প্রবাসে সংস্কৃতির চর্চা : শিল্পীদের যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে না

প্রবাসী কন্ঠ রিপোর্ট : টরন্টোসহ কানাডার অন্যান্য বাঙ্গালী অধ্যুষিত শহরগুলোতে আগের যে কোন সময়ের তুলনায় বাংলাদেশীদের সংস্কৃতিক চর্চা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কানাডার বৈরী আবহাওয়া আর বহুজাতীয় সংস্কৃতির মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশীদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখার পিছনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন যে শিল্পী সমাজ তাদের যথাযথ মূল্যায়ন আজো হয়ে উঠছে না বলে অনেকেই অভিযোগ তুলছেন।

খোঁজ নিলে দেখা যাবে শুধুমাত্র টরন্টোতেই রয়েছেন এ গ্রেডের অনেক শিল্পী। গুণ এবং মানে দিক থেকে বিচার করলে বাংলাদেশের মূলভূখন্ডের প্রথম সারির শিল্পীদের কাতারেই পড়বেন তারা। দেশে থাকলে হয়েতো এদের অনেকে আজ সেলিব্রিটিও হয়ে উঠতেন। কিন্তু সুদূর এই প্রবাসে পড়ে থাকার কারণে তারা আজ সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত এবং এই প্রবাসেও তারা অনেকটাই কদরহীন হয়ে পড়েছেন। পাচ্ছেন না যথাযথ মূল্যায়ন।

দেখা গেছে, প্রবাসের বিভিন্ন সংগঠনের কর্তাব্যক্তিদের অনেকেই এখনো কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে “সাফল্যমন্ডিত” করার জন্য বাংলাদেশ থেকে এক্সিকিউটিভ বা বিজনেজ ক্লাসের প্লেন টিকিট দিয়ে শিল্পী আনার চেষ্টা করেন যদি সামর্থ্যে কুলায়। অন্যদিকে প্রবাসের স্থানীয় শিল্পীদের গাড়ির তেল খরচও দিতে নারাজ থাকেন তারা, সম্মানীতো দূরের কথা। অভিযোগ রয়েছে যে, আয়োজকদের অধিকাংশই অনুষ্ঠানের জন্য হল ভাড়া দিতে পারেন, সাউন্ড সিস্টেমের জন্য পয়সা খরচ করতে পারেন, নিরাপত্তার জন্য সিকিউরিটি পার্সন এমনকি পুলিশও নিয়ে আসেন পয়সা খরচ হলেও। কিন্তু যাদেরকে ছাড়া অনুষ্ঠান সম্ভব নয় সেই তাদেরকেই সম্মানী দিতে যত কার্পন্য তাদের। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে সিংহভাগ শিল্পীই অনুষ্ঠান শেষে কোন সম্মানী পান না। এ জন্য তাদের রয়েছে যথেষ্ট ক্ষোভ।

প্রবাসী শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। এদের কেউ কেউ জানান, অনুষ্ঠানে গান গাইলে স্থানীয় শিল্পীদেরকে সাধারণত কোন সম্মানী দেয়া হয় না। আয়োজকদের ভাবখানা এইরকম -তোমাকে গান গাইতে দেয়া হয়েছে এটাই তোমার বড় সম্মানী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিল্পী আয়োজকদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা সবই করলেন একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য। হল ভর্তি দর্শক। অনুষ্ঠানও শুরু হলো। কিন্তু মঞ্চে শিল্পী নেই। আপনারা কি ভাবে অনুষ্ঠান চালাবেন? অথচ সেই শিল্পীদেরকেই আপনারা সম্মানী দেন না বা দিতে চান না। এটি কি ধরণের আচরণ? একজন শিল্পী কি জন্মেই শিল্পী হয়ে যায় না শিল্পী হয়েই জন্মায়? শিল্পী হতে হলে একজন মানুষকে কি পরিমান সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করতে হয় সে সম্পর্কে আপনাদের কোন ধারণা আছে? আমার মনে হয় আপনাদের সেই ধারণা নেই। থাকলে আপনাদের বোদধয় ঘটতো।

টরন্টোর বাঙ্গালী কমিউনিটির বিশিষ্ট কন্ঠ শিল্পী সারাহ্ বিল্লাহ ইতিপূর্বে প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শিল্পীদের যথাযথ মূল্যায়নের বিষয়টি সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, অনুষ্ঠানে গান গাইলে শিল্পীরা কোন সম্মানী পান না, পান যন্ত্রীরা। কথাটা শুনতে খারাপ শুনায়। কিন্তু এভাবেই এখানে একটা ঐতিয্য গড়ে উঠেছে। এর অবসান হওয়া উচিৎ। সারাহ্ আরো বলেন, এখন টরন্টোতে দর্শনীর বিনিময়ে প্রচুর অনুষ্ঠান হচ্ছে। হল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তারপরও শিল্পীদের মূল্যায়ন হচ্ছে না – এটা খুবই দুঃখজনক।

সারা বিল্লাহর সঙ্গে প্রবাসের শিল্পীদের অনেকেই একমত। বিষয়টা এমন নয় যে সাম্প্রতিককালে সকলেই লোকসান দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন। টরন্টোর দর্শকরাও আগের তুলনায় বেশী সচেতন হয়ে উঠেছেন। তারা টিকি কেটে অনুষ্ঠান দেখতে যান। টিকিটের পুশিং সেল আর আগের মতো করতে হয় না। ভাল মানের অনুষ্ঠান হলে হল কানায় কানায় ভরে উঠে। আর ভাল মানের অনুষ্ঠান হচ্ছেও টরন্টোতে। তাই শিল্পীরা মনে করেন সম্মানী না দেয়ার কালচার বদলানোর সময় এসেছে। তবে শিল্পীদের অনেকেই মনে করেন, টিকিট বিহীন অনুষ্ঠানের কথা আলাদা। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে কোন কোন সংগঠন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে এবং কোন প্রবেশ ফি থাকে না। দেশের প্রতি টান বা নিজেদের তাগিদ থেকে এ জাতীয় অনুষ্ঠান করে থাকে তারা। ঐ সকল অনুষ্ঠানে শিল্পীদের সম্মানী দেওয়া হবে কি হবে না সে বিষয়টি পারষ্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে ঠিক করে নেয়া যেতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।

টরন্টোর শিল্পী সমাজের পরিচিত মুখ মেরী রাশেদীন। তিনি প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের সঙ্গে এ বিষয়ে মত বিনিময় করতে গিয়ে বলেন, টরন্টোতে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয় কোন শিল্পী পারফরম করলে তাকে সম্মানী দেওয়া হয় না- কথাটা পুরো পুরি সত্য নয় । গানের কিছু কিছু শিল্পি আছেন তারা যেভাবেই পারেন সম্মানী আদায় করে নেন। তবে সেটা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। আমার জানামতে আবৃত্তি শিল্পিরা এবং অনুষ্ঠান যিনি পরিচালনা করেন অর্থাৎ অনুষ্ঠানের হোস্ট তিনি মোটেও কোন সম্মানী পান না। যেহেতু আমি আবৃত্তি শিল্পী তাই এই বিষয়টি এখানে লক্ষ্য করেছি যে এই শিল্প এখানে বড়ই অবহেলিত। আবৃত্তি শিল্পকে এখানে যে কোন অনুষ্ঠানের ফিলার হিশেবে ব্যাবহার করা হয়। তবে স্থানীয় শিল্পীদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ার বিষয়ে সামগ্রিক ভাবে আমার প্রতিক্রিয়া হলো, প্রবাসে আয়োজকদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিরাট আকারের কোন অনুষ্ঠান আয়োজন করার মতো ক্যাপাসিটি তাদের নেই। যারা অনুষ্ঠানের স্পন্সর করেন তাদেরও কার্পন্যতা রয়েছে। আবার এটিও ঠিক, এখানে এতবেশী অনুষ্ঠান হচ্ছে যে -স্পন্সরাররাও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন।

মেরী রাশেদীন আরো বলেন, আমাদের সময় এসেছে ভাববার যেন আমরা বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। তবেই আমার মনে হয় শিল্পীরা সম্মানিত হবেন। ছোট ছোট অনুষ্ঠান আর বিভক্তিকরন আমাদেরই ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়। আবৃত্তি শিল্পী হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা এবং পাশাপাশি অনুষ্ঠান আয়োজন করার যে অভিজ্ঞতা আছে তা থেকেই বলছি, এখানে আয়োজকদের একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হিমশিম খেতে হয় , নিজেদের পকেটের ডলার খরচ করে একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপন করতে হয় । আয়োজকরা নিতান্তই এটা তাদের ভাল লাগা থেকে করে থাকেন। অনুষ্ঠান থেকে তাদের আয় হয় না। যদি হত তবে তারা নিশ্চয় শিল্পীদের সন্মানি দিতেন। এটি অবশ্য আমার ব্যক্তিগত মতামত। এর সাথে কারো কারো দ্বিমত থাকতে পারে।

মেরী রাশেদীন সবশেষে বলেন, একটি পরামর্শ দিতে চাই- আমরা যদি শিল্পিদের সন্মানী পাইয়ে দিতে চাই তবে এখানকার ইন্ডিয়ান কমিউনিটির দিকে একটু চোখ বুলালেই দেখতে পাব তারা কি করে একটি অনুষ্ঠান অরগানাইজ করেন। তারা শিল্পীদের সন্মানীসহই তাদের প্রোগ্রাম প্লানিং এবং বাজেট তৈরী করেন। এখন আমরা তাদেরকে দেখে কিছু শিখতে চাই কিনা সেটাই প্রশ্ন। আমি মনে করি, অনুষ্ঠানের মূল চালিকা শক্তি যেমন শিল্পী তেমনি দর্শকও। সে দিক বিবেচনা করলে আমাদের প্রথম কাজ হবে ভাল দর্শক তৈরি করা , হল বিমুখ দর্শকদের হলে ফেরত নিয়ে আসা এবং তা তখনি সম্ভব হবে যখন একটি ভাল অনুষ্ঠান আমরা দর্শকদের উপহার দিতে পারব। ভাল দর্শক হলে টিকেট এবং প্রচার ভাল হবে এবং তখনই আয়োজকরা শিল্পীদের সন্মানী দেবার মত সামর্থ্য অর্জন করতে পারবেন বলে আমি মনে করি।

ফারহানা শান্তা, আরেক জনপ্রিয়

শিল্পী টরন্টোর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। তার কাছে প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল – টরন্টোতে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয় কোন শিল্পী পারফরম করলে তাকে সম্মানী দেওয়া হয় না। এ বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া কি?

ফারহানা শান্তা বলেন, এটা পুরোপুরি ঠিকনা যে স্থানীয় শিল্পীদের কোন সম্মানী দেয়া হয়না। আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি প্রতিবছরই আমি অনেকগুলো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করি পারিশ্রমিকের/সম্মানীর বিনিময়ে। আবার অনেক অনুষ্ঠান করি যেখানে পারিশ্রমিক বা সম্মানী পাইনা বা প্রত্যাশা করিনা। পারিশ্রমিক না পাওয়া অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে বেশীরভাগই আমাদের দেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপন অনুষ্ঠান। তবে একথা ঠিক যে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় আয়োজরা শিল্পীদেরকে পারিশ্রমিক দিতে চান না।

ফারহানার কাছে দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, আপনি কি মনে করেন আয়োজকরা ইচ্ছে করেই সম্মানী দেন না?

উত্তরে তিনি বলেন,অবশ্যই। কেননা একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গেলে শিল্পী ছাড়াও আরো অনেক কলা-কুশলীদের অংশগ্রহন থাকে । যেমন, মিউজিশিয়ান, সাউন্ড টেকনিশিয়ান, ইত্যাদি । আয়োজকরা প্রায় সবক্ষেত্রেই এদের পারশ্রমিক দিতে কখনও গড়িমসি করেন না কিন্তু শিল্পিদের পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে আয়োজকদের অনিহা বিশেষভাবে লক্ষনীয় । ফারহানা আরো বলেন, আয়োজকরা হলের ভাড়া দিতে পারেন, সাউন্ড সিস্টেমের ভাড়া দিতে পারেন, আপ্যায়নসহ অন্যান্য খরচ বহন করতে পারেন তবে কেন শিল্পীদের সম্মানী দেবার সময় অর্থের সংকট দেখা যায় এটা সব শিল্পীদেরই প্রশ্ন।

ফারহানা শান্তা সবশেষে বলেন, শিল্পীরাই অনুষ্ঠানের প্রধান চালিকা শক্তি বা আকর্ষন, সে ক্ষেত্রে শিল্পীদের পারিশ্রমিক/সম্মানী সবার আগে নিশ্চিত করেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা উচিত ।

টরন্টোর বাংলাদেশী কমিউনিটির বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, নাট্যকার, উপস্থাপক ও আবৃত্তি শিল্পী আহমেদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, শিল্পীরা সম্মানী পান এমন অনেক উদারণ আছে এখানে। তবে এ কথাও সত্য যে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই শিল্পীরা তাদের প্রাপ্য সম্মানী পান না। শিল্পীদেরকে সম্মানী না দেওয়ার একটি প্রবনতা এখানে লক্ষ্য করা যায়। এই প্রবনতা বা মনমানসিকতা অবশ্যই পরিহার করতে হবে বলে আমি মনে করি।

জানুয়ারী ১, ২০১৫