তরমুজ জোড়া লাগায়ে দাও
শুজা রশীদ
এই কাহিনী অল্প কিছুদিন পূর্বের। একটি গুরূত্বপূর্ণ পরিবর্তন এলো আমার জীবনে । সংক্ষেপে, পূর্বের কাজটিতে বড় হুজুর, ছোট হুজুর, তাদের মুখ্য চামচা, পাতি চামচা সকলের সাথে বাক-বিতন্ডা, মুখ দেখাদেখি বন্ধ হবার উপক্রম হতে অন্য কাজ দেখা ছাড়া দ্বিতীয় পথ খোলা ছিলো না। সৌভাগ্যবশতঃ দ্রূতই আরেকটি কাজ পেয়ে যাওয়ায় পূর্বের আগে’য়গিরি থেকে পরিত্রাণ পেলাম। নতুন কাজটিও টরন্টো ডাউন টাউনে। বাস্তবে পূর্বের কর্মক্ষেত্র থেকে “গলা বাড়ালেই নজরে পড়ে” অবস্থা। এখনও বাসে ও সাবওয়েতেই যাতায়াত চালিয়ে যাই। অফিস আঠারো তলায়। লাঞ্চের সময় সুযোগ পেলেই নীচে নেমে আসি। নীচতলার সমগ্রটুকুই দোকানপাট ভরপুর। নানান জাতের খাবার দোকান থেকে শুরু করে জুতা সেলাইয়ের দোকানও রয়েছে। আমি সুযোগ পেলেই একটি গ্রোসারীর মধ্যে ঢুকে থরে থরে সাজিয়ে রাখা দৃষ্টিনন্দন ফলমুল, শাকসব্জি
পরখ করি। যেকোন ধরনের খাদ্যের সংস্পর্শেই আমার হৃদয় উৎফুল্ল্ল হয়ে উঠে। মাঝে মাঝে যুৎসই মূল্যে কিছু পেয়ে গেলে কিনে ফেলি। এই বিশেষ দিনে দোকানে ঢুকেই দেখলাম বিশাল এক ঝুড়ি ভর্তি থরে থরে সাজানো গোলাকৃতি তরমুজ।
তাদের চেকনাই শরীর দেখেই জিহ্বায় উত্তেজনা। বেশ কয়েকজন চৈনিক বৃদ্ধের ভীড় ঠেলে একটি বড়সড় তরমুজ বগলদাবা করে কেটে পড়ছিলাম, ধমক খেয়ে থমকে দাঁড়াতে হলো। চৈনিক বৃদ্ধদের একজন আমার নাকের ডগায় তর্জনি নেড়ে ভয়ানক উচচারণে ইংরেজি ও চীনা ভাষার মিশ্রণে যা বললো তার বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায় – ‘কেমন উজবুক হে তুমি? তরমুজ চেনো না? এটাতো পানসে হবে। রেখে দাও, জলদি রেখে দাও।’
রেখে দেই। তাদের বক্রিম হাসি দেখে নিজেকে বাস্তবিকই অপদার্থ মনে হয়। বললাম, ‘কোনটা ভালো?’ আবার নাকের ডগায় তর্জনি। ‘এই সামান্য ব্যাপার জানো না, কোন দেশের মানুষ তুমি হে? দেখো।’ বৃদ্ধ একটি তরমুজ বাম হাতের তালুতে সাবধানে তুলে ভারসাম্য রক্ষা করতে করতে ডান হাতের আঙুল দিয়ে চটাস করে একটি চাটি দেয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় চাটির পর অপদার্থ তরমুজটি ফিরে যায় যথাস্থানে। অন্য একটির শরীরে পড়ে চাটি। পরবর্তি দশ মিনিটে ডজনখানেক তরমুজে তাল তুলে, আঙুলের ডগা টাটিয়ে পরিশেষে সকল বৃদ্ধের সম্মতিক্রমে একটি তরমুজ বাছাই করা গেলো। সিক্স নাইনটি নাইন (ছয় ডলার নিরানব্বুই সেন্ট দিয়ে সেটি ক্রয় করে বগলদাবা করে অফিসে নিয়ে এলাম। বাসায় ফেরার সময় সঙ্গে নিয়ে যাবো। সাবওয়েতে এই তরমুজ নিয়ে উঠতে দেখলে কিছু রসিক হৃদয়ে রসের সঞ্চার হতে পারে ধারণা করি, কিন্তু সেই ভয়ে ভীত হয়ে স্থিত হবার মানুষ আমি নই। ফিরতির সময় দেখা হলো আযম ভাইয়ের সাথে। তিনিও একই দালানে অন্য একটি কম্পানীতে কাজ করেন। বয়েসের ফারাক অল্পই। আমাদের মধ্যে যথেষ্ট সখ্যতা রয়েছে। বিশেষ করে তারও মৎস্য ধরার বাতিক থাকায় আমাদের ছুটির দিনগুলিতে দুর-দুরান্তে যাওয়া হয় অসহায় অর্বাচীন মৎস্যদের জীবননাশ করতে। তিনি তরমুজ হাতে আমাকে দেখেই
আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। ‘করছেন কি ভাই, এইডা কি নিয়া চললেন? মানুষের কাছে তো আর মুখ দেখাইতে পারবেন না। প্যান্ট শার্ট, জুতা পইরা চলছেন এক তরমুজ মাথায় নিয়া! ছিঃ, ছিঃ। হা হা-হা….. ’
আমি আড়চোখে চতুর্দিকে নজর বোলাই। বেশ কিছু ঠোঁটে হাসির ঝিলিক। রূপসী এক তরূণীর মুখে সম্ভাব্য ব্যাঙ্গের হাসি দেখে দুর্বল হৃদয়ে বীনা বেজে উঠলো। ‘কি করি বলেন তো আযম ভাই? দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না ….।’
আযম ভাইয়ের কাছে সব কিছুরই সমাধান আছে। তিনি অফিসে ব্যাকপ্যাক নিয়ে আসেন। ভেতরে তার ক্ষুদ্র লাঞ্চ বক্স ছাড়া অন্য কিছু থাকে বলে মনে হয় না। তিনি তার ব্যাকপ্যাক নামিয়ে ফেললেন। ‘এইটার মধ্যেই ঢুকাইয়া ফ্যালেন। মজবুত আছে। ছিঁড়বো না।
প্রাণে পানি পাই। তার বিশালকায় ব্যাক প্যাকে আমার তরমুজ চমৎকার এঁটে যায়। আমি সেটাকে কিছুক্ষণ হাতে বহন করে বিরক্ত হয়ে পিঠেই ঝুলিয়ে ফেলি। কিং ষ্টেশন থেকে সাবওয়েতে উঠে ব্লর ষ্টেশনে নামি আমরা। এখানে ট্রেন পাল্টাতে হবে। স্বভাবতই অফিস ফেরত যাত্রীদের ভয়ানক ভীড় এই জাংশনটিতে। ট্রেনের বাইরে পা রাখতেই প্রথম যে দৃশ্যটি হৃদয়ে বিশেষ রকম দোলা দিলো তা হচেছ পুলিশের উপস্থিতি। মাত্র কয়েকদিন আগেই লন্ডনের সাবওয়েতে ভয়াবহ বোমা হামলা হয়ে গেছে। টরন্টোতেও মানুষজন বেশ ভীত চকিত। কানাডার ভূমিকা আদতেও ঝুঁকিপূর্ণ না হলেও উত্তেজিত মস্তিষ্কের বুদ্ধি-বিবেচনার উপর আস্থা রাখাটা সহজ নয়। টরন্টোর কিছু কিছু জনপূর্ণ স্টেশনে পুলিশ মোতায়েন করা হবে বলে শুনেছিলাম। অফিসে যাবার সময় সম্ভবত দূর থেকে তাদের শ্রীবদন দেখেছিলাম। কিন্তু ট্রেন থেকে নেমেই চারজনের একটি দলের একেবারে মুখোমুখি পড়ে যাবো চিন্তাও করিনি। মুহূর্তের মধ্যেই তাদের টানটান শরীর এবং ভীত বিহ্বল নড়াচড়া দেখেই মানস চক্ষে আমার এই নশ্বর জীবনের সকল ভ্রান্তি সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেলো। আমার পিঠে বিশাল একটি ব্যাক প্যাক দেখে এই আইনের রক্ষকদের হৃদয়ে অসম্ভব উত্তেজনার সৃষ্টি হলে আশ্চর্য হবার যে কিছু নেই, এই অপ্রীতিকর মুহূর্তেও তা স্বীকার করতে হলো। আযম ভাই সম্ভবত প্রায় একই সময়েই ভুলটি ধরতে পারলেন। তিনি বিড়বিড়িয়ে বললেন, ‘খাইছেরে! এক্কেরে সর্বনাশ হইছে। একদম নইড়েন না। গুল্লী মাইরে দিবো।’
আমি তাকে উদ্দেশ্য করে আশ্বস্তকর কিছু বলার আগেই পুলিশ অফিসারদের দলটি আমাদেরকে অর্ধচন্দ্রাকারে ঘিরে ধরলো। বিশালকায় শ্বেতাঙ্গ অফিসারটি কাঁপা হাতে পিস্তলের বাঁট চেপে ধরে কণ্ঠস্বরে যথেষ্ট কাঠিন্য এনে বললো-‘দাঁড়াও! একপাও নড়বে না। হাত তোলো।’
আমি হাসিমুখে শ্রাগ করি। ‘না, না, তোমরা যা ভাবছো তা নয়’।
আযম ভাই বললেন, ‘আবার কথা কন ক্যান? হাত তুলেন। আমার মত এক্কেরে সোজা কইরা।’
আমি তার কথায় কর্ণপাত না করে আবার এই হাস্যকর ভুলটি ভেঙে দেবার প্রচেষ্টা করি। কিন্তু এইবার মুখ খুলবার আগেই একাধিক কণ্ঠের সম্মিলিত হুংকার ভেসে এলো, ‘হাত তোলো, জলদি! দু’জনার কেউ নড়বে না।’
কি কেলেংকারি! চারদিকে শত শত মানুষ প্রস্তরীভূত হয়ে গেছে। তাদের ভীত চকিত দৃষ্টি যে আমার ব্যাক প্যাকের উপর তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমি হাসবো না কাঁদবো ঠাহর করতে না পেরে আযম ভাইয়ের অনুসরণে দুই হাত খাড়া গগনমুখী তুলে দিলাম। ‘দেখো অফিসার, তোমরা ভুল করছো ………’
এক খর্বাকৃতি কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশ অফিসার বাঁজখাই গলায় বললো, ‘উত্তেজিত হয়ো না। ধ্বংসাত্মক কিছু করবার কোন প্রয়োজন নেই। এটা কানাডা।’
আমি সহাস্যে বলি, ‘তরমুজ! তরমুজ!’
আমার কণ্ঠে কিছু ছিলো নাকি শব্দটির মধ্যেই কোন যাদু আছে, মুহূর্তের মধ্যে চারজনের হাতেই পিস্তল উঠে এলো।
এবার আমার হৃৎপিন্ড দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ধড়াক ধড়াক নৃত্য শুরু করলো। আযম ভাই কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘কি বালা মুসিবতে ফালাইলেন ভাই। পোলা মাইয়ার মুখগুলান লাস্ট টাইমের মতো দেখতে মন চায়।’
তাকে ভীন দেশীয় ভাষায় আলাপ করতে শুনে অফিসারদের ভীতিবোধ দ্বিগুণ হলো। তরূণ অফিসার দু’জনার পায়ের কাঁপাকাপি পরিষ্কার নজরে পড়ছে। বেচারীরা অস্থির দৃষ্টিতে তাকালো বিশালকার শ্বেতাঙ্গ ও ক্ষুদ্রাকৃতি কৃষ্ণাঙ্গ অফিসারের (ভারতীয় বংশোদ্ভুত বলেই ধারণা হলো) দিকে । অন্যজন সম্ভবত ইস্ট ইউরোপীয়ান। আমার শরীর এবার শীতল হয়ে এলো। ভয়ে দিক বিদিক হয়ে এই ছোড়া দুটি গুলি ছুঁড়তে শুরূ না করলেই হয়। আমি কণ্ঠস্বর যথেষ্ট সংযত করে ঠোঁটের মাঝে ঝুলতে থাকা হাসিটাকে সম্পূর্ণভাবে উধাও করে দিয়ে তরমুজের ব্যাপারটা পুনরায় ব্যাখ্যা করতে শুরূ করেছিলাম, কিন্তু কে শোনে কার কথা। চারদিকে সন্ত্রস্ত যাত্রীদের হুড়োহুড়ির আওয়াজ চাপিয়ে শ্বেতাঙ্গ অফিসারটি বললো-‘ব্যাকপ্যাক খুলে মাটিতে রাখো।’
আমি শ্রাগ করি। যাক, অবশেষে পরিস্থিতি সঠিক পথে এগুচ্ছে। কোনরকমে ব্যাকপ্যাকটা খুলে ভেতরের বস্তুটির অবয়ব এই অপগন্ডগুলিকে দেখাতে পারলে এই যাত্রা ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। আমি ব্যাকপ্যাকে হাত দিতেই চার
খানা পিস্তলের নল আমার শরীর বরাবর স্থির হলো। ‘আস্তে, খুব আস্তে।’ সতর্কবাণী ভেসে এলো। তাদের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। খুব ধীরে ধীরে ব্যাকপ্যাকটাকে নামিয়ে রাখি আমার পাদপ্রান্তে। হায়রে তরমুজ! আবার বাঁজখাই কণ্ঠের নির্দেশ এলো, ‘পিছিয়ে যাও। খুব সাবধানে। কোন চালাকি নয়।’
চালাকি! এই ঝামেলা থেকে রেহাই পেলে শিরনি দেবো। আমি এবং আযম ভাই কয়েক পা পিছিয়ে দাঁড়াই।
পরিস্থিতি কিঞ্চিৎ সহজ হয়েছে ধারণা করে বলি, ‘একটা তরমুজ কিনেছিলাম। সেটাই ব্যাকপ্যাকে। বোমা নয়। ’
শব্দ চয়নে ভুল হলো। বিকট এক চীৎকার দিয়ে সমর ভঙ্গিতে ফিরে গেলো অফিসার চারজন। তারা তারস্বরে চীৎকার করতে লাগলো-‘নড়বে না। একদম নড়বে না!’
নড়তে আমার বয়েই গেছে। আমার এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। আযম ভাইয়ের অবস্থা আমার চেয়েও এক কাঠি মন্দ। এই অযাচিত চীৎকার চেঁচামেচিতে যাত্রীদের মধ্যে আরেকটি হৈ হল্ল্লা উঠলো, ছুটাছুটি শুরূ হলো। ঠিক কি কারণে পরিষ্কার নয়, সম্ভবত এতো ছুটাছুটির কারণে যে কম্পনের সৃষ্টি হলো তাতেই ব্যাকপ্যাকটি গোলাকৃতি তরমুজের ভারে গড়াতে শুরূ করলো ট্রেন লাইনের দিকে। প্লাটফর্ম ট্রেন লাইন থেকে প্রায় পঁ াচ-ছয় ফুট উঁচু হবে। নীচে পড়লে তরমুজটি নির্ঘাত ছাতু হবে। আমি বিনীত কণ্ঠে বললাম, ‘পড়ে যাবে তো। ধরবো?’
তারস্বরে চীৎকার, ‘নড়বে না। সবাই মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ো। বোম! বোম!’
আমার অসহায় দৃষ্টির সামনে প্লাটফর্ম থেকে সাবলীল গতিতে গড়িয়ে নীচের মাটিতে ধপাস করে আছড়ে পড়লো তরমুজটা। ভেঙ্গে চৌচির হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। আড়চোখে তাকিয়ে যা দেখলাম তাতে হৃদয়ে ঝড় উঠলো।
চৈনিক বৃদ্ধেরা ঠিকই বলেছিলো। তরমুজ বাছাইয়ে তাদের ভুল হয়নি। রক্তলাল শাঁস দেখেই বোঝা গেলো ফলটি নিঃসন্দেহে স্বাদের ছিলো। আমি অগ্নি দৃষ্টি মেলে পুলিশ চারজনকে ভস্ম করতে লাগলাম। তারা কিঞ্চিৎ লজ্জিত হাসি হেসে পরস্পরের সাথে চোখাচোখি করে। আমি তীক্ষè কণ্ঠে বললাম, ‘তখনই বলেছিলাম। কোন কথাই শুনলে না তোমরা। এখন দাও আমার তরমুজ জোড়া লাগিয়ে। চঁঃ সু সবষড়হ ঃড়মবঃযবৎ. ’
আযম ভাই চোখ বড় বড় করে আমাকে দেখছেন। ‘কি করতাছেন ভাই! গবষড়হ, সবষড়হ কইরেন না, চলেন ফুটি।’ আমি তাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করি। আমার ক্রোধ বেশী নয় বলেই আমার ধারণা। কিন্তু এই জাতীয় অবিবেচনার কারণে আমার সাধের তরমুজের করুণ দশা দর্শনে মস্তিষ্কের নিভৃতে নিশ্চয় কোন এক অপ্রতিরোধ্য ঝংকারের সৃষ্টি হয়ে থাকবে।
আমি তীক্ষè কণ্ঠে দ্বিতীয়বারের মতো
বললাম, ‘চঁঃ সু সবষড়হ ঃড়মবঃযবৎ. তরমুজ জোড়া লাগিয়ে দাও, এক্ষুনি!’
শ্বেতাঙ্গ অফিসারটি হতভম্ব কণ্ঠে বললো, ‘ভাঙ্গা তরমুজ কেমন করে জোড়া লাগায়? (ঐড়ি ফড় ুড়ঁ ঢ়ঁঃ ধ নৎড়শবহ সবষড়হ ঃড়মবঃযবৎ?) ’
আমি গলার রগ ফুলিয়ে বলি- ‘জোড়া লাগাতে না পারলে ভাঙলা ক্যান? ’
তারা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। আমি বেশ কয়েকটি আপত্তিকর মন্তব্য করে নিজ পথে রওনা দেই। আযম ভাই দৌড়ে আমার সঙ্গ নিলেন। ‘বেশ কইছেন ভাই। ইরাকে কি করলো ওরা! সোনার দ্যাশডা ভাইঙ্গা দিলো।
লন্ডনে বোমা পড়বো না কি আমার মাথায় পড়বো? হালায় বেলেয়ার (ইষধরৎ)! তোরে কই নাই আগে, ইরাকে যাইস না।
আমাগো ভাই-বোনেরাই তো মরতাছে। ভালো কইরা দুইখান কথা শুনাইছেন।’
আমি তিক্ত কণ্ঠে সত্য প্রকাশ করি, ‘আরে রাখেন আপনার ইরাক, লন্ডন। আমার সিক্স নাইনটি নাইন (ছয় ডলার নিরানবূই পয়সা) মাটিতে গেলো, আর আপনি ভাবতাছেন অন্যের কথা!’
আযম ভাই ভয়ানক আহত কণ্ঠে বললেন- ‘ছিঃ ছিঃ, এইডা ক্যামন কথা কইলেন ভাই? হাজার হাজার মানুষ মরলো।
এইডা বড় হইলো না আপনার তরমুজ বড় হইলো? ’
মেজাজে ঝংকার উঠলে স্বধর্মীয় অনেকের মতই আমারও মস্তিষ্ক গোলমলে পরিণত হয়। আমি সোজাসাপটা জানিয়ে দেই, ‘অতো বড় বড় কথায় আমার দরকার নাই। সারা জীবন তো চায়ের কাপে ঝড় তুলে গেলেন। কি এমন দুনিয়া উদ্ধার করেছেন?’
তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে মানিব্যাগ বের করে আমার হাতে সাতখানা ডলার ধরিয়ে দিলেন। ‘লন টাকা। পুরা সাত ডলার। কিন্তু কথাবার্তা একটু সামলাইয়া কইয়েন। আর মাছ ধরনের সময় আমারে ফোন দিয়েন না।’
আমি নির্বিকারে টাকাগুলি পকেটে ঢুকিয়ে বলি, “এক পয়সা নিয়া যান।”
তিনি আমাকে একটি অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাবার আগে বললেন, ‘রাইখ্যা দেন। পরকালে কামে দিবো।’
তার শেষোক্ত উক্তিটি আমার এন্টেনার উপর দিয়ে চলে গেলেও ভুল বুঝতে দেরী হয় না। সেই রাতেই আমি তার বাসায় গিয়ে তার টাকা ফেরত দেই। পরিবর্তে তিনি পরবর্তি ছুটির দিনে আমার সাথে মাছ ধরতে যেতে সম্মত হন। Posted onFebruary 1, 2014