বর্ণবাদ কানাডায় এখনো একটি অস্বস্তিকর সত্য
কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (সিবিসি) পরিচালিত সাম্প্রতিক এজ জরীপে দেখা গেছে এখানকার সমাজে এবং শ্রমশক্তিতে অভিবাসীদের অবস্থান ও ভূমিকা প্রশ্নে কানাডীয়দের মধ্যে সাংঘর্ষিক চিন্তা রয়েছে। সিবিসি নিউজের জরিপে অংশ নেয়া ৭৫ ভাগ মানুষই বলেছেন, কানাডা হলো ‘সব জাতিগোষ্ঠীর লোকদের স্বাগত জানানোর মত জায়গা।’’
তবে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে যেমন অর্থনীতির প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তার জবাবেও অধিকতর ভিন্নতা দেখা দেয়।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সারাদেশে ৭৯ শতাংশ বলেছেন, তারা ভিন্ন কোন জাতিগোষ্ঠী থেকে আসা কোন ব্যক্তিকে কাজে নিয়োগ দেয়া বা তার সঙ্গে কাজ করা উভয় ক্ষেত্রেই সচ্ছন্দ বোধ করবেন।
এর চেয়ে অনেক কম সংখ্যক মানুষÑ ৫৫ শতাংশ Ñ ‘‘একমত’’ অথবা ‘‘জোরালোভাবে একমত’’ যে, অভিবাসীরা ‘‘কানাডার ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়ে তোলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’’
কিন্তু জরিপে দেখা গেছে যে, ৩০ শতাংশ জবাবদাতা একটি বিষয়ে একদম অথবা জোরালোভাবে একমত যে, ‘‘অভিবাসীরা কানাডীয়দের কাছ থেকে চাকরি ছিনিয়ে নিচ্ছে।’’ জরীপ রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় গত ১০ নভেম্বর, ২০১৪।
অঞ্চলভেদে মনোভাবের ভিন্নতার আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো, উপকূলীয় অঞ্চলের ৮৬ শতাংশ মানুষ বলেছে যে, তারা ‘‘সচ্ছন্দ’’ বা ‘‘অত্যন্ত সাচ্ছন্দ্য’’ বোধ করবেন যদি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কোনও মানুষ তাদের প্রতিবেশি হিসাবে আসেন। এদিকে প্রেইরি অঞ্চলের ৭২ শতাংশ লোক একইরকম মতামত দিয়েছে।
এখানে জরীপে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো, কানাডায় অভিবাসীদের ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বা মনোভাব এখনো আছে এবং তা একেবারে উপেক্ষা করার মতো নয়। বা আরো স্পষ্ট করে বলা যেতে পারে যে বর্ণবাদ কানাডায় এখনো একটি অস্বস্তিকর সত্য।
টরন্টোর ইয়র্ক ইউনিভারসিটির অধ্যাপক কেরী কাওয়াকামীর মতে বর্ণবাদ এখনো বিদ্যমান কানাডার মাটিতে। তবে তিনি মনে করেন, প্রকাশ্য বর্ণবাদ ও এ সম্পর্কিত সংস্কার নিশ্চিতভাবেই হ্রাস পাচ্ছে যদিও অভিবাসী এবং বিশেষ করে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত অভিবাসীদের বেলায় বর্ণবাদের শিকার হওয়া প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। অধ্যাপক কেরী মনোবিদ্যা ও সংস্কার বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ।
আমরা দেখেছি, বর্ণবাদ সম্পর্কে সিবিসি’র এই জরীপ ছাড়াও ইতিপূর্বে পরিচালিত অন্যান্য জরীপে প্রায় একই চিত্র উঠে এসেছে। এখন সমস্যা হচ্ছে, যারা প্রকাশ্যে বর্ণবাদী আচরণ করেন তাদের বিরুদ্ধে হয়তো ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। কিন্তু যারা বর্ণচোরা অর্থাৎ যারা নিজেদের বর্ণবাদী মনোভাব গোপন রেখে নিরবে বর্ণবাদী আচরণ করেন তাদেরকে সামাল দেয়া মোটেও সহজ নয়। সমাজের সংখ্যালঘু তথা অভিবাসীদের প্রতি তাদের বর্ণবাদী আচরণ বা ব্যবহার তারা অতি সুক্ষ্মভাবে করে থাকেন।
অধ্যাপক কেরী সম্প্রতি সিবিসি’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সাধারণত একজন মানুষ অন্য মানুষ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করার সময় খুব সতর্ক থাকেন এবং তারা যথেষ্ট সমতার মনোভাব প্রদর্শন করেন। ন্যায্যতার পক্ষেও কথাও বলেন তারা। কিন্তু যখন আমরা কৌশলে তাদের মনোভাব জানার চেষ্টা করি, অর্থাৎ তারা যখন সতর্ক না থাকেন বা একটু অমনোযোগী থাকেন তখন দেখা যায় এদেরই অনেকে অন্যবর্ণের মানুষ সম্পর্কে এমনসব কথা বলেন যা থেকে প্রমানিত হয় যে, উত্তর আমেরিকায় বর্ণবাদ এখনো বেশ প্রচলিত। তবে আশার কথা এই যে, পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে দিন দিন। দেখা গেছে, কেউ যদি প্রকাশ্যে বর্ণবাদী আচরণ করার চেষ্টা করেন তবে তার বিরুদ্ধে জনগণ সোচ্চার ভাবে প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। টরন্টোর গত সিটি নির্বাচনেও তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এটি নিশ্চিতভাইে উৎসাহব্যাঞ্জক।
অধ্যাপক কেরীর সাথে আমরাও একমত যে কানাডায় বর্ণচোরা বর্ণবাদীদের কর্মকান্ড সত্বেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে দিন দিন। আমরা দেখেছি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানাডায় অসবর্ণ বিয়ের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯১ সালে এই হার যেখানে ছিল শতকরা ২.৬ ভাগ, ২০১১ সালে এসে তা বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৪.৬ ভাগে। তবে এখানে মানুষের উদারতার চেয়ে প্রয়োজনের বিষয়টিই প্রাথমিক ভূমিকা পালন করেছে। কারণ কানাডায় বিভিন্ন এথনিক গ্রুপের মধ্যে এমনকি তথাকথিত মূলধারার জনগোষ্ঠির মধ্যেও বরের জন্য কনে বা কনের জন্য বর পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে মধ্যে জনসংখ্যার স্বল্পতার কারণে। সে কারণে অসবর্ণের বিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ‘প্রয়োজনের’ কারণে অসবর্ণ বিয়ে বৃদ্ধি পেলেও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মানুষজন ক্রমশ বর্ণবাদ বিরোধী হয়ে উঠছে বলেই অসবর্ণ বিয়ে বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনুকুল পরিবেশ তৈরী হয়েছে। অন্যথায় মানুষজন পাত্র-পাত্রী স্পন্সরের দিকেই ঝুঁকে পড়তো বেশী।
তবে এ কথাও সত্যি যে, কানাডায় আমাদেরকে বর্ণবাদ বিরোধী সমাজ গড়ে তুলতে হলে আরো অনেকটা পথ এগিয়ে যেতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্ণবাদ একজন মানুষের মস্তিষ্কের গভীরে গ্রথিত হয়ে থাকতে পারে তার অজান্তেই। তাছাড়া আমরা এও দেখছি যে, ব্রিটিশ কলম্বিয়ার শতকরা ৮১ ভাগ চাইনিজ ও সাউথ এশিয়ান অভিবাসী বলেছেন তারা তাদের এথনিক পরিচয়ের কারণে কোন না কোনভাবে বর্ণবাদের শিকার হচ্ছেন প্রায়শই। এর মধ্যে আছে মৌখিক গালাগালের শিকার হওয়া, মন্দ গ্রাহক সেবা পাওয়া, কর্মক্ষেত্রে অন্যায্য আচরণ ইত্যাদি। এ কথা অন্টারিও, কুইবেক প্রভৃতি অভিবাসী অধ্যুষিত শহরগুলো ক্ষেত্রেও কমবেশী সত্য।
পরিশেষে বলা যায়, আমরা হয়তো সম্পূর্ণভাবে বর্ণবাদবিরোধী সমাজ গড়ে তুলতে পারবো না। সেটি বর্তমান পৃথিবীর কোথাও নেই। কিন্তু পরিস্থিতির আরো উন্নতিসাধণ যাতে করা যায় সে চেষ্টা আমাদেরকে অব্যাহত রাখতে হবে। অতীতে এ চেষ্টা অব্যাহত ছিল বলেই দাস যুগের সেই ভয়াবহ বর্ণবাদী সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হয়ে আমরা আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছি।
জানুয়ারী ১, ২০১৫