টরন্টো এখন কানাডার বৈষম্যের রাজধানী

মে ১০, ২০১৫:

টরন্টো এখন কানাডায় আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্যের রাজধানী। ইউনাইটেড ওয়ে টরন্টোর নতুন এক গবেষণা রিপোর্টে দেখা গেছে যে, এই নগরীতে ধনী ও গরিব পরিবারের মধ্যকার ব্যবধান জাতীয় হারের চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণে বাড়ছে।
প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, টরন্টোতে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য ১৯৮০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ৩১ শতাংশ বেড়ে গেছে। এটি কানাডার যে কোনও বড় শহরের চেয়ে নাটকীয় বৃদ্ধি। কারণ সারাদেশে ধনী-গরিবের আয়ের ব্যবধান বেড়েছে গড়ে ১৪ শতাংশ হারে।
আয়ের অসাম্য বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে একটি বিকাশমান সংস্থার ওই রিপোর্টে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয় যে, নগরীর ক্রমবর্ধমান ব্যবধান সামাজিক সচলতাকে স্থবির করে দিতে, সামাজিক বন্ধনকে দুর্বল এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে খর্ব করতে পারে।
তবে গবেষণায় এটিও বেরিয়ে এসেছে যে, টরন্টোবাসী এখনও পরস্পরের প্রতি উচ্চস্তরের আস্থা পোষণ করে। এতে নীতিনির্ধারকদেরকে সামাজিক গাথুনি শিথিল হয়ে পড়ার আগেই বৈষম্যের বিষয়টি সামলে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়।
ইউনাইটেড ওয়ে টরন্টোর প্রেসিডেন্ট এবং সিইও সুসান ম্যাকইসাক বলেন, “এটি অবশ্যই একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা, তবে আমরা দক্ষিণে আমাদের প্রতিবেশি কিছু বৃহত্তম শহরের পথ অনুসরণ করিনি। এটি হচ্ছে একটি সতর্ক বার্তা। আমাদেরকে সক্রিয় হতে হবে এবং আমরা তা পারি।”
কানাডার বৃহত্তম শহরগুলোর মধ্যে টরন্টো যেহেতু ন্যায্যতার দিক থেকে এখনও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে, রিপোর্টে ১৯৯০ থেকে কীভাবে টরন্টোর আয়ের বৈষম্য নাটকীয়ভাবে ত্বরান্বিত হয়েছে এবং কার্যত মন্ট্রিয়ল, ভ্যাঙ্কুভার ও ক্যালগেরিকে ছাড়িয়ে গেছে সেই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ওই শহরগুলিতে উল্লেখিত ২৫ বছর সময়ের মধ্যে পারিবারিক আয়ের বৈষম্য বেড়েছে যথাক্রমে ১৫, ১৭ ও ২৮ শতাংশ হারে।
রিপোর্টে বলা হয়, নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন এমন কিছু ফ্যাক্টর যেমন গ্লোবালাইজেশন এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তন যা উচ্চমানের ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের চাকরি থেকে অনিশ্চিত চাকরির দিকে ঠেলে দিয়েছে সেগুলি দিয়ে ক্রমবর্ধমান অসাম্যের বিষয়টি অংশত ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
এর আগে ইউনাইটেড ওয়ে টরন্টো এবং ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির আরেকটি গবেষণায় দেখা যায় যে, গ্রেটার টরন্টো এলাকায় শ্রমিকদের অর্ধেকই অনিশ্চিত চাকরিতে নিয়োজিত।
রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি নীতিগত সিদ্ধান্তেও কেবল নগরীর অসাম্যের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। সেইসঙ্গে কর ব্যবস্থার সংস্কার এবং সামাজিক সুবিধা কর্তন করা হয়েছে। ইউনাইটেড ওয়ের গবেষণা পরিচালক মিচেলিন লাফ্লেচি বলেন, নগরীর জন্য বৈষম্য অপরিহার্য ছিলো না। তিনি বলেন, “আমরা এটিকে মন্থর করতে পারতাম, এর প্রভাব প্রশমিত করতে পারতাম কিংবা এটিকে এমনকি সামান্য হলেও বিপরীত মুখে পাল্টে দেয়া সম্ভব ছিলো। আর একটি সমাজ হিসাবে আমরা যা কিছু করতে পারি তা হলো এ বিষয়ে আলোচনায় বসা এবং একটি অভিন্ন কর্মপন্থা ঠিক করে নেয়া।”
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডেভিড হালচানস্কির সাড়া জাগানো গবেষণাতেও একইরকম বক্তব্য এসেছে। তিনি নগরীর সঙ্কুচিত হয়ে আসা মধ্য আয়ের এলাকার চিত্র তুলে ধরেছেন। ইউনাইটেড ওয়ের রিপোর্টে টরন্টোর ক্রমবর্ধমান হারে জটিল হয়ে ওঠা ভৌগোলিক বিভক্তির ব্যাপারেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। এতে বলা হয়, প্রতিবেশি লোকালয়গুলোর মধ্যে আয়ের বৈষম্য ১৯৮০-র পর থেকে ৯৬ শতাংশ বেড়েছে। এতে যুক্তি দেখানো হয় যে, এধরণের মেরুকরণের প্রভাব ব্যাপকভাবে অনুভব করা যাবে।
ম্যাকইসাক বলেন, “আয়ের বৈষম্য যেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিদ্যমান সেখানে সমাজে আমাদের জানা সব ধরণের বিষয়ই ত্বরান্বিত হবে।”
ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ রিচার্ড জি উইলকিনসন এবং কেট পিকেট-এর ব্যাপকভিত্তিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, এমনকি ধনী দেশগুলোতেও আয়েল ক্ষেত্রে বৈষম্য বেশ কিছু সামাজিক সমস্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেমন, ব্যাপক সহিংসতা, কারারুদ্ধ করা, মাদকাসক্তি এবং স্থ’ূলোতা। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংস্থার এক
রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর আয় বৈষম্যের নিশ্চিত প্রভাব রয়েছে।
ইউনাইটেড ওয়ের গবেষণায় কর দেয়ার আগের আয় কিন্তু সরকারের স্থানান্তরের পরের আয়ের মধ্যে তুলনা করার জন্য বৈষম্য পরিমাপের সাধারণ পরিমাপক জিনি কোএফিশিয়েন্ট এবং স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে। এতে কর দেয়ার পরের আয়ের তুলনা না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কারণ ২০০৬ সালের আগের কর আদায় সম্পর্কিত কোন তথ্য নেই। তাই আগের সময়ের সঙ্গে তুলনা দেখানো অসম্ভব।
এটি বেসরকারি জরিপ সংগঠন ইকোস রিসার্চ অ্যাসোসিয়েটস এর সঙ্গে মিলে একটি জরিপ চালায়। এই জরিপে টরন্টোবাসীকে জিজ্ঞাসা করা হয় তারা এই আয় বৈষম্যকে কীভাবে দেখে। আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষের মধ্যে এই জরিপে দেখা যায়, ৮৬ শতাংশ মানুষ মনে করে তাদের শহরের এই আয় বৈষম্য খুবই বেশি। প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষ বলেছে, তারা মনে করেন যে, এগিয়ে যাওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম যথেষ্ট নয় এবং এক-তৃতীয়াংশ বলেছে যে, তারা আগের প্রজন্মের মানুষদের চেয়ে খারাপ আছেন বলে মনে করেন।
লাফ্লেচি বলেন, “ আয়, বয়স, লিঙ্গ, দশ্যমান সংখ্যালঘুর মর্যাদা এবং শিক্ষার স্তর নির্বিশেষে সব ধরণের মানুষ মনে করেন যে, এটি ঘটছে। জনগণ মনে করে যে, এগিয়ে যাওয়ার জন্য মেধা আর ভিত্তি হিসাবে কাজ করছে না। আমার মনে হয়, জনগণের এধরণের ভাবনা এটি সমস্যা কারণ, এটি একটি ইঙ্গিত যে, জনগণ এমন মনে করছে না যে, ঘটনাপ্রবাহ তাদের জন্য ভালো যাচ্ছে না।”
জরিপে তরুণ টরন্টোবাসীর সম্ভাবনা দিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের বিসয়টিও জানা গেছে। মাত্র ১৭ শতাংশ মানুষ মনে করেন যে, আজ থেকে ২৫ বছর পর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের লোকেরা ভাল থাকবে।
ডনয়া সেন্টার অব আর্টস-এর নির্বাহী পরিচালক মার্ক ক্যাম্পবেল-এর শুক্রবার ওই রিপোর্টের ওপর এক সিম্পোজিয়ামে বক্তৃতা করার কথা রয়েছে। তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি এবং পোস্ট গ্রাজুয়েট ইন্টার্নশিপ ক্যারিয়ার গঠনে ভূমিকা রাখছে না বরং অনিশ্চিত চাকরির দিকেই ঠেলে দিচ্ছে, সেই অবস্থায় আশাবাদী থাকা বেশ শক্ত।”
তবে উদ্বেগের মধ্যেও গবেষণা রিপোর্টে এটাও দেখা গেছে যে, টরন্টোবাসী তাদের নগরী সম্পর্কে ব্যাপকভাবে ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন রয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, ৪৬ শতাংশ মানুষ বলেছে, তারা মনে করেন যে, সরকার তাদের জীবনের জন্য অনুকূল ভূমিকা পালন করছে।
ইকোস-এর প্রতিষ্ঠাতা ফ্রাঙ্ক গ্রেভস বলেন, “আমি মনে করি, এটা আন্তরিকভাবেই বলা যায় যে, এখানে এখনও প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে যথেষ্ট আস্থার জায়গা রয়েছে যাতে জনগণ মনে করে যে, এই সমস্যাটা সমাধানযোগ্য।”
জরিপে দেখা গেছে, ৯৫ ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে যে, তারা ব্যক্তিগতভাবে টরন্টোতে পরিবর্তনকে প্রভাবিত করতে পারেন, আর ৫৭ ভাগ মানুষ মনে করেন নগরীর বেশিরভাগ মানুষকেই বিশ্বাস করা যায়। এই সংখ্যাটি জাতীয় গড়ের চেয়ে সামান্য বেমি। জাতীয় পর্যায়ে এই গড় হলো ৫৫ শতাংশ।
যদিও স্বল্প আয়ের টরন্টোবাসী তাদের উচ্চ-আয়ের প্রতিপক্ষের চেয়ে বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে তবুও লাফ্লেচি বলেন, এই তথ্য নগরীর জন্য “শুভ বার্তা”।
তিনি বলেন, “টরন্টোর মত একটি বড় শহরে বা এমন বিচিত্র একটি শহরে বিশ্বাসের স্তর কম হওয়াটাই স্বাভাবিক। জনগণ অনুভব করে… একই চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তারা এমনটাও মনে করে যে, টরন্টোতে ইতিবাচক কিছু রয়েছে যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা যায়। আর এটাই আমাদের দেখিয়ে দেয় যে, আমাদের মধ্যে এখনও সামাজিক সংলগ্নতা বেশ ভাল পরিমাণেই রয়েছে।”
নীতি-নির্ধারকদেরকে জনগণের শুভ ইচ্ছাকেই পুঁজি করতে হবে উল্লেখ করে রিপোর্টে টরন্টোর সম্প্রসারমান আয়ের ব্যবধান ঘুঁচাতে বেশ কিছু পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, তরুণদেরকে ভালো শিক্ষার ক্ষেত্রে সমান সুযোগ দেয়া যা শুরু করতে হবে উচ্চ মানের এবং সবার সাধ্যের মধ্যে থাকা শিশু প্রযতেœর মধ্য দিয়ে। এতে মেট্রোলিঙ্কস পরিকল্পনার মত সামাজিক সুবিধা চুক্তির মত কর্মসূচির মাধ্যমে ভাল চাকরির সুযোগ সৃষ্টিরও সুপারিশ করা হয়। ওই উদ্যোগের মাধ্যমে স্বল্প-আয়ের লোকেদেরকে এগলিংটন টাউনের নির্মাণ থেকে সৃষ্টি হওয়া ভালো চাকরির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হয়। প্রদেশটির কর্মসংস্থান ও শ্রমমান পর্যালোচনা যা গত সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছে রিপোর্টে তার প্রশংসা করা হয়েছে এই বলে যে, এটি নগরীর বর্ধিষ্ণু অনিশ্চিত চাকরীজীবীদের কর্মস্থলে সুরক্ষা দেয়ার একটি বিরাট সুযোগ।
ম্যাকইসাক বলেন, “মূল বিষয় এই যে, আমরা কর্মসংস্থান, তরুণদের সুযোগ-সুবিধা এবং শক্তিশালী লোকালয় গড়ে তোলার দিকে নজর দিচ্ছি। আমার বিশ্বাস, সরকারি ও বেসরকারি খাত এবং একইসঙ্গে কমিউনিটি খাতের অনেক কিছু করার রয়েছে।” -টরস্টার নিউজ সার্ভিস