ড্যানফোর্থের বাংলাদেশ সেন্টার আলো ছড়াতে শুরু করেছে

ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৬

রেজাউল হাসান ॥ ড্যানফোর্থের বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা -যা লিটল বাংলাদেশ হিসেবে ইতোমধ্যে সবার কাছে আদরণীয় হয়ে ওঠেছে- সেখানেই অবস্থিত বাংলাদেশ সেন্টার এন্ড কমিউনিটি সার্ভিসেস এর কার্যালয়টি। বাংলাদেশী কমিউনিটির মাঝে দীর্ঘ দিন ধরেই নিজেদের একটি সেন্টার-অর্থাৎ একটি বাংলাদেশী সেন্টারের দাবী বা চাহিদা ছিল। লিবারেলের সাবেক মন্ত্রী ও পার্লামেন্ট সদস্য মারিয়া মিন্নারও আগ্রহ ছিল বাংলাদেশী কমিউনিটির জন্যে কিছু করার। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় তাকে জয় যুক্ত করার ব্যাপারে এই কমিউনিটির অবদান তিনি কখনোই খাঁটো করে দেখেন নি। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সেন্টার প্রতিষ্ঠা লগ্নে আড়াই লক্ষ ডলারের একটা ফান্ড পেয়ে যায়। সেই অর্থে আর কস্টি ইমিগ্র্যান্ট সার্ভিসের সহায়তায় বাংলাদেশ সেন্টার একটি বাড়ি কেনে। সে ছিল ২০১০ সালের ঘটনা। তারপর এই বাড়ি নিয়ে ঘটেছে অনেক ঘটনা আর দলাদলি। আমরা সেসব ঘটনারও যেমন পুনরাবৃত্তি করতে চাইনা-আমরা দেখতে চাই সেন্টারটি কেমন চলছে-এর ভেতরে গণতন্ত্র আছে নাকি মুষ্টিমেয় ক’জন লোক এটিকে কবজা করে রেখেছে!

হাসিনা কাদের

সেন্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব মাহবুব রেজার সাথে একদিন আলাপ হলো প্রবাসী কন্ঠের অফিসেই। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে জানা গেল, তিনি জাপান সরকারের সাথে বেশ কয়েকটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে জড়িত ছিলেন। এবং সেই লিঙ্ক আপটা আছে। তিনি বেশীর ভাগ সময়ই কাটান বাংলাদেশ সেন্টারে। তাকে বলি,সেন্টার সম্পর্কে যা শুনি তাতে তো ওদিকটায় মাড়াতে ইচ্ছে করেনা। ব্যবহারে বিন¤্র,মিতভাষী জনাব রেজা বললেন, কে কি বললো-তা না শুনে-একবার এসে নিজের চোখেই দেখে যান-না। তাকে বলি যাবো একদিন।

হঠাৎ করেই এক বিকেল বড্ড কনকনে হয়ে ওঠলো। ড্যানফোর্থের ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাংলাদেশ সেন্টারের সাইনবোর্ডটা চোখে পড়লো।পায়ে পায়ে দোতালায় উঠে যাই। মনে পড়ে গেল, অনেক কাল আগে এখানে একবার এসেছিলাম বাংলাদেশ কনস্যুলেটের সেবা নিতে। পাসপোর্টের পাতায় ‘নো ভিসা রিকোয়ার্ড’-এর সিল লাগাতে। বেশ লম্বা এক হারা গড়ণের একটি ঘর। শেষ প্রান্তে বেশ বড়সরো মিলনায়তন। সেখানে ক’জন মহিলা বসে সেলাই শিখছেন। মাহবুব রেজাদের সাথে দেখা হলো সিড়িঁ দিয়ে উপরে ওঠার মুখে হাতের ডান দিকে অফিস কক্ষে। তার আগের রুমটিতে চলছে কমপিউটার ক্লাশ। অবাক করার বিষয় হলো, যারা কমপিউটার শিখছেন-তাদের বেশীর ভাগই বয়স্ক মানুষ। ফেইস বুকে কি করে নাতি নাতকুরের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলা যায় সেগুলো যেমন শিক্ষা দেয়া হচেছ তেমনি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে কমপিউটারের বেসিক বিষয়গুলো এবং ধীরে ধীরে এই কোর্সের গভীরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অফিসের এক কোণায় বসেছিলেন-যার চোখে মুখে ব্যাক্তিত্ব আবার এক ধরণের স¯েœহ প্রশ্রয়ের নীল আকাশের উদারতাও ছিল। তিনি ফারজিয়া মাহমুদ, ইয়র্ক ইউনির্ভাসিটি থেকে এনভায়রনমেন্ট-এর উপর পি এইচ ডি করছেন। তারই সুযোগ্য নেতৃত্বে কমপিউটার ক্লাশ বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। আলাপ হলো সেন্টারের প্রেসিডেন্ট হাসিনা কাদেরের সাথে। তার মুখে তো হাসি লেগেই আছে। আরও একজন, ছিলেন তার নাম হাসিনা  বেগম । বর্তমানে সেন্টারের ডাইরেক্টর হিসাবে একজন নিবেদিত প্রান কর্মী।

ফারজিয়া মাহমুদ
মাহবুব রেজা

হাসিনা কাদের এদেশে এসেছেন ৮৩ সালে। তার স্বামী এসেছিলেন আরও এক বছর আগে। জীবন শুরু করেছিলেন মন্ট্রিয়াল থেকে। যুক্ত হন সাউথ ইস্ট এশিয়া ভিত্তিক একটি এনজিও-এর সাথে। পরে টরন্টোতে এসে মেইনস্ট্রিমের একটি নন

প্রফিট সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হন। মন্ট্রিয়ালে ওই এনজিওতে কাজ করার সময় অন্যান্য নারীদের দ্বারা যেভাবে হেনস্থার স্বীকার হয়েছিলেন-তাতে আর কোন দিনই সাউথ এশিয়ার কোন সংগঠনের সঙ্গে তার যুক্ত হওয়ার কোন অভিপ্রায় ছিলনা। কিন্তু বাংলাদেশ সেন্টার হওয়ার পর এই নন প্রফিট সংস্থার প্রভাবশালীদের আগ্রহের কারণে ধীরে ধীরে যুক্ত হন এই সেন্টারের সাথে। চলে আসেন নেতৃত্বে। বললেন, তিন বছর আগে আমরা এই ঘরের কর্তৃত্ব পেয়েছি। আমরা রেভিনিও কানাডার থেকে চ্যারিটির মর্যাদাও পেয়েছি।

মিসেস কাদের বলেন, এখানে আসার পর ইমিগ্র্যান্টদের সবচে’ বড় সমস্যায় পড়তে হয়-সেটা হলো ভাষা-কমিউনিকেশন। আমরা ‘চা-ই মিতা’ নামে একটি কার্যক্রম শুরু করি। মিতা নামের একটি মেয়ে শেখাতো কিভাবে ইংজেীতে কমিউনিকেট করতে হয়। অনেকটা চা পান করতে করতে ইংরেজী শেখা। এটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তারপর সেটেলমেন্ট সাপোর্ট, এমপ্লয়মেন্ট এ্যান্ড স্কিল ডেভালেপমেনট, এডুকেশন অন হেলথ কনসার্ণ এবং এলডার্স এবিউজ-এর ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধির ব্যাপারেও আমাদের কমিউনিটিতে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যায়। এ বিষয়গুলোর উপরও আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে।

আমি এবং প্রবাসী কন্ঠ সম্পাদক খুরশিদ আলম-দু’জনেই এলডার্স এবিউজের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাই-হাসিনা কাদের বললেন, বিষয়টি এখন আর নতুন নয়। অনেক বাবা মাই নাতিনদের সঙ্গে বিদেশে থাকতে পারবেন-বৃদ্ধ বয়সে ছেলে মেয়েদের সাথে একত্রে থাকা যাবে-এটা তো একটা বিরাট ব্যাপার। কিন্তু সেই আনন্দ নিরানন্দ হয়ে ওঠতে বেশী দেরী লাগেনা। ধীরে ধীরে তাদের কাঁধে প্রথমে বেবী সিটিং এবং পরে রান্নার দায়িত্বটাও এসে যায়। এবং পান থেকে চুন খসলে দেশে শ্বাশুড়ি যে ধোলাইটা দিয়ে থাকেন এখানে সেই শ্বাশুড়ি আর শশুর যে নিগ্রহের শিকার হন তা বলার মতো নয়। এঁরা কিভাবে এই নিগ্রহের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারেন সে ব্যাপারে আমরা পরামর্শ দেই। এই প্রগ্রামের দায়িত্বে রয়েছে নাহিদ শরীফ। মোদ্দা কথা, আমাদের কমিউনিটির লোকজনেরা যেন অসহায় বোধ না করে আমরা ধীরে ধীরে আলো ছড়াতে শুরু করেছি। অমরা সবাই ভলানটিয়ার। মাত্র দু’জনকে আমরা হায়ার করতে পেরেছি। কমপিউটার্স আর এলডার্স প্রোগ্রামের জন্যে। ইয়থদের নিয়েও আছে আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম।

নাহিদ শরীফ

আমরা বিভিন্ন সময়ে রেক্সডেল ওমেন্স সেন্টার, কস্টি ইমিগ্র্যান্টস সার্ভিসেস, ওয়ারডেন উড কমিউনিটি সেন্টার, এক্সেস এলায়ান্স, ড্যানফোর্থ ভিলেজ বিআইএ,সাউথ রিভারডেল কমিউনিটি হেলথ্ সেন্টার, কাউন্সিল অব এজেন্সিস সার্ভিং সাউথ এশিয়ানস,বাংলাদেশ-কানাডিয়ান কমিউনিটি সার্ভিসেস ও আশা বেঙ্গলী গার্লস সোসাইটির সঙ্গে কাজ করেছি। এরা আমাদের পার্টনার হিসাবে আছে।

সেন্টারের সূত্রে আরও জানা যায়, মাত্র ২০ডলার দিয়ে বাৎসরিক সদস্য হওয়া যায়।

সেন্টারের সেন্টারের পরিচালনা পর্ষদে অন্যান্যদের মধ্যে যারা আছেন তারা হলেন, সিরাজুল ইসলাম – সেক্রেটারী, এস. সওকত মাহমুদ – ট্রেজারার, শিবু চৌধুরী -পরিচালক, কফিল উদ্দিন পারভেজ

-পরিচালক, আলমগীর হাকিম -পরিচালক, হাসিনা বেগম -পরিচালক, সৈয়দ এ গাফ্ফার -পরিচালক, এম আফজাল মোমেন -পরিচালক, এন্ড্রু ফ্লিন্ট -পরিচালক, ম্যাক আজাদ -পরিচালক ও সুমনা সাফিনাজ-পরিচালক।

আমরা হাসিনা কাদেরের কাছে জানতে চাই-এখানে গণতন্ত্রের চর্চা কেমন হয়?

হাসিনা কাদের বলেন,আমাদের প্রতি বছরই বার্ষিক সভা (এনুয়াল জেনারেল মিটিং) হয়। তাতে কাউন্সিলর জেনিট ডেভিস, স্থানীয় এমপিপি থাকেন এবং মারিয়া মিন্না তো থাকেনই। এখানে আয় ব্যায়ের হিসাব এবং পরিচালনা পর্ষদের নতুন সদস্য নির্বাচন করা হয়। এখানে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কোন সুযোগ নেই। সবাই সেবার মনোভাব নিয়েই এখানে আসেন কাজ করতে। আমারা আমাদের জাতীয় ইভেন্টগুলো বেশ সাড়ম্বরেই পালন করে থাকি।

এবারের মহান একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে সেন্টারের পক্ষ থেকে যে দু’দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে তার সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মাহবুব রেজাকে। তিনি বলেন, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ছাড়াও আমরা অস্থায়ী শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবো। এবং একুশে উপলক্ষে ড্যানফোর্থে একটা বর্ণাঢ্য র‌্যালী বের করে আমাদের আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস সম্পর্কে অন্যান্যদেরকে একটা ধারণা দিতে চাই।

হাসিনা কাদের বলেন, সরকারী অনুদান আর আমাদের কমিউনিটির মানুষদের ডোনেশনের ভিত্তিতেই আমরা এর কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। বাংলা ভাষাভাষি মানুষেরা এখানে  এলে অনুধাবন করতে পারবেন-এ সেন্টার তাদেরই সেন্টার এ ঘর তাদেরই ঘর। যেমন ব্যারিস্টার চয়ণিকা দত্ত-শিশুদের পরুষ্কারটা তিনি দেবেনই। আর তিনি তো ডোনেশন দেনই অন্যদেরকেও ডোনেশনের ব্যাপারে উৎসাহিত করেন।