প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার যেভাবে বিভেদ সৃষ্টি করেন এবং অনেক সংখ্যালঘুর মন জিতে নেন

হারুন সিদ্দিকী

কানাডার প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার যতটা না কানাডার জন্য শাসন করেন তার চেয়েও বেশি করেন তার নিজ দল রক্ষণশীল দলের জন্য। তিনি এটি করেন গোপন কূশলতার সঙ্গে। এখন তিনি এটি করছেন খোলামেলাভাবে অনেকটা ওয়াশিংটনের রিপাবলিকানদের মতো যারা প্রকৃতপক্ষে তাদের দলীয় ঝুঁকি গ্রহণের কৌশল থেকে পিছু টানতে শুরু করেছেন ঠিক যেমনটা হারপার বিরাট অহংবোধ থেকে সবকিছু তছনছ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

নির্বাচনী আইনে তার প্রস্তাবিত পরিবর্তনের বিষয়টি ধরুন, যা রক্ষণশীলদের জন্য সহায়ক হবে Ñ প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা মার্ক মেরান্ড-এর (যিনি নির্বাচনী আইন লংঘনের দায়ে রক্ষণশীল দলকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন) ক্ষমতাকে নিঃশেষ করে এমন আইন করলেন যাতে ভোটারদের জন্য ভোট দেয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অর্থ সংগ্রহ করা সহজতর হবে।

জন বেয়ার্ডের বহুল প্রচারিত ইউক্রেন সফরের কথা ধরুন Ñ সেটি ছিলো নির্লজ্জভাবে একটি রক্ষণশীল দলের মিশন, কানাডার স্বার্থের অনুকূলে নয়।

ধরুন শুক্রবার ম্যাসি হলে আগা খানের বক্তৃতা অনুষ্ঠানে কীভাবে সরকার বিরোধী দলকে বর্জন করলো সেই দৃষ্টান্তও। এমনকি ওই এলাকার এমপি লিবারেল দলের ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডকে পর্যন্ত উপস্থিত হতে দেয়া হয়নি।

এই সবকিছুই হয়েছে হারপারের ইজরায়েল ও পশ্চিম তীর সফরের পর- যে সফর ছিলো সব বিচারেই সম্পূর্ণ রাজনৈতিক।

সেখানে একটি ঘটনায় ইয়র্ক সেন্টারের রক্ষণশীল দলীয় এমপি মার্ক এডলার লিবারেল দলের শ্রদ্ধাভাজন এমপি ইরউইন কোটলারকে কথা বলতে বাধা দেন। কোটলার নিজের কাজে ইজরাইল গিয়েছিলেন। হারপারের ২০০ সদস্যের অস্বাভাবিক বড় প্রতিনিধিদলে কানাডীয় আরবদের একজনকেও নেয়া হয়নি অথচ চরমপন্থী জুইস ডিফেন্স লিগের প্রতিনিধি রাখা হয়। এই জুইস ডিফেন্স লিগ হলো এমন একটি সংগঠন যা অন্যান্য সংগঠনের পাশাপাশি ইসলাম আতঙ্কে ভোগা দক্ষিণপন্থী ব্রিটিশ গ্র“প ইংলিশ ডিফেন্স লিগের সঙ্গে কাজ করে। খুব কম লোকই জানে যে, টরন্টোর বৃহত্তম সিনাগগগুলোর (জুইসদের প্রার্থনাস্থল) অন্যতম উদারপন্থী বেথ জেডেক কংগ্রেগেশন-এর অত্যন্ত সম্মানিত রাবি (জুইসদের ধর্মীয় নেতা) বারুচ ফ্রিডম্যান-কোলকে প্রতিনিধি দল থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন খোদ হারপার নিজে।

ফ্রিডম্যান-কোল হলেন টরন্টোর বোর্ড অব রাবির প্রেসিডেন্ট যে বোর্ড ২০১২ সালে আমেরিকার ইসলামবিরোধী নষড়মমবৎ পামেলা গেলারকে বক্তৃতা করতে ডাকার জন্য জুইস ডিফেন্স লিগের নিন্দা করেছিলো। গেলারের দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘অরুচিকর’ আখ্যা দিয়ে বোর্ড বলেছিলো, ‘‘ইহুদিদের সমাবেশে বক্তৃতা করার জন্য তাকে এখানে আমন্ত্রণ জানানোর কোন অর্থ হয় না।’’

হারপারের সুশীল কানাডীয় ইহুদির সংজ্ঞার মধ্যে ফ্রিডমান-কোল পড়েন না, কোটলারও নন।

এসব দৃষ্টান্ত এবং আগের উদাহরণগুলো একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ধরণের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ Ñ সেটি হলো শাসনের ক্ষেত্রে হারপারের ‘‘হয় তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে নাহলে বিরুদ্ধে থাকবে’’ এই নীতি; তার রক্ষণশীল দলের স্বার্থের অনুকূলে কানাডার পররাষ্ট্র নীতিকে ছিনতাই করে নেয়া; আর এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আরেক সম্প্রদায়কে প্ররোচিত করার জন্য বিভেদ সৃষ্টি করো ও জয় করো কৌশল।

আগা খানকে সম্মান জানানো, ২০০৯ সালে তাকে সম্মানজনক নাগরিকত্ব দেয়া এবং বৃহস্পতিবার তাকে পার্লামেন্টে এবং শুক্রবার টরন্টোতে বক্তৃতা করার সুযোগ দেয়ার বিষয়টি ঠিক আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে সন্দেহজনক।

কানাডার ইসমাইলী জনগোষ্ঠীর সমর্থন আদায়ে তার চেষ্টা অন্য কয়েকটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি রক্ষণশীলদের যে তোষণনীতি রয়েছে সেই অবস্থানের ধরণকেই অনুসরণ করে।

তিনি এধরণের কাজ কেবল ইহুদিদের সঙ্গেই করেননি Ñ সম্প্রতি থর্নহিলে প্রাদেশিক উপনির্বাচনেও অনেক ইহুদি ভোটার প্রকাশ্যেই এটি জানিয়েছেন যে তারা ‘‘হারপারকে ভোট দিয়েছেন’’। নির্বাচনে রক্ষণশীলদেরই জয় হয়েছে। তিনি হিন্দু, শিখ, বাহাই, কপটিক খ্রিস্টান, পাকিস্তানী খ্রিস্টান এবং পাকিস্তানী আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও অনুপ্রবেশ করেছেন।

কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গোষ্ঠীগত বা তাদের আধ্যাত্মিক ভূমির ব্যাপারে কোন সরকারের খোঁজখবর নেয়ার মধ্যে খারাপ কিছু থাকতে পারে না, যদি না সেটা দলের জন্য ভোট আকর্ষণ বা অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যর সঙ্গে বা তার চেয়েও খারাপ কানাডার পুরনো গোলযোগকে উস্কে দেয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে।

হারপারের সাদা-কালো পৃথিবীতে ইজরাইলকে সমর্থন জানানোর অর্থ হলো কানাডায় আরবদের বিরোধিতা করা। কানাডার আরবদের মধ্যে অর্ধেকই খ্রিস্টান  এবং তাদের সংখ্যা সাত লক্ষ ৮০ হাজার হলেও তাদের ব্যাপারে হারপারের খুব সামান্যই অথবা একেবারেই সংশ্লিষ্টতা নেই। অন্যদিকে সারাদেশে ইহুদির সংখ্যা মাত্র ৩লাখ ২৯ হাজার যা আরবদের তুলনায় অর্ধেকমাত্র। এই সংখ্যাার ভিত্তিতে নীতিমালা গ্রহণ করা হবে এমনটা বলা হচ্ছে না তবে বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অফিসের অবিবেচনাপ্রসূত অশ্রদ্ধা প্রদর্শন তার দফতরকেই অসম্মানিত করে।

কানাডার মুসলমানদেরও হারপার উপেক্ষা করেন। অথচ মুসলিমরা হলো সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান এবং সবচেয়ে তরুণতর একটি জনগোষ্ঠী যাদের গড় বয়স মাত্র ২৮.৯ বছর যেখানে কানাডীয়দের গড় বয়স ৪০.২ বছর। এটি হলো স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার হিসাব। ১০ লাখের বেশি মুসলিম কানাডায় বসবাস করে যারা সংখ্যায় বৌদ্ধদের (৩৬৮,০০০) তুলনায় তিনগুণ; হিন্দুদের (৪৯৮,০০০) লুথারীয় ও পেন্টাকোস্টাল খ্রিস্টান (প্রতিটিরই সংখ্যা ৪৭৮,০০ করে) এবং শিখদের (৪৫৫,০০০) তুলনায় দ্বিগুণ; অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের (৫৫০,৭০০০) তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ এবং ইউনাইটেড চার্চের অনুসারীদের (২০ লাখ) অর্ধেক।

স্টিফেন হারপার সুনির্দিষ্টভাবে সেইসব ক্ষুদ্রতর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষেই ওকালতি করেন যারা মুসলিম ভূখন্ড থেকে হয়রানি এড়িয়ে কানাডায় এসেছে। তাদের ভোগান্তি অবশ্যই যথেষ্ট সত্য। কিন্তু হারপার বা তার প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক দফতর মিয়ানমারের মত জায়গাগুলোতে নির্যাতিত মুসলিম সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে খুব কমই কথা বলে।

ক্ষমতাসীন দলের সেবা কার্যক্রমে এধরণের বাছাই করা, আদর্শিক, দলীয়, নিষ্করুণ তৎপরতার ফলে কানাডার সাধারণ স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়া হয়। তার চেয়েও যেটা মারাত্মক সেটা হলো, এসব কর্মকান্ড একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে অন্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মাধ্যমে আমাদের বিভেদগুলোকে আরও গভীরতর করে তোলে অথবা একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ বাড়িয়ে দেয়। এসব তৎপরতা একটি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় অথচ এখনও ঐক্যবদ্ধ জাতিকে শাসন করার উপায় নয়।

এপ্রিল ৫, ২০১৪

সৌজন্যে : টরন্টো স্টার