কানাডা আমার সেকেন্ড হোম : ববিতা

এফডিসিতে গেলে এখন কান্না পায়-একসময় এখানে প্রতিভার বিকাশ ঘটতো,সৃষ্টি হতো-এখন সৃষ্টি নেই আছে অনাসৃষ্টি

জানুয়ারী ১২, ২০১৬

রেজাউল হাসান ॥ উপরের কথাগুলো আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন চিত্র তারকা ববিতার। প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে ববিতা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সাম্প্রতিক অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তার এই আক্ষেপের কথা বলেন। ববিতা বলেন, আমি তো ছবিতে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম-সেই আমার পুতুল খেলার বয়স থেকেই। আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল কিংবদন্তির সেই সব পরিচালকদের সাথে যেমন-এহ্তেশাম, কাজী জহির, খান আতাউর রহমান, জহির রায়হান, মিতা, কামাল আহমেদ,সুভাষ দত্ত, আমজাদ হোসেন -যারা এক সময় পাকিস্তান ও ভারতের দুর্দান্ত প্রতাপ রুখে দিয়ে বাংলায় ছবি নির্মাণ করে চলচ্চিত্র শিল্পের ধমণীতে রক্ত সঞ্চালন করেছিলেন। সমৃদ্ধ করেছিলেন এই শিল্পকে। তখন এঁদের ছবি মুক্তি পাওয়া মানেই সিনেমা হল হাউজফুল।

ববিতা বলেন, সবচে’ আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে-যে বাংলা ভাষার জন্যে আমাদের এতো সংগ্রাম-এতো রক্ত ঝরানো, কষ্ট লাগে এখন ছবির যে সংলাপ-তা এতোই বিজাতীয় যে-সেখানে আর আমার মায়ের ভাষাকে আর খুঁজেই পাওয়া যায়না।

ববিতা বলেন, আমি একজন শিল্পী, যুক্ত থাকতে চাই শিল্পের সঙ্গেই-কিন্তু যেসব চরিত্রের জন্যে অফার পাই তাতে সৃষ্টির কোন আনন্দ নেই-তাই এমনও হয়েছে যে সাইনিং মানি নিয়েও পরে তা ফেরত দিয়ে দিয়েছি।

ওয়াটারলুতে কনভোকেশন অনুষ্ঠানে মা ববিতার সঙ্গে ছেলে অনিক

অতি সম্প্রতি স্বল্প সময়ের জন্যে ববিতা এসেছিলেন কানাডায়। তার একমাত্র ছেলে ওয়াটার লু ইউনির্ভাসিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অধ্যায়নরত অণীক ইসলামকে সঙ্গ দিতে। তার ছেলে ২০০৮ সাল থেকে এখানে পড়ছেন। ২০১৩ সালে ডিস্টিংসনসহ গ্র্যাজুয়েশনের পর সম্প্রতি মাস্টার্স ও শেষ করেছেন। গ্র্যাজুয়েশনে অণীকের এই কৃতিত্বের বিষয়টি মিডিয়ারও নজর এড়ায়নি। ২০১৩ সালের ১১ জুন  টরন্টো স্টারের সংখ্যায় ববিতা ও অণীকের যুগল ছবি ছাপিয়ে রিপোর্টার জেসিকা ম্যাকডিয়ারমিড বিষয়টি কভার করেছিলেন। সেখানে জেসিকা উল্লেখ করেন, দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন নায়িকা ববিতার একমাত্র তনয় অণীক ইসলামও মায়ের মতোই দীপ্তিমান।

ববিতা তার ছেলেকে দেখতে বছরে দু’বার তিনবার কানাডায় আসেন। নিজের হাতে ছেলেকে রান্না করে খাওয়ান। ববিতা ঢাকায় বাস করেন গুলশানের অভিজাত এলাকায়-যেখানে তার পক্ষে রাস্তায় বেরুনো দুস্কর-রাস্তায় তাকে একা পেয়ে তার অগণিত ভক্তরা তাকে ছেঁকে ধরবে-তাই তাকে সেখানে চলতে হয় নিজেকে আড়াল করে আর এখানে তার সেই অসুবিধে নেই। দেশে তার পক্ষে প্রাইভেট কার ছাড়া চলাচল অসমম্ভ হলেও এখানে তিনি টিটিসি কিংবা সাবওয়েতে নির্বিঘেœ চলাফেরা করেন। অবশ্য  এতো বড় একজন নায়িকা তার পক্ষে এভাবে নির্বিঘেœ চলাফেরা করাও কি সম্ভব! ভক্তরা তাকে ঠিকই চিনে ফেলে এবং তার সাথে ছবি তুলতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। অবশ্যই ববিতা হাশি মুখে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান।

সাক্ষাতকারে অণীক তার মায়ের জন্যে তার গর্বের অনুভ ূতির কথা জানান।

বিষয়টি ববিতাকে জানালে তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। বলেন, ইট ওয়াজ অ্যা গ্রেট ইভেন্ট। টরন্টো স্টারে আমাদের ইন্টারভিউ দেখে অনেকেই চোখ কপালে তুলে বলেছিলেন,বাব্বা-টরন্টো স্টারের মতো পত্রিকায় কি সুন্দর কভার করেছে আপনাদেরকে! ববিতা বলেন, সেবারে আমি কনভোকেশনে এসেছিলাম। টরন্টো স্টারের রিপোর্টার আমাদেরকে ঠিকই খুঁজে বার করেছে। সে সময় আমরা আমাদের এক আতœীয়ের বাসায় ছিলাম। টরন্টো স্টার থেকে ফটোগ্রাফার এসে মনে আছে-পার্কিং লটে অনেক ছবি তুলেছিল।

পরিচালক সত্যজিত রায়ের সঙ্গে ববিতা

ববিতা বলেন, এখন তো আমার এই ছেলেই সব। ওর কাছে আসি। খুঁজে খুঁজে হালাল মাংস কিনে ওকে রান্না করে দিয়ে যাই।

তাকে প্রশ্ন করি-আপনি রান্না করতে পারেন?

ববিতা হাসতে হাসতে বলেন, এতো মেয়েদের সহজাত ধর্ম। আপনারা তো জানেন না, আমার বাসায় একটা ছোট্ট সুন্দর অনুপম এলাকা সৃষ্টি করেছি। ছোট্ট একটি বাগান, মাটির চুলো, মাটির হাঁড়ি চেলা কাঠ সবই আছে সেখানে। আমি খুবই সুন্দর সময় কাটাই সেখানে।

-কিন্তু আপনি একজন প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী, অভিনয় থেকে কিভাবে নিজেকে গুঁটিয়ে রেখেছেন?

ববিতা বলেন, কিন্তু যেখানে আমার করার কিছু নেই সেখানে থাকিই বা কি করে? আমি তো প্রায় পৌনে তিন’শ ছবি করেছি। বাণিজ্যিক ছবিও যেমন করেছি তেমনি বিনে পয়সায় আর্ট ফিল্মেও অভিনয় করে দিয়েছি। দেশে বিদেশে কতো এওয়ার্ড পেয়েছি। আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভালে জুরি হয়েছি। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতেও অভিনয় করেছি-এটা তো আমার এচিভমেন্ট-সেটা এ সময়ে এসে নষ্ট করি কিভাবে! তখন তো আপনারাই বলবেন-ববিতা এসব কি করছেন! অবশ্য এবার দেশে ফিরে গিয়ে কিছু ছবিতে অভিনয়ের ব্যাপারে চুিক্ত বদ্ধ হতে পারি। বেশ প্রেশার আছে।

-ছবি পরিচালনায় আসবেন নাকি? কবরী তো ইতোমধ্যে পরিচালিকার খাতায় নাম লিখিয়েছন!

ববিতা বলেন,হ্যাঁ  শুধু কবরী নন, আমাদের সমসাময়িক নায়িকারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। আমার বোন সুচন্দা আপা ছবি বানিয়েছেন। আমিও ছবি প্রযোজনা করেছি কিন্তু পরিচালনার বিষয়টি তো সহজ নয়। বিভিন্ন চ্যানেল থেকে আমাকে বলেছে-আপনাকে কিছুই করতে হবেনা, আমরাই সব কিছু করে দেব-শুধু আপনার নামটা যাবে। আমি সবিনয়ে তাদের সেসব অফার ফিরিয়ে দিয়েছি। আমি মনে করি শুধু ক্যামেরা একশন কাট বলতে পারলেই পরিচালক হওয়া যায় না-পরিচালককে অনেক কিছু জানতে হয়। সবাইকে দিয়ে তো সব কিছু হয়না-আমি অভিনয় পারি-অভিনয়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করি-পরিচালনায় নয়। শিখছি-যদি মনে করি হ্যাঁ এখন আমি পারবো-তখন নিশ্চয়ই ছবি বানাবো।

পরিচালক জহির রায়হানের সঙ্গে ববিতা

-আপনি একবার বলেছিলেন, ডিজিটাল মুভির ব্যাপারে আপনি কনফিউজড!

ববিতা বলেন, হ্যাঁ বলেছিলাম, ওরা ডিজিটাল ছবির নামে আশলে নাটক বানায়। নাটক আর চলচ্চিত্র তো এক নয়। দর্শকরা হলে যায় ছবি দেখতে। নাটক দেখতে নয়। আর আমিও অবশ্য এতে পরিচালকদের তেমন একটা দোষ দেইনা। ছবি বানানো তাদের পেশা-এটা তাদের রুটি রুজি-তারা কি করবে! ছবিতে যারা লগ্নি করেন, তারাই বলে দেন গল্পটা কি হবে-ক’টা গান থাকবে-কে হবেন নায়ক নায়িকা-এখন পরিচালক যদি তার পেশায় থাকতে চান তবে তো প্রযোজকের আজ্ঞাবহ হতেই হবে। আর গল্পও বলিহারি কি সব মাদ্রাজি- হিন্দি ছবির মিশেলে কি সব বানায় তাতে না থাকে দেশ না থাকে দেশের সংস্কৃতি। আবার শুনছি ভারতীয় ছবিও নাকি আসছে-তাতে অবশ্যই সকলের মতো আমিও আমাদের এই শিল্প নিয়ে শঙ্কিত।

ববিতা বলেন, এ শিল্পের সঙ্গে আমরা যারা জড়িত-আগে আমরা ছিলাম-একটা পরিবারের মতো। এখন আর সেই ফিলিংস নেই। ভাল কিছু সৃষ্টি করতে হলে অবশ্যই এই পারিবারিক ফিলিংসটা থাকতে হবে।

-ছবির সঙ্গে আপনি এখন তো আর সেইভাবে ইনভলভ্ নন-তা হলে আপনার সময়

কাটে কিভাবে? ববিতা বলেন, এখন আমি বিভিন্ন সেবা মূলক কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছি। যেমন এসিড সারভাইবার ফাউন্ডেশনের হয়ে কাজ করলাম অনেকদিন। আর এখন করছি আমেরিকা ভিত্তিক একটি এনজিও ‘ডিসট্রেস চিলড্রেন এ্যান্ড ইনফেন্ট ইন্টারন্যাশনাল’-এর হয়ে। এদের হয়ে বিভিন্ন দেশে যাই-বিত্তবানদের বলি, তোমরা এই হতভাগ্য শিশুদের পাশে এসে দাঁড়াও-তাতে কাজ হয়, বেশ সাড়া পাই।

ভক্তদের কৌতুহল,ভালবাসা খুবই উপভোগ করেন ববিতা। ছবিতে  ববিতার সঙ্গে দেখা যাচ্ছে টরন্টোর বাংলাদেশী  কমিউনিটির বিশিষ্ট রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদকে

ববিতার এই সাক্ষাতকারটি গ্রহন করা হয় টেলিফোনের মাধ্যমে। ড্যানফোর্থে মারহাবা গ্রোসারীর উপর তলায় প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের অফিসে এ বিষয়ে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। প্রতিবেশী রিয়েলটার, সুদর্শন নূর মোহাম্মদ আমাদের কথা বার্তা শুনে কৌতুহলী হয়ে উঠলেন। বললেন, ববিতাকে তো আমি সেদিন দেখেছি। আমরা কুইক লাঞ্চের জন্যে রিচমন্ড হিলের হোস্ট-এ ঢু মারলাম। ওয়েটার ছিলেন বাঙ্গালী। বললেন, ববিতা এখানে লাঞ্চ করছেন। আমরা তার কথা শুনে কৌতুহলী হয়ে উঠি। তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। শি নাইসলি এক্সসেপ্টেড আস। সুন্দর ইংরেজী বলেন। ছবি তুললেন আমাদের সাথে। সেলোফোন ঘেঁটে নূর মোহাম্মদ ছবিও বার করলেন।

টেলিফোনে ববিতার সঙ্গে সংযোগ হতেই আমরা হোস্ট এর ব্যাপারটি তুলি। ববিতা বললেন, হ্যাঁ ওখানে খেতে গিয়েছিলাম। যেখানেই যাই ভক্ত অনুরক্তরা ঘিরে ধরে-দেশের বাইরে আমার ব্যাপারে মানুষের এই কৌতুহল,ভালবাসা খুবই উপভোগ করি।

-কানাডা কেমন লাগে?

ববিতা বলেন, ৮০-এর দশকে কানাডায় এসেছিলাম যৌথ প্রযোজনার ছবি দূরদেশে অংশ নিতে। নায়াগ্রা ফলসেও আমরা সুটিং করেছি। তখন থেকেই কানাডা আমার প্রিয়। আর এখন তো এখানে আমার ছেলে থাকে কানাডায়। বলতে পারেন-কানাডা এখন আমার সেকেন্ড হোম। কিন্তু সবচে’ প্রিয় হচ্ছে আমার দেশ। কি সুন্দর আমাদের দেশটা। দেশ ছেড়ে আমি খুব বেশী দিন বাইরে থাকতে পারিনা। দেশে যে সম্মানটা পাই-সেটা আমি সব সময়ই খুব গুরুত্ব দেই। ফিতে টিতে কাটতে ডাকে-ইঁটস আ্য গ্রেট অনার।

-আপনার ছেলে কি বিয়ে থা করেছে?

ববিতা হাসতে হাসতে বললেন, না না ওর তো মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়স। পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত। এখন জানিনা-ওর কাগজ হয়তো এখানে হয়ে যাবে। ও যদি এখানে থাকতে চায় থাকবে-দেশে ফিরতে চাইলেও ফিরবে। এটা সম্পূর্ণই ওর ব্যাপার। এ ব্যাপারে আমার কোন মত নেই। ওর ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে।

সবশেষে ববিতা বললেন, আমাদের চলচ্চিত্র এখন মেধাশূণ্য হয়ে পড়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী মেধাবানরা আমাদের এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হবেন। আবার সুবাতাস বইবে আমাদের এই অঙ্গণে।

-প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ববিতার ছবিটি যায় যায় দিন থেকে সংগৃহীত