যারা সঙ্গীত ভালবাসে না তারা ভালবাসতে জানে না : শান্তা
মার্চ ১৯, ২০১৫
মাত্র চার বছর বয়সে মা ও ছোট ফুপু’র কাছে সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয় ফারহানা শান্তার। সরকারী কর্মকর্তা বাবা’র চাকুরীর সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে অবস্থান করতে হয়েছে শান্তাকে। ঐ সময়ে বিভিন্ন গানের স্কুলে গান শেখা ছাড়াও বাড়িতে গানের শিক্ষকের কাছে নিয়মিত গানের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। বাবার মৃত্যুর পর রাজশাহী শহরে দাদা বাড়িতে অবস্থানকালে উস্তাদ ফায়জুর রহমান (প্রয়াত) এর কাছে দীর্ঘ ছয় বছর রবীন্দ্রসঙ্গীত ও উচ্চাংগ সঙ্গীতে তালিম নেন। ১৯৯১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের লক্ষ্যে ঢাকাস্থ সরকারী সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হন। ১৯৯৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধীনস্থ সরকারী সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় থেকে মেধাতালিকায় ২য় স্থানসহ বি মিউজিক ডিগ্রী অর্জন করেন। সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ কালীন সময়ে বাংলাদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সাদি মহম্মদ, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী খালেদ হোসেন, উচ্চাংগ সঙ্গীত শিল্পী শামীমা পারভীন, লোকসঙ্গীত শিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশীসহ আরো অনেক গুনীজনের কাছে হাতে-কলমে সঙ্গীতশিক্ষা লাভ করেন।
ফারহানা শান্তা ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে অবস্থানকালে বাংলাদেশী কমিউনিটির বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন ও বিভিন্ন অন্ষ্ঠুানে সঙ্গীত পরিবেশন করে যথেষ্ঠ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ২০০৫ সাল থেকে ফারহানা শান্তা পরিবার সহ কানাডায় অভিবাসন নিয়ে টরন্টো শহরে বসবাস করছেন। টরন্টো বাংলা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একজন নিবেদিত কর্মী ছাড়াও ফারহানা শান্তা সাংস্কৃতিক সংগঠন ক্বণন, অন্য থিয়েটার টরন্টো ও ধ্রুপদ এর অন্যতমসদস্য হিসাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করে আসছেন। ২০১২ সালের মার্চ মাসে “কন্ঠে নিলেম গান” শীর্ষক ফারহানা শান্তা’র একক সঙ্গীত সন্ধ্যা দর্শক-শ্রোতাদের অকুন্ঠ প্রশংসা অর্জন করে। তার-ই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে “ভাব” (ঠড়ষঁহঃববৎং অংংড়পরধঃরড়হ ড়ভ ইধহমষধফবংয) এর তহবিল সংগ্রহের জন্য টরন্টো শহরে প্রথমবারের মত সফলভাবে আয়োজন করে ফারহানা শান্তা’র একক সঙ্গীতসন্ধ্যা। ফারহানা শান্তা’র এই সেচ্ছাসেবক উদ্যোগ টরন্টো বাংলা কমিউনিটিতে এক বিরল দৃষ্টান্ত, যা সবার প্রশংসা অর্জন করে।
২০১০ সালে রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী সাদি মহম্মদের নির্দেশনায় ফারহানা শান্তা’র প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের একক এলবাম “সীমার মাঝে অসীম” বের হয়, যা শ্রোতামহলে খুব-ই সমাদৃত হয়। ২০১৩ সালে ভারতের প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী নচিকেতা’র কথা, সুর ও নির্দেশনায় আধুনিক গানের এলবাম “ডিঙ্গা ভাসাও” বের হয়। এ বিষয়ে শান্তা তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, “নচিকেতা দাদা’র মৎ আকজন উঁচুমানের সঙ্গীতজ্ঞ আমার জন্য পুরো একটি এলবামের গান লিখেছেন, সুর করেছেন এবং পরিচালনাও করেছেন। নচিকেতা এই প্রথম কোলকাতা’র বাইরের কোন শিল্পী’র জন্য পুরো একটি এলবামের কাজ করেছেন। সেইদিক থেকে আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করি।”
তাছাড়া স্বনামধন্য সঙ্গীত পরিচালক দুর্বাদল চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় ফারহানা শান্তার দ্বিতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের এলবাম “সার্থক জনম” বের হয়। ব্যক্তিগত জীবনে ফারহানা শান্তা টরন্টো শহরে একজন দন্ত চিকিৎসকের প্রধান সহকারী হিসাবে কর্মরত। স্বামী মনির বাবু একজন চাকুরীজীবী। তিনি টরন্টো’র একজন পরিচিত সাংস্কৃতিক কর্মী, অনুষ্ঠান সংগঠক, টরন্টো’র কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত এবং শখের ফটোগ্রাফার। তাঁদের প্রথম দেখা হয়েছিল এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেই থেকে জানাশুনা, প্রণয় এবং উভয় পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে। ২৩ বছরের দাম্পত্য জীবনে তাঁদের রয়েছে দুই সন্তান, অর্ক ও মাধবী। মেয়ে গান করে । ছেলে কিবোর্ড বাজায়। মিথুন রাশির জাতক ফারহানা শান্তা’র আজীবন লালিত স্বপ্ন সঙ্গীতে নিজেকে নিবেদন করা ।
প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে জনপ্রিয় ও গুণী এই কন্ঠ শিল্পী ফারহানা শান্তার একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় সম্প্রতি। সাক্ষাৎকারটি এখানে পত্রস্থ করা হলো:
প্রশ্ন : গানের শিল্পী না হয়ে অন্য কিছুও তো হতে পারতেন। যেমন অভিনেত্রী, চিত্র শিল্পী, খেলোয়ার বা আবৃত্তি শিল্পী। গানে এমন কি আছে যা আপনাকে এই মাধ্যমে টেনে এনেছে?
উত্তর : আমার দাদু’র বাড়ির পারিবারিক পরিবেশ সাংস্কৃতিক চর্চ্চার অনুকুলে থাকায় ছোটবেলাতেই গান শিখতে শুরু করি। তারপর যখন বড় হই তখন বলতে গেলে গানের প্রেমে পড়ে যাই । তাই গান শেখা ছাড়া আর অন্য কিছু করা বা শেখার কথা চিন্তাও করিনি ।
প্রশ্ন : আপনি কি ধরনের গান বেশী পছন্দ করেন বা গাইতে ভালবাসেন?
উত্তর : লোকগীতি, পুরোনো দিনের আধুনিক গান করতেও ভালোবাসি ।
প্রশ্ন : আপনার প্রিয় শিল্পী কে?
উত্তর : অনেকেই । তার মধ্যে সাদি মহম্মদ, সাবিনা ইয়াসমীন, নচিকেতা, ইন্দ্রানী সেন, জয়তী চট্টোপাধ্যায়, লোপামুদ্রা, শুভমিতা অন্যতম।
প্রশ্ন : টরন্টোতে আপনি নিয়মিত স্টেজ পারফরমেন্স করে থাকেন। এখানকার দর্শকরা কতটা সমঝদার বলে মনে হয়?
উত্তর : সত্যি কথা বলতে কি স্টেজ পারফরমেন্স করে প্রকৃত পক্ষে সমঝদার শ্রোতা বিচার করা খুব দুরুহ। ওখানে বিভিন্ন রুচি ও বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের শ্রোতারা আসেন। এদের একেকজনের একেক রকম ডিমান্ড । তবে আমি অনেক ঘরোয়া বা সীমিত দর্শকদের অনুষ্ঠান করে থাকি সেখানে আমি অনেক সমঝদার শ্রোতা পাই । টরন্টো শহরে যেমন আছে অনেক গুণী শিল্পী তেমনি আছে অনেক বোদ্দা বা সমঝদার শ্রোতা ।
প্রশ্ন : কানাডার বিভিন্ন শহরে বাঙ্গালীরা নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। দেখা গেছে এই সব অনুষ্ঠানে, বিশেষত বড় বড় অনুষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশ থেকে শিল্পী আনার জন্য বিশাল অংকের বাজেট করা হয়। অথচ আমরা জানি এই প্রবাসেই অনেক গুনী শিল্পী আছেন যারা এখানে মঞ্চ মাতাতে পারেন। কিন্তু তাদের কদরটা এখানে ঠিকমত হয় না। এব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া বা পরামর্শ কি?
উত্তর : এটা অনেকাংশেই সত্যি। যতই জনপ্রিয় বা গুনী শিল্পীই হোক না কেন এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার পর সেই শিল্পী হয়ে যায় লোকাল, তার প্রতি কেন যেন দর্শক শ্রোতারা বা উদ্যোক্তরা আকর্ষন হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া আমরা বাঙ্গালীরা ট্র্যাডিশনালী বিদেশের প্রতি আমাদের মোহ একটু কেন যেন বেশী। একজন শিল্পী যখন এখানে বসবাস করেন তখন তিনি হয়ে যান লোকাল আর বাংলাদেশ থেকে শিল্পী এলে হয় বিদেশী ।
প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন প্রবাসে আমাদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্ম বাঙ্গালী কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ধরে রাখবে বা রাখতে পারবে? কেন মনে করছেন বা কেন মনে করছেন না? এ ব্যাপারে আমাদের করনীয় কি?
উত্তর : এটা নেকটা নির্ভর করে এ দেশের ইমিগ্রেশন পলিসির উপরও । যদি অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এবং ভারত থেকে বাংলা ভাষী নতুন ইমিগ্রেন্ট আশা বন্ধ হয়ে যায় তবে আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম হয়তো বাঙ্গালী কৃষ্টি ও সংস্কৃতি কিছুটা ধরে রাখতে পারবে তারপর আস্তে আস্তে হারিয়ে যাবে। আর যদি এ দেশের ইমিগ্রেশন পলিসি আগের মতই থাকে মানে সবসময় ধারাবাহিকভাবে নতুন নতুন বাংলা ভাষী ইমিগ্রেন্ট আসতে থাকে তবে আমাদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্ম বা তার পরের আরো অনেক প্রজন্মও বাঙ্গালী কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ধরে রাখবে।
প্রশ্ন : গান নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
উত্তর : এখানে নিজের প্রফেশনাল কাজ, বিভিন্ন শহরে এবং অনুষ্ঠানে গান গাইতে যাওয়া ও সংসারের কাজের পর অনেক পরিকল্পনা থাকা সত্তেও কোনটাই এখন আর জোর দিয়ে ভাবছি না। তবে আবার দেশে বেড়াতে গেলে আরো কইয়েকটি গানের এলবাম করার পরিকল্পনা আছে ।
প্রশ্ন : সঙ্গীত সাধনা বা চর্চার ব্যাপারে আপনি আপনার স্বামীর কাছে থেকে কতটা সহযোগিতা বা সহানুভূতি পান? নাকি পানই না?
প্রশ্ন : ওর কাছ থেকেই সব চেয়ে বেশী উৎসাহ, সহযোগিতা ও অনুপ্রেরনা পাই । ও আমার গানের সবচেয়ে বড় সমালোচক ও পরামর্শদাতা ।
প্রশ্ন : অবসরে আপনি কি করেন?
উত্তর : গানের রেওয়াজ করি, পারিবারিক আড্ডা, গান শুনি, বই পড়ি ।
প্রশ্ন : প্রিয় হবি কি?
উত্তর : গান শোনা, রান্না করা, বেড়ানো।
প্রশ্ন : প্রিয় লেখক কে বা কারা ?
উত্তর : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ইমদাদুল হক মিলন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
প্রশ্ন : প্রিয় গ্রন্থ?
উত্তর : চানক্য সেনের পিতা পুত্রকে, সুনীলের প্রথম আলো, অর্জুন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত , ইমদাদুল হক মিলনের নুরজাহান।
প্রশ্ন : প্রিয় চলচ্চিত্র?
উত্তর : চারুলতা, ঘরে-বাইরে, নায়ক – সত্যজিত রায়ের প্রায় সবছবিই আমার প্রিয় । ইদানিং কালের হিন্দী ছবি “পিকে” খুব ভালো লেগেছে ।
প্রশ্ন : প্রিয় অভিনেতা/অভিনেত্রী কে বা কারা?
উত্তর : আমির খান, উত্তম কুমার ,অপর্ণা সেন, সুচিত্রা সেন, ববিতা, রাজ্জাক, সুবর্ণা, আফজালসহ আরো অনেকে ।
প্রশ্ন : “যারা সঙ্গীত ভালবাসে না তারা মানুষ খুন করতে পারে”- মন্তব্য করুন।
উত্তর : যারা সঙ্গীত ভালবাসে না তারা ভালবাসতে জানে না ।
প্রশ্ন : ‘সঙ্গীত ছাড়া ফারহানা শান্তা’ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন।
উত্তর : ডাঙ্গায় মাছ।