জঙ্গীবাদের প্রসার : কানাডায় মুসলমানদের ভবিষ্যত কি সঙ্কটাপন্ন?

মুসলমানরা অধিক হারে ঘৃণা বা বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের শিকার হচ্ছেন কানাডায়

জুলাই ১১, ২০১৫

খুরশিদ আলম : ইসলাম ধর্মের নামে বিশ্বব্যাপী জঙ্গীবাদের বিস্তার ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর সেই বিস্তারের থাবা এসে লেগেছে কানাডাতেও। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি কানাডার রাজধানী অটোয়াতে অবস্থিত পার্লামেন্ট ভবন জঙ্গীবাদী হামলার শিকার হয়েছে। ঐ হামলায় নিহত হয়েছেন একজন তরুন কানাডীয় সৈন্য। তারো আগে কুইবেকে একজন কানাডীয় সৈন্য নিহত হয়েছেন জঙ্গী হামলার শিকার হয়ে। তিউনিশিয়ার এক মুসলমান যুবক গ্রেফতার হয়েছেন কানাডার ভিয়া রেল সেতু ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করায়। পাকিস্তানী এক মুসলমান যুবক গ্রেফতার হয়েছেন টরন্টোর মার্কিন কনসুলেট অফিস উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করায়। মাস দুই আগে মন্ট্রিয়লের বিমান বন্দর থেকে ১০ জন যুবককে গ্রেফতার করা হয় যারা জঙ্গী সংগঠন আই এস এর সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য দেশ ত্যাগ করতে যাচ্ছিল। জঙ্গী সংগঠন আই এস এ যোগ দেওয়ার জন্য ৪ জন বাঙ্গালী তরুন কানাডা ছেড়েছে এমন খবরও রয়েছে। কয়েক বছর আগে টরন্টোতে গ্রেফতার হয়েছিলেন ১৮ জন মুসলমান যুবক যারা পার্লামেন্ট ভবন সহ আরো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।

উপরে উল্লেখিত কারণসমূহের জন্য কানাডার মূলধারায় বিশেষভাবে যে শঙ্কাটি দেখা দিয়েছে তা হলো, “মুসলমান ইমিগ্রেন্টরা কি কানাডার জন্য হুমকী?”

এদিকে সদ্য প্রকাশিত এক জরীপ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জঙ্গীবাদ প্রসারের কারণে কানাডায় মুসলমান ইমিগ্রেন্টদের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের মাত্রা গত কয়েক বছরে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, “কানাডায় মুসলমানদের ভবিষ্যত কি সঙ্কটাপন্ন?”

এই দুই প্রশ্নের মুখমুখি এখন কানাডার সাধারণ মানুষ। একদিকে কানাডার অমুসলমান জনগোষ্ঠি অন্য দিকে কানাডার মুসলমান জনগোষ্ঠি।

গত ৯ জুন প্রকাশিত স্ট্যাটিসকিক্স কানাডার এক রিপোর্টে দেখা যায়, কানাডায় মুসলমান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা আগের তুলনায় অধিক হারে ঘৃণা বা বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের শিকার হচ্ছেন। তবে অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকদের প্রতি এই ঘৃণা বা বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের মাত্রা হ্রাস পেয়েছে।

এই জরীপ তথ্যে প্রসঙ্গে দৈনিক ন্যাশনাল পোস্টের সঙ্গে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিম এর হিউম্যান রাইটস কো-অর্ডিনেটর আমীরা এলগাওয়েবী বলেন, বিষয়টি অপ্রীতিকর এবং এটি প্রমান করছে যে, কানাডায় মুসলমানের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের নিজস্ব তথ্য-উপাত্ত বলছে ২০১৪ সালে এই পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। সুতরাং বিষয়টির প্রতি আরো বেশী করে নজর দেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে।

উল্লেখ্য যে, ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিম এর মতে মুসলমান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকদের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের সব খবর মিডিয়াতে আসে না। সে কারণে স্ট্যাটিসটিক্স কানাডা যে হিসেব দেখিয়েছে তা বাস্তব অবস্থার সামগ্রিক চিত্র নাও হতে পারে।

২০১৩ সালের শেষের দিকে Angus Reid পরিচালিত এক এক জরীপেও দেখা যায়, কানাডায় মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাব বিগত ৪ বছরে (২০০৯-২০১৩) ক্রমশ খারাপের দিকে গেছে। অথচ এই একই সময়ে অন্যান্য ধর্মের লোকজনের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাবের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।

কানাডায় যারা ইসলাম ধর্মের প্রতি মানুষের নেতিবাচক ধারনাকে পাল্টানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিরন্তর, তাদের কাছে জরীপের এই তথ্যটি সত্যিকার অর্থেই নিরুৎসাহব্যাঞ্জক।

Angus Reid পরিচালিত জরীপে আরো দেখা গেছে কানাডিয়ানদের মধ্যে যারা অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় পোষাকের ব্যাপারে কোন আপত্তি করেন না, তারাই আবার বোরখা এবং নেকাবের প্রতি অত্যন্ত বিরুপ মনোভাব পোষণ করেন। জরীপ তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় কুইবেকের ৯০% এবং কানাডার অন্যান্য অঞ্চলের ৬২% লোক বোরখা পছন্দ করেন না এবং তারা বলেছেন সরকারী অফিস আদালতে এই পোষাক পরে কাউকে কাজ করার অনুমোদন দেওয়া উচিৎ নয়। তবে হিজাবের বিরুদ্ধে লোকজনের মনোভাব কিছুটা নমনীয়। ৬৫% কানাডিয়ান মনে করেন হিজাব পরা মহিলাদেরকে সরকারী অফিস আদালতে কাজ করার অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে।

কানাডার হাফিংটন পোস্ট এর কলামিস্ট আবু বকর কাশিম সম্প্রতি তার এক কলামে লিখেছেন, “কানাডায় মুসলমান ইমিগ্রেন্টরা অতিমাত্রায় অবজ্ঞার শিকার হচ্ছেন। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্নস্থানে জঙ্গী হামলার কারণে মুসলমান ইমিগ্রেন্টদের জীবন বেশ চ্যালেঞ্জের মুখমুখি হয়ে পড়েছে।”আবু বকর তার কলামে ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর এলিমিনেশন অব রেসিয়াল ডিসক্রিমিনেশন উদযাপনের কয়েকদিন আগে প্রকাশিত এক জরীপের তথ্য তুলে ধরেন যাতে দেখা যায়- “কানাডার অর্ধেকেরও বেশী লোক মনে করেন মুসলমানদেরকে বিশ্বাস করা যায় না। তারা আরো মনে করেন, মুসলমানদের এই অবস্থার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। ঐ জরীপে আরো দেখা যায় কুইবেকের ৭০% ফারাসী ভাষাভাষীর লোকেরা মুসলমানদেরকে বিশ্বাস করেন না। অপরদিকে কানাডার অন্যান্য অঞ্চলের ৪৩% ইংরেজী ভাষাভাষীর লোকেরাও মুসলমানদেরকে বিশ্বাস করেন না। আর মুসলমানদের এই পরিনতির জন্য কারা দায়ী এমন প্রশ্নের উত্তরে ৪২% কানাডিয়ান মনে করেন, এ জন্য মুসলমানদের কর্মকান্ডই দায়ী।”

আবু বকর কাশিম আরো লিখেন, নর্থ আমেরিকার মুসলমানদের চেয়ে ইউরোপের ইমগ্রেন্ট মুসলমানরা বেশী মাত্রায় নিগৃহীত হচ্ছেন। তবে উত্তর আমেরিকার পরিস্থিতিও দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য যে, গত ২৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা রিচার্ড ফাডেন সিনেটের জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কমিটির কাছে বলেছেন, “বিদেশ থেকে কানাডায় অর্থ সাহায্য আসছে জঙ্গীবাদী ভাবাদর্শকে উষ্কে দেওয়ার জন্য। আর এই অর্থ সাহায্য পাচ্ছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।”

এই অর্থ কোন দেশ থেকে আসছে তা নির্দিষ্ট করে না বলা হলেও ইঙ্গিতটা রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। আর কি পরিমান অর্থ আসছে সেটিও নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আসছে কানাডায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে।

রিচার্ড ফাডেন বলেন, “কোন সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে এই অর্থ আসছে তা নয়, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যারা প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক তারাই এই অর্থ পাঠাচ্ছে । ধনবানদের ব্যাক্তিগত উৎস থেকেও আসছে এই সব অর্থ। ফলে এগুলো চিহ্নিত করা খুব কঠিন আমাদের পক্ষে।” (উইকিলিকস এর সর্বশেষ প্রকাশিত ডকুমেন্টস থেকে দেখা যায় খোদ সৌদী সরকারই কানাডায় বিভিন্ন ধর্মীয় স্কুলে ডোনেশন দিয়ে আসছে)।

রেভিনিউ কানাডা’র ডকুমেন্টস থেকে জানা যায়, গত ২০০৯ সাল থেকে বিপুল পরিমানের অর্থ সাহায্য এসেছে কানাডায় বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। কানাডার আইন অনুযায়ী স্থানীয় দাতব্য সংস্থাগুলো কত অর্থসাহায্য পেল তা প্রকাশ করতে বাধ্য। তবে অর্থ কে পাঠালো তা বলতে বাধ্য নয়।

ন্যাশনাল পোস্টের সঙ্গে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও কানাডার রয়েল মিলিটারী কলেজ এবং কুউন্স ইউনিভারসিটির অধ্যাপক অধ্যাপক ক্রিশ্চিয়ান লুপ্রেট বলেন, “ দাতারা অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় আদর্শ প্রচার করার লক্ষ্য নিয়ে।”তিনি আরো বলেন, “এই সকল অর্থ সাহায্য কানাডার মতো একটি উদারপন্থী সমাজে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারছে তা বলা কঠিন। তবে আশংকা হলো, সংকীর্ণতা যদি পেয়েই বসে তবে কি হবে।”

বিদেশী সাহায্য দাতাদের বিষয়ে আগেও জানতে চাওয়া হয়েছিল কানাডার সিনেট কমিটিতে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারী  উইনিপেগের ইসলামিক স্যোসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক শাহিনা সিদ্দিকী এই কমিটির সামনে বলেন, তার প্রতিষ্ঠানও প্রায় ৩ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য পাওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিল। কিন্তু তারা তা গ্রহণ করেনি। শাহিনা  বলেন, “ একই প্রস্তাব এসেছিল ম্যানিটোবায় আমাদের মসজিদের জন্যও। এই প্রস্তাব এসেছিল লিবিয়া থেকে যখন আমরা আমাদের প্রথম মসজিদ নির্মান করছিলাম। কিন্তু আমরা সেই অর্থ সাহায্য নেইনি।”

শাহিনা জানান, “আমরা আমাদের বিভিন্ন সংগঠনকে পরামর্শ দিয়েছি বিদেশী সাহায্য না নেওয়ার জন্য। কারণ,আপত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এগুলো খাঁটি সাহায্য। কিন্তু, এ সব সহায্যের পিছনে কোন না কোন গোপন উদ্দেশ্য থাকে।”

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, আর সেটি হলো শাহিনা সিদ্দিকীর এই পরামর্শ কি কানাডার সবকটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পৌঁছেছে? আর যে কটি প্রতিষ্ঠানে পৌঁছেছে তারা সবাই কি সেই পরামর্শ গ্রহণ করেছে?

যারা নিয়মিত পত্রপত্রিকা পড়েন তারা হয়তো দেখে থাকবেন যে, বিভিন্ন সময়ে কানাডায় কিছু কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অর্থ কেলেংকারীর মতো ঘটনা ঘটেছে। আর এই কেলেংকারীর সঙ্গে ঐ সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নেতৃবৃন্দই জড়িত। সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্যের প্রস্তাব আসলে তা লুফে নেওয়ার লোকের অভাব নেই এখানে। আর এর মাধ্যমে কানাডায় জঙ্গীবাদের আদর্শ অনুপ্রবেশের সুযোগ থেকেই যাচ্ছে।

উল্লেখ্য যে, আগামী অক্টোবরে ১৯ তারিখে কানাডায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আসন্ন ঐ নির্বাচনে ইমিগ্রেন্টদের ভোট পাওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ দলসহ অন্যান্য দলগুলো ইতিমধ্যেই জোর তৎপরতা শুরু করেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল ভোট পাওয়ার জন্য সন্ত্রাস / জঙ্গীবাদ, বোরখা-নেকাব, অনার কিলিং ইত্যাদিকে ইস্যু করে সামনে এগুবার চেষ্টা করছে। ফল যা হবার তাই হচ্ছে। অর্থাৎ কানাডায় মুসলমান বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, নাগরিকত্ব লাভের জন্য শপথ গ্রহণের সময় নেকাব পরা যাবে কি যাবে না এ বিষয়ে বিষয়ে ফেডারেল কোর্টের রায় ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার বলেছিলেন তাঁর সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে। ফেডারেল কোর্ট নেকাবের পক্ষেই রায় দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় নেকাব একটি অগ্রহণযোগ্য প্রথা। তিনি  বলেন, আমার বিশ্বাস অধিকাংশ কানাডিয়ান মনে করেন যে নাগরিকত্বের জন্য শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে নিজের পরিচয় গোপন রাখাটা আপত্তিকর বা অপরাধমূলক আচরণ। তিনি আরো বলেন, আমরা একটি স্বচ্ছ সমাজে বাস করি যেখানে সকলেই সমান। ( উল্লেখ্য যে, গত ১৯ জুন সরকার সংসদে এ বিষয়ে একটি নতুন বিল উত্থাপন করেছে যাতে বলা হয়েছে নাগরিকত্ব লাভের জন্য শপথ নেওয়ার সময় সবাইকে মুখমন্ডল উন্মোচন করতে হবে।)

নেকাব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঐ বক্তব্য প্রচারের পর অবশ্য প্রশ্ন উঠেছিল তাঁর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে। তিনি কি আসলেই নেকাব নিষিদ্ধ করার পক্ষে নাকি এই নেকাব নিয়ে নতুন কোন রাজনীতি শুরু করেছেন?

সমালোকচরা বলছেন, আগামী ১৯ অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে কুইবেকের ভোট বেশী সংখ্যায় পাওয়ার জন্যই তিনি এই নেকাব রাজনীতিতে নেমেছেন। নিকাবের বিরুদ্ধে কথা বললে কুইবেকের ভোটারগণ খুশি হবেন। কারণ, কুইবেকের সিংহভাগ ভোটার মুসলমানদের এই নেকাব আর হিজাবের ঘোর বিরোধী।

প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের প্রতি ক্যালগারির একটি মুসলিম গ্রুপ আহ্বান

জানিয়েছিলেন তিনি যেন নেকাব নিয়ে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করেন। সেখানকার ইসলামিক সুপ্রিম কাউন্সিল অব কানাডা’র পক্ষ থেকে বলা হয়, শপথ গ্রহনের সময় নেকাব পরা নিয়ে আদলত যে রায় দিয়েছেন সেটি কোন গুরুত্বপূর্ন বিষয় নয়। কিন্তু প্রধানন্ত্রী এটিকে অযথা একটি গুরুত্বপূর্ন ইস্যু বানাচ্ছেন। তাঁরা বলেন, নেকাব পরা না পরা একান্তই কোন মহিলার ব্যক্তিগত বিষয় যেমনটা ব্যক্তিগত বিষয় একজন মহিলা কতটা সংক্ষিপ্ত পোষাক পরবেন।

এদিকে অভিযোগ উঠেছে যে, প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার ওমর খাদারের (গুয়ান্তানামার সাবেক বন্দি যিনি আফগানিস্তানে আলকায়দার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বালক বয়সে। তার বাবা তাকে সেখানে নিয়ে যায়) বিষয়টি নিয়েও অতি বাড়াবাড়ি করেছেন ভোট রাজনীতির কারণে। আদালত যেখানে ওমরকে জামিনে মুক্তি দিয়েছে সেখানে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তাকে জেলের অভ্যন্তরে আটকে রাখার। এই ইস্যুতে ওমরের আইনজীবী ডেনিস এ্যাডনি  প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারকে প্রকাশ্যে মুসলমান বিরোধী এক ধর্মান্ধ ব্যক্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, “এটি প্রমান করার জন্য যথেষ্ট প্রমানাদিও রয়েছে।”

প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৯/১১ এর বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে সিবিসি‘র সঙ্গে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “কানাডায় এখনো সবচেয়ে বড় হুমকী জঙ্গীবাদ।”

এদিকে গত ২১ মে মন্ট্রিয়লে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য কানাডার আরসিএমপি ও কানাডার বর্ডার সার্ভিসেসকে অর্থ যোগান দেওয়ার কথা ঘোষণা করার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জঙ্গীবাদ কানাডায় ভবিষ্যতে ঘটবে তা নয়। এটি এখন বর্তমান বাস্তবতা।”

অনেকে ধারণা করেন, আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে রক্ষণশীল দল মুসলমান বিরোধী মনোভাবকে আরো চাঙ্গা করার জন্য সংসদে বিল সি-৫১ উত্থাপন করেছিলো। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস বিরোধিতার দোহাই দিয়ে ক্ষমতাসীন দল এই বিলটি পাশ করায় এবং গত ১৮ জুন তা রাজ সম্মতিও পায়। ফলে এটি এখন কানাডার নতুন আইন।

এভাবে ক্ষমতাসীন দল ও প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার মিলে ভোট রাজনীতির নামে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কানাডার সাধারণ মানুষদের মন বিষিয়ে তুলছেন এমন অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ।

কানাডার অন্যান্য মহল থেকেও নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে মুসলমান বিরোধী মনোভাবকে চাঙ্গা করার জন্য। ‘ইমিগ্রেশন ওয়াচ কানাডা’নামের একটি সংস্থার ওয়েবসাইটে প্যাট্রিক গ্রেডি নামের একজন এক লেখা লিখেছেন যার শিরোনাম হলো, “মুসলিম ইমিগ্রেন্টরা কানাডায় জঙ্গী হুমকী সৃষ্টিতে ইন্ধন যোগাচ্ছে”।

প্যাট্রিক লিখেছেন, “ইমিগ্রেশন পলিসির মাধ্যমে কানাডার সরকারগুলো দেশটিকে ইসলামী জঙ্গীদের কাছে ক্রমবর্ধমানভাবে অরক্ষিত করে তুলেছে।”তিনি আরো লিখেছেন, “৯/১১ এর ঘটনার পর এটি খুবই সুষ্পষ্ট ছিল যে উত্তর আমেরিকাকে ইসলামী জঙ্গীদের কাছ থেকে আরো বেশী মাত্রায় হুমকী মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু তা জানা সত্বেও কানাডার বিভিন্ন সময়কার সরকার প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫৬ হাজার মুসলিম ইমিগ্রেন্টকে এ দেশে আসার অনুমতি দিয়েছে। ২০০২ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সরকার ৬ লক্ষ ২৩ হাজার মুসলিম ইমিগ্রেন্ট এনেছে কানাডায়। এদের মধ্যে এক লাখ এক হাজার এসেছে পাকিস্তান থেকে এবং ৭১ হাজার এসেছে ইরান থেকে। আর এই দুটি দেশই আন্তর্জাতিক জঙ্গী তৎপরতায় সরকারীভাবেই সহায়তা করে থাকে।”

প্যাট্রিক অবশ্য বলেছেন, “সব মুসলমানই জঙ্গী তা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই মুসলিম কমিউনিটিই কানাডায় জঙ্গীদের জন্ম ও আশ্রয় দিচ্ছে।”প্রমান হিসেবে ২০০৭ সালের একটি জরীপ রিপোর্টের কথা তিনি উল্লেখ করেন যাতে দেখানো হয়েছে – কানাডায় বসবাসকারী ১৩% মুসলমানের সমর্থন ছিল ২০০৬ সালে কানাডায় জঙ্গী হামলার পরিকল্পনাকারী ১৮জন যুবকের (যারা গ্রেফতার হয়) প্রতি।

প্যাট্রিক তার লেখায় আরো উল্লেখ করেন, “কানাডায় অমুসলমান তরুনরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে জঙ্গী হয়ে উঠছে এটিও একটি উদ্বেগের কারণ।… তাছাড়া আদম সুমারীতে দেখা গেছে কানাডায় এসে ২০ থেকে ৩০ পার্সেন্ট ইমিগ্রেন্ট অন্য দেশে চলে যায় নাগরিকত্ব লাভের পর। এদের মধ্যে মুসলমানও রয়েছে। আর এই মুসলমানদের মধ্যে যদি কেউ জঙ্গীর খাতায় নাম লেখায় তবে তারা তাদের কার্যক্রম সহজভাবে চালানোর জন্য কানাডার পাসপোর্ট নানান ভাবে অপব্যবহার করতে পারে।”

সব শেষে প্যাট্রিক তার লেখায় বলেন, “বাস্তবতা হলো, ইসলামী জঙ্গীপনা মুসলমান কমিউনিটিতেই গভীরভাবে গ্রোথিত হয়ে আছে। তাই এই কমিউনিটি যতই বড় হতে থাকবে, ততই বাড়তে থাকবে জঙ্গীদেরও সংখ্যা। এর উদাহরণ দেখতে পাই আমরা যুক্তরাজ্যে (মোট সংখ্যার ৪.৬% মুসলমান), জার্মানীতে (মোট সংখ্যার ৫% মুসলমান), ফ্রান্সে (মোট সংখ্যার ৭.৫% মুসলমান), বেলজিয়ামে (মোট সংখ্যার ৬% মুসলমান), নেদারল্যান্ডে (মোট সংখ্যার ৫.৫% মুসলমান) এবং সুইডেনে (মোট সংখ্যার ৪.৯% মুসলমান)। ঐ দেশগুলোতে মুসলমানের সংখ্যা বেশী এবং জঙ্গীপনার সমস্যাও বেশী কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায়।”

অটোয়া সিটিজেন পত্রিকায় রবার্ট শিবলী নামের এক কলামিস্ট তার কলামে লিখেছেন, “৯/১১ এর ঘটনার পর পশ্চিমা সমাজে একটি আশংকা দেখা দিয়েছে যে, দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া মুসলমান ইমিগ্রেন্টদের কারণে পশ্চিমাদের মূল্যবোধগুলো পদদলিত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। মুসলমানদের সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব অবশ্য আগেও ছিল যা ইউরাবিয়া (“Eurabia” is a conspiracy theory and a doomsday scenario about the imminent total Islamisation of Europe)  নামে পরিচিত। সে কারণে পশ্চিমারা মনে করেন, মুসলমানরা বিশ্বাসঘাতক, মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে তাদের একটি রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি রয়েছে, মুসলমানদের মধ্যে উচ্চ প্রজনন হার রয়েছে বিধায় তারা শীঘ্রই সংখ্যাগুরুতে পরিনত হবে।”

তিনি আরো লিখেছেন, “পশ্চিমাদের এই বিশ্বাস বা ধারণার কারণে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় রাজনীতিতে বিষবাষ্প যোগ হচ্ছে, বিষবাষ্প যোগ হওয়ার কারণে কমিউনিটি সম্পর্কের মধ্যেও ফারাক তৈরী হচ্ছে। আর এর প্রভাবই আমরা দেখতে পাই নরওয়ের গণহত্যার ঘটনায় যেটি ঘটেছিল ২০১১ সালের ২২ জুলাই। এন্ডার্স বিহ্রিং নামের এক চরম দক্ষিণপন্থী যুবক প্রথমে গাড়ি বোমার সাহায্যে ৮জনকে হত্যা করে। এর পর একটি যুব সমাবেশে বন্দুক হামলা চালিয়ে ৬৯ জনকে হত্যা করে। ইলামোফবিয়ার কারণেই সে এটি করেছে।”

ইউনিভারসিটি অব ওয়েস্টার্ন ওন্টারিও’র অধ্যাপক ও টরন্টো সান এর নিয়মিত কলামিস্ট সেলিম মনসুর মনে করেন, “কানাডা সাংস্কৃতিক দিক থেকে এমন এক প্রক্রিয়ায় দ্রুত পাল্টাচ্ছে যা নিয়ে এখানকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, মিডিয়া নেতৃবৃন্দ এবং সুশীল সমাজ খোলামেলা ভাবে কথা বলতে চান না। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে সাধারণ মানুষ বিষয়টি জানে না। তারা দেখছেন, কত অল্প সময়ের মধ্যে এখানকার সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট পাল্টে যাচ্ছে। আর এই পরিবর্তন যদি আগামী কয়েক দশক এভাবে চলতে থাকে তবে কানাডা রাজনৈতিক ভাবে এমন এক পর্যায়ে চলে যাবে যেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব হবে না। এই পরিবর্তন কানাডার উদার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের জন্য মঙ্গলজনক হবে না মোটেও।”

সেলিম মনসুর আরো বলেন, “বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষ করে রক্ষণশীল মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলো থেকে কানাডায় ইমিগ্রেন্টদের আসার অর্থ হলো একটি উদারনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় অ-উদার লোকসংখ্যা বৃদ্ধি। আমরা জানি অনুদার সংস্কৃতির লোকজন যখন উদার সমাজব্যবস্থায় (যেমন কানাডা) সম্পৃক্ত হতে যায় তখন নানান সংকট তৈরী হয়।”

উল্লেখ্য যে,  কানাডায় মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই বৃদ্ধি ধীর গতিতে নয়, দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। Pew Research Center Forum  ভবিষ্যতবাণী হলো, কানাডায় ২০৩০ সালের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা বর্তমানের তিনগুন হবে। তাদের হিসেবে ঐ সময়ে মুসলমান জনসংখ্যা ২.৭ মিলিয়নে দাড়াবে যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬.৬ ভাগ।

Pew Research Center Forum  মতে ইউরোপে ২০৩০ সালের মধ্যে

মুসলমানদের সংখ্যা ৫৮ মিলিয়নে দাড়াবে। ২০১০ সালের হিসেবে দেখা যায় ইউরোপে মুসলমান জনসংখ্যা ছিল ৪৪.১ মিলিয়ন। ইউরোপে মুসলমানদের সংখ্যা বেশী বৃদ্ধি পাবে ফ্রান্স, জার্মীনী ও নেদারল্যান্ডে। তবে সম্ভবত উত্তর আমেরিকায়ই মুসলমানদের সংখ্যা বেশী বৃদ্ধি পাবে। কারণ হিসেবে চবি Pew Research Center Forum  এর কর্মকর্তা কুপারম্যান বলেন, এখানকার মুসলমান ইমিগ্রেন্টদের প্রজনন ক্ষমতা এবং অল্প বয়স এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

তবে এই বৃদ্ধিকে অনেকে সুনজরে দেখবে না এমনই আশংকা কানাডিয়ান ইসলামিক কংগ্রেসের ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ওয়াহিদা ভেলিয়ানেটির। তিনি বলেন “এই তথ্যকে মুসলমান বিরোধী প্রচারণায় ব্যবহার করা হবে।”

উল্লেখ্য যে, কানাডা যদিও ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় মাপের জঙ্গী হামলার শিকার হয়নি তবু এখানে মুসলমানদের উপস্থিতিকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে কোন কোন গোষ্ঠি। ফলে মুসলমানরা সত্যিকার অর্থে এখানে অন্যান্য ধর্মাবলম্বিদের মতো সহজভাবে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিতে পারছেন না। একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি সবসময়ই তাদের মনের মধ্যে কাজ করে।

২০১৩ সালের গোড়ার দিকে লন্ডনের অক্সফোর্ড ইউনিয়ন একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যার শিরোনাম ছিল, “এই সভা বিশ্বাস করে ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম।”বিতর্কে অংশ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। এর মধ্যে একজন ছিলেন বৃটেনের ন্যাশনাল সেকুলার সোসাইটির সদস্য এ্যানি  মেরী ওয়াটার্স। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদের বিষয়টি বাস্তব অবস্থার নীরিখে বিচার করতে হবে। ধর্মগ্রন্থে আদর্শ নিয়ে কি লেখা আছে তা দিয়ে বিচার করলে হবে না। তিনি বিভিন্নস্থানে জঙ্গীদের হামলার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, এই ধর্মেই আছে জেন্ডার বৈষম্য, আছে জোরপূর্বক বিয়ের রীতি ইত্যাদি। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, ধর্মের নিন্দা করলে বা কোন মুসলমান স্বধর্ম ত্যাগ করলে তাকে কঠিন বিচারের সম্মুখীন হতে হয় যার মধ্যে আছে মৃত্যুদন্ডও। এ সকল তথ্য প্রমান করে যে ইসলাম সম্পূর্ণভাবে একটি শান্তির ধর্ম নয়।

বিতর্ক অনুষ্ঠানে এ্যানি  মেরী ওয়াটার্স এর এ বক্তব্য শুনে হাফিংটন পোস্ট এর সাংবাদিক মেহেদী হাসান প্রশ্ন রাখেন, যদি ইসলাম ধর্মে হত্যাকে প্রশ্রয় দেওয়া হতো তবে এ অল্পসংখ্যক লোক (যারা জঙ্গী হিসেবে চিহ্নিত) কেন এই কাজটি করছে? তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের কি মনে হয় ১.৬ বিলিয়ন মুসলমান সবাই জঙ্গীবাদের সমর্থক?

বিতর্ক অনুষ্ঠান শেষে ভোটাভুটিতে দেখা দেখা গেছে ইসলাম শান্তির ধর্ম এই বক্তব্যের পক্ষে ২৮৬ টি ভোট পড়েছে এবং ইসলাম শান্তির ধর্ম নয় এই বক্তব্যের পক্ষে ভোট পড়েছে ১৬৮টি।

কানাডায় মুসলমানদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা থাকলেও ২০০৬ সালে Environics Institute  পরিচালিত জরীপে দেখা গেছে কানাডায় মুসলমানরা এখানকার মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চায় এবং কানাডায় আসতে পেরে তারা খুশী। কিন্তু সেই মুসলমানদেরই যদি সন্দেহের চোখে দেখা হয়, তাদের উপর যদি হামলা চালানো হয়, তাদের মসজিদ যদি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন তাদের মানসিক অবস্থাটি কি হতে পারে?

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই মুসলমানদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে কিছু জঙ্গী অথবা জঙ্গী সমর্থক। কানাডার ম্যাগডোনাল্ড লরিয়ার ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত সম্প্রতিক এক জরীপ রিপোর্ট থেকে জানা যায় “কানাডার শতকরা ৬৫ ভাগ মুসলমান ইসলামী জঙ্গী সংগঠনের কার্যক্রম পছন্দ করেন না। তবে শতকরা ৩৫ ভাগ মুসলমানের সমর্থন রয়েছে ইসলামী জঙ্গী সংগঠনগুলোর কার্যক্রমের পক্ষে। যা মোটেও সুখকর নয়। বেশীরভাগ কানাডীয় মুসলিম জঙ্গীবাদের বিপক্ষে থাকলেও শতকরা ৩৫ ভাগ রয়েছে এর পক্ষে।”

উপরের তথ্য উপাত্ত থেকে আমরা যা দেখতে পাই তা হলো কানাডায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস, ঘৃণা ও ভীতি ক্রমাগত বাড়ছে। কানাডার বাইরে আই এস জঙ্গীরা ইসলাম ধর্মের নামে যা করছে সেটিও এই অবিশ্বাস, ঘৃণা ও ভীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে ইন্ধন যোগাচ্ছে। সেই সাথে আছে কানাডার রক্ষণশীল রাজনীতিকদের ভূমিকা এবং ইমিগ্রেন্ট বিরোধী গোষ্ঠিসমূহের অপপ্রচার।

কিন্তু কানাডায় খোদ মুসলমানদের কি কোন দোষ নেই এই অবিশ্বাস, ঘৃণা ও ভীতি তৈরীতে? এই প্রতিবেদনের শুরুতেই এক জরীপ রিপোর্টে আমরা দেখেছি “মুসলমানদের এই পরিনতির জন্য কারা দায়ী এমন প্রশ্নের উত্তরে ৪২% কানাডিয়ান উত্তর দিয়েছেন এই বলে যে, এ জন্য মুসলমানদের কর্মকান্ডই দায়ী।”

মুসলিম কানাডিয়ান কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা তারেক ফাত্তা ইতিপূর্বে এক বক্তব্যে বলেন, কতক মুলমান আছেন যারা কানাডায় আসেন একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। আর এ উদ্দেশ্য হলো এখানকার সৌহার্দপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া। তিনি এদেরকে মুসলমান না বলে ‘ইসলামিস্ট’হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

বিভিন্ন তথ্য থেকে দেখা যায় – জঙ্গীপনার দিকে ঝুঁকে আছেন এরকম বেশকিছু তরুন ও যুবক রয়েছেন কানাডায়। সরকারী লিস্টেই আছে ৯০ জনের বেশী। তাদের উপর রয়েছে কড়া নজরদারী। তারা যাতে দেশের বাইরে গিয়ে ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে যুক্ত না হতে পারেন তার জন্য অনেকের পাসপোর্টও আটক করা হয়েছে।

আরো লক্ষনীয় যে, আগে কানাডার মুসলিম নেতৃবৃন্দ বা মুসলিম আলেমগণের মধ্যে দুইএকজন ছাড়া বাকিদের কেউ এই জঙ্গীদের বিরুদ্ধে তেমন কোন উচ্চবাচ্য করতেন না। তারা জঙ্গীদের প্রকাশ্যে সমর্থন দিতেন না, কিন্তু বিরোধিতাও করতেন না। যেন একধরণের নিরব সমর্থন দিয়ে আসছিলেন। এমনি একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন চলতে হয়েছে কানাডার মুসলমানদেরকে। তবে গত দুই তিন বছর যাবত তাদেরকে ক্রমশ জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা গেছে। অনেকেই মনে করেন, এই জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে তারা যদি আরো আগে থেকেই কঠোর ভাবে প্রতিবাদী হয়ে উঠতেন তবে বিষয়টি হয়তো আজকের পর্যায়ে এসে ঠেকতো না।

ইসলামিক সুপ্রিম কাউন্সিল অব কানাডার প্রেসিডেন্ট সৈয়দ সোহরাওয়ার্দী ইতিপূর্বে কানাডার সিবিসি নিউজকে বলেন, “এক দশক আগের চেয়ে এখন স্থানীয় তরুণদের মৌলবাদী হয়ে উঠার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। ”

এর সাথে আরো আছে নেকাব পরা নেয়ে বাড়াবাড়ি, অনার কিলিং এর মতো জঘন্য অপরাধ, মূল সমাজ ব্যবস্থা থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখার সংকীর্ণতা ইত্যাদি।

এ কারণে অনেকেই মনে করেন, এই যদি হয় পরিস্থিতি তবে কানাডায় সাধারণ মানুষের মধ্যে মুসলমান বিরোধী মনোভাব কেন গড়ে উঠবে না? অবিশ্বাস, ঘৃণা ও ভীতি কেন জন্ম নিবে না? সুযোগতো বাস্তব অর্থে মুসলমানরাই করে দিচ্ছেন। এই অবস্থায় কানাডায় মুলমানদের ভবিষ্যত যদি সঙ্কটাপন্ন হয় তবে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।

বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখন কানাডার মুসলমানদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে মুসলমানরা কতটা আগ্রহী? টরন্টো প্রবাসী বিশিষ্ট পন্ডিত ও লেখক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান স্ট্র্যাটফর-এর মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক উপদেষ্টা কামরান বোখারী তার এক লেখায় বলেন, ‘‘ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ড যারা চালায় তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করার পরও বেশিরভাগ মুসলমান তাদের মধ্যে অবস্থানরত এধরণের জঙ্গীদের বিরুদ্ধে সক্রিয় তৎপরতায় অংশ নিতে অনিচ্ছুক।’’

তিনি আরো বলেন, “আইন প্রয়োগকারীদের যত ক্ষমতাই দেয়া হোক না কেন তাতে চরমপন্থার সমস্যা সমাধান করা যাবে না। … আমরা কানাডার মুসলিম কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে যারা ধর্মীয় বিষয় নিয়ে চর্চা করেন তাদের তরফ থেকে এমন একটি দীর্ঘমেয়াদি মুসাবিদার জন্য অপেক্ষা করছি যাতে সাহস ও সৃজনশীলতার ছাপ থাকবে। ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’এধরণের বিবৃতি এবং নিন্দাবাদ যথেষ্ট নয়।”

কামরান বোখারীর মতে, “চরমপন্থীদের ব্যখ্যার বিরুদ্ধে কার্যকর পাল্টা বক্তব্য উপস্থাপন করা কানাডীয় মুসিলমানদের বৃহত্তর স্বার্থের জন্যই জরুরী। কারণ তারা যদি চরমপন্থার বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন তাহলে তারা সরকারের পক্ষ থেকে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখোমুখি হবেন যা পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে ঠেলে দেবে।”

তবে কানাডায় ইসলাম বিরোধী মনোভাব পরিবর্তন করতে হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এমনটাই মনে করেন এখানকার মুসলমান নেতৃবৃন্দ। ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিম এর নির্বাহী পরিচালক এহসান গার্দি’রও একই অভিমত।