নড়বড়ে ও নিশ্চয়তাহীন চাকরি অনেক টরন্টোবাসীর জীবনধারা হয়ে উঠছে
জানুয়ারী ১, ২০১৫ :
ক্লডিয়া দুরহাম তার কর্মস্থলে এর সবকিছুই দেখেছেন। তাকে লাথি মারা হয়েছে, নির্বোধ বলে গালি দেয়া হয়েছে এবং সবচেয়ে মারাত্মক যে বর্ণবাদী অভক্তি তার প্রতি দেখানো হয়েছে।
তার ভাষায়, ‘‘এটি ছিলো খুবই বাজে চাকরি।’’ কিন্তু ‘‘কাউকে না কাউকে তো এই চাকরি করতেই হবে।’’
আর দুরহাম গত ১৭ বছর ধরে পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে এই কাজ করেছে এবং লাঞ্ছনা সহ্য করেছে। প্রদেশের সবচেয়ে নাজুক ব্যক্তিদের দেখাশোর জন্য ব্যক্তিগত সহায়তা কর্মী হিসাবে কাজ করতে গিয়ে দুরহাম অবশ্য নিজের কাজে গর্বিত। গত দুই দশকের মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই সে এই কাজ করেছে ভাল বেতন, নিয়মিত ছুটি এবং নিরাপদ কর্মস্থলের কারণে।
অনেক টরন্টোবাসীর জন্যই অনিশ্চিত কর্মসংস্থানের বিষয়টি দ্রুত জীবনধারার অংশ হয়ে উঠছে। এক হিসাবে দেখা গেছে জিটিএর ৪০ শতাংশ মানুষ তাদের চাকরির ক্ষেত্রে কোন ধরণের অনিশ্চয়তায় ভোগেন। এমনকি ঐতিহ্যগতভাবে স্থিতিশীল অবস্থানে থাকা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরাও এখন প্রায়শ কিছু সুবিধা ও ভাতার বিনিময়ে স্বল্প-মেয়াদি চুক্তিতে কাজে যোগ দিচ্ছে।
কিন্তু ৪০ শতাংশের মধ্যে আবার গভীর ফাঁকফোকর রয়েছে। এই শ্রেণীর প্রায় অর্ধেক সত্যিকার অর্থেই ভঙ্গুর কর্মসংস্থানÑ কাজের সময়সূচির অনিশ্চয়তা, আয়ের অনিশ্চয়তা এবং প্রায়শ স্বল্প মজুরির কারণে এগুলি ভঙ্গুর। আর বর্তমানে যখন অনিশ্চিত চাকরির বাস্তবতা ব্যাপকভাবে অনূভূত হচ্ছে তখন দেখা যাচ্ছে ঝুঁকিতে থাকা সেইসব লোকেদের বেশিরভাগেরই নির্দিষ্ট পরিচিতি রয়েছে: তারা হলো অভিবাসী। তারা হলো দৃশ্যমান সংখ্যালঘু এবং প্রায়শ তারা হলো নারী।
কানাডার সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভ-এর শেইলা ব্লক-এর মতে, এধরণের শ্রমিকরাই ‘‘স্বল্প-বেতনের অনিশ্চিত কাজে সবচেয়ে বেশি নিয়োজিত। আমরা দেখতে পারছি যে, অন্টারিওতে অন্যান্য শ্রমিকদের চেয়ে বর্ণবাদী আচরণের শিকার নারীদেরই নি¤œতম মজুরিতে কাজ করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।’’
ওয়ার্কার্স অ্যাকশন সেন্টারের দীনা ল্যাড বলেন, উন্নত যোগ্যতা অর্জনের জন্য বা ভাষার ওপর প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য অভিবাসী পরিবারগুলোর প্রায়শ তাদের সম্পদের এক শতাংশমাত্র বিনিয়োগের সক্ষমতা থাকে। সেই সম্পদ সচরাচর বিনিয়োগ করা হয় পুরুষদের পেছনে। শিশু প্রযতœ গ্রহণের মত সম্পদের অভাবেও নারীদের চাকরি বা প্রশিক্ষণ পাওয়া বিলম্বিত হয় এবং তাদের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় সামান্যই।
ল্যাড বলেন, মহিলারা চেষ্টা করতে এবং সহজে নিতে পারেন এমন কোন কাজটি রয়েছে? সেটি হলো ব্যক্তিগত সহায়তার কাজ। সেটি হলো শিশুর দেখাশোনা এবং পরিচ্ছন্নতার কাজ।’’
ক্লডিয়া দুরহামও এর ব্যতিক্রম নন। তিনি ক্যারিবীয় অঞ্চল থেকে ১৯৮৮ সালে কানাডার টরন্টোতে আসেন। মন্দ স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া তিন সন্তানের মা ক্লডিয়ার পক্ষে তার নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার পেছনে অর্থ ব্যয়ের সুযোগ ছিলো না। তিনি বলেন, ‘‘ওই সময় আপনি নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে পারেন না, আপনাকে আগে সন্তানদের কথাই চিন্তা করতে হবে।’’
তাই তিনি এমন এক কাজে নিয়োজিত হন যেখানে মোট শ্রমশক্তির ৯৭ভাগই নারী। ২০১৩ সালে পারসোনাল সাপোর্ট ওয়ার্কার্স রেজিস্ট্রির পক্ষে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, উল্লেখিত ৯৭ শতাংশের মধ্যে ৪০ শতাংশই হলো দৃশ্যমান সংখ্যালঘু নারী। যদিও তারা এক্ষেত্রে নিয়োজিত মোট শ্রমশক্তির মাত্র ১২ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। সমীক্ষায় অংশ নেয়া নারীদের প্রায় অর্ধেকই বলেছেন সামান্য ছুটি এবং খুবই সামান্য সুবিধা পাওয়ার কথা; ৬৪শতাংশ বলেছেন যে তাদের মজুরি খুবই কম।
ল্যাড বলেন, সাধারণত এসব কর্মীদের বিরাট অংশের জোগান দেয় বিভিন্ন হাসপাতালের ইউনিয়নভুক্ত শ্রমিকরা। কিন্তু এখন এর অনেকটাই চুক্তির বাইরে করা হচ্ছেÑ তাই এক অসম্ভব প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে যে, কে সবচেয়ে কম মজুরিতে কাজটা করতে পারবে।’’
এই একই ধরণ এখন অনেক সেক্টরেই খুব সাধারণ বিষয়। আর এটিই অন্যতম কারণ যেজন্য অনিশ্চিত চাকরি এখনকার
দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। ল্যাড বলেন, লোভনীয় চুক্তি করার বিষয়ে কেয়ার এজেন্সিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার অর্থ হলো, ‘‘বেতন ও সুবিধাদি দেয়ার ব্যাপারে সবসময়ই একটা নি¤œমুখি চাপ থেকে যাওয়া।’’
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর শেইলা নেস্মিথের মতে, এই বিষয়টি যখন ব্যক্তিগত সহায়তা কর্মীর ক্ষেত্রে আসে তখন এই নি¤œমুখি চাপের কারণে অনেকেই বিল পরিশোধ করা জন্য বিভিন্ন কাজ নিতে বাধ্য হন। ছুটির সময় বাড়িতে আসা-যাওয়ার জন্য বেশিরভাগই কোন ভাতা পান না। আর অনিশ্চিত সময়সূচির কারণে অনেককেই ফাঁকা সময় কাটাতে হয় কোনরকম সুবিধা ছাড়াই।
কিন্তু ব্যক্তিগত সহায়তা কর্মীদের ব্যাপারটা অনিশ্চিত কাজের মধ্যেও ভিন্নতা বহন করে কারণ এতে কিছু অপ্রত্যক্ষ চাপ এবং নাজুক ব্যক্তির সেবাযতেœর জন্য কিছু বাড়তি আশা করে থাকার ব্যাপার রয়েছে।
নেস্মিথ বলেন, “আপনি বলতে পারেন যে, বয়ঃবৃদ্ধ লোকটি অনিশ্চিত জীবন যাপন করছেন এবং অপেক্ষাকৃত কম বয়সী সেবাদানকারী অনিশ্চিত কাজ করে চলেছেন। কখনও সেবাদানকারী কিছুটা বাড়তি সময় কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন… কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এটি তার ব্যক্তিগত সময় থেকে ব্যয় হয়, আর এটি একটি বেসরকারী বিষয় হিসাবেই দেখা হয়, সরকারের পক্ষে দেখার মত কোন বিষয় হয়ে ওঠে না। সুতরাং এটি ঘরের কাজের লোকের দৈনন্দিন কাজের মধ্যে লুক্কায়িত থেকে যায়।’’
গোয়া ম্যাঙ্গো কাজ হারানোর ভয়ে তার আসল নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, তিনি পরিচিত একজন খদ্দেরের সহিংস আচরণের কথা জেনেও তার দেখাশোনার কাজ নিয়েছিলেন যদিও তার নিয়োগদাতা ওই খদ্দেরের কাজ ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
তিনি বলেন, “তার পাশে কেউ ছিলো না বলে আমি তার প্রতি দুঃখ বোধ করেছিলাম। কিন্তু তার বাড়িতে গিয়ে দেখি শুধু প্রশ্রাবের গন্ধ। সর্বত্র নোংরা ময়লা ছড়িয়ে আছে।”
কিন্তু শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হবার পর তিনি নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে অত্যন্ত জরুরী চাকরিটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
সেবা কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ম্যাঙ্গোর মত কর্মীদের কর্মপরিবেশের এখন কিছুটা উন্নতি হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, গত এক দশক ধরে তারা এই খাতের অর্থ বরাদ্দ অন্তত ১০০ ভাগ বাড়িয়ে বছরে ২৪০ কোটি ডলারে উন্নীত করেছে। ২০০৭ সালে অন্টারিও সরকার সরকারি অর্থায়নে ব্যক্তিগত সহায়তা কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি ঘণ্টায় ১২.৫০ ডলারে উন্নীত করে এবং ২০১৬ সালের মধ্যে এর পরিমাণ ১৬.৫০ ডলারে উন্নীত করা হবে।
কিন্তু নীতিগত ফাঁকফোকরের কারণেই দৃশ্যত কিছু কর্মী মজুরি বাড়ানোর প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে গেছে। ক্লডিয়া দুরহাম তাদের একজন। তার টরন্টো-ভিত্তিক এজেন্সি স্প্রিন্ট সিনিয়র কেয়ারকে সরকার তাদের কিছু কর্মীর জন্য বাড়তি মজুরি দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। তবে সবার জন্য নয়। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক স্ট্যাসি ল্যানডাউ বলেন, প্রদেশের সব এজেন্সিই একই ধরণের নির্দেশনা পেয়েছে। কিন্তু এটি অস্পষ্ট যে মন্ত্রণালয় কেন বিশেষ কিছু সার্ভিসের ক্ষেত্রে এই নির্দেশনা দিলো। প্রাদেশিক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জোয়ান উডওয়ার্ড ফ্রেজার টরস্টার নিউজ সার্ভিসকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নের আওতায় কর্মী সরবরাহকারী সব এজেন্সির ক্ষেত্রেই বাড়তি মজুরি দেয়ার বিষয়টি প্রযোজ্য হবে। নীতিগত ফাঁকফোকর বন্ধ করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হবে কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়েছে।
যেহেতু ব্যক্তিগত সহায়তাদানকারীরা কোনও নিয়ন্ত্রিত সংগঠনের কর্মী নয় সেহেতু নীতিগত ফাঁকফোকরের কারণে কতজন কর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। গার্হস্থ্য কাজে নিয়োজিত কর্মীদের সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশের প্রতিনিধিত্বকারী কানাডার সরকারি কর্মচারী ইউনিয়নের স্টেলা ইয়েডন বলেন, তিনি আশঙ্কা করেন যে, এসব কর্মীরা ইউনিয়নভুক্ত না হওয়ায় অনেক কর্মী এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়ার জন্য লড়াই করতে পারেন এমন কাউকে পাশে পাবে না।
প্রায় দুই দশক পর দুরহাম তার কর্মক্ষেত্রে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন। তাকে স্প্রিন্টে পূর্ণকালীন কাজের সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং একটি ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েচে। এখন তিনি তার কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাগ্যবতী। কিন্তু ১৭ বছর ধরে কাজ করার পর এখন তিনি এজন্য ক্ষুব্ধ যে, তার কাজের খাতটি এখনও অনেক বিভক্তি এবং অসাম্যের শিকার।
তিনি বলেন, “নির্বাচনের সময় প্রিমিয়ার ওয়েনি বলেছিলেন, ব্যক্তিগত সহায়তা কর্মীরা বর্ধিত মজুরি পাবে। তিনি বলেননি যে, কিছু সংখ্যক এই সুবিধা পাবে। তিনি এখন তার চেয়েও ভালো কিছু করতে পারেন।’’
শুধু মজুরি বাড়ানো হলে এই খাতটির ভালো কাজের খাত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে। এক্সেস অ্যালায়েন্স মাল্টিকালচারাল হেলথ অ্যান্ড কমিউনিটি সার্ভিসের যোগেন্দ্র শাক্য বলেন, “ অধিকতর স্থায়ী এবং পূর্ণকালীন চাকরি সৃষ্টির জন্য কিছু মানদ- তৈরির ব্যাপারে আমাদের দরকার জাতীয় বা প্রাদেশিক পর্যায়ের অঙ্গীকার। তাহলেই সুস্থ জাতি পাওয়া যাবে।’’
ম্যাঙ্গো যোগ করেন যে, ‘‘আমি মনে করি আমরা যেহেতু বাজে সার্ভিস দিই না তাই আমরা পূর্ণকালীন কাজের নিশ্চয়তা পেতে পারি। আমরা সমস্ত আন্তরিকতা দিয়ে আমাদের সেরাটাই দিই।” -টরস্টার নিউজ সার্ভিস