কানাডায় মুসলিম বিদ্বেষ বনাম সহিষ্ণুতা

নভেম্বর ৮, ২০১৪: ২২ অক্টোবর এক সন্ত্রাসী আক্রমনের ঘটনা ঘটে কানাডার জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু পার্লামেন্ট ভবনে। ঘটনার খল নায়ক সন্ত্রাসী মাইকেল জেহাফ বিবু বন্দুক হাতে পার্লামেন্ট ভবনে প্রবেশ করার আগে অনতিদূরে অবস্থিত ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়ালে কর্তব্যরত এক সেনা সদস্য কর্পোরাল নেথান কিরিলোকে পিছন দিক থেকে গুলি করে হত্যা করেন।

ঐ ঘটনার মাত্র ৪৮ ঘন্টা আগে মন্ট্রিয়ল থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে একটি ছোট শহরে ঘটে আরেক সন্ত্রাসী ঘটনা। সন্দেহভাজন এক জঙ্গী মার্টিন কুট্যুর রুল্লো দুই সেনা সদস্যকে গাড়ি চাপা দেন। এতে প্যাট্রিক ভিনসেন্ট নামের এক সেনা সদস্য নিহত হন এবং অপরজন আহত হন। গাড়ি চাপা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন মার্টিন কুট্যুর রুল্লো নামের ঐ সন্ত্রাসী।

পর পর দুটি সন্ত্রাসী ঘটনায় যুগপৎ আতঙ্কিত ও বিস্মিত হয়ে পড়েন কানাডার সাধারণ মানুষ। আতঙ্কিত হয়ে পড়েন কানাডা প্রবাসী মুসলিম সম্প্রদায়ও। নাইন এলিভেন এর ঘটনার জের এখনো চলছে গোটা উত্তর আমেরিকায়। এর মধ্যে কি এবার যোগ হলো কানাডার ‘নাইন এলিভেন’? অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে দিনভর অপেক্ষা করছিলেন কানাডার মুসলিম সম্প্রদায়। তারা কায়মনবাক্যে কেবলই প্রার্থনা করছিলেন যাতে হামলাকারীর পরিচয়ের সাথে মুসলিম নামের কোন সম্পর্ক না থাকে। কিন্তু দিন শেষে জানা গেল আক্রমনকারী একজন ধর্মান্তরিত মুসলমান। কুইবেকের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিটিও ধর্মান্তরিত মুসলমান। তাহলে কি হতে যাচ্ছে? বা কি হবে কানাডার মুসলিম অধিবাসীদের? আবারো কি তাদের বিরুদ্ধে হেটক্রাইম বৃদ্ধি পাবে বা ইসলামোফোবিয়া কি এখন চূড়ান্ত রূপ নিবে? রব উঠবে মুসলমান খেদাও আন্দোলনের?

পর পর দুটি সন্ত্রাসী হামলার পর এরকমই এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে কয়েকদিন কাটাতে হয়েছে কানাডার মুসলমানদেরকে। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দল ও আরসিএমপি একে জঙ্গী হামলা বলেই চিহ্নিত করেছে। ফলে দুশ্চিন্তা আরো বৃদ্ধি পায় মুসলমান সম্প্রদায়ে মধ্যে। তবে বিরোধী এনডিপি দলের প্রধান থমাস মুলকেয়ার একে জঙ্গী হামলা বলতে নারাজ। তিনি বলেন, আমাদের হাতে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই এ কথা বলার যে, এটি জঙ্গী হামলা। আমরা যতদুর জেনেছি, পার্লামেন্ট ভবনে হামলাকারী ব্যক্তিটি ছিল একজন মানসিক রোগী এবং সে তার ঐ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার জন্য সাহায্য খুঁজছিল।

কিন্তু থমাস মুলকেয়ারের এই বক্তব্যেও মুসলমান সম্প্রদায় আস্বস্ত হতে পারছিলেন না। আর ঠিক এমনই সময় ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিউ ক্লিপ বয়ে আনলো তাদের জন্য এক নির্ভরতার বাণী। পার্লামেন্ট ভবনে হামলার ঘটনাকে কেউ কেউ কানাডার ‘নাইন এলিভেন’ এর সঙ্গে তুলনা করলেও বাস্তবে কানাডার সাধারণ মানুষ সেরকম ভাবছেন না। বিষয়টিকে তারা বিচ্ছিন্ন ফেনাটিক ঘটনা হিসেবেই দেখছেন এবং এর জন্য তারা কানাডায় বসবাসরত সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠিকে অভিযুক্ত করছেন না।

ভিডিওটি তৈরী করা হয়েছিল সন্ত্রাসী ঐ দুটি হামলার পর মুসলমানদের সম্পর্কে কানাডার সাধারণ মানুষ কি ভাবছে বা তাদের প্রতিক্রিয়া কি তা দেখার জন্য। কানাডায় জন্ম নেয়া প্যালেস্টাইন বংশোদ্ভূত ওমর আলবাচ নামের এক যুবক তার দুই বন্ধুকে নিয়ে ভিডিওটি তৈরী করেন। ভিডিওটি তৈরী করার জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ি তারা হ্যামিলটনে যান যেখানে অটোয়ায় সন্ত্রাসী হামলায় নিহত সেনা সদস্য কর্পোরাল নেথান কিরিলোকের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। সেখানে তারা মুসলিম বিদ্বেষমূলক কয়েকটি সাজানো ঘটনার অবতারণা করেন এবং দেখার চেষ্টা করেন ঐ ঘটনায় কানাডিয়ানদের প্রতিক্রিয়া কি হয়। প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় ওমরের এক বন্ধু ইসলামী পোষাক পরে বাস ছাউনির পাশে দাড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে। এমন সময় ওমরের আরেক বন্ধু এগিয়ে গিয়ে ঐ ইসলামী পোষাক পরা ব্যক্তিটিকে সবার সামনেই জঙ্গী হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে অপদস্থ করার চেষ্টা করেন এবং তাকে বলেন সে যাতে পরবর্তী বাসে উঠে। ধারনা করা হয়েছিল হয়তো অন্য যাত্রীদের মধ্যেও কেউ কেউ একই আচরণ করতে পারেন। কিন্তু ঘটলো তার ঠিক উল্টোটি । অপেক্ষমান যাত্রীদের মধ্যে দুইজন তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বললেন, অটোয়ার ঘটনা অবশ্যই দুঃখজনক। কিন্তু একজন ব্যক্তির পোষাক বা বিশ্বাসের কারণে তাকে এভাবে অপদস্থ করার অধিকার কারো নেই। তারা এও বললেন যে অটোয়া ও কুইবেকের ঘটনা নিছকই ধর্মান্ধদের কান্ড।

দ্বিতীয় দৃশ্যটি ছিল এরকম- একটি বাড়ির সামনে অপেক্ষমান ইসলামী পোষাক পরা এক যুবককে ঐ স্থান থেকে সরে যেতে বলছিলেন একজন ইসলাম বিদ্বেষী যুবক। আসপাশে আরো কিছু লোকজন অপেক্ষমান ছিলেন। বিষয়টি তাদেরও নজরে পড়ে। তারা এই বিদ্বেষী আচরণকে মেনে নিতে পারেনি। শুধু তাই নয়, এদেরই একজন এসে বিদ্বেষী ঐ যুবকের উপর হামলে পড়েন। ঘুষি মেরে তার নাক ফাটিয়ে দেন। বিদ্বেষী সাজা যুবকটি অবস্থা বেগতিক দেখে আক্রমন উদ্যত যুবকটিকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে এটি একটি সাজানো ঘটনা। কিন্তু তার আগেই ঘটনা ঘটে যায়।

দুটি দৃশ্যেই দেখা গেল কানাডার সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলামোফোবিয়া আগের মত কাজ করছে না। তারা বিশ্বাস করেন গুটি কতক ধর্মান্ধ ব্যক্তির কারণে গোটা মুসলিম সম্প্রদায়কে দোষারোপ করার কোন যুক্তি নেই। কানাডার সাধারণ মুসলমানরা জঙ্গী নন। তাদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করাই শ্রেয়।

মুসলিমদের প্রতি কানাডিয়ানদের এই মনোভাব একদিনেই গড়ে উঠেনি। নাইন এলিভেনের পর অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটেছিল সত্যি। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এবং জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানাডার মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন মসজিদের ইমামদের প্রতিবাদী ভূমিকার কারণে অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। এ ব্যাপারে কানাডিয়ান মেইন স্ট্রিমের মিডিয়াগুলোও (দুএকটি বাদে) যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও ইমামদের জঙ্গীবিরোধী বক্তব্যকে জনসমক্ষে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে।

ভিডিও ক্লিপটির নির্মাতা ওমর বলেন, সে বিশ্বাস করে তার ভিডিওর মাধ্যমে কানাডিয়ানদের সহিষ্ণুতাই প্রকাশ পেয়েছে। তবে আমরা মনে করি, ওমরের এই বক্তব্যে সন্তুষ্ট হয়ে কানাডার মুসলিম সম্প্রদায়কে এখানে থেমে থাকলেই চলবে না। কারণ, জঙ্গীবাদীদের কারণে কানাডায় যে ইসলামোফোবিয়া সৃষ্টি হয়েছিল তা এখনো সম্পূর্ন মুছে যায় নি। ভিডিও চিত্রে আমরা যা দেখেছি তা উৎসাহব্যঞ্জক হলেও মূলত সেটি একটি খন্ডিত চিত্র। তাই কানাডা প্রবাসী মুসলীম সম্প্রদায়কে আরো সতর্ক হতে হবে জঙ্গীদের বিরুদ্ধে। মনে রাখতে হবে তারা এই কানাডারই অংশ। এই দেশকে নিরাপদ রাখতে তাদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।