বাড়িবদল

মীজান রহমান ॥

ও মারা যাবার পর সবাই ধরে নিয়েছিল এবার আমি বাড়ি বিক্রি করে ছোট একটা কণ্ডোতে চলে যাব। হয়ত যাওয়া উচিত ছিল আমার, কিন্তু যাইনি। একা একা ভয় করে না আপনার, বলত ওরা। কিসের ভয় বলুন তো? এপাড়ায় চোরডাকাতের ভয় নেই, ভূতপ্রেতে আমি কোনদিনই বিশ্বাস করি না, আধিদৈবিক আর আধিভৌতিক এসব গালভরা শব্দেই বরং আমার ভয় বেশি, ভাবে বা ভারে নয়। বড়কথা, স্বাধীনতা। একার মত স্বাধীন মানুষ কে আছে সংসারে। একাতে যে আশ্চর্য স্বনির্ভরতা, যে অবারিত প্রান্তর ছড়ানো তার চতুর্দিকে, তার সাথে আর কিসের তুলনা হয় বলুন তো। তাছাড়া এবাড়ির প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গেই তো আমার নিবিড় ঘনিষ্ঠতা। শীতের রাতে ঝড়ের প্রকোপে নরম উত্তরীয়র মত তারা জড়িয়ে রাখে আমাকে, তাপ দেয়, অভয় দেয়। কেবল বিছানার বাঁপাশটাই খালি থাকে রাতের বেলা, যেখানে ওর নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যেত। সে শব্দটা এখন থেমে গেছে, এই যা। মানুষের সবকিছুই সয়ে যায় একসময়, এমনকি মৃত্যুও। এবাড়ির দেয়ালগুলো আমাকে চেনে, বেশ ভাল করেই চেনে। না চেনার কোনও কারণ নেই। অনেকদিনই তো হয়ে গেল—-পাকা ঊনত্রিশ বছর। ঢুকেছিলাম ১৯৮৫ সালের পয়লা মার্চ। দিনটা মনে আছে। সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল। মার্চের প্রথমদিন অটোয়াতে বৃষ্টি হতে শুনেছেন কখনো? তুষাড়ঝড় হয়, ফ্রিজিং রেইন হয়, আইস পেলেট হয়, কিন্তু বৃষ্টি? হ্যাঁ, সেবছর ঠিক তা’ই হয়েছিল। সেকারণেই মনে আছে। এবং তার পরের দিন গাকাঁপানো ঠাণ্ডা পড়েছিল, তা’ও ভুলিনি।

আমাদের বড় ছেলে বাবুর বয়স তখন ১৯, ছোট ছেলে রাজা ১৬। কে কোন্ ঘর নেবে সেটা আমরাই ঠিক করে দিয়েছিলাম, নইলে ওরা দুটিতে মাথা ফাটিয়ে ফেলত একে অন্যের। তবে বাড়িটা কেনা হয়েছিল প্রধানত ছোট ছেলের জন্যই—-মানে ওর পিয়ানোর জন্য। ওকে পিয়ানো বাজাতে হবে, নিরিবিলি জায়গাতে, এবং বড় পিয়ানোতে, যাতে বড় আওয়াজ হয়, ঘর কাঁপে, বাতাস থেমে যায়। ওর শিক্ষকরা বলতেন ও বড় পিয়ানিস্ট হবে, তাই আমরা অনেক টাকা খরচ করে বড় পিয়ানো কিনে দিয়েছিলাম ওকে, কারণ বড় পিয়ানিস্টদের বড় পিয়ানো না হলে নয়। এবং সেই বড় পিয়ানোকে বেইজমেন্টের মেঝেতে নেবার জন্যে লিভিং রুমের মেঝে ফুটো করতে হয়েছিল। তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। অনেক স্বপ্ন ধূলার সাথে মিশে গেছে, অনেক আকাঙ্খা আপস করে নিয়েছে বাস্তবতার সঙ্গে। না, আমাদের ছেলে বড় পিয়ানিস্ট হয়ে ওঠেনি এখনো, হয়ত হবেও না কোনদিন, কিন্তু তাতে আসে যায় না কিছু। বড় স্বপ্ন তো চিরকালই একটা রূপকথার গল্পের মত—-আলাদিনের চাদরে করে উড়ে যাওয়ার চেয়ে বেশি কিছু নয়। ওই চাদরে করে সে আমাদের উড়িয়ে নিয়ে গেছে কটা বছর, এই বাড়িতে থাকাকালেই। ওর মায়ের মৃত্যুর পর মৃতদেহ নিয়ে আসা হয়েছিল আমাদের লিভিংরুমে। উদ্দেশ্য একটাই—-শেষ যাত্রার আগে ছেলের মিউজিক শুনে যাবে, ওর অত্যন্ত পছন্দের একটি ফিউনারেল মার্চ। তার একবছর পর পিয়ানোটি বিক্রি করে দিই আমি—-কি লাভ রেখে। ছেলে চলে গেছে দূরে, সুর তোলার কেউ নেই, মিছিমিছি একটা অসম্ভব সুন্দর জিনিসকে একা একা ফেলে রাখা নিচের ঠাণ্ডা ঘরে। অতএব আবার সেই মেঝে ফুটো করে বিশাল যন্ত্রটিকে উদ্ধার করা অবহেলার কারাগার থেকে। তা’ও অনেক বছর হয়ে গেল। ২০০৩, তাই না? সময় তো একটা খরস্রোতা নদী, কিভাবে তার গতির খবর রাখব আমি।

ভাবতে অবাক লাগে যখন আমার শূন্য ব্যাকইয়ার্ডটির দিকে তাকাই। একসময় দেখতে রীতিমত একটা গ্রাম্য কৃষকের শাকসবজির ক্ষেত বলে মনে হত। মানে গ্রীষ্মকালে। শিম, টমাটো, বেগুণ, জুখিনি, লঙ্কা, কুমড়ো। উইকেণ্ডের একটা দিন আমি ওখানেই পড়ে থাকতাম কাস্তে কোদাল নিয়ে, ময়লা জামাকাপড় পরে, আর গিন্নির বকা খেতাম ঘন্টায় ঘন্টায়। বাজারে যেতে হবে মনে আছে? বাবুর সকার আছে আজকে সেটা যেন ভুলে না বসেন সাহেব। ওপরের বাথরুমে একটা টাওয়েল-হ্যাঙ্গার লাগাতে হবে কবে থেকে বলছি, সেদিকে কি কান আছে কারো? না, এসব আর শুনতে হয়না এখন। সেই সবজির ক্ষেতটাও ভরে গেছে দুর্বায়। চারদিকে এখন কেবল অপার অনন্ত স্তব্ধতা। ক্ষণে ক্ষণে একটি দুটি নীল শালিক এসে হাজির হয় ঘাসের পোকা কুড়োবার লোভে। অথবা কেবল সাদা বরফের স্তূপ, কবরের মত, স্ত্রীর মুখটি মনে করিয়ে দেয় বারবার, সারা শীতব্যাপী। ভাবিনি, এবাড়ির মায়া কাটিয়ে আমি অন্য কোথাও চলে যাবার কথা প্রশ্রয় দেব মনে। এই তো মাত্র সেদিন আমি জোরগলায় বললাম, না আমি কোনদিনই পারব না এবাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে। যেতে চাইলেও বাড়ির দেয়ালগুলো আমাকে আটকে রাখবে, বলবে তুমি বিশ্বাসঘাতক। তোমাকে যেতে দেওয়া হবে না। এবাড়ি তোমার নয়, তোমার ছেলেদের, যারা মন হারাপ হলে এখানেই আসতে চাইবে। এ’ই তাদের একমাত্র স্থায়ী ঠিকানা। তাদের হোম। এবাড়ি তাদের, তোমার নয়। এবাড়ি তোমার স্মৃতির কাছে বাঁধা। হ্যাঁ, তাই তো ভাবতাম আমি, ভেবে শান্তিও পেতাম কত। কিন্তু তারপর কি হয়ে গেল হঠাৎ করে? কেন এমনটি হয় মানুষের জীবনে?

সিদ্ধান্তটা আসলে হঠাৎ করেই নিয়ে ফেলি। এই একটা দোষ আমার চরিত্রের—-ছোট সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা করি, সময় নিই, কিন্তু বড় সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে ফেলি ঝটাপট, অনেকটা ঝোঁকের মাথায়। সেদিন কথা ছিল বৃষ্টি হবে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে বৃষ্টি মানে খারাপ খবর। বিপদ। ছোটদের নয়, বড়দের, বুড়োদের। আকাশ থেকে যখন নামে তখন তরল বৃষ্টি। মাটির ছোঁয়া পাওয়ামাত্র শক্ত বরফ। এর নাম ফ্রিজিং রেইন। যাকে আমি যমের মত ভয় করি। পিচ্ছিল রাস্তার ওপর আছাড় খেয়ে পড়ে যাওয়া ছোটদের জন্য পরম আনন্দের হতে পারে, কিন্তু আমার মত বুড়োদের জন্যে পরম আতঙ্কের। আমাদের বয়সে মাটিতে পড়ে যাওয়া অনেক সময় মাটির নিচে চলে যাবার শামিলই হয়ে দাঁড়ায়। আমার দুজন সহকর্মী, আমারই মত অবসরপ্রাপ্ত গাণিতিক, কিন্তু আমার চেয়ে হাজারগুণে শক্তসমর্থ পুরুষ, ব্যায়ামপুষ্ট শরীর, হঠাৎ ফ্রিজিং রেইনের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে সেই যে কোমর ভেঙ্গে হাসপাতালে চলে গেলেন সেখান থেকে সোজা কবরস্থানে।

ক্যানাডার শীতকালে, আমার মত প্রবীনরা সাধারণত মৃত্তিকাবাসী প্রাণীদের মত ঘরে বসেই জীবন কাটায়—-যাকে আমরা ইংরেজিতে বলি হাইবারনেটিং। সারাদিন লিভিংরুমের টেলিভিশন ছেড়ে রেখে, গায়ে লেপকাঁথা মুড়ে বসে বসে ঝিমোয়। আমার ভাগ্যে সে সুখটাও নেই। আমাকে বাজার করতে হয় সাপ্তাহিক খাবারদাবারের জন্যে। বড় কথা প্রতি সপ্তাহে গার্বেজ রাখতে হয় রাস্তার মোড়ে। অতএব আমার পক্ষে আছাড় খেয়ে হাসপাতাল হয়ে গোরের দিকে রওয়ানা হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়, এবং সেভাবে মহাপ্রভুর দরবারে গিয়ে হাজির হবার ইচ্ছা আমার নেই। অনেকটা সেকারণেই বাড়ি বিক্রির বাসনা—-কণ্ডোতে সে ঝামেলাটা থাকবে না। গার্বেজ রাখতে গিয়ে গোরে যাবার প্রয়োজন হবে না। অন্তত সেরকমই একটা আশা মনে।

কেরেন স্কট ও তাঁর স্বামী গ্রেগ, দুজনই বাড়ি বিকিকিনির ব্যবসাতে লিপ্ত—-একই কোম্পানিতে। সাধারণ বাংলা ভাষায় বলা হয় বাড়ির দালাল। কিন্তু ‘দালাল’ শব্দটি আমার অত্যন্ত অপছন্দ, তাই বাড়ি ক্রয়বিক্রয়ের মত একটা সম্মানজনক ব্যবসাতে যাঁরা জীবিকা অর্জন করেন তাঁদের বেলায় শব্দটা কেমন অভদ্র শোনায়। তাছাড়া কেরেন আর গ্রেগ দুজনই আমার অনেকদিনের চেনাজানা লোক, একরকম বন্ধুত্বই হয়ে গেছে বলতে পারেন। এঁরা গুণি মানুষ। কেরেনের হবি হল ছবি আঁকা। গ্রেগ করেন কাঠের কাজ, আসবাবপত্র নিয়ে লেগে থাকেন অবসর সময়ে। কেরেনকে একটা ইমেইল পাঠিয়ে বললাম, আমি বাড়ি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সাথে সাথে চাকা ঘোরা শুরু হয়ে গেল।

বাড়িতে পা দিতেই ভদ্রমহিলার নাক উঁচুতে উঠে গেল। উঁহু, এবাড়ি বিক্রি করা যাবে না। আমি ঘাবড়ে যাই। ঠিক আছে, এমন কোনও আহামরি বাড়ি নয় আমার, জানি, একা একা যতটুকু পারি সাফসুফো করে রাখার চেষ্টা করি, তাতেও চলবে না? উনি মাথা নেড়ে জানালেন, এটা সাফসুফাইর ব্যাপার নয়, আগাগোড়া চেহারাবদলের ব্যাপার। থরো আপগ্রেডিং করতে হবে। দেয়াল বদলাতে হবে, মেঝের কার্পেট সব ফেলে দিয়ে নতুন কার্পেট লাগাতে হবে ওপরতলায়, নিচের তলায় বসাতে হবে কাঠের মেঝে। খাঁটি কার্ডবোর্ড না হলেও চলবে, নকল কাঠে দোষ নেই। ( ক্যানাডা কাঠের দেশ অথচ এখানেই ভালো কাঠ এখন দুষ্প্রাপ্য এবং দুর্মূল্য। বাংলাদেশের গলদা চিংড়ির মত) তার ওপর আপনার জিনিসপত্র সব ছড়ানো চতুর্দিকে, সেগুলোকে হয় ফেলে দিন নয়ত গুদাম করে রাখুন কোথাও। এতসব জঞ্জাল দেখে কেউ কিনতে চাইবে না আপনার বাড়ি। সুতরাং ‘জঞ্জাল’ সরাবার ব্যবস্থা করতে হল। ভদ্রমহিলাকে কেমন করে বোঝাব যে এই ‘জঞ্জাল’ই আমার সম্বল, বস্তুর মূল্যতে না হলেও অন্তরের মূল্যতে। এই ‘জঞ্জাল’এর মাঝে ছিল আমার স্ত্রীর কাপড়জামাগুলো, পায়ের জুতোজোড়া, যেগুলো নিয়ে সে হাসপাতালে গিয়েছিল শেষবারের মত। এই জঞ্জালের মাঝে ছিল তার নরম কুশনটা যাতে গা এলিয়ে সে বসত আমার পাশে, দুজনে মিলে টেলিভিশন দেখতাম সন্ধ্যেবেলা খাবারের পর। এই জঞ্জালের মধ্যে আমার সব পুরনো বইগুলো, সেই কবেকার কোন্ মহাদেশের কোন্ শহরের কোন্ পুরনো বইএর দোকান থেকে কেনা মনেও নেই। স্মৃতির গভীর কন্দর থেকে মন্থন করে আনা যত নির্মূল্য দ্রব্যাদি, যাকে আজকের নতুন যুগের লোকেদের নতুন ভাষাতে ‘জঞ্জাল’ বলে আখ্যায়িত করা হয়, সেগুলোকে হয় ফেলে দিতে হবে আমাকে, নতুবা কোনও গোপন অন্ধকার খুঁজে পেতে হবে যেখানে তাদের লুকিয়ে রাখা যায়। এগুলো আধুনিক যুগের ক্রেতাদের চোখে দৃষ্টিকটু মনে হতে পারে। একবার ইচ্ছে হয়েছিল ভদ্রমহিলাকে বলে দিইঃ না ভাই, আমাকে বাড়ি বিক্রি করতে হবে না। এই জঞ্জালের ভেতরই আ্মাকে ডুবে থাকতে দিন। কিন্তু তারপর আবেগের ঝাপসা পর্দাটা কেটে গিয়ে খানিক সুমতি এল মনে। শেষ হিসেবে এগুলোর কি’ই বা মূল্য? বললাম, তাহলে বলুন আমাকে কি করতে হবে। না, আপনাকে কিছুই করতে হবে, আমাদের লোকই সব করেকেটে দেবে, আপনি শুধু চেকটা লিখে দেবেন কাজ সারা হলে।

এক সপ্তাহ পর আমার বাড়িখানা আর নিজের বাড়ি থাকল না—-একটি আকর্ষণীয় কঞ্জিউমার গুডে পরিণত হয়ে গেল। দেয়ালে দেয়ালে টাঙ্গানো হল বড় ফ্রেমের ছবি, যার অনেকগুলোই কেরেন স্কটের নিজের হাতে আঁকা ( ভদ্রমহিলা বেশ ভালোই আঁকেন বলতে হয়), জায়গায় জায়গায় রুচিসম্মতভাবে স্থাপন করা ফুলের পট (নকল অবশ্যই), বড় বড় আয়না বসানো হয়েছে ঘরে ঘরে, প্লাস্টিকের তৈরি (সম্ভবত মেইড ইন চায়না ) ইন্ডোর প্ল্যান্ট কোনায় কোনায়, বেডরুমগুলোতে মখমলের বেডকভার ছড়ানো বিছানার ওপর, ছোট ছোট বালিশ কায়দা করে সাজানো সেই বেডকভারের ওপর, বাথরুমগুলোতে দামি দামি তোয়ালে যা কেনার সাধ্য অন্তত আমার নেই, প্রতিটি ঘরের প্রতিটি কোনায় বড় বড় লাইট ল্যাম্প। মানে, এবাড়ি কারুর বাসোপযোগী নয়, দর্শনোপযোগীই কেবল। একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার আনিয়ে সবগুলো ঘরেরই ছবি তোলা হল—-সর্বমোট ৬৭ খানা ছবি। নানা ভঙ্গিতে, নানা এঙ্গেল থেকে, নানারঙ্গে, ইতালির ফ্যাশান শোতে বিরলবসনা, কুহকিনী নারীদের মত।

পরের দিন সামনের লনে বড় করে লেখা বিজ্ঞাপনঃ ফর সেইল। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি মনের। যেন আমার প্রিয়জনদের সবাইকে জড়ো করে গ্যারাজ সেইলে দিয়েছি। আমার এতদিনের সব সঞ্চিত স্মৃতি, সব আনন্দগুলো বেদনাগুলো, যত অব্যক্ত কথা ছিল মনে, যত সঙ্কলিত কামনা বাসনা, সব উদোম করে আমি বাজারে তুলে দিয়েছি সস্তা পণ্যের মত করে। না, এই ‘আমি’কে আমি চিনি না।

সেদিন বিকেল থেকেই লোক আসতে শুরু করল বাড়িতে। ক্রমাগত তাদের আগমন-নিষ্ক্রমন, চলতে লাগলো সারাদিনব্যাপী। প্রতিদিন। এবং প্রতিদিনই আমাকে চুপটি করে বেরিয়ে পড়তে হল বাড়ি থেকে। বেরুবার আগে ওপর নিচ প্রতিটি ঘরের প্রতিটি আলো জ্বালিয়ে রাখতে হল। প্রতিটি টেবিলের প্রতিটি ধূলিকণা মুছে ঝকঝকে তকতকে চেহারা নিয়ে রেখে যেতে হল সদয়চিত্ত ক্রেতাদের জন্যে। এমনকি আমার কিচেনের টেবিলটি, যেখানে আমার জীবনের অর্ধেক সময় কাটিয়েছি, (আমার বইপত্র, ল্যাপটপ, খাতাকলম থেকে শুরু করে খাওয়ার সময় হলে কাঁটা চামচ বাসন পেয়ালা সবকিছুরই নিরাপদ আশ্রয়) সেটিও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখতে হল। কেবল ল্যাপটপটিই রেখে যেতে চেয়েছিলাম। কেরেন বললেন, সরি, চলবে না। অতএব আমার ল্যাপটপ বেচারির জন্যও একটা জায়গা খুঁজে পেতে হল বাড়ির কোনও গুপ্তস্থানে। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল আমার নিজের। প্রথমদিন একবেলা বন্ধু আমিনুলের স্ত্রী আরাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে একটা নিমন্ত্রণ আদায় করা গেল। সেটা দুপুরে। সন্ধ্যাবেলা যাই কোথায়? ভাগ্য ভাল পাড়াতে একটা শপিং মল আছে। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নই বলা যায়। ভদ্র পাড়া—-বকাটে ছেলেমেয়েরা এসে গাঁজা খাবে আর বেলেল্লাপনা করে বুড়োদের আর মেয়েদের জ্বালাতন করবে সারাক্ষণ, সেরকম নয়। আমার সাপ্তাহিক বাজারটা সেখানেই করি সাধারণত। আমার মত বৃদ্ধদের জন্য, যাকে বলে ইউজার-ফ্রেণ্ডলি জায়গা। খোলামেলা, ভিড় কম, বসার জায়গা প্রচুর। অতএব হাতে একটা বই নিয়ে সেখানেই হাজির হলাম। অন্যান্য বুড়োদের সঙ্গে আসন গ্রহণ করে নিশ্চিন্তে বইএর পাতা উল্টাতে থাকলাম। সাথে সাথে ঘড়ির দিকে নজর রাখলাম কখন আমার ঘন্টার কাঁটা একপাক ঘুরে আগের জায়গাতে ফিরে আসে।

এভাবে, লুকোবার জায়গা খুঁজে খুঁজে প্রতিদিন একবেলা, দুবেলা, হয়ত তারও বেশি, কাটলো আমার দুটি সপ্তাহ। অবশেষে একদিন বর্শিতে কামড় লেগেছে বলে খবর পাঠালেন আমার সহৃদয় স্কটদম্পতি। এক ভদ্রলোক খুব পছন্দ করে ফেলেছেন আমার বাড়িটা। সে যে কি অদ্ভুত শান্তি আমার—-বিরাট একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললাম অনেকদিন পর। অনেকদিন পর বাসায় এসে ইচ্ছে হল কিচেনের টেবিলিটাকে আদর করে জড়িয়ে ধরি। সেদিন, মনে হল যেন কতকাল পর, কতযুগ পর, আমি খেয়েদেয়ে বাসনপত্র যেখানেসেখানে ছড়িয়ে রাখতে পারছি। বাইরে থেকে এসে জুতোজোড়া ছুড়ে ফেলতে পারছি দরজার সামনে। বাথরুম ব্যবহার করার পর ভুল করে নয় ইচ্ছে করেই ফ্লাশ না করেই উঠে আসতে পারছি পরম আনন্দে। অগুছালো থাকার যে কি সুখ সেটা আগে জানতাম না আমি। সেদিন আমি ইচ্ছে করেই টাইম ম্যাগাজিনটা, খবরের কাগজের মাঝের পাতাদুটি, নতুনকেনা একটা উপন্যাস, এগুলো সব ছড়িয়ে রাখলাম খালি মেঝের ওপর। সংসারে কার কি আসে যায় তাতে। এরই নাম যে স্বাধীনতা। এরই নাম ইচ্ছা। এবং এই ইচ্ছার কাছেই নতিস্বীকার করা, আর কারো কাছে নয়, আর কারো ইচ্ছার ওপর নয় কেবল নিজেরই ইচ্ছা ছাড়া।

ভাবলাম খুশির খবরটা সবাইকে জানানো দরকার। আমার ছেলেরা। নিউইয়র্কের মেয়েটি। টরন্টো-মন্ট্রিয়ল থেকে প্রিয়জন যারা আমার বাসায় এসে থেকেছে, রাত কাটিয়েছে, শক্ত মেঝের ওপর ঘুমিয়েছে, তারা। আমার আত্মীয়স্বজন যে যেখানে আছে তাদেরও জানার অধিকার আছে। আমাকে যারা ভালোবাসে, কিংবা বাসে না তবুও নীরবে সহ্য করে গেছে আমাকে, এমনকি তারাও, জানুক আমি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাবার আয়োজন করেছি। সবারই দাবি আছে আমার ওপর। কিন্তু কি আশ্চর্য, ‘খুশি’র খবরটিকে সবাই সমান খুশিতে গ্রহণ করতে পারেনি। ছেলেরা ইমেইলে প্রতিক্রিয়া পাঠালোঃ ‘বিটারসুইট’। অম্লমধুর। মেয়েরও একই মত। বন্ধু জালালুদ্দিন, সেই কবেকার বন্ধু আমার, একাত্তুরের সংগ্রামে একসঙ্গে কত কাজ করেছি, কত আন্দোলনে যোগ দিয়েছি, কত স্মৃতি আমাদের, সেই বন্ধুটি সোজা মুখের ওপর বলে দিলঃ “আমি মনে মনে চাইছিলাম খুব করে যেন তোমার বাড়িটা বিক্রি না হয়”। শুনে আমি অবাক। সেকি, কেন বলত। ও কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। যেন কেঁদে ফেলবে। মজার ব্যাপার যে আমার এই বন্ধুটি জীবনে যত বাড়িবদল করেছে সংসারে এতবার আমি কাউকে দেখিনি বাড়ি বদলাতে। কদিন পরপরই শুনতাম, আমরা অন্য বাসায় যাচ্ছি। এই মানুষটি কি সেই একই মানুষ? এতদিন পর, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই অদ্ভুত কাতরতা কেন।

মন্ট্রিয়লের নাহার মনিকা, আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ একজন, যে কোনদিন আমার বাড়িতে আসেনি, আসতে চেয়েও আসা হয়ে ওঠেনি, সে’ও লিখে পাঠালোঃ আপনার বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কেন এমন হয় বলুন তো। না, আপনাকে বলতে হবে না। উত্তর খানিকটা জানাই আমার। ‘বাড়ি’ একটা ইঁটপাথরের আবাসস্থলই নয় কেবল। বাড়ি, হোম, একটা আভ্যন্তরীন আকুতির নাম। যা বারবার হাতের কাছে পেয়েও কখনোই ঠিক পাওয়া হয়ে ওঠে না। বাড়ি একটি কূলকিনারাহীন মহাসিন্ধুর নাম। একটা এবস্ট্রাক্ট আইডিয়া। মানুষের অন্তহীন আরাধনার বেদীমূলই যার একমাত্র স্থায়ী ঠিকানা।

অটোয়া, ১৯শে এপ্রিল, ‘১৪।