সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সুনজরে না দেখার মনোভাব শোভন নয়
ফোরাম রিসার্স নামের একটি জরীপ প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি একটি জরীপ চালিয়েছিল। জরীপে তারা দেখতে চেয়েছিল সংখ্যালঘু তথা বিভিন্ন এথনিক বা ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতি কানাডিয়ানদের মধ্যে ‘unfavourable’ মনোভাব কতটুকু।
ফোরাম রিসার্সের সাম্প্রতিক ঐ জরীপে দেখা গেছে মুসলমান ইমিগ্রেন্টদের প্রতি সবচেয়ে বেশী ‘unfavourable’ মনোভাব যারা প্রকাশ করেছেন তাদের সিংহভাগই রক্ষণশীল কানাডিয়ান। রক্ষণশীল এই কানাডিয়ানরা আরো যাদেরকে সুনজরে দেখেন না তাদের মধ্যে আছেন – রেড ইন্ডিয়ান, সাউথ এশিয়ান, এশিয়ান, ইহুদী এবং কৃষ্ণাঙ্গ ইমিগ্রেন্ট। ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত ফোরাম রিসার্স এর ঐ জরীপে দেখা গেছে কুইবেক প্রভিন্সে শতকরা ৫৭ জন কোন না কোন এথনিক গ্রুপকে সুনজরে দেখেন না। আলবার্টায় এই হার ৪৫%, আটলান্টিক কানাডায় ৩৯%, ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ৩৫% এবং অন্টারিও, মেনিটোবা আর সাচকাচুয়ানে ৩৩%।
টরস্টার নিউজ সার্ভিসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ফোরাম রিসার্স এর প্রেসিডেন্ট লরনে বজিনফ বলেন, “জরীপে যে তথ্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো, আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে যে, কানাডায় কিছু লোক আছেন যারা বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সুনজরে দেখেন না। তবে এই সুনজরে না দেখার বিষয়টি যে খুব খারাপ পর্যায়ে চলে গেছে তা বলা যাবে না। আবার এটিও স্বীকার করতে হবে যে, এই সুনজরে না দেখার বিষয়টি উপেক্ষা করার মতও নয়। আর এটি সঠিক অর্থে বর্ণবাদের ভাষান্তরও নয়।”
কানাডায় যারা বিভিন্ন এথনিক বা ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতি বর্ণবাদী আচরণ করেন তাদের সঙ্গে এই গ্রুপটির পার্থক্য কোথায়?
দেখা গেছে বর্ণবাদী নীতিতে যারা বিশ্বাসী বা যারা বর্ণবাদী আচরণ করেন তারা বেশীর ভাগই রক্ষণশীল রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। সেটা কুইবেকে হোক বা কানাডার অন্যান্য অঞ্চলে হোক তাতে কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। আর যারা সংখ্যালঘু ইমিগ্রেন্টদেরকে সুনজরে দেখেন না তারাও ঐ রক্ষণশীল রাজনৈতিক মতাদর্শেই বিশ্বাসী।
তবে শুধু রক্ষণশীল দলের সমর্থকরাই যে সংখ্যালঘু এথনিক গ্রুপের সদস্যদেরকে সুনজরে দেখেন না তা কিন্তু নয়। দেখা গেছে লিবারেল পার্টি, এনডিপি ও গ্রীন পার্টির সমর্থকদের মধ্যেও কিছু লোক আছেন যারা বিভিন্ন এথনিক গ্রুপ ও ধর্র্মীয় সংখ্যালঘুদের সুনজরে দেখেন না। এদের হার যথাক্রমে শতকরা ৩৩, ৩০ এবং ৩১ ভাগ।
আমরা মনে করি যারা বিভিন্ন সংখ্যালঘু এথনিক গ্রুপের সদস্যদেরকে সুনজরে দেখেন না তারা যে মতাদর্শেই বিশ্বাসী হোন না কেন তাদের এই মনোভাবটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে।
অমাদের ধারণা, কানাডায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি এই মনোভাব সৃষ্টির পিছনে জেনোফোবিয়া একটি কারণ হতে পারে। আর সেই সাথে ইসলামোফোবিয়ার ভূমিকাতো রয়েছেই। জেনোফোবিয়া হলো বিদেশী লোক বা বিদেশী কোন কিছু সম্বন্ধে অহেতুক ভয়। আমরা জানি কানাডায় প্রচুর সংখ্যক বিদেশী রয়েছেন যাদেরকে সাধারণভাবে ইমিগ্রেন্ট হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। যদিও বাস্তব অর্থে এদেশে সকলেই ইমিগ্রেন্ট একমাত্র আদীবাসী সম্প্রদায় ছাড়া। এই ইমিগ্রেন্টদের কেউ আগে এসেছেন কেউ পরে এসেছেন।
আগে আসা ইমিগ্রেন্ট বা তথাকথিত মূলধারার কানাডিয়ানদের কেউ কেউ মনে করেন পরে আসা ইমিগ্রেন্টরা তাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। এরা কানাডিয়ানদের চাকরির বাজার দখল করে নিচ্ছে, এদের সন্তানেরা শিক্ষা ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে, রাজনীতিতেও নতুন ইমিগ্রেন্টদের অনুপ্রবেশ ঘটছে। এরকম আরো কিছু বিষয় নিয়ে মূলধারার কানাডিয়াদের মধ্যে অনেকেই আতংকে রয়েছেন। আর সেই আতংক থেকেই অসন্তোষের সৃষ্টি বলে আমাদের ধারণা।
অন্যদিকে ইসলামোফোবিয়ার বিষয়টিতো রয়েছেই। ৯/১১ এর ঘটনার পর থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জঙ্গীবাদী সংগঠনের উত্থান ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে তাদের হামলার ঘটনা থেকে প্রধানত এই ইসলামোফোবিয়ার সৃষ্টি। এই দুই ফোবিয়া মিলেই প্রধানত সৃষ্টি করেছে সংখ্যালঘুদের প্রতি অসন্তোষ বা সুনজরে না দেখার মনোভাব।
এই অসন্তোষ বা সুনজরে না দেখার পিছনে একদিকে যেমন রয়েছে কিছুটা যৌক্তিকতা তেমনি অন্যদিকে রয়েছে এর কিছু অযৌক্তিকতাও। তবে যৌক্তিকতা বা অযৌক্তিকতা যেটাই থাকুক, সংখ্যালঘু কোন সম্প্রদায়কে সুনজরে না দেখা বা তাদেরকে ‘unfavourable’ মনে করা শোভন নয়। যদি আমরা ধরেও নেই যে এই সুনজরে না দেখার বিষয়টি ঠিক বর্ণবাদ নয়, তবু আমরা বলবো এটি পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি। এই পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও অশোভনতাই পর্যায়ক্রমে বর্ণবাদের দিকে মানুষকে ধাবিত করে। তাই এই মনোভাব পরিবর্তন করা জরুরী বলে আমরা মনে করি। কারণ, নতুন ইমিগ্রেন্টরা কানাডার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার জন্য আবশ্যকীয় জনগোষ্ঠি, কারো গলগ্রহ নন।
মার্চ ১০, ২০১৭