ওমর খাদারকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া হোক

জুন ৯, ২০১৫

সাম্প্রতিক সময়ে কানাডায় সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিদের একজন হলেন ওমর খাদার। এক নামেই তাকে সবাই চিনেন। পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না কে সে। তবে কানাডিয়ানদের মধ্যে তার পরিচয়টা এতদিন ইসলামী জঙ্গী হিসেবে থাকলেও সম্প্রতি তাতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। বিশেষ করে গত মাসে সে যখন জেল থেকে মুক্তি পায় এবং মুক্তির পর সে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে যে সব উত্তর দেন তাতে অধিকাংশ কানাডিয়ানের ধারণাই পাল্টে যেতে থাকে। তবে এখনো কিছু কিছু কানাডিয়ান আছেন যারা তাকে ইসলামী জঙ্গী হিসেবেই ভাবছেন।

আলবার্টার জেল থেকে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর পরবর্তী ২৪ ঘন্টায় সোস্যাল মিডিয়াতে তার পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠে। একদল তার কথায় তার হাসিতে অবিভূত হয়ে তাকে ক্রমাগত অভিনন্দন জানাতে থাকেন এমনকি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ারও প্রস্তাব দিতে থাকেন অনেকে। অন্যদিকে কেউ কেউ তাকে নানারকম হুমকীও দিতে থাকেন।

কানাডার মেইনস্ট্রিম পত্রপত্রিকাগুলোও ওমরের ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। রক্ষনশীলদের পত্রিকা হিসেবে পরিচিত টরন্টো সান তাদের সম্পাদকীয়তে ওমরকে একজন “নিরাপত্তা ঝুঁকি” ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে ওমরের বাবা ছিলেন ওসামা বিন লাদেনের অন্তরঙ্গ বন্ধু। পত্রিকাটি এও বলে যে ওমরের পরিবার কানাডার প্রথম সন্ত্রাসী পরিবার।

অপরদিকে উদারপন্থী পত্রিকা টরন্টো স্টার তাদের সম্পাদকীয়তে লিখে, ‘ওমর খাদারের উপর যে অবিচার করা হয়েছে তার লজ্জার ভার আমাদের সকলের।’ পত্রিকাটি আরো মনে করে, ’কানাডা নাগরিক অধিকার রক্ষায় এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর বলে সবাই জানে। কিন্তু অটোয়া ওমরের বিষয়ে যে কদর্য ভূমিকা পালন করেছে তাতে করে কানাডার সেই ভাবমূর্তি যথেষ্ট পরিমানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর সেই ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার সহসাই হবে বলে মনে হয় না।’

বর্তমান ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল সরকার নানান কুটকৌশল করে অনেক চেষ্টা করেছে ওমরকে জেলে রাখার জন্য। তারা এমনো বলেছে যে, ওমরকে মুক্তি দিলে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। সম্পর্কের অবনতি ঘটবে অন্যান্য মিত্র দেশের সঙ্গেও। কিন্তু বিচারক সে কথা মানতে রাজী হননি। আর ক্ষমতাসীন কেন্দ্রিয় সরকার কোন অকাট্য প্রমানও দাড় করতে পারেনি ওমরকে মুক্তি দিলে কেন সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। বরং দেখা গেছে ওমরের মুক্তির কয়েক ঘন্টা পরেই যুুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ‘ওমরের মুক্তির বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হবে না।’

ওমরকে নিয়ে কানাডার ক্ষমতাসীন দল যে রাজনীতি করে আসছে ও মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে সে কথাই প্রমান হয় এর মধ্য দিয়ে।

ওমরের মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষন করে মনোরোগ চিকিৎসকরাও রায় দিয়েছেন এই বলে যে সে কানাডার জন্য কোন বড় ঝুঁকি নয়। মুক্তির পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় সে নিজেই বলেছে সে নতুন জীবন গড়ে তুলতে চায়। সে জঙ্গীবাদকে সমর্থন করে না। ওমরের আইনজীবীদের একজন নেট ওয়েটলিং বলেন, ওমরের চিন্তায় বা চেতনায় জঙ্গীবাদ সমর্থনের কোন আলামতই নেই। তিনি আরো বলেন, আমরা বছরের পর বছর বহু সময় কাটিয়েছি ওমরের সঙ্গে। আমরা যখন গুয়ান্তানামায় গিয়েছি তার সাক্ষাৎকার নিতে তখনও তার সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। উইকএন্ডে আমরা একসাথে খেলা করেছি, কার্ড খেলেছি, মুভিও দেখেছি। কিন্তু কখনো কোন অবস্থায়ই তার মধ্যে জঙ্গীপনা বা জঙ্গীবাদের প্রতি কোন সমর্থনের কোন লক্ষণ দেখিনি।

ওমর আফগানিস্তানে নিজের ইচ্ছায় যায়নি। তার বাবা ছিলেন জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী।

তিনিই ওমরকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে সেখানে নিয়ে যান। ওমরের বয়স তখন মাত্র ১৫। রাজনীতি, সমরনীতি, জঙ্গীবাদ এগুলো বুঝার বয়স তার ছিল না তখন। সে ছিল ঘটনার শিকার। ভুল সময়ে ভুল স্থানে ছিল সে। যুদ্ধকালীন সময়ে যে স্থান থেকে ওমরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সেখানে একজন মার্কিন সৈন্য নিহত হন। ওমরকে ঐ ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়। পরবর্তীতে ঐ মার্কিন সৈন্য নিহত হওয়ার ঘটনায় ওমর একাধিকবার ক্ষমাও চেয়েছেন।

ঘটনাচক্রে ওমর যে বয়সে যুদ্ধে জড়িয়ে পরে সে বয়স হিসেব করলে তাকে বলা যেতে পারে শিশু সেনা। বিশ্বের নানা প্রান্তে বর্তমানে প্রায় ৩ লক্ষ শিশু সেনা রয়েছে যাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে বা যারা পরিস্থিতির শিকার হয়েছে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে। ওমরও সেরকমই একজন শিশু ছিলেন ২০০২ সালে যখন তার বাবা তাকে আফগানিস্থানে নিয়ে যান। ওমরের দুর্ভাগ্য তার বাবা তাকে মৃত্যু কুপের সামনে ঠেলে দেন, ওমরের দুর্ভাগ্য তার দেশ তাকে ত্যাগ করে, ওমরের দুর্ভাগ্য মার্কিনীরা তাকে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জেলখানার একটি জেলখানা গুয়ান্তানামো বন্দিশিবিরে নিয়ে আটকে রাখে বহু বছর ধরে।

ওমরের বিরুদ্ধে মার্কিন সৈন্য হত্যার যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার জন্য তাকে প্রায় ১৩ বছর জেল খাটতে হয়েছে অত্যন্ত অমানবিকভাবে। লিবারেল সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ওমরকে কুখ্যাত গুয়ান্তানামো বন্দি শিবির থেকে কানাডায় স্থানান্তরের কোন পদক্ষেপ নেয়নি। পদক্ষে নেয়নি বর্তমান কনজারভেটিভ সরকারও। বরং কানাডার কর্তাব্যক্তিরা যখন গুয়ান্তানামায় ওমরের সঙ্গে দেখা করতে যান তখন ওমর তাদেরকে তার শরীরে বিভিন্ন স্থানে নির্যাতনের চিহ্ন দেখালে ঐ কর্তাব্যক্তিরা তাকে মিথ্যাবাদি বলে আখ্যায়িত করেন। তাকে কোনরকম সহায়তা দিতে চায়নি বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার শুরু থেকেই। বরং কানাডিয়ানদের টেক্সমানি খরচ করে তার বিরুদ্ধে নানারকম আইনী প্রক্রিয়া চালিয়ে গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত ওমরকে কানাডায় ফেরত এনেছে কনজারভেটিভ সরকার। তবে নিজে থেকে নয়। বা নৈতিকতার খাতিরেও নয়। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়েই বছর তিনেক আগে ওমরকে কুখ্যাত গুয়ান্তানামো বন্দি শিবির থেকে কানাডার জেলে স্থানান্তর করা হয়েছিল।

গুয়ান্তানামো বন্দি শিবিরে থাকা অবস্থায় ওমরকে স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়েছিল যে সে যুদ্ধাপরাধী। এই স্বীকারটুকু না করলে সে গুয়ান্তানামো থেকে বেরিয়ে আসতে পারতো না। এই সুযোগে কানাডার ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রীরা এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীও দাবী করে আসছেন যে ওমর নিজেই স্বীকার করেছে যে সে মার্কিন যুদ্ধাপরাধী এবং প্রতিপক্ষ সৈন্যকে খুন করেছে। অথচ যুদ্ধ আইন বলে, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের সৈন্যকে হত্যা করলে তা যুদ্ধাপরাধ নয়। তাছাড়া খোদ কানাডার সুপ্রিম কোর্টও বলেছে গুয়ান্তানামোতে যে নির্যাতন চালানো হয়েছে তা আইনবিরুদ্ধ।

আর সবচেয়ে বড় কথা ওমর তখন শিশু। ঐ বয়সের একটি ছেলে যদি খোদ কানাডার মাটিতেও কাউকে হত্যা করতো তবে ওমর ১৩ বছরের যে সাজা ভোগ করেছে তার প্রায় অর্ধেক সময়ের সাজা ভোগ করে জেল থেকে মুক্ত হয়ে যেত। তাছাড়া গুয়ান্তানামো বন্দি শিবিরের যে অমানবিক ও ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল ওমরকে তাও সইতে হতো না।

এত কিছুর পরও ওমর জেল থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে (নানান শর্ত রয়েছে জামিনে মুক্ত হলেও) একটি কুটু বাক্যও করেনি কানাডার রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে। তার আইনজীবী যেখানে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারকে প্রকাশ্যে মুসলিম বিরোধী এক ধর্মান্ধ ব্যক্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন সেখানে ওমর শুধু  বলেছে সে প্রধানমন্ত্রীকে নিরাশ করবে। নিরাশ করবে এই অর্থে যে প্রধানমন্ত্রী তার সম্পর্কে যা ভাবছেন সে আসলে তা নয়। এবং খুব শিঘ্রই সে তা প্রমান করে ছাড়বে। তখন প্রধানমন্ত্রী নিশ্চই নিরাশ হবেন এই ভেবে যে ওমরকে জঙ্গী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা গেল না।

দৈনিক টরন্টো স্টার পত্রিকার ন্যাশনাল এফেয়ার্স কলামিস্ট থমাস ওয়ালকম কতগুলো গুরুত্বপূর্ন ইস্যুর কথা বলেছেন যা জামিনে মুক্ত হওয়ার পর ওমর তীব্র ও তেতো সুরে জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারতেন। কিন্তু তিনি তার কোনটাই করেননি। বরং সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় সম্পূর্ণ শান্ত থেকেছেন, অতিশয় ভদ্র ও নম্রসুরে কথা বলেছেন। মুখে তার সহৃদয় হাসি লেগে ছিল পুরোটা সময় ধরে।

কলামিস্ট থমাস ওয়ালকমের মতে ওমর যে সব প্রশ্ন তুলতে পারতেন তার কয়েকটি হলো:

–  সাবেক ক্ষমতাসীন দল লিবারেল পার্টি ও বর্তমান ক্ষমতাসীন দল কনজার্ভেটিভ কেন চাইল্ড সোলজার বা শিশু সৈনিককে আন্তর্জাতিক চুক্তির বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসেনি?

–  অটোয়া কেন কুখ্যাত গুয়ান্তানামো বন্দি শিবিরে বন্দিদেরকে জিজ্ঞাসাবাদে অংশ নেয় যে বন্দি শিবিরকে কানাডার সুপ্রিম কোর্ট পরবর্তীতে অবৈধ ও     দমনমূলক বলে আখ্যায়িত করে?

–  ওমর আরো প্রশ্ন তুলতে পারতো কেন শতকরা ৬০ ভাগ কানাডিয়ান (২০১২ সালে পরিচালিত এক জরীপ রিপোর্ট। রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে  অনেকের) চাননি সে গুয়ান্তানামো বন্দি শিবির থেকে কানাডায় ফিরে আসুক?

ওমর এই প্রশ্নগুলোর কোনটাই সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেননি। বরং যথেষ্ট ভদ্রতা বজায় রেখে তিনি বলেছেন, “আমি সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাস করি না। আমি নতুনভাবে  জীবন শুরু করতে চাই।” আমরাও মনে করি ওমর খাদারকে নতুন ভাবে জীবন শুরু করার সুযোগ দেওয়া উচিৎ। জঙ্গীবাদ যে কোন অর্থেই নিন্দনীয়। এটি একটি জঘন্য অপরাধের কাজ। যারা এ কাজের সঙ্গে জড়িত বা যারা এ কাজে তরুনদেরকে উৎসাহিত বা উদ্ধুদ্ধ করে তাদের সাজা হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের আলোচিত ওমর নিজে থেকে জঙ্গীপনায় পা বাড়াননি। তার বাবা তাকে বাধ্য করেছেন আফগানিস্তানে নিয়ে যেতে। আর এ কারণে শিশু সৈনিক হিসেবে ওমরকে ইতিমধ্যে যে সাজা ভোগ করতে হয়েছে তা তার অপরাধের তুলনায় বহুগুন বেশী হয়ে গেছে। এবার তাকে সুযোগ দেওয়া হোক সুন্দর জীবন গড়ে তোলার। তিনি ইতিমধ্যেই বলেছেন তিনি একজন ডাক্তার হতে চান। আমরা কামনা করছে তিনি ডাক্তার হয়ে মানবতার সেবা করুন এবং প্রমান করুন যে মুসলমান মানেই জঙ্গী নয়। মুসলমানরা মানবতার সেবাও করতে পারেন।