অন্টারিও’র নতুন যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচি নিয়ে বিতর্ক
আপনি কোন পক্ষে যাবেন?
জুন ৯, ২০১৫
॥ খুরশিদ আলম ॥
অন্টারিওর স্কুলসমূহে ছেলে-মেয়েদেরকে অধুনিক যৌন শিক্ষা প্রদান করার জন্য নতুন পাঠ্যসূচি প্রস্তুত। আগামী সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু হবে এই শিক্ষাদান কর্মসূচি। কিন্তু এই পাঠ্যসূচী আলোর মুখ দেখার আগেই শুরু হয়েছে তীব্র বাদপ্রতিবাদ। প্রধানত মুসলিম সম্প্রদায়ই এর তীব্র বিরোধীতা করছেন। বিরোধী গোষ্ঠির মধ্যে আরো আছেন গোড়া খ্রীষ্টানপন্থীরাও।
টরন্টো প্রবাসী সিংহভাগ মুসলমান অভিভাবক অন্টারিও’র এই আধুনিক যৌন শিক্ষা কার্যক্রম বা অন্টারিও সেক্স এডুকেশন কারিকুলাম এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তাদের সন্তানদেরকে স্কুলে যেতে দেননি।
টরন্টোর থর্নক্লিফ পার্ক এলাকাটি মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা। বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানী, বাংলাদেশী ও ভারতীয় মুসলমান বাস করেন ঐ এলাকাতে। সেখানকার থর্নক্লিফ পার্ক এলিমেন্টারী স্কুলে গত ৪ মে সোমবার ১৩৫০ জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে উপস্থিত ছিল মাত্র ১৩০ জন। শতকরা হিসেবে প্রায় ১০ জন। পরের দিন মঙ্গলবার উপস্থিতি সামান্য বেড়ে দাড়িয়েছিল শতকরা ১৬ ভাগে। নতুন আধুনিক যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ক্লাসবর্জনের এই কার্যক্রম চলে সপ্তাহব্যাপী। টরন্টো এবং এর আশপাশ এলাকায় মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে কমবেশী একই চিত্র দেখা যায় ঐ সময়টাতে।
অন্টারিও’র স্কুলগুলোতে যৌন শিক্ষা প্রদান কর্মসূচী নতুন কোন বিষয় নয়। অনেক আগে থেকেই চলে আসছে এই শিক্ষাদান কর্মসূচী। তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এটি আধুনিকীকরণ করা হয়নি প্রায় দুই দশক ধরে। পুরানো যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচী অনুযায়ী এতদিন যে শিক্ষাপ্রদান করে আসা হচ্ছে তা নিয়ে কাউকে কোন বাদপ্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি এখন পর্যন্ত। কিন্তু বিতর্ক শুরু হয় এটি আধুনিকীকরণ করার পর থেকেই। আধুনিকীকরণ করতে গিয়ে এই শিক্ষা কর্মসূচীতে এমন কিছু বিষয় অন্তভূক্ত করা হয়েছে যা দেখে বা শুনে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিশেষ করে মুসলমান সম্প্রদায়ের অভিভাবকমহল তীব্রভাবে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেন।
এই প্রতিবাদ অবশ্য আগেও একবার হয়েছে। আমরা দেখেছি গত ২০১০ সালে আধুনিকীকরণ করা এই যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচী বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ নেওয়া হলে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। সেই সময় অন্টারিও’র প্রিমিয়ার ছিলেন লিবারেল দলের ডল্টন ম্যাগগুয়েন্টি। আর তখন তার শিক্ষা মন্ত্রী ছিলেন বর্তমান প্রিমিয়ার ক্যাথিলিন উয়েন। সেই সময় প্রতিবাদ এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছিল যে ডল্টন ম্যাগুগইন্টির সংখ্যালঘু সরকার সাহস করে সামনে এগুতে পারেনি। প্রতিবাদ শুরু হলে কয়েকদিনের মাথায়ই নতুন পাঠ্যসূচীটি শিকেয় তুলে রাখা হয় ভবিষ্যতের জন্য। আর ঐ প্রতিবাদে তখন মূখ্য ভূমিকা রাখেন খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের গোড়া অংশ। সেদিন মুসলমান সম্প্রদায়ের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো ছিল না।
কিন্তু প্রায় ৫ বছর পর গত ফেব্রুয়ারীতে যখন নতুন ঐ যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচী বিষয়ে আবারো ঘোষণা আসে তখন দেখা গিয়েছিল প্রায় অর্ধেক অন্টারিওবাসী এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। বিরোধীতা করেছিলেন শতকরা ৩৪ ভাগ অভিভাবক। কিন্তু দুই মাস পরে দেখা গেল নতুন এই যৌনশিক্ষা কার্যক্রমের প্রতি সমর্থন কমে এসেছে। ঐ সময় সমর্থনকারীদের সংখ্যা ছিল শতকরা ৪২ ভাগে আর বিরোধীতাকরীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় শতকরা ৪০ ভাগে।
সেপ্টেম্বর মাস আসতে আরো তিন মাস বাকী। এর মধ্যে আধুনিকীকরণ করা এই যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচীর বিরুদ্ধে অন্টারিও’র স্কুল পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকগণ আরো সোচ্চার হয়ে উঠবেন না ক্রমশ তাদের আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়বে তা এই মুহুর্তে বলা কঠিন। অন্যদিকে প্রিমিয়ার ক্যাথিলিন উয়েন কতদূর এগুবেন তাও বলা যাচ্ছে না। তার শিক্ষামন্ত্রী লিজ সেন্ডালস গত ২৩ ফেব্রুয়ারী টরন্টোতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, সরকার এবার পিছু হটবে না, যেমনটি হটেছিল গত ২০১০ সালে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রবল বিরোধীতার মুখে। তিনি আরো বলেন, কেউ কেউ এর বিরোধীতা করতে পারেন, কিন্তু নতুন এই পাঠ্যসূচী আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তার জন্যই করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর ঐ ঘোষণার পরও যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচির ব্যাপারে আগে থেকেই চলে আসা বিতর্ক থেমে যায়নি। বরং অন্টারিও পার্লামেন্টের সামনে এমনকি অভ্যন্তরও বিতর্ক হয় এই বিষয়টি নিয়ে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারী কুইন্স পার্কের সামনে সোসিয়্যালি কনজারভেটিভ ক্যাম্পেইন লাইফ কোয়ালিশন যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা করে। ঐ সভায় প্রতিবাদকারীরা বলেন, এই শিক্ষাকার্যক্রম অন্টারিওর হাজার হাজার ছাত্রী-ছাত্রীকে বিপদগ্রস্ত করে তুলবে। তারা যৌন নিপীড়নকারীদের লালসার শিকার হবে।
উল্লেখ্য যে, টরন্টোতে অনেক বাবা-মা’র মধ্যে এমন ভীতি কাজ করছে যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় না নিয়েই প্রিমিয়ার ক্যাথেলিন ওয়েন নতুন পাঠ্যক্রম চালু করতে পারেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে ক্ষমতায় আসা ক্যাথিলিন এবার আর তাদের প্রতিবাদে কর্ণপাত করবেন না বলেই অনেকের ধারণা। ক্যাথেলিনের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ, স্বঘোষিত এই লেজবিয়ান প্রিমিয়ারের গোপন কোন ‘gay agenda’ রয়েছে যার ফলশ্রুতি হলো এই নতুন যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচী।
কুইন্স পার্কে রক্ষণশীল দলের এমপিপি মন্টে ম্যাক্নঘটন প্রিমিয়ার ক্যাথেলিন ওয়েনকে দোষারোপ করে বলেন, বিষয়টি চূড়ান্ত করার আগে অভিভাকদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিৎ ছিল।
ওই পাঠ্যক্রমের বিরোধিতা করে প্যারেন্টস এজ ফার্স্ট এডুকেটরস (PAFE) ২৭,০০০ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছে। চঅঋঊ পক্ষ থেকে বলা হয়, “শিশুদেরকে জন্মনিয়ন্ত্রণের মূল্য বা হস্তমৈথুন খুব ভালো এমন শিক্ষা দেয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।
নতুন যৌন শিক্ষা পাঠ্যক্রমের যারা সমর্থক তারা অবশ্য বলছেন অন্য কথা। তাদের মতে প্রিমিয়ার ক্যাথেলিন ওয়েন লেসবিয়ান হলেও তাতে কারো কিছু আসে যায় না। সেটি তার ব্যক্তিগত জীবনের বিষয়। ওখানে বাইরের কারো প্রবেশাধিকার নেই এবং তা নিয়ে কারো কোন মন্তব্য করাটা সমীচিন নয়, শোভনও নয়। আধুনিক যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচী যারা পছন্দ করছেন না তারা এটিকে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসে নানারকম খোড়া যুক্তি দাড় করানোর চেষ্টা হিসেবে এগুলো করছেন।
এদিকে যারা নতুন এই যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচী নিয়ে হৈ-চৈ করছেন বা পানি ঘোলা করার চেষ্টা করছেন তাদের অনেকেই আসলে জানেন না ঐ পাঠ্যসূচীতে মূলত কি আছে। অন্যের দেখাদেখি বা শুনা কথায় কান দিয়ে এরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছেন এমন অভিযোগও তোলা হচ্ছে যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচীর সমর্থকদের তরফ থেকে। উদাহরণ হিসেবে তারা যে প্রমাণপত্রটি তুলে ধরেন তা হলো, আরবীতে লেখা একটি লিফলেট যা টরন্টোর নিকটবর্তী পিল রিজিয়নে বিলি করা হয়েছিল নতুন যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচী’র বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলা কালে। আরবীতে লেখা ঐ লিফলেটটিতে বলা হয় নতুন যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচীতে এমন একটি চেপ্টার বা বিভাগ রয়েছে যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের বলা হবে পর্নোম্যাগাজিন বা পর্নোমুভি দেখার জন্য। এসব দেখে ছাত্র-ছাত্রীরা বুঝতে পারবে যৌনক্রিয়ার কোন বিষয়গুলো তাদেরকে বেশী উত্তেজিত বা উৎসাহিত করবে এবং এর মাধ্যমে তারা কি ভাবে যৌনতাকে উপভোগ করবে।
নতুন যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচীর সমর্থকরা বলেন, লিফলেটের কোথাও উল্লেখ নেই কারা এটি তৈরী ও বিলি করেছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে বেনামী ঐ লিফলেটে যা বলা হয়েছে তা মোটেও সত্য নয়। সবটাই কল্পকাহিনী। নতুন যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচীর বিরুদ্ধে আরো যে সব কল্পকাহিনী ছড়ানো হচ্ছে তার মধ্যে আছে, মাস্টারবেশন ও এনাল সেক্স প্রসঙ্গ। অভিভাবকদেরকে আগে থেকেই ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলা হচ্ছে এই বলে যে নতুন যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচীতে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে মাস্টারবেশন ও এনাল সেক্স-এ উৎসাহিত করা হবে। আরো বলা হচ্ছে এই পাঠ্যসূচী বাস্তবায়িত হলে শিশুরা যৌন নির্যাতনকারীদের টার্গেটে পরিনত হবে সহজেই যা মোটেও সত্য নয়। নতুন যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচীর সমর্থকরা বলেন, দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো একশ্রেণীর অভিভাবক এই অপপ্রচারকারীদের কথায়ই বিশ্বাস করে বসে আছেন। তারা কোন নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে তথ্যগুলো যাচাই করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছেন না।
বস্তুত: নতুন এই পাঠ্যসূচীটি ২৪০ পাতার একটি নির্দেশিকা বা ডকুমেন্ট যার শিরোনাম হলো -The Ontario Curriculum, Grades 1-8: Health and Physical Education. এই পাঠ্যসূচীর মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীরা ফায়ার সেফটি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে। নিউট্রিশন বা খাদ্যের পুষ্টিমান সম্পর্কে অবহিত হবে, সাইকেল চালানোর সময় হ্যালমেট ব্যবহারের উপকারিতা সম্পর্কে জানবে, জানবে বাদামের এলার্জি সম্পর্কে, বাড়িতে রাখা ওষুধ ক্যাবিনেট খুলে যাতে ক্যান্ডি মনে করে ওষুধ খাওয়া শুরু না করে সে সম্পর্কেও সতর্ক করা হবে, ঘরের মধ্যে সারাক্ষণ বসে টিভি দেখার কুফল সম্পর্কেও জ্ঞানদান করা হবে। এছাড়াও বয়স বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের যে শারীরিক পরিবর্তনসমূহ আসবে সে সম্পর্কেও জ্ঞান দান করা হবে এবং চিনিযুক্ত ড্রিংস ও সিগারেটের কুফল সম্পর্কে জ্ঞান দান করা হবে। আরো জ্ঞান দান করা হবে এসটিডি বা সেক্সুয়ালী ট্রান্সমিটেড ডিজিজ (যৌন বাহিত রোগ) সম্পর্কেও।
রক্ষণশীল বাবা-মা’রা অবশ্য বলছেন, যৌন শিক্ষা দান করার নামে যে পাঠ্যসূচী তৈরী করা হয়েছে তা শিশুদের বয়সের তুলনায় অনেক বেশী। এতে শিশুরা অল্প বয়সেই ইঁচড়ে পাকা বা অকালপক্ক হয়ে উঠবে।
অন্যদিকে নতুন যৌন শিক্ষা কার্যক্রমের সমর্থকরা বলছেন, শিশুদের যৌন শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের শরীরে যে পরিবর্তন আসে সেগুলো সম্পর্কে ভাল করে জানা খুবই জরুরী। এতে করে তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া থেকে কি করে মুক্ত থাকা যায় সে কৌশল সম্পর্কে অবহিত হতে পারবে। আরো অবহিত হতে পারবে কি করে যৌনবাহিত রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা শিশুদের মৌলিক অধিকার। এবং স্কুলই হচ্ছে এ বিষয়ে জ্ঞান দান করার উপযুক্ত স্থান। কারণ সেখানে শিশুরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের কাছে শিক্ষা পাবে এবং সেই শিক্ষা হবে বিশুদ্ধ এবং নির্ভরযোগ্য।
নতুন যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচীর সমর্থকদের আরো বক্তব্য হলো- আজকের দিনের বাস্তবতা এই যে, ইন্টারনেট এর এই যুগে শিশুরা আর কোন তথ্যের বাইরে নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ইন্টারনেটে এমন অনেক সাইট আছে যেগুলোর কোন বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। ভুল তথ্য আর বিকৃত তথ্যে ভরাট থাকে ঐ সব সাইট। ফলে শিশুদের পক্ষে বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশী। আর বাবা-মায়ের হাতে শিশুদের যৌন শিক্ষা দানের ভার ছেড়ে দেওয়ার যে দাবী উঠেছে তারও রয়েছে নানারকম জটিলতা। এটা ঠিক যে বাবা – মা তাদের শিশুকে যতটা জানেন অতটা অন্য কেউ জানেন না। কিন্তু কথা হলো,বাবা-মা’রা কি শিশুদের বয়সের তুলনায় যেটুকু জানা প্রয়োজন সেটুকু শিক্ষা দানের ব্যাপারে খোলা মন নিয়ে কথা বলতে পারবেন? সমস্যা আরো রয়েছে। যেমন – যৌন বিষয়ে শিশুদেরকে যে শিক্ষা দিতে হবে সে সম্পর্কে অধিকাংশ বাবা-মা‘র কি প্রয়োজনীয় শিক্ষা বা জ্ঞান রয়েছে? বা যতটুকু জানেন তা কতটুকু নির্ভরযোগ্য বা প্রামানিক? তারা তো এ বিষয়ের উপর কোন প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি বা কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেও তা শিখেন নি। নিজেরাই অনেক ভুলভ্রান্তি নিয়ে নানারকম ভোগান্তির শিকার হয়েছে না এখনো হচ্ছেন। আরেক বাস্তবতা হলো, যে সকল অভিভাবক চান না স্কুলে তাদের সন্তানেরা যৌন শিক্ষা লাভ করুক, সে সকল অভিভাবক বাসায়ও তাদের সন্তানদের এ বিষয়ে কোন শিক্ষা দিবেন না। ফলে এই শিশুদের পক্ষে ভ্রান্ত পথে পা বাড়ানোর সম্ভাবনা থাকবে অনেক বেশী।
প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের গত ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় অন্টারিও’র নতুন যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচিতে কি কি পড়ানো হবে তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরনী প্রকাশ করা হয়েছিল। এখানে পুনরায় সেটি তুলে ধরা হলো:
নতুন যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচিতে যা যা পড়ানো হবে:
গ্রেড ওয়ানের ছাত্র-ছাত্রীরা শিখবে কি করে মুখের এবং কন্ঠস্বরের অভিব্যক্তি হৃদয়ঙ্গম করা যায় এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ কোনটার কি নাম তা।
গ্রেড টু এর ছাত্র-ছাত্রীরা শিখবে মানব শরীরের ক্রমবিকাশের ধাপসমূহ কি কি এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত শারীরিক পরিবর্তনসমূহ কি কি তা।
গ্রেড থ্রি এর ছাত্র-ছাত্রীরা সম-লিঙ্গ সম্পর্ক বা রিলেশনশীপ কি সে সম্পর্কে অবহিত হবে। অন্টারিওর প্রিমিয়ার ক্যাথলিন ওয়েন এর (যিনি নিজেও একজন লেজবিয়ান) ভাষায়- এতে করে শিশুরা জানবে এবং বুঝতে পারবে যে দুই মা অথবা দুই বাবার সংসার অন্যান্য সংসারের মতোই আরেকটি সংসার এবং এটি নিরাপদ।
অনলাইন বুলিং বা হুমকী-ভয় ভীতি প্রদর্শন এবং এর বিপদ কি হতে পারে সে সম্পর্কে শিক্ষাদান করা হবে গ্রেড ফোর এর ছাত্র-ছাত্রীদেরকে। অনলাইনে যৌনতাপূর্ণ ছবি পোস্ট করা বা শেয়ার করার বিপদ সম্পর্কেও তাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হবে।
গ্রেড ফাইভ এর ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বংশ বৃদ্ধিতে মানব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভূমিকা কি সে সম্পর্কে জ্ঞানদান করা হবে। জ্ঞানদান করা হবে মেয়েদের পিরিয়ড কি এবং পিরিয়ড চলাকালীন কি কি করনীয় সে সম্পর্কে।
লিঙ্গ অভিব্যক্তি ও হস্তমৈথুন কি সে সম্পর্কে অবহিত করা হবে গ্রেড সিক্স এর ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ।
গ্রেড সেভেন ও এইট এর ছাত্র-ছাত্রীদেরকে জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে শিক্ষাদান করা হবে। এনাল সেক্স ও ওরাল সেক্স, গর্ভাবস্থা এবং যৌনবাহিত রোগ সম্পর্কেও আলোচনা করা হবে এই দুই গ্রেডের ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসে।
গ্রেড নাইনের ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানো হবে কি করে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে অনিচ্ছাকৃত গর্ভবতী হওয়া থেকে এবং বিভিন্ন যৌনবাহিত রোগ থেকে বাঁচা যায়। যৌন স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য নিজেদের জ্ঞানকে কিভাবে প্রয়োগ করতে হবে সেগুলো শিক্ষাদানের পাশাপাশি কনসেপ্ট অব কনসেন্ট বিষয়েও শিক্ষাদান করা হবে। কনসেপ্ট অব কনসেন্ট হলো যৌন মিলনে সম্মতি প্রদান। কেউ যদি (বিশেষত মেয়ে বা মহিলা) যৌন মিলনের ব্যাপারে মুখে ‘না’ বলে তবে তা না হিসেবেই ধরে নিতে হবে। আবার মুখে না বলেনি কিন্তু তার শরীর সায় দিচ্ছে না, সেক্ষেত্রেও ধরে নিতে হবে যৌন মিলনের ব্যাপারে তার সম্মতি নেই। এটিকে না হিসেই ধরে নিতে হবে। মাদকাগ্রস্থ বা নেশাগ্রস্থ অবস্থায় অথবা অপ্রাপ্তবয়স্ক কেউ যৌনমিলনে সম্মতি দিতে পারে না। অর্থাৎ তারা মুখে হা বললেও তা আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হবে না।
গ্রেড টেন এ যৌনতা সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণা এবং এই ধারণা কি ভাবে মানুষকে ক্ষতিগ্রস্থ করে সে বিষয়ে সচেতন করে তোলার জন্য শিক্ষা দান করা হবে।
গ্রেড এলিভেনে এসে ছেলে-মেয়েদের যৌন স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উপর জোর দেয়া।
গ্রেড টুয়েলভ এ যৌন নির্যাতন, হয়রানী বা জুলুম বিষয়ে আইনী পদক্ষেপ কি কি হতে পারে সেগুলো সম্পর্কে জ্ঞান দান করা হবে। হেলদি রিলেশনশীপ বা সুস্থ সম্পর্ক কিভাবে গড়ে তোলা যায় বা বিকশিত করা যায় সে সম্পর্কেও জ্ঞানদান করা হবে।
সম্মানিত পাঠক, এখন আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন অন্টারিওর নতুন যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচী নিয়ে যে বাদপ্রতিবাদ চলছে তাতে আপনি কোন পক্ষ অবলম্বন করবেন। আমরা এ বিষয়ে পক্ষ বিপক্ষের মতামত আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। সেই সাথে আধুনিকীকরণ করা যৌন শিক্ষা পাঠ্যসূচীতে কি কি পড়ানো হবে তাও তুলে ধরা হলো। শিশু সন্তান আপনার, সিদ্ধান্তও আপনার।