বহুসংস্কৃতিবাদ কেন ব্যর্থ হচ্ছে?

কানাডায় বহুসংস্কৃতিবাদ বিভিন্ন সংস্কৃতিকে বিকাশের সুযোগ দিয়েছে কিন্তু বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে যোগাযোগের কোনও উপায় তৈরি করেনি। এটি কখনই জাতিগত সংখ্যালঘুদেরকে অর্থবহভাবে অন্য সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা অর্জন বা শিক্ষা নেয়ার বিষয়ে উৎসাহিত করেনি।

মে ১০, ২০১৫:

প্রদীপ রড্রিগেজ : গত সপ্তাহে বেলজিয়ামে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের পর ইউরোপীয় দেশগুলো যখন গভীর সতর্কাবস্থার মধ্যে রয়েছে তখন আটলান্টিকের উভয় পাড়ের জনগণ নিরাপত্তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু এসব ঘটনার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে বহুসংস্কৃতিবাদের। কারণ এই ধারণার প্রতি মানুষের সমর্থন উদ্বেগজনক হারে কমে যাচ্ছে। এমনকি প্যারিসে শার্লি হেবদোর কর্মচারীদের হত্যার ঘটনার আগেও ইউরোপ জুড়ে জরিপের ফলাফলে আভাস পাওয়া যায় যে, জনগণ এই উপসংহারে পৌঁছাচ্ছে যে, বহুসংস্কৃতিবাদের পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, “এই (বহুসংস্কৃতিবাদী) উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে, চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।” ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন জনসমক্ষে একইধরণের উপসংহার টেনেছেন। বিবিসির সাম্প্রতিক এক জরিপে ৯৫ শতাংশ জবাবদাতা বলেছেন, তারা মনে করেন যে, ব্রিটেনে বহুসংস্কৃতিবাদ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

কানাডীয়দের আত্মতুষ্ট বোধ করা উচিৎ নয়
আমাদের কানাডীয়দের বহুসংস্কৃতিবাদের প্রতি সহিষ্ণুতার জন্য আত্মতুষ্ট বোধ করার প্রয়োজন নেই। ইউরোপের আকৃতি ও অতিরিক্ত জনবহুল হওয়ার কারণে সেখানে বেশিরভাগ মানুষ পরিবর্তনশীল জনসংখ্যার ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রভাবই দেখতে পাচ্ছে। সেখানে পরিস্থিতি কানাডার মত নয়। কানাডায় বিশাল বিশাল শুন্যস্থান অনেকটাই বাফার জোন হিসাবে কাজ করে।
কানাডায় বহুসংস্কৃতিবাদের পক্ষে ব্যাপক সংখ্যায় কথা বলার মত লোকেরা হয়তো প্রকৃতপক্ষে এমন অঞ্চলে বসবাস করে যেখানে জনগণের মধ্যে বৈচিত্র্য খুব সামান্যই যেমন ম্যারিটাইম প্রদেশগুলো অথবা প্রেইরি অঞ্চল। ব্রাম্পটনে বসবাসরত ককেসীয়দেরকে বহুসংস্কৃতিবাদ সম্পর্কে তার ধারণার কথা জিজ্ঞাসা করা হলে তারা কিছু আলোকসঞ্চারী জবাব দিতে পারেন। এখন প্রশ্ন হলো এর পর কী আসবে। অনেকের ধারণা হলো, এর পর আসবে আন্তঃসংস্কৃতিবাদ (রহঃবৎপঁষঃঁৎধষরংস)। তাহলে বর্তমানে ক্ষয়িষ্ণু বহুসংস্কৃতিবাদের সঙ্গে আন্তঃসংস্কৃতিবাদের প্রকৃত পার্থক্য কি? আসলে আন্তঃসংস্কৃতিবাদ বলতে বোঝায় বিভিন্ন সংস্কৃতির জনগণের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের বিষয়টিকে। অন্যদিকে বহুসংস্কৃতিবাদ হলো ব্রিটিশ লেখক ও সম্প্রচার বিশেষজ্ঞ কিনান মালিকের ভাষায় একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, “যার লক্ষ্য হলো জনগণকে জাতিগোষ্ঠীগত ও সাংস্কৃতিক বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বৈচিত্র্যের ব্যবস্থাপনা এবং তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করা। এই লক্ষ্যে বহুসংস্কৃতিবাদ ওইসব বাক্সের গুণাবলীর প্রেক্ষিতে ব্যক্তিবিশেষের চাহিদা ও অধিকারের সংজ্ঞায়ন করে এবং বাক্সগুলিকে সরকারী নীতির আকার দিতে ব্যবহার করে।”

আন্তঃসংস্কৃতি একীকরণ একটি সমাধান হতে পারে
আশা করা হচ্ছে যে, আন্তঃসংস্কৃতি একীকরণ জনগণের বৈচিত্র্যকে সম্পদ হিসাবে দেখবে এবং সরকারি কর্তৃপক্ষ, ব্যবসায় খাত, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমের সক্রিয় সহায়তায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে। বছরের পর বছর ধরে কানাডার রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী শ্রেণি সংস্কৃতির নাচ-গানের বিষয়গুলিকে প্রাধান্য দিয়ে সেক্ষেত্রে অর্থ যোগান দিয়ে এবং অতিঅবশ্যই উৎসব ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে প্রধান অতিথি এবং ভিআইপি হিসাবে নিজেদের উপস্থাপনের মাধ্যমে তাদের বিবেককে প্রশমিত করে এসেছে। অভিবাসীরা যখন বুঝতে পেরেছে যে, তাদের পৃথক পরিচিতি একটি সত্যিকারের সম্পদ বৃহত্তর কানাডীয় সমাজের সঙ্গে একীভূত হওয়ার চিন্তা কুব সামান্যই কাজ করেছে। ইউরোপ এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

একীভূতকরণ বনাম আত্তীকরণ
বহুসংস্কৃতিবাদের ধারণার আগে আমেরিকায় এমন অবস্থা ছিলো যেখানে সকল জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা সমবেত হয়েছে, তাদের নিজস্ব পরিচিতি পেছনে ফেলে রেখেছে এবং তারা আত্তীকরণ হয়ে গেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আত্তীকরণ একটি নোংরা শব্দে পরিণত হয়েছে যেহেতু এটি একটি কমিউনিটিকে একটি বহুসংস্কৃতির সমাজের মধ্যে শোষণ করে নেয়ার একমুখি প্রক্রিয়া হিসাবে দেখা দিয়েছে। এর পেছনে এমন মৌলিক অনুমান কাজ করেছে যে, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য প্রার্থক্যের ওপর খুব বেশি জোর দেয়ার অর্থ হবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা এবং এভাবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আলাদা পাড়া-মহল্লা গড়ে ওঠা। বহুসংস্কৃতিবাদের সমালোচকরা বলেন, কানাডার বিভিন্ন শহরে এই প্রক্রিয়াই চলছে। বহুসংস্কৃতিবাদ একটি জাতীয় কর্মকাঠামোর ভেতরে থেকে সব সংস্কৃতির বিকাশের সুযোগ দেয়। এটি ইউরোপে স্পষ্টতই কাজ করেনি কারণ সেখানকার অভিবাসীদের একটি বিরাট অংশই সমাজের সঙ্গে মিশে যেতে রাজী ছিলো না এবং সেখানে এমন সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বাধা রয়েছে যা সত্যিকারের একীভবনকে কঠিন করে তোলে। অভিবাসীরা সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে একীভূত না হওয়ায় সেখানে সন্ত্রাসবাদের জন্ম হওয়ার অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে। এ থেকে বিচ্ছিন্নতাবোধ ইন্ধন পেয়েছে এবং পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে জাতিগোষ্ঠীগত কমিউনিটিগুলো তাদের আবাসস্থলে নিজেদের মত দেখতে এমন লোকেদের নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। এসব জাতিগোষ্ঠীগত আবাসস্থল হলো গোটা দেশে সমাজের সঙ্গে ঢিলেঢালাভাবে বিরাজমান সমান্তরাল সমাজ। এখন কানাডায় এটি কাজ করুক বা না করুক গত প্রায় ২০ বছর ধরে এটি সামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে একসঙ্গে মিশে গেছে।
আন্তঃসংস্কৃতিবাদের প্রবক্তারা বলছেন, এটি সমান সুযোগ, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তিতে ভাল অবদান রাখতে পারবে। কানাডায় বহুসংস্কৃতিবাদ বিভিন্ন সংস্কৃতিকে বিকাশের সুযোগ দিয়েছে কিন্তু বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে যোগাযোগের কোনও উপায় তৈরি করেনি। এটি কখনই জাতিগত সংখ্যালঘুদেরকে অর্থবহভাবে অন্য সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা অর্জন বা শিক্ষা নেয়ার বিষয়ে উৎসাহিত করেনি। এটি একজনের সংস্কৃতির সংরক্ষণে বিশেষভাবে কাজ করেছে কিন্তু তাদেরকে সামাজিক বা অর্থনৈতিকভাবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টির নিষ্পত্তি করেনি।

বহুসংস্কৃতিবাদ সাংস্কৃতিক পার্থক্য ও বিদেশি স্বাতন্ত্র্য উদযাপন করেছে
আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের রাজনীতিক ও ব্রবসায়িক শ্রেণি বহুসংস্কৃতিবাদের এই ধারণাকে সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছেন কারণ সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার মধ্যে যেখানে নাচ-গানের বিষয় রয়েছে এবং বিশেষ রন্ধনপ্রণালী ইত্যাদি জড়িত সেটিকে ভালবাসা খুবই সহজ। কিন্তু জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য ক্ষমতার করিডোরে বা বোর্ডরুমে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করাটা খুবই কঠিন। সম্প্রতি আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সরকারের সব স্তরে ককেসীয় রাজনীতিকরা আমাদেরকে স্বমতে আনার চেষ্টা করছেন এই বলে যে তারা আমাদের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করছেন। এটি কি সাংস্কৃতিক স্পর্শকাতরতার বাইরের কিছু? এর মধ্যে কী সেই নিশ্চয়তা রয়েছে যে আমরা ইপ্সিত চাকরি পাবো, সব বাধাগুলো সরিয়ে ফেলবো এবং সবার জন্য সমান সুযোগ দিয়ে খেলতে নামবো? বেশিরভাগ কানাডীয় সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে জাতিগত গ্রুপগুলির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলবেন এবং আমাদের শহরগুলোতে যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বিরাজ করছে সেকথা বলবেন, কিন্তু কেউই আমাদের বোর্ডরুমগুলোতে, উচ্চতর ব্যবস্থাপনার পদগুলিতে কিংবা রাজনীতিক অঙ্গনের অবস্থা সত্যিকার অর্থে গর্ব করে বলতে পারবেন না।

বহুসংস্কৃতিবাদের সাফল্য বা ব্যর্থতা কীভাবে বিচার করবেন?
বহুসংস্কৃতিবাদের সাফল্য বা ব্যর্থতা বিচার করতে হবে কেবলমাত্র কানাডীয় লোকালয়গুলিতে নয় বরং প্রতিটি ক্ষেত্রে জাতিগত সংখ্যালঘুদের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বের নিরিখে। এই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে এমন যে কোনও নীতির প্রতি আমি সমর্থন জানাই। কানাডীয়রা যদি আমার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বুঝতে না পারে তাতে আমি কিছু মনে করি না, তারা আমার খাদ্যাভ্যাস এড়িয়ে যেতে পারে, কিন্তু একমাত্র যে বিষয়টি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো তারা আমার সম্ভাবনাকে বুঝবে, আমাকে কেবল বেঁচে থাকার মত নয় বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হওয়ার ক্ষেত্রে সমর্থন দেবে। যদি আন্তঃসংস্কৃতিবাদ লক্ষ অভিবাসীর জন্য এই লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয় তাহলে তা সর্বাত্মক সমর্থন পাবে। – সৌজন্যে : ক্যানইন্ডিয়া.কম