মুসলিম নারীদের নেকাব পরা নিয়ে কানাডায় বিতর্ক ও রাজনীতি আবারো চাঙ্গা

মাচার্ ১৯, ২০১৫

খুরশিদ আলম ॥

গত ৬ ফেব্রুয়ারী কানাডার ফেডারেল কোর্ট মুসলিম নারীদের নেকাব পরা নিয়ে এক রায় প্রদান করেন। প্রদত্ত ঐ রায়ের কারণে এ বিষয়ে বিতর্ক আবারো চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। আর প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার ঐ বিতর্কে ঘি ঢেলে দিয়ে একে আরো বেগবান করে তুলেছেন। সেই সাথে লিবারেল নেতা জাস্টিন ট্রুডো, এনডিপি নেতা থমাস মুলকেয়ার এবং কানাডার মেইনস্ট্রিম পত্রিকাগুলোও পক্ষে বিপক্ষে নানা মন্তব্য ও তথ্য দিয়ে বিতর্কের এই বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলেছেন।

উল্লেখ্য যে, বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেসন কেনি ইমিগ্রেশন বিষয়ক মন্ত্রী থাকাকালে মুসলিম নারীদের নাগরিকত্বের শপথ গ্রহণের সময় নেকাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন ২০১১ সালে। পরবর্তীতে তিনি এ বিষয়ে টুইটারে স্ট্যাটাস দেন। টুইটারে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘আমার বিশ্বাস, নাগরিকত্বের শপথ গ্রহণকারীদেরকে শপথ নিতে হবে প্রকাশ্যে, তাদের মুখমন্ডল অনাবৃত থাকতে হবে।’’ তিনি ঐ স্ট্যাটাস দেন যখন শপথ অনুষ্ঠানে নেকাব নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা চলছিল।

বর্তমানে মিসিসাগায় বসবাসরত জুনেরা ইসহাক নামের একজন পাকিস্তানি মহিলা ওই নিষেধাজ্ঞার কারণে রক্ষণশীল দলের সরকারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন। তিনি তখন যুক্তি দেখান যে, তার ধর্মবিশ্বাসকে ধারণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ওই নিষেধাজ্ঞা তার অধিকারের সনদ লংঘন করেছে।

ইসহাককে স্পন্সর করে পাকিস্তান থেকে কানাডায় নিয়ে এসেছেন তার স্বামী ২০০৮ সালে। ২০১৩ সালে ইসহাক সিটিজেনশীপ পরীক্ষা পাশ করেন । কিন্তু পরবর্তীতে তিনি যখন নেকাব নিষিদ্ধ করার বিষয়টি জানতে পারেন তখন তিনি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ফেডারেল সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে বসেন। কিন্তু কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় হলো, তিনি তার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেয়ার জন্য কানাডায় আসার পর মুখমন্ডল উন্মোচন করেছিলেন। তখন তার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগেনি এবং পরপুরুষের সামনে মুখমন্ডল উন্মেচিত করার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে লাইসেন্স নিতে অস্বীকৃতি জানাননি। তিনি যখন পাকিস্তান থেকে কানাডা আসছিলেন তখন বিভিন্ন বিমান বন্দরে এবং কানাডার ইমিগ্রেশন দরজা পার হতে নিশ্চই তাকে একাধিকবার মুখের পর্দা সরাতে হয়েছিল। তখনও তিনি কানাডায় আসার ব্যাপারে আপত্তি জানাননি। জানালে নিশ্চই তিনি কানাডায় আসতে পারতেন না।

জুনেরা ইসহাক নেকাব পড়তে শুরু করেন ১৫ বছর বয়স থেকে। পরবর্তীতে তিনি আইডিয়েন্টিফিকেশনের জন্য বিভিন্ন সময় মুখমন্ডল উন্মোচন করেছেন। কিন্তু সিটিজেনশীপ পাওয়ার জন্য যখন তিনি মুখমন্ডল উন্মোচন করে শপথ নিতে অস্বীকৃতি জানান তখন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা তাকে শপথ গ্রহনের সময় একেবারে সামনের সিটে অথবা একেবারে পিছনের সিটে বসার প্রস্তাব দেন। কিন্তু তাতে তিনি রাজী হননি। তার যুক্তি ছিল- ইমিগ্রেশন জাজ বা অন্যান্য কর্মকর্তারা নারী না হয়ে পুরুষ হতে পারেন। তাছাড়া লোকজন সেখানে ছবিও তুলতে পারেন।

তবে জুনেরা ইসহাকের সৌভাগ্যই বলতে হবে। কারণ, কানাডার ফেডারেল আদালত তার পক্ষেই রায় দিয়েছেন। গত ৬ ফেরুয়ারী আদালত তার রায়ে বলেন, নাগরিকত্ব লাভের জন্য শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে কাউকে তার মুখের পর্দা উন্মোচন করতে বলাটা “অবৈধ”। সরকার এ বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করতে পারে না। আদালত অবিলম্বে এই আইন প্রত্যাহার করার জন্য ফেডারেল সরকারকে নির্দেশ দেন এবং জুনেরা ইসহাক যাতে মুখের পর্দা অপসারণ না করেই শপথ নিতে পারেন সেই ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দেন। তবে ফেডারেল সরকার ইচ্ছে করলে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে এবং আপিলে রায় যদি ফেডারেল সরকারের পক্ষে যায় তবে জুনেরা ইসহাককে হয় মুখমন্ডল উন্মোচন করতে হবে অথবা নাগরিকত্ব ছাড়াই এ দেশে বসবাস করতে হবে। অবশ্য ফেডারেল আপিল কোর্টের পর সুপ্রিম কোর্টের আরেকটি ধাপ রয়েছে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবার জন্য।

ইমিগ্রেশন মন্ত্রী ক্রিস আলেকজান্ডারের মুখপাত্র কেভিন মেনার্ড অবশ্য বলেন, কানাডায় যাঁরা নতুন নাগরিক হিসেবে শপথ নিবেন তাঁরা তাঁদের মুখায়বব শপথ অনুষ্ঠানে সর্বসমক্ষে প্রদর্শন করতে বাধ্য। তিনি বলেন, এটি একটি সাধারণ কান্ডজ্ঞানের বিষয় যে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে নিজের মুখ ঢেকে রাখাটা ন্যায়সঙ্গত নয়।

উল্লেখ্য যে, হিজাব, বোরখা বা নেকাব নিয়ে কানাডায় ইতিপূর্বেও অনেক বিতর্ক হয়েছে। সর্বশেষ বিতর্ক শুরু হয় ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে কুইবেক কোর্টের এক বিচারক এলিনা মারেঙ্গো যখন মুসলিম মহিলাদের হিজাব পরিধান নিয়ে বক্তব্য রাখেন। রানিয়া এলাউল নামের এক মুসলিম মহিলা কোর্টে গিয়েছিলেন তার গাড়িটি পুলিশের হেফাজত থেকে ছুটিয়ে আনার আবেদন নিয়ে। কিন্তু বিচারক তার আবেদন শুনতে রাজী হননি। কারণ ঐ মহিলার মাথায় হিজাব পরা ছিল। বিচারকের যুক্তি ছিল- কোর্টে রূমে কোন ধর্মীয় পোষাক পরা যাবে না। আইন অনুযায়ী মাথার হ্যাট বা সানগ্লাসও কোর্ট রূমে গ্রহণীয় নয়। কোর্ট রূমের কোথাও কোন ধর্মীয় চিহ্ন নেই।

রানিয়া এলাউল বিচারকের উদ্দেশ্যে বলেন, এটি আমার ধর্মীয় পোষাক। আমি এটি ত্যাগ করতে পারবো না। পরে তিনি আরো বলেন, আমি একজন কানাডিয়ান নাগরিক। কোথায় আমার অধিকার এবং বিচার?

মহিলা একজন সিঙ্গেল মাদার। তিন সন্তান নিয়ে থাকেন। তার গাড়িটি ঐ সন্তানদের একজন চালাতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পরে। তার লাইসেন্স সাসপেন্ডেড অবস্থায় ছিল।

হিজাবের ঘটনাটি মিডিয়াতে চলে আসার পর প্রধানন্ত্রীর অফিস থেকে এর বিরুদ্ধে বক্তব্য আসে। প্রধানমন্ত্রীর একজন মুখপাত্র বলেন, যদি কেউ মুখ ঢেকে না রাখে তবে তাকে কোর্ট রূমে তার বক্তব্য পেশ করতে দেওয়া উচিৎ। লিবারেল নেতা জাস্টিন ট্রুডো বলেন হিজাব পরার কারণে একজন মুসলিম মহিলার বক্তব্য শুনতে না চাওয়া গ্রহনযোগ্য নয়। এনডিপির নেতা থমাস মুলকেয়াল বলেন, বিচারক হিজাব পরার কারণে একজন মুসলিম মহিলার বক্তব্য শুনতে না চেয়ে ভুল করেছেন।

উল্লেখ্য যে, কানাডার ক্যালগারী মাউন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মাহফুজ ইতিপূর্বে বলেন, কোরআনের কোথাও লেখা নেই যে মহিলাদেরকে হিজাব পরতেই হবে। বোরখা, হিজাব নেকাব ইত্যাদি সৌদি আরবের আদিকালের সংস্কৃতি। ইসলামের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই।

অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি, নেকাব বা বোরখা পরাতো দূরের কথা, হিজাব নিয়েও ইসলামে তেমন বাড়াবাড়ির কথা নেই। কিন্তু আমরা দেখেছি ২০০৭ সালে মিসিসাগায় আকসা পারভেজ নামের এর তরুনীকে হিজাব না পরার কারণে তার বাবা ও ভাই মিলে তাকে হত্যা করে। ঐ সময় কানাডিয়ান কাউন্সিল অব ইমাম এর সহ-সভাপতি ও ইসলামী চিন্তাবিদ ড. মোহাম্মদ আলনাডুই বলেছিলেন, ইসলাম এটি সমর্থন করে না। হিজাব পরার জন্য আমরা আমাদের মেয়েদের বাধ্য করতে পারি না। যদি মেয়েরা নিজ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে হিজাব পরে সেটিই ভাল। একই সময় মিসিসাগায় অবস্থিত ইসলামিক সোসাইটি অব নর্থ আমেরিকার ইমাম শেখ আলা ই. সাঈয়েদ বলেছিলেন, হিজাব পরলে মহিলারা ইসলামে উচ্চতর আসনে আসীন হন সত্যি তবে এটি পরা না পরা সম্পূর্ণ মহিলাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, সাধারণ হিজাব (যেখানে মহিলাদের মুখমন্ডল উন্মোচিত থাকে) নিয়েই যদি ইসলাম ধর্মে কোন বাধ্যবাধকতা না থাকে তবে সেখানে বোরখা বা নেকাব নিয়ে কেন এতটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে?

আর এই বাড়াবাড়ির ফলাফলই বা কি দাড়াচ্ছে? লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, এতে ইসলামের উপকারের চেয়ে অপকারই হচ্ছে বেশী। পাশ্চাত্ত্যের দেশসমূহে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তৈরী হচ্ছে এক ধরণের ভীতি। সাধারণ মুসলমানরাই এখন ঐ ‘ইসলামিস্ট’ বা অতি মুসলমানদের ভয়ে অতিষ্ট থাকেন। আমরা আরো দেখছি কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ পশ্চিমের কোন কোন দেশে এক শ্রেণীর গোড়াঁ মুসলমান বোরখা ও নেকাব ছাড়া রাস্তায় বের হন না। আদালতে গিয়ে বা ভোট দিতে গিয়েও নেকাবে ঢাকা মুখ খুলতে চান না। অথচ অধিকাংশ মুসলিম দেশেই এই রেওয়াজ নেই। বোরখার এই ঘোমটা বা নেকাব শরীয়া আইনেরই বাধ্যবাধকতা। আজকে বাংলাদেশসহ আরো অনেক মুসলিম দেশ শরীয়া আইন ছাড়াই যদি শাসন ব্যবস্থা সচল রাখতে পারে তবে সে ক্ষেত্রে কানাডাসহ পাশ্চাত্যের গুটি কতক দেশে বোরখা বা নেকাব পরা নিয়ে নিয়ে একশ্রেণীর মুসলমানদের এই বাড়াবাড়ির কোন যুক্তি আছে কি?

এদিকে নেকাব বিষয়ে ফেডারেল কোর্টের রায় ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার বলেছেন তাঁর সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে। গত ১২ ফেব্রুয়ারী কুইবেকের ভিক্টোরিয়াভিলে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি একটি অগ্রহণযোগ্য প্রথা। আমার বিশ্বাস অধিকাংশ কানাডিয়ান মনে করেন যে নাগরিকত্বের জন্য শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে নিজের পরিচয় গোপন রাখাটা আপত্তিকর বা অপরাধমূলক আচরণ। তিনি আরো বলেন, আমরা একটি স্বচ্ছ সমাজে বাস করি যেখানে সকলেই সমান।

নেকাব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য প্রচারের পর অবশ্য প্রশ্ন উঠেছে তাঁর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে। তিনি কি আসলেই নেকাব নিষিদ্ধ করার পক্ষে নাকি এই নেকাব নিয়ে নতুন কোন রাজনীতি শুরু করেছেন?

সমালোকচরা বলছেন, আগামী ১৯ অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে কুইবেকের ভোট বেশী সংখ্যায় পাওয়ার জন্যই তিনি এই নেকাব রাজনীতিতে নেমেছেন। নিকাবের বিরুদ্ধে কথা বললে কুইবেকের ভোটারগণ খুশি হবেন। কারণ, কুইবেক এই নেকাব আর হিজাবের ঘোর বিরোধী। তার প্রমাণও পাওয়া গেছে ভিক্টোরিয়াভিলে প্রধানমন্ত্রীর ঐ দিনের বক্তব্যের পর। তাঁর এই বক্তব্যের পর দর্শক সারিতে তুমুল করতালি লক্ষ্য করা যায়।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, গত জাতীয় নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল কুইবেক থেকে মাত্র ৫টি আসন পেয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বিশ্লেষনে দেখা যায় কুইবেকে স্টিফেন হারপারের ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আগামী নির্বাচনে ১৫টি বা তারো বেশী আসন পেতে পারে তাঁর দল। এটি সম্ভব হয়েছে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে কনজারভেটিভ দলের শক্ত অবস্থানের কারণে। নিকাবের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিলে কুইবেকে কনজারভেটিভ দলের জনপ্রিয়তা আরো বৃদ্ধি পাবে সন্দেহ নেই। কারণ কুইবেক বরাবরই ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী এবং এই মতবাদকে প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এটি অবশ্য সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয়। কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্নও আছে। কারণ, দেখা গেছে পার্টি কুইবেকো কুইবেক প্রভিন্সের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় গত ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এমন এক বিতর্কিত বিল পার্লামেন্টে তুলেছিল যা পাশ হলে সরকারী অফিস-আদালতে কর্মরত শিখদের পাগড়ী পরা, মুসলমানদের হিজাব – বেরাখা – নেকাব পরা, খ্রিষ্টানদের ক্রশ চিহ্ন ব্যবহার ইত্যাদি সবই বন্ধ হয়ে যেতো।

ঐ বিলের মূল টার্গেট ছিল মূলত মুসলমানরাই। কিন্তু বিলটি যাতে আপতদৃষ্টিতে পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট বলে মনে না হয় সেই জন্যই তাতে যোগ করা হয়েছিল পাগড়ী, ক্রসচিহ্ন ইত্যাদি। এর প্রমাণ মিলে যখন দেখা যায়, খোদ কুইবেক পার্লামেন্ট ভবনের অভ্যন্তরে স্পীকারের মাথার উপর অবস্থিত যিশু খৃষ্টের ক্রশবিদ্ধ বিশাল আকৃতির দেয়াল মূর্তিটি অপসারণের ব্যাপারে পার্টি কুইবেকো অস্বীকৃতি জানায়। পার্টি কুইবেকোকে এর মূল্যও দিতে হয়েছে পরবর্তী নির্বাচনে লিবারেল দলের কাছে পরাজিত হয়ে। তবে পার্টি কুইবেকা এখনো ঐ বিল পাশের আশা ত্যাগ করেনি।

এদিকে নেকাবের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের অবস্থানের সমালোচনা করেছেন লিবারেল দলের প্রধান নেতা জাস্টিন ট্রুডো। তিন বলেন, সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করার সময় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। তিনি আরো বলেন, সরকার বা অন্য যে কোন নেতা যখন সংখ্যালঘুদের কোন অধিকারকে নিয়ন্ত্রিত বা সীমিত করতে চাইবে তখন তার পিছনে জোড়ালো কারণ বা যৌক্তিকতা থাকতে হবে।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের প্রতি ক্যাালগারির একটি মুসলিম গ্রুপ আহ্বান জানিয়েছেন তিনি যেন নেকাব নিয়ে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করেন। সেখানকার ইসলামিক সুপ্রিম কাউন্সিল অব কানাডা’র পক্ষ থেকে বলা হয়, শপথ গ্রহনের সময় নেকাব পরা নিয়ে আদলত যে রায় দিয়েছেন সেটি কোন গুরুত্বপূর্ন বিষয় নয়। কিন্তু প্রধানন্ত্রী এটিকে অযথা একটি গুরুত্বপূর্ন ইস্যু বানাচ্ছেন। তাঁরা বলেন, নেকাব পরা না পরা একান্তই কোন মহিলার ব্যক্তিগত বিষয় যেমনটা ব্যক্তিগত বিষয় একজন মহিলা কতটা সংক্ষিপ্ত পোষাক পরবেন। কাউন্সিল সদস্যরা আরো মনে করেন নাগরিকত্বের জন্য শপথ নেওয়ার সময় কেউ নেকাব পরে থাকলে তা কানাডিয়ান, পশ্চিমা বা খ্রীষ্টীয় মূল্যবোধকে ক্ষতিসাধন করে না।

আমরা জানিনা প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার ইসলামিক সুপ্রিম কাউন্সিল অব কানাডা’র এ আহ্বানে সাড়া দিবেন কি না। সম্ভবত দিবেন না। কারণ, তাঁকে আগামী নির্বাচনে জয়ী হতে হবে। একজন রাজনীতিকের কাছে নির্বাচনে জয়ী হওয়াটাই মূখ্য। আর সাম্প্রতিক সব জরীপে দেখা যাচ্ছে জনপ্রিয়তার দিক থেকে লিবারেল দল স্টিফেন হারপারের কানজারভেটিভ দল থেকে এগিয়ে আছে। সুতরাং নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য স্টিফেন হারপার মরিয়া হয়ে উঠবেন এটাই স্বাভাবিক।

এখন দেখতে হবে নেকাবকে ইস্যু বানানোর ক্ষেত্র আসলে কে তৈরী করে দিয়েছে। আমরা আগেই দেখেছি ইসলাম ধর্মে কোথাও বলা হয়নি নেকাব পরার কথা। এটি আরবীয় একটি ট্রেডিশন। আমাদের মনে রাখতে হবে আরব মানেই ইসলাম নয়। আরব দেশেও অনেক অপকর্ম হয়। খোদ রাজপরিবারেই হয়। তাই বলে সেগুলো কি ইসলামের অংশ হয়ে যাবে? পাকিস্তান থেকে কানাডা পর্যন্ত আসতে গিয়ে জুনেরা ইসহাক ঘাটে ঘাটে মুখের পর্দা সরিয়েছেন। এমনকি কানাডার অভ্যন্তরে এসেও এ কাজটি করেছেন ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়ার সময়। তখন পর্যন্ত তার ধর্ম নষ্ট হয়ে যায়নি। আঘাত লাগেনি তার সম্ভ্রমে। সমস্যা তৈরী হলো শুধু শপথ গ্রহণের সময়?

সাবেক ইমিগ্রেশন মন্ত্রী জেসন কেনী বলেন, কানাডীয়দের একটি গ্রুপকে আলাদা করে দেয়া বা তাঁদেরকে তাঁদের মুখ ঢেকে রাখার অনুমোদন দেয়া, বিশেষ করে যখন তাঁরা আমাদের সমাজে অংশগ্রহণ করছে তখন তাঁদের পরিচয় আমাদের কাছ থেকে গোপন রাখার বিষয়টি কানাডার গর্ব এবং খোলানীতি ও সামাজিক সংলগ্নতার প্রতি আমাদের অঙ্গীকারের সঙ্গে সঙ্গতিহীন। তিনি আরো বলেন, যাঁরা মুখ ঢেকে রাখেন তাঁরা সত্যিই শপথবাক্য পাঠ করছেন কিনা তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন বলে আমার কাছে অভিযোগ করেছেন পার্লামেন্টের সদস্য, নাগরিকবৃন্দ ও নাগরিকত্ব বিষয়ক আদালতের বিচারকরা।

মুসলিম কানাডিয়ান কংগ্রেসও জেসন কেনীর বক্তব্যকে এই বলে সম্মান জানিয়েছে যে, নেকাব ও বোরকা হলো যারা মুসলমানদেরকে একটি ধর্মীয় গন্ডির মধ্যে আলাদা করে রাখতে এবং তাঁদেরকে সমাজের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চান সেইসব ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক হাতিয়ার। এই কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা তারেক ফাত্তা ইতিপূর্বে এক বক্তব্যে বলেন, কতক মুলমান আছেন যারা কানাডায় আসেন একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। আর এ উদ্দেশ্য হলো এখানকার সৌহার্দপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া। তিনি এদেরকে মুসলমান না বলে ‘ইসলামিস্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

কানাডার চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডম এ ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্বসহকারে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জুনেরা ইসহাক সেই স্বীকৃতির দোহাই দিয়েই সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। কিন্তু ইসলাম ধর্মের সঙ্গে নেকাবের যে কোন সম্পর্ক নেই সেই কথাতো ইসলামী চিন্তাবিদরাই বলছেন। তাহলে জুনেরা যে দাবী করছেন তার ধর্মীয় স্বাধীনতা লংঘিত হয়েছে- সে দাবীর পিছনে যৌক্তিকতা কোথায়? আর কানাডার রাজনৈতিক নেতারা এবং মেইনস্ট্রিমের পত্রপত্রিকাগুলো নেকাবের পক্ষে বিপক্ষে নেমে কোন খেলায় মেতে উঠেছে? তারা কি মুসলিম সম্প্রাদায়কে আরো কোনঠাসা করতে চায় নেকাব ইস্যুটিকে আরো বিতর্কিত করে দিয়ে?

জুনেরা ইসহাক কানাডায় এসেছেন এমন একটা সমাজ ব্যবস্থা থেকে যেখানে নারীদের মর্যাদা ও সম্ভ্রম পদে পদে লংঘিত হয়। নারীদের ব্যক্তিস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি প্রায় নেই বললেই চলে। অনার কিলিং নামক এক জঘন্য ও বর্বর আইন ঐ দেশটিতে এখনো প্রচলিত। জুনেরা নিজে ঐ ইসলামিস্ট সমাজ ব্যবস্থায়ই বড় হয়েছেন এবং শৈশব থেকেই তিনি নেকাব পরে আসছেন যার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই।

এবার পাঠক আপনারাই বিবেচনা করুন জুনেরা ইসহাক কোন ক্যাটাগরীতে পড়েন, তিনি কাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার বুদ্ধি ও পরামর্শ তাকে কে বা কোন বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহল দিল আর কেনই বা দিল?

খুরশিদ আলম সম্পাদক ও প্রকাশক, প্রবাসী কন্ঠ