মিয়ানমারে পৈশাচিক গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ বন্ধে কানাডার আরো জোরালো ভূমিকা প্রয়োজন
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর পৈশাচিক গণহত্যা চলছে, চলছে জাতিগত নিধনযজ্ঞ। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিয়ানমারের বর্তমান হত্যাযজ্ঞকে ‘এথনিক ক্লিনজিং’-এর ‘টেক্সটবুক এক্সাম্পল’ হিসেবে উল্ল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ পাঠ্য বইয়ে জাতিগত নিধনযজ্ঞের বর্ণনায় আদর্শ উদাহরণ হতে পারে এটি। এর আগে ওআইসি মহাসচিবসহ অনেকেই একে গণহত্যার শামিল বলে উল্ল্লেখ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরও এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনীর এই নিষ্ঠুর অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রু–ডো মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সরকারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সুচিকে ফোন করে মিয়ানমারে মুসলমানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে তাতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সিবিসির খবরে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমারের সামরিক ও বেসামরিক নেতাদের জরুরী ভিত্তিতে শক্ত অবস্থান গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে অং সান সুচিকে চাপ দেন জাস্টিন ট্রুডো। অন্যদিকে কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড বেশ কড়া কণ্ঠেই নিন্দা জানিয়েছেন মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।Globe and Mail জানায়- মন্ত্রীর অফিস থেকে এক বিবৃতি বলা হয়, কানাডা দৃঢ়ভাবে মায়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি এবং সে দেশের সামরিক নেতৃবৃন্দকে মনে করিয়ে দেন এই বলে যে, বর্তমান সংকট মোকাবেলায় দায়িত্ব নিয়ে তাদেরকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হিংস্রতা এখনই বন্ধ করতে হবে। তাদেরকে দেশে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং সম্মান করতে হবে। রোহিঙ্গাদের অধিকারকে অস্বীকার করা হলে সেদেশের গণতন্ত্রকে দুর্বল করা হবে।
কিন্তু টনক নড়ছে না মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চির কিংবা সেখানকার সেনানায়কদের। তারা লাশের ওপর দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলছে। রোহিঙ্গারা নিজেরাই নাকি তাদের বাড়িঘরে আগুন লাগাচ্ছে। অথচ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার বলছেন, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া এবং নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ পলায়নরতদের গুলি করে মারার তথ্য-প্রমাণ ও স্যাটেলাইট চিত্র তাদের হাতে রয়েছে। বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রতিনিধি জোনাথন হেড বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে পুলিশের সামনেই রাখাইন বৌদ্ধদের আগুন লাগাতে এবং লুটপাট চালাতে তিনি নিজে দেখেছেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের এর চেয়ে বড় অপমান আর কী হতে পারে?
রোহিঙ্গারা শত শত বছর ধরে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বসবাস করে আসছে। আগে এর নাম ছিল আরাকান। ষাটের দশকে সামরিক শাসন আসার আগে পর্যন্ত মিয়ানমার পার্লামেন্টে রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বও ছিল। সত্তরের দশকে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয় এবং তার পরপরই শুরু হয় দেশটি থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়ন ও নিধনযজ্ঞ।
এদিকে রহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব ছাড়াই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের উন্মুক্ত বিতর্ক শেষ হলেও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পালানো অব্যাহত থাকায় মিয়ানমার সরকারকে অবিলম্বে রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর অভিযান বন্ধ করার সাহসী পদক্ষেপ নিতে বলেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেন, পরিস্থিতি এতটা জটিল হয়ে উঠছে যে শরণার্থী সংকটের দ্রুত অবনতি হয়ে মানবিক সংকট ও মানবাধিকারের দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে।
আমরা মনে করি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী শরণার্থী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে যাতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়, সেই লক্ষ্যে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। তবে মানবাধিকারের দেশ হিসাবে কানাডারও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কল্পে। তাছাড়া মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি কানাডারও নাগরিক। সে কারণে অনেকেই মনে করেন কানাডার সঙ্গে মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ যুগসূত্র তৈরী হয়ে আছে। তাই কানাডা এই দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
অক্টোবর ৭, ২০১৭