অভিবাসীদের সন্তানেরা ও তাদের চ্যালেঞ্জ

ব্রায়ান জে ডি’সুজা

নভেম্বর ৮, ২০১৪: একটি দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য থিতু হতে গিয়ে বিশেষ করে অপরিমেয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাধার মোকাবিলা করার কারণে প্রাপ্তবয়স্কদের যখন হিমশিম খাওয়ার জোগাড় হয় তখন তাদের সন্তানদেরকে যেসব দুরুহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয় সেগুলো প্রায়শ নজর এড়িয়ে যায়।

কানাডায় বা অন্য কোনও দেশে যেখানেই জন্মগ্রহণ করে থাকুক না কেন অভিবাসী পরিবারের সন্তানদেরকে তাদের সাংস্কৃতিক পটভূমি এবং যে সমাজে তারা একীভূত হওয়ার চেষ্টা করছে তার সাংস্কৃতিক পরিবেশের ভিন্নতার কারণে প্রায়শ প্রবল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। একজন তরুণের বেড়ে ওঠার নানা যন্ত্রণার ওপর এসব চ্যালেঞ্জ বাড়তি বোঝা হিসাবে দেখা দেয় যা তাদেরকে জটিল ও বেকায়দা পরিস্থিতিতিতে ফেলে।

হাইস্কুলে যাওয়া শুরু হতেই আমার চার/পাঁচজন সহপাঠী খুব দ্রুতই আমাকে পরীক্ষা করে দেখতে চাইলো। তারা আমাকে উপহাস করে নানা প্রশ্ন করে যেমন তারা জানতে চায়, ‘‘তুমি কি কারী খাও’’? আমি কানাডায় জন্মগ্রহণ ও বেড়ে উঠলেও তাদের সমালোচনার ক্ষেত্রে তার কোনও প্রভাব পড়েনি; এমনকি একই ধর্ম এবং বস্তুগত পরিচিতি থাকার পরও তারা আমাকে গ্রহণ করতে সামান্যই উৎসাহিত হয়েছে। আমার গায়ের ভিন্ন রঙয়ের অর্থই হলো আমি বাইরের মানুষ, আর দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে তারা আরও বেশি উৎসাহিত হয়েছে। অনেক অভিজ্ঞতাই আমার জন্য অপ্রীতিকর ছিলো, তবে সেগুলো থেকে আমি বিশ্বকে দেখার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করি।

একটা কথা বলতেই হয় যে, অভিবাসীর সন্তান হোক বা না হোক, যে কোন শিশুকে বিরোধিতা কাটিয়েই সামনে এগুতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এমনকি একজন কানাডীয়ও যখন স্থানীয় কোন ক্লাবে যোগ দিতে যায় তখন নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। কারণ তাকে এমন সব লোকেদের মুখোমুখি হতে হয় যারা বছরের পর বছর ধরে অভিন্ন স্বার্থে নিজেদের মধ্যে বন্ধন তৈরি করে নিয়েছে। এক্ষেত্রে অভিবাসীর সন্তানদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সমস্যাটাই আরেকটু গভীর হয়ে ওঠে মাত্র।

তাদের মধ্যকার ভিন্নতার কারণে অভিবাসী সন্তানেরা হয়তো বকাঝকার শিকার হতে পারে, কারণ ভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিত্বকারী কাউকে আক্রমণ করা খুব সহজ। এই কারণেই জাতিগত সংখ্যালঘু শিশুরা তাদের স্কুলে, সামাজিক পরিমন্ডলে এমনকি ক্লাশরুমেও তার প্রতিহিংসাপরায়ণ সহপাঠী বা শিক্ষকের হাতে নিগ্রহের সহজ শিকারে পরিণত হতে পারে।

এধরণের গালাগালির জবাব হতে পারে খুবই সহজ, নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলা, সমমনা সহপাঠীদের সঙ্গে জোরালো বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং প্রয়োজনে আত্মরক্ষার কৌশল শিখে নেয়া।

অভিবাসী শিশুদের বাবা-মায়েরা প্রায় ক্ষেত্রেই সন্তানের উচ্চতর শিক্ষাগত অর্জনের বিষয়ে বেশি নজর দেন, কিন্তু ওই সন্তানেরা যে সামাজিকভাবে নানা প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করতে বাধ্য হচ্ছে সেটা সবসময় অনুধাবন করতে পারেন না। বেশি বেশি নম্বর পাওয়া অবশ্যই জরুরী, কানাডায় কিন্তু কেবলমাত্র নম্বরই ভবিষ্যতে কর্মজীবনের সাফল্য বা মানসম্মত জীবন গড়ে তোলার একমাত্র নিয়ামক নয়। জীবন-জীবিকার জন্য গভীর আবেগ এবং আগ্রহ হলো সবচেয়ে ভাল উপায়। তরুণ অভিবাসীদেরকে তাদের সামর্থের বাইরে খুব বেশি চাপ প্রয়োগ করা হলে তা তাদের মঙ্গলের চেয়ে বরং বেশি ক্ষতিরই কারণ হতে পারে।

একজন তরুণ অভিবাসীকে টিনএজে যেসব বিষয়ের মুখোমুখি হতে হয় তা অনেকসময় বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে, যেমন মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে ডেটিং করা। টিনএজারদের বাবা-মাকে অবশ্যই বুঝতে হবে, সম্পর্ক গড়ে তোলা তাদের সন্তানের জন্য একটি স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর বিষয়। এসব ক্ষেত্রে সন্তানকে চারদেয়ালে আবদ্ধ রাখা বা দোষারোপ করার পরিবর্তে, বিশেষ করে ভিন্ন কোনও জাতিগোষ্ঠীর কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে সন্তানকে যথাযথ নির্দেশনা দেয়া এবং তাকে উৎসাহিত করা অধিকতর সুফলদায়ক হতে পারে।

বেশিরভাগ অভিবাসী পরিবারে সচরাচর ঘটা অতিরিক্ত কঠোরতা, নিছক মজা করতে চাওয়া তরুণদের সঙ্গে অনৈক্যের অন্যতম কারণ। নিরাপত্তার জন্য কার্ফ্যু ও বিধিনিষেধ আরোপের প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু অতিরিক্ত নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ বাস্তবে বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যকার বিশ্বাসের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এরপর এটি সন্তানের অবাধ্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। বাবা-মা আশঙ্কা করতে থাকেন যে তারা তাদের সন্তানের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন; আর টিনএজাররা মনে করতে থাকে যে, কানাডার নতুন পরিবেশে তারা যে বিকাশমান স্বাধীনতার আস্বাদন পেতে যাচ্ছে তা না বোঝার কারণে বাবা-মার উপর থেকে তাদেরও নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে যাচ্ছে।

এমতাবস্থায় সমস্যা থেকে গেলে অভিবাসী সন্তানদেরকে নিজেদের ওপর আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে এবং কঠোর অবস্থান নিতে হবে। লেগে থাকাটা সাফল্যের জন্য সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর; সুযোগ আপনি এসে ধরা দেবে সেজন্যে অপেক্ষায় বসে থাকলে হবে না বরং সুযোগ খুঁজে নিতে হবে। আপনি যদি সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগুতে না পারেন তাহলে আপনার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে এমন মুষ্ঠিমেয় লোকেদের ব্যাপারে মনোনিবেশ কেন করবেন না?

আর আপনি যদি মনে করেন যে,আপনার পরিবার কর্তৃত্ববাদী এবং অনমনীয় তাহলে মনে রাখবেন যে আপনি একা নন।

আপনার কমিউনিটিতে আপনিই প্রথম এ ধরণের অবস্থার মোকাবিলা করছেন এমন মনে করার কোনও কারণ নেই, আপনার একার ইতিহাসকে এধরণের পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়াতে দিন। এক্ষেত্রে কিছু জিনিস হয়তো সহজতর মনে হবে কিন্তু এর অনেক কিছুই আছে যা ব্যাখ্যামূলকভাবে গুরুতর; বেড়ার এপাশে অর্থাৎ আপনার পাশে যে ঘাস আছে তা আপনি যতটা ভাবছেন তার চেয়ে অনেক বেশি সবুজ। মনে রাখবেন যে, বিদেশী সংস্কৃতির অনেক বিষয়কে কানাডায় খুব বেশি সম্মানের সঙ্গে দেখা হয়, আর তারা যে দেশ থেকে এসেছেন সেই দেশটির জন্য গর্ব বোধ করতে পারেন। আমার নিজের ক্ষেত্রে দেখেছি, দক্ষিণ এশীয় রান্না বেশিরভাগ কানাডীয়র কাছে দারুণ ও সুস্বাদু বলে মনে হয়েছে এবং এটি রীতিমত উদযাপনের মত বিষয়। এর বাইরে আর যেসব পার্থক্য থাকতে পারে সেগুলোর ক্ষেত্রে শিশুদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, বর্তমান উত্তর আমেরিকায় বিদ্যমান অন্য অনেক কিছুর মত না হলেও তাদের নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠীগত পরিচয়েরও অনন্য গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটা হতে পারে রাজনৈতিক, শৈল্পিক বা এমনকি অ্যাথলেটিক্স-এর মত কোন বিষয়, কিন্তু প্রত্যেক জাতিরই রয়েছে নিজস্ব বিশেষ

বৈশিষ্ট্য।

আমার নিজের অভিজ্ঞতা এবং বছরের পর বছর ধরে তরুণ অভিবাসীদের কাছ থেকে শোনা অভিজ্ঞতার আলোকে আমি অভিবাসী তরুণদের এ কথা বলতে পারি যে, সবকিছুই আপনার অনুকূলে যাবে এমনটা না-ও হতে পারে, আপনাকে হয়তো নানা ধরণের সংস্কার, উপহাস বা সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হতে হবে। তারপরও এই সব বিরূপতা আপনার মধ্যে এক ধরণের জোরালো ও প্রাণবন্তু ইচ্ছাশক্তির জন্ম দেবে। অনেক অভিবাসী শিশুর মধ্যে কিছু সহজাত উদ্যম থাকে যা তাদেরকে বিশাল উচ্চতায় পৌঁছে দেয়; জীবনের শুরুর দিকে তাদেরকে যেসব বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হতে হয় সেটি তাদের জন্য উচ্চাভিলাষের জ্বালানি হিসাবে কাজ করে এবং তারা গড়পরতা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি অর্জন করতে সহায়ক হয় ।

অভিবাসী শিশুদের এই সংগ্রাম যখন যৌবনের স্বাভাবিক সংগ্রামশীলতার সঙ্গে চালিয়ে যেতে হয় তখন এটি সত্যিই প্রচন্ড আঘাতের মত মনে হয় কিন্তু তারও জবাব রয়েছে। নিজেকে স্বমতে আনুন যে, আপনি নিজের ক্ষেত্র অনুসন্ধানে ব্যাপৃত রয়েছেন এবং আপনি যা হতে চান তাই হতে পারেন। নিছক খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য নিজেকে বিক্রি করে দেবেন না এবং আপনার সংস্কৃতির যা কিছু অনন্য তা বর্জন করবেন না। সর্বোপরি, মনে রাখবেন, আপনি একা নন। -ঈধহধফরধহরসসরমৎধহঃ.পধ