স্পাই এজেন্সিকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা সংবিধানবিরোধী এবং এটি লক্ষণীয়ভাবে বিচার বিভাগের ঐতিহ্যগত ভূমিকার বিপরীতমুখী কর্যক্রমকে প্রতিনিধিত্ব করছে। এই অভিযোগ এনে কানাডার দুটি জাতীয় গ্রুপ ‘কানাডিয়ান সিভিল লিবার্টিজ এসোসিয়েশন’ ও ‘কানাডিয়ান জার্নালিস্ট ফর ফ্রি এক্সপ্রেশন’ বিতর্কিত বিল সি-৫১ এর বিরুদ্ধে সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। তারা অন্টারিওর সুপরিয়ার কোর্ট অব জাস্টিস এর নিকট মকদ্দমাটির শুনানির জন্য আবেদন জানায়। চ্যালেঞ্জ আসছে বিল সি-২৪ এর বিরুদ্ধেও। টরন্টো ভিত্তিক সংবিধান বিশেষজ্ঞ আইনজীবী রোকো গালাতি সম্প্রতি সিটিভি নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানান, বিল সি-২৪ এর বিরুদ্ধে আদালতে চ্যালেঞ্জ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। আগামী শরৎকালের শেষের দিকে অথবা শীতের শুরুতে বিষয়টি নিয়ে তিনি আদালতে হাজির হবেন।