প্রবাসে পরহিতকর্ম

কি ভাবছেন, এটা করা আদৌ ঠিক কিনা ?? ঠিকই ভাবছেন!! পরের উপকার করেছেন কি মরেছেন!! তাও আবার যাকে বলে বিশাল ওজনদার ছক্কা খেয়ে মরা । তবু বলছি এই মরাতেও কিন্তু আপনি অমৃতের স্বাদ পাবেন। বিশ্বাস করুন! বুকে হাত দিয়ে এবং দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার বিশ্বাস নিয়ে বলছি।
পরহিত করতে গেলে আগেই বলে রাখছি আপনার কি কি ক্ষতি হবে:
১. প্রচুর সময় নষ্ট হবে!
২. সীমাহীন এনার্জি নষ্ট হবে। এমনি কি আপনার প্রেসার লো অথবা হাই হবার প্রচুর আশংকা রয়েছে! যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের রক্তে সুগার উঠা নামা করতে পারে!
৩. প্রচুর অর্থদন্ড হবে। সেল ফোনের বিল আসবে আকাশচুম্বী। উপকার করতে যেয়ে গাড়ীর গ্যাসের পয়সা খরচ হবে দেদার। আপনি বুঝতেও পারবেন না! যখন বুঝবেন তখন অলরেডী আপনার ক্রেডিড কার্ডের অর্থদন্ড দেখে চোখ অবশ্যই ছানাবড়া হতে বাধ্য।
৪. পারিবারিক সমস্যাও হবে, নানাভাবে। অন্যের উপকার করতে গিয়ে নিজেরই পরিবারের প্রায় প্রতিটি সদস্যের অহর্নিশ তিরস্কার! বাক্য যন্ত্রণা!! এমনকি আপনার পার্টনার যদি আপনার সমমনা না হয়, তাহলে দেখা যাবে পরের ঘর গড়তে গিয়ে নিজের ঘর-ই ভাঙ্গার উপক্রম হবে!!
তবু। এই ’তবু’ টা বিশাল অর্থবহ। যাদের এই পরিহিত করার বাসনা থাকে, এটা কিন্তু তাদের মূলতই মজ্জাগত। কোন ‘না’-ই তাদেরকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। তবে পার্টনার যদি সমঝদার হয়, তবে পরহিত করার তাৎপর্য আরো বেড়ে যায়।
পরহিত করার কিছু তথ্য আছে। এটা (পরহিত কর্ম) দানের (সদকা) সমপর্যায়ের। এবং এটা সদকাতুল জারিয়া। এবং সব ধর্মেই কিন্তু, মানুষের উপকারের কথা বলা হয়েছে।
স্বামী বিবেকানন্দও বলেছেন, যে জন সেবিছে মানুষ, সে জন সেবিছে ঈশ্বর!!
আবার যার উপকার করবেন, তার দ্বারা যে আপনি অপকৃত হবেন অথবা বিশাল আকারের লেংচী খাবেন, এ বিষয়ে আপনি আগে ভাগেই শারীরিক এবং মানসিকভাবে তৈরী হয়ে থাকবেন।
তো, এইরকম একটা অতিকায় ব্যামো আমার জন্মগত এবং মজ্জাগত ভাবে আছে। এবং আমি একে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে লালন এবং পালন করে চলেছি প্রায় কৈশর কাল থেকেই। মজার ব্যাপার হলো, প্রায় প্রথাগত ভাবে সেই যতবার, যত ভাবে মানুষের উপকার করেছি, ততোবার-ই সুন্দর ভাবে লেংচী খেয়েছি। এখন মোটামুটিভাবে আমার মনুষ্য চামড়াটা গন্ডারের চামড়ায় পরিনত হয়েছে। কারণ, মানুষের দেওয়া লেংচীটা আর আগের মত আমার মনুষ্য চামড়ায় স্পর্শ করে না।
বিয়ের আগে যাহোক, তাহোক করে পরহিত করেছি। লেংচী খেলেও ( তার কষ্টটা) চুপচাপ একাকীই হজম করেছি। কিন্তু বিয়ের পর হয়েছে মুস্কিল। এই কুকর্ম বা সুকর্ম যাই-ই বলুন, সম্পাদন করার পর… ঐ লেংচীটা আমার স্বামীপ্রবর মোটেই সহ্য করতে পারতো না। মুখেই তখন গলা ফাটিয়ে উত্তম-মাধ্যম, “তখনই বলেছি…করোনা….এসব যথেষ্ট হয়েছে….ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে যেওনা… তাতো শুনবে না! এখন কেমন লাগছে?? বলেছি না… কতবার… বামুনের কথা বাসী হলেই ফলে… ইত্যাদি ইত্যাদি। তো যতই মধুবর্ষণ সহযোগে চেঁচামেচী করুন না কেন…আস্তে আস্তে হলো কি, ঐ যে ‘সঙ্গদোষে সর্বনাশ’, তাকেও পেয়ে বসলো পরহিতে!!
তো, এখন একরকম ভালই হয়েছে। পরহিত করি দুজনে একসাথে। লেংচীও খাই দুজনে একসাথে। আমার লেংচী খাবার পর (যদিও বলি এখন চামড়াটা গন্ডারের হয়েছে) বেশ কিছু দিন যথেষ্ট মন ভারাক্রান্ত থাকে। অনেকগুলো রাত ঘুমহীন কেটে যায়। ভাল করে খেতেও পারিনা। শারীরিক সমস্যাগুলো সব একসাথে আক্রমন করে বসে। স্বামীর মধুবর্ষণ চলতেই থাকে। ছেলেদের বকাবকী, বিরক্তি, টিপ্পনি কাটা – আসলের উপর সুদের মতো চলতেই থাকে সমানে। এবং মজার ব্যাপার হলো, এই একটি ব্যাপারে দুই ছেলের কন্ঠের তাপ ও মন্তব্য একই থাকে “ মামনি, ইনাফ! অনেক করেছো পরহিত, প্লিজ…নো…মোর।”
আমিও সাথে সাথে ওদের সাথে তাল দিয়ে যাই “নারে বাবা, আর ও মুখো হচ্ছি না! ঐ সব হ্যাপায় আর যাচ্ছি না।“ -ছোট ছেলে আবার গম্ভীর প্রকৃতির, মারাত্মক একটা ভ্রুকুটি করে বলবে, “ হু! দেখা যাক…কদ্দিন, যদি তোমাকে না জানতাম!!“ হা হা হা এটা আমার দুঃখের এবং সুখের মিশ্র হাঁসি।
বাংলাদেশে যদ্দিন ছিলাম, এক রকম করে করেছি, তখন এইভাবে নিয়মিতভাবে ব্যস্তও ছিলাম না। ব্যস্ততা থাকলেও, তখন সর্বক্ষেত্রে, ঘরে, বাইরে সাহায্যকারী ছিলো! এখানেতো সেই সুবিধাও নেই! কিন্তু তাই বলেতো ’পরহিত’ থেমে থাকার নয়, এ জীবনে!!!
এই প্রবাসে সাবাইকে (বাংলাদেশী) আত্মার আত্মীয় বলে মনে হয়! কারো একটু দুঃখ কষ্ট দেখলেই মনটা দ্রবীভূত হয়ে পড়ে। এই প্রবাসে আমরা যারা এসেছি রীতিমত সর্বতোভাবে যুদ্ধ করছি।
যদিও এটাও ঠিক, সার্বিকভাবে যুদ্ধ করার মানসিকতা নিয়ে আমরা আসিনি। ধরতে গেলে ৮০ভাগ মানুষই এসেছে (কানাডায়) সোনার হরিন ধরার কথা ভেবে। বিশেষ করে যারা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ক্যাটাগরীতে এসেছেন, তাদের বেলায়ই এই ঘটনাটি ঘটেছে বেশী। কারণ, তারা ভেবেছেন কানাডা এত বড় দেশ, এত ধনী দেশ, তাই গেলেই যার যার শিক্ষাগত যোগ্যতায় চাকুরী পেয়ে যাবেন। পিয়ারসন্স এয়ারপোর্টে নামতেই যতক্ষণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আসার পর একে একে দিন যায়, মাস যায়! বছরও গড়িয়ে যায়, তবুও নিজ প্রফেশনের কোন চাকুরীর কোন সন্ধান পাওয়া যায়না। এদিকে দেশ থেকে আনা ডলারও (টাকার পরিবর্তে আনা ডলার!!) তলানীতে নামে। তখন কি আর করা? স্বামী, স্ত্রী এমনকি ১৫/১৬ বছরের বাচ্চাদেরও আমরা কাজে নামিয়ে দেই। যে সব কাজের কথা দেশে (গরীব দেশের নাগরিক হলেও) আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি! তবুও করতে হয়। করে যেতে হয়। কারো কারো হয়ত বা কিছুকাল। কারো কারো হয়ত বা আমরণ!! আহা!! এসব সত্যি বড়ই কষ্টের!! চিন্তার অতীত!!
তো এই সব নতুন প্রবাসীদের প্রভূত সহযোগিতার দরকার হয়। আমার একটি পরিচিত পারিবারিক বন্ধু পরিবার আছে (খুব ঘনিষ্ঠ আমাদের)। সেই পরিবারের ঐ ভাইটি এই পরহিতকর্মের সাথে জড়িত প্রায় ৩০/৩৫ বছর ধরে। এই দীর্ঘকাল উনি নানাভাবে পরহিত করে চলেছেন নিরলসভাবে। আমাদের বাংলাদেশীদের এমন কোন সমস্যা নেই, যে সমস্যায় উনি উপকার (সাধ্যের মধ্যে, এমনকি সাধ্যের বাইরেও) করেননি। তবে আমার ঐ ভাইটির ভাগ্য ভালই বলতে হবে, পরোপকার করতে যেয়ে উনি জীবনে কটি লেংচী খেয়েছেন জানিনা, তবে বছর দুই আগে উনি লন্ডন (অন্টারিও) ইনিভারসিটি থেকে সমাজ কর্মের জন্য এওয়ার্ড পেয়েছেন। উনি আসলেই ডিজার্ভ করেন ঐ এওয়ার্ড। এই পরোপকার করতে গিয়ে নিজের সংসার ধর্মকেও উনি অনেকাংশে উপেক্ষা করেছেন। যদিও সংসারের অর্থনৈতিক দিকটা উপেক্ষা করেননি। কিন্তু এইসব দেশে অর্থপোর্জানের পাশাপাশি সাংসারিক অনেককিছুও স্বামী/স্ত্রীকে যৌথ ভাবে করতে হয়। উনি তা করেন নি। যদিও তার অতি বিচক্ষণ এবং কর্মনিষ্ঠ স্ত্রী দু হাতে সংসারকে সামলে যাচেছন আজ এতটা বছর ধরে। যদি এই গুনবতী স্ত্রী না করতেন এতসব, তাহলে হয়তো বা দেখা যেত, পরোপকার করতে গিয়ে নিজের ঘরই ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে আমার ঐ ভাইটির। আমি নিজে দেখেছি, পরের উপকার করতে গিয়ে এই মহান ব্যক্তি নিজের বাড়ি পর্যন্ত বন্ধক রেখেছেন। সংসারে এরকম মানুষ বিরল। উনি নমশ্য।
তো, যা বলছিলাম, এরকম যারা নতুন এসেছে, সংসার চলছে না, এমনকি ঘরভাড়াও দিতে পারছে না। আমার কাছে দুঃখের বিলাপ করাতে, বস’কে ধরে চাকরী পাইয়ে দিয়েছি এরকম ৪/৫জনকে। প্রতিবারই এরা চাকরী পাবার পর বিশাল আকারের লেংচীটা আমাকেই খেতে হয়েছে। প্রথম ৪ জনতো হাতে নাতে ধরা পড়েছে চুরি করে। চিন্তা করুন একবার, একেতো দেশী, তার উপর আবার বাঙ্গালী বলে কথা। কি ভিষণ লজ্জা! চিন্তা করুন একবার। শেষ বারতো যাকে চাকরী পাইয়ে দিয়েছিলাম, সোতো আরো গভীর জলের মাছ! সেতো আমাকে এমনই বিপদে ফেললো যে, আমারই চাকরী যায় যায় অবস্থা! যাই হোক, আল্লাহ পাক শেষ মুহুর্তে আমাকে মহা বিপাক থেকে রক্ষা করেছেন।
কিন্তু তাই বলেতো, হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান নয়। অনেকে এমনও আছেন, যারা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আপনার করা উপকার, হৃদয়ের মনিকোঠায় স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখেন। এবং প্রতিটি মুহুর্তে নিজেকে তৈরী রাখেন, আপনার উপকারে আসার জন্য।
মানছি তাদের সংখ্যা লঘু। হোক লঘু। কিন্তু আছে তো? একেবারে বিরল তো নয়। অতএব, সেই সংখ্যা লঘুদের কথা চিন্তা করেও, আপনি আপনার জনহিতকর কাজ করে যাবেন। বিশেষতঃ এই প্রবাসে (এখন পর্যবেক্ষন করছি) অর্থকরী দিক থেকেও পারিবারিক সমস্যা মহামারির মত ছড়িয়ে গেছে। ‘মহামারী‘ এই জন্য বলছি, কারণ, এটা অনেকটা যেন ছোঁয়াচে। এ করেছে, সে করেছে, আমি কেন করবো না ? অনেকটা এইরকম। আমাদের বাংলার সামাজিক মূল্যবোধ, কৃষ্টি এ সবতো ধরে রাখতে হবে আমাদেরকেই। তাইনা? সন্তানদেরও নানারকম সমস্যা আমরা ফেস করছি। এ ব্যাপারে আমাদের একজন অন্যজনকে অবশ্যই সাহায্য করতে হবে। (চলবে)

জুলাই ২৭, ২০১৪