কানাডার নাগরিকত্বের জন্য একটি খারাপ বছর
কানাডার নাগরিকত্ব এখন আর অধিকার নয় একটি সুবিধা যা আচরণের সঙ্গে শর্তাধীন
ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৫
হুমেরা জাবির
কানাডার নাগরিকত্ব আইনে বড় ধরণের পরিবর্তন সাধনের সময় গত জুন মাসে মন্ত্রী ক্রিস আলেকজান্ডার এর সপক্ষে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেন যে, “নাগরিকত্ব কারও অধিকার নয়, এটি একটি সুযোগমাত্র।” ওই সংস্কার কর্মসূচিতে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর পরিবর্তন হলো মারাত্মক অপরাধে অভিযুক্ত কারও নাগরিকত্ব হরণ করার ক্ষমতা নাগরিকত্ব ও অভিবাসন মন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত করা।
এর আগে প্রতারণামূলকভাবে অর্জন করা হলেই কেবল নাগরিকত্ব হরণ করা যেতো। কিন্তু গত বছরের সংস্কারের পর নাগরিকত্বকে সদাচরণের সঙ্গে শর্তাধীন করা হয়েছে। দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে এমন যে কোন নাগরিক বিশ্বের যে কোনও স্থানে সন্ত্রাসবাদ, বিশ্বাসঘাতকতা বা গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনায় দায়ে অভিযুক্ত হলে তার কানাডার নাগরিকত্ব হরণ করা যাবে। সুতরাং নাগরিকত্ব এখন আর কোনও অধিকার নয়, এটি আচরণের সঙ্গে শর্তাধীন একটি সুযোগমাত্র।
এর মধ্য দিয়ে কানাডার নাগরিকত্বের অর্থ কীভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে তারই প্রতিফলন ঘটে। নাগরিকত্ব হরণের ক্ষমতা এখনও প্রয়োগ করা হয়নি। তবে আগামী বছরগুলোতে হয়তো জানা যাবে কোন কানাডীয় নাগরিকদের সরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে পরিণত করা হবে।
নাগরিকত্ব হরনের বিষয়টি মোটেও সামান্য বিষয় নয়। সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বিশ্ব ব্যবস্থায় নাগরিকত্ব একটি প্রয়োজনীয় অধিকার। রাষ্ট্রবিহীনতার ওপর লেখালেখির ক্ষেত্রে অগ্রণী হান্নাহ আরেন্ডট (ঐধহহধয অৎবহফঃ) এটিকে এই বলে সংজ্ঞায়িত করেন যে, “একজন নাগরিককে তার সমাজ যেসব অধিকার দেয় তা থেকে তাকে কখনওই বঞ্চিত করা যাবে না।” নাগরিকত্ব থেকে বাদ দেয়ার অর্থ হলো রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জন্য যেসব অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে তা তাকে দিতে পুরোপুরি অস্বীকার করা।
এর আগে কখনওই কানাডার নাগরিকত্বকে তার নাগরিকদের সদাচরণের সঙ্গে শর্তযুক্ত সুবিধা হিসাবে পরিগণনা করা হয়নি। এটিকে বৈধতা দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত এই মৌলিক অধিকারের মূল্যবোধকে ব্যাপকভাবে খর্ব করেছে।
প্রথমত, নাগরিকত্ব এখন আর সব কানাডীয়র সমতার সুরক্ষা দেয় না। কারণ কানাডা ১৯৬১ সালের রাষ্ট্রহীনতা হ্রাস সংক্রান্ত সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ, সুতরাং আর কোনও দেশের নাগরিকত্ব নেই এমন কারও নাগরিকত্ব কানাডা হরণ করতে পারে না। সেজন্য আইনের সংস্কারে তাদের নাগরিকত্ব হরণের কথা বলা হয়েছে যারা দ্বৈত নাগরিক অথবা যারা অন্য কোথাও নাগরিকত্বে দাবি করতে পারবেন। হাইতি থেকে ইসরাইল এবং ফিলিপিন্সসহ অসংখ্য দেশ আছে যারা জন্মস্থানের ভিত্তিতে নয় বরং নাগরিকত্ব দিয়ে থাকে বাবা-মায়ের ধারাবাহিকতা, ধর্ম, জাতিগোষ্ঠীগত পরিচয় এবং অন্যান্য বন্ধনের উপর ভিত্তি করে। একটি পরিবারের সন্তান বা নাতি-নাতনিরা বিদেশের মাটিতে জন্মগ্রহণ করার কারণে তাদের নাগরিকত্ব হরণ করা হতে পারে কারণ তারা তাদের নিজ দেশে আগে কখনও না গেলেও তত্ত্বগতভাবে তারা নিজ দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে। আইনের পরিবর্তন বৈষম্যমূলকও, কারণ এতে কানাডায় যারা স্থানীয় এবং অন্য কোনও দেশের নাগরিকত্ব দাবি করতে পারবে না তাদের প্রতি বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। সকল নাগরিককে সমভাবে সুরক্ষার নিশ্চয়তা না দিয়ে আইনে নাগরিকদের বিভিন্ন স্তর সৃষ্টি করা হয়েছে যাদের জন্য একই ধরণের অপরাধ করলে ভিন্ন ভিন্ন পরিণতির অবকাশ রাখা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, অভিবাসনের বিষয়টিকে কেন্দ্রীয় সরকারের অপরাধমূলক করে তোলার ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সংস্কারের আওতায় নাগরিকত্বকেও অপরাধমূলক করে তোলা হয়েছে। কানাডায় অপরাধ করার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন কিন্তু নাগরিক নন এমন ব্যক্তিদেরকে আটক করা বা দেশে ফেরত পাঠানো রক্ষণশীল সরকারের অগ্রাধিকারের বিষয়ে পরিণত হয়েছে যার ফলে বৈধতা নেই এমন ব্যক্তিরা একবার কারাদ- এবং তারপর দেশ থেকে বের করে দেয়ার মত দ্বিগুণ শাস্তি ভোগ করছেন।
নাগরিকত্ব এখন একটি শাস্তিদানের হাতিয়ার। যেসব নাগরিক ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবেন তাদের
ফৌজদারি আইনে শাস্তি না দিয়ে বরং অভিবাসন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হবে। এই উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব সংরক্ষণ আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৯৫৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, কোনও নাগরিক যে অপরাধই করুক না কেন তাকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা সরকারের জন্য শাস্তিমূলক হাতিয়ার হতে পারে না। পাশ্চাত্যের বেশিরভাগ দেশ এধরণের শাস্তির ব্যবস্থা করেনি, সুতরাং এক্ষেত্রে কানাডা সংখ্যালঘুর পর্যায়ে রয়েছে।
এধরণের অপরাধের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনের প্রয়োগের পরিবর্তে অভিবাসন আইন প্রয়োগে সরকারের উদ্দেশ্য হলো সবচেয়ে উদ্বেগজনক। উদ্বাস্তু বিষয়ক আইনজীবীদের কানাডীয় অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, আইন লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ সক্ষম। তাদের ভাষায়, “শাস্তিদানের লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের মধ্যযুগীয় নির্বাসনদন্ড ফিরিয়ে আনার কোনও প্রয়োজন নেই।”
কিন্তু নাগরিকত্ব বঞ্চিত করা সরকারের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে কারণ এর ফলে লোকেদের বিচার পাবার এবং ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার নাকচ করে দেয়া যায়। আর যারা নাগরিক নয় এমন লোকেদের আইনের বাইরে গিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া যেতে পারে। মেহের আরার-এর ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ ধরণের ঘৃণ্য মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা কানাডায় ঘটে না এমন নয়। যারা নাগরিক নয় তারা সরকারের ক্ষমতার কাছে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে কারণ তাদের পক্ষে কানাডা বা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অধিকার দাবি করার খুব সামান্যই সুযোগ রয়েছে।
অথবা সম্ভবত কারণটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। কেন্দ্রীয় সরকার এবং কিছু সংখ্যক কানাডীয় মনে করেন যে, নির্দিষ্ট কিছু নাগরিককে তাদের অপরাধের জন্য নির্বাসনে পাঠানো যেতে পারে। কানাডায় জনসমক্ষে সবচেয়ে বেশি নিন্দিত দোষী সাব্যস্ত সন্ত্রাসী ওমর খাদর-এর ঘটনা এই যুক্তির পেছনে সবচেয়ে বড় ইন্ধন। খাদরকে দোষী সাব্যস্ত করার বিষয়টি সম্পূর্ণ আইনসম্মত বলে হারপার সরকার অত্যন্ত জোরালোভাবে তুলে ধরেছে। গুয়ান্তানামো বেতে মার্কিন সেনা কমিশনের আইনের শাসন লংঘন এবং নির্যাতনের মত বিকৃত পথ অবলম্বনের পরও কানাডায় এটা ঘটেছে। খাদর জন্মগতভাবে কানাডীয় নাগরিক কিন্তু সে জাতিগতভাবে মিসরীয় এবং সে মিসরের নাগরিকত্ব দাবি করতে পারে। খাদরের ঘটনা এটি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য হলো জনগণ যাদেরকে দেশের জন্য ভালো মনে করবে না তাদেরকে শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে তারা রাজনৈতিক ফায়দা ওঠাতে চায়।
পাশ্চাত্যের আরেকটি দেশ নাগরিকত্ব হরণের আইন করেছে, সেটি হলো যুক্তরাজ্য। তবে তারা কানাডার মত না হয়ে বরং আইনটি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করছে। নাগরিকদের বিচারের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করা, সন্দেহের বশে ব্যবস্থা নেয়া এবং রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ করে দেয়ার জন্য ক্ষমতার ব্যবহারের জন্য যুক্তরাজ্য সরকার সমালোচনার মুখে পড়েছে। যুক্তরাজ্যের মানবাধিকার আইনজীবী এবং হাউস অব লর্ডস-এর সদস্য হেলেনা কেনেডি সরকারের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, “নাগরিকত্ব কোনও সুবিধা নয়, এটি হলো সুরক্ষাপ্রাপ্ত আইনগত মর্যাদা…আমরা যাকে অপরাধ বলে গণ্য করি তার জবাব হলো বিচারের ব্যবস্থা করা।” তিনি আরও বলেন, “আধুনিক বিশ্বে এর সকল পরিণতি থেকে বঞ্চিত করার অর্থ হলো সবচেয়ে গুরুতর শাস্তিমূলক অবরোধ আরোপের সামিলÑ যা ফৌজদারি আদালতে বিচার, দোষী সাব্যস্ত করা, সাক্ষ্যপ্রমাণের রুদ্ধদ্বার বা উন্মুক্ত পরীক্ষা এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগদান ছাড়াই আরোপ করা হয়েছে।”
চূড়ান্ত পর্যায়ে এই সংস্কারের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক ফলাফল হলো এই যে, নাগরিকত্বের বিষয়টি এখন একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সংস্কারের আগে প্রতারণামূলকভাবে নাগরিক হবার অপরাধে কারও নাগরিকত্ব হরণের সিদ্ধান্ত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সরকারের সিদ্ধান্ত পুরর্বিবেচনার জন্য আদালতে শুনানী করার সুযোগ পেতেন। এখন সে সুযোগ নেই। একজন বিচারকের পরিবর্তে এখন একজন রাজনীতিবিদ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কারা নাগরিকত্ব হরণের যোগ্য, বিদেশে দোষী সাব্যস্ত হলে তার আইনগত বৈধতা কতটুকু এবং কার নাগরিকত্ব রক্ষা করা বা কারটা হরণ করা হবে।
নাগরিকত্ব ও অভিবাসন এখন অতিশয় রাজনৈতিক ভুবনে পরিণত হয়েছে বিশেষ করে বর্তমান সরকারের অধীনে। কিন্তু নাগরিকত্ব হরণের বিষয়টিকে রাজনৈতিকীকরণ করা হলে তার ফলে কানাডীয় নাগরিকদের জীবন বিপন্ন হবে। হারপার সরকার গুয়ান্তানামো কমিশনের অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত করার প্রক্রিয়াকে আইনসিদ্ধ মনে করে। তাহলে কী অন্যান্য দেশে বানোয়াট অভিযোগকেও আইনসিদ্ধ বিবেচিত হবে? অন্যান্যের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মী ও সাংবাদিকদের বিদেশে সংঘটিত অপরাধের অন্যায় অভিযোগের ভিত্তিতেও কি নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হবে? বিদেশে কৃত অপরাধ কানাডার আইনে অপরাধ কিনা সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার মন্ত্রীর, কিন্তু এব্যাপারে আইনগত মূল্যায়নের চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাবে এটি স্পষ্ট।
অপরাধীদের জন্য নাগরিকত্ব বাতিলের কারণে কিছু কানাডীয়র হয়তো কোনও ক্ষতির কারণ ঘটবে না। কিন্তু, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের কানাডীয়দের জন্য উদ্বেগের কারণ রয়েছে। দেশে বা বিদেশে একটি ভ্রান্তিকর দন্ডাদেশের কারণে কারও জীবন বিপন্ন হতে পারে। আমরা কী সরকারকে বিশ্বাস করতে পারি যে তারা সবসময় যথাযথ ও ন্যায় বিচার করবে? আর একজন নাগরিক যদি কোনও অপরাধ করেও থাকে এজন্য কি তাকে নির্বাসনে পাঠানো যায়?
আইনের সর্বশেষ সংস্কার রাজনীতিকদের হুজুকের মাথায় নাগরিকত্ব বাতিলের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। সামনের বছরগুলোতে এটি স্পষ্ট হয়ে যাবে যে কাদেরকে বের করে দেয়ার এবং কাদেরকে এদেশে রেখে দেয়ার বিশেষ সুবিধা দেয়া হবে। যখন থেকে অটোয়া তার নিজ নাগরিকদের প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করবে তখন থেকে কানাডার নাগরিকত্ব লজ্জাজনকভাবে কমে আসবে।
Ñহুমেরা জাবির ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির একজন আইন বিষয়ের শিক্ষার্থী
সৌজন্যে : টরন্টো স্টার