চোখবাঁধা চোখে দুটো দিন
মীজান রহমান
জীবনে এই প্রথম চোখবাঁধা অবস্থায় পথে নামার অভিজ্ঞতা। না, সত্যি সত্যি কেউ আমার চোখ বেঁধে রাখেনি, তবে মনে হয়েছে সেরকমই।
গাড়িতে পাঁচজন যাত্রী। বড় ছেলে বাবু, ওর স্ত্রী সোফিয়া, ওদের সতেরো বছরের ছেলে মীজান, তেরো বছরের মেয়ে লায়লা, আর আমি। পাঁচটি সুস্থসবল মানুষের মধ্যে কেবল একজনেরই জানা ছিল আমরা কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি এবং ক’দিনের জন্যে। সোফিয়া। কিছুতেই ফাঁস করবে না কিছু, নিজের স্বামীর কাছেও না। একসময় আমি নিজেও একই খেলা খেলেছি আমার পরিবারের সঙ্গে। হঠাৎ করে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই বলতামঃ চল। বউ বেচারি থতমত খেয়ে বলত কোথায়। বাইরে। বাইরে কোথায়। যেদিকে দুচোখ যায়। ভীষণ ক্ষেপে যেত সে। আমি হাসতাম। হেঁড়ে গলায় হয়ত একটা গানের কলি ছুঁড়ে দিতাম। তখন সেই ক্ষ্যাপা মুখ বিকেলের বৃষ্টিধোয়া রোদের মত ফিক করে ফুটে উঠত। ও আমার পাগলামির খবর জানত।
সেই একই খেলা আজকে, শতযুগ পরে, খেলতে শুরু করেছে আমার বৌমা। শুধু এটুকু ইঙ্গিত পেলামঃ একটা সারপ্রাইজ। কাকে উদ্দেশ্য করে? আপনাকে। মানে আমি। উপলক্ষ? বলব না। রহস্য আমার সবসময়ই ভাল লাগে। কোথায় যাচ্ছি সেটা জানতে না পারার মাঝে একটা রোমাঞ্চ আছে। বয়সে ভারি হলেও সে-রোমাঞ্চ অনুভব এবং উপভোগ করার মন এখনও হারাইনি। সোফিয়া সেটা জানে। ছেলের বৌ হলেও শ্বশুরের স্বভাব বোঝার মত মন তার আছে। আমার জীবনের প্রায় কোনকিছুই ঠিক গতানুগতিক নয়—বৌমার সঙ্গে সম্পর্কটি, তা’ও না।
খুব সকালেই রওয়ানা হয়ে গেলাম। অনুমানে বুঝে নিলাম জায়গাটি খুব নিকটবর্তী কোনও শহর নয়—-তাহলে এত বোঁচকাপত্র সঙ্গে নেবার প্রয়োজন হত না। তাছাড়া ছুটির দিনে এত সকালে বিছানা ছেড়ে উঠে যাওয়ার মত বোকা ওরা নয়। বাচ্চাদের তো কথাই নেই। অতএব দিল্লি অনেক দূর। তাহলে তো আরো মজা।
কিছুক্ষণ পর সোফিয়া তার রহস্যপুরির একটা প্রাথমিক আভাস প্রকাশ করে দেয়ঃ “নেপচুন”।
পেশায় আমি গণিত করি, গোয়ান্দাগিরি নয়। পেরি মেসন আর ডব্ল্-ও-সেভেনের গল্প পর্দায় দেখে মজা লাগত খুবই, কিন্তু বৌমার ‘নেপচুন’এর মাথামুণ্ডু উদ্ধার করার মত সরস মাথা আমার নয়। সৌভাগ্যবশতঃ আমার অন্য তিনজন সহযাত্রী, তাদের উর্বরতর মস্তিষ্ক থেকেও কোন সাড়াশব্দ বের হল না।
একঘন্টা পর দেওয়া হবে দ্বিতীয় ক্লুটি, বিজয়গর্বে ঘোষণা করলেন আমার রহস্যময়ী পুত্রবধূ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপককে ধাঁধায় ফেলার চেয়ে বড় মজা আর কি হতে পারে। বুঝলাম যে গন্তব্যটি অন্তত দু’তিন ঘন্টার দূরত্বে অবস্থিত। মনে মনে এয়ারলাইন ট্র্যাফিকের মত চাকা ঘুরিয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম কোথায় হতে পারে সোফিয়ার সেই রহস্যনগর। কোনটার সঙ্গেই ‘নেপচুন’ শব্দটিকে ধারেকাছে দাঁড় করাতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত কি আশির শনিতে ধরেছে আমাকে? মাত্র তিনমাস আগে নিউইয়র্ক আর টরণ্টোতে ওরা বেশ ঢাকঢোল বাজিয়ে আমার আশিতম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করল। আশি একটা বড়রকমের মাইলফলক সন্দেহ নেই। আমার দৃষ্টিকোন থেকে কেবল বড়রকম মাইলফলকই নয়, সম্ভবত শেষ ফলক। অর্থাৎ এর পর আর কোন ফলক নেই ভাই। আর কোনও কেক কাটা হবে না, জন্মদিনের কার্ড পাঠানো হবে না ‘মেনি হ্যাপি রিটার্ন্স’ নামক কতগুলো ভাওতা শব্দ জুড়ে দিয়ে। এই অবস্থাটিতে, কারো অজানা নয়, যে আশিবাবুর মাথার মগজ কোরবানির গরুর কোপতাকরা মগজের মতই কঠিন পদার্থে পরিণত হয়। সুতরাং আমার এই গোবর মাথাটিকে নিয়ে আর খেলা করিস না রে মা।
ঘন্টা কাবার হতে-না-হতেই সোফিয়ার দ্বিতীয় ক্লুঃ “মৌট”।
মৌট? সে আবার কি জিনিস। সাথে গুগল বা ওয়েবস্টার কোনটাই ছিল না। হাইস্কুলের ছাত্রাবস্থায় শব্দটার সঙ্গে আবছা পরিচয় হয়েছিল—-সম্ভবত দুর্গ জাতীয় কিছুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু দুর্গ কোথায় আমেরিকায়? আচ্ছা মেয়ে তো! এ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাকে? ভাগ্যক্রমে আমার তরুণতর সহযাত্রীদের মুখ দেখে বুঝলাম ওরাও একই রকম দিশেহারা। বৌমা, তুমি তোমার “মৌট” নিয়ে থাক, দয়া করে এই ধাঁধার যন্ত্রণা থেকে রেহাই দাও আমাদের।
আধঘন্টা পর তৃতীয় ক্লুঃ “হলিউড”।
সুন্দর বোধগম্য একটা শব্দ। কিন্তু তাতে লাভ কি হল। ধাঁধা তো ধাঁধাই থেকে গেল। নেপচুন, মৌট আর হলিউডের সঙ্গে সম্পর্কটা কোথায়? তবে হলিউড বলাতে একটু আলো দেখতে পেলামঃ হয়ত হলিউডের কোনও চরিত্রের সংগে জড়িত। আমার কোপতা-হয়ে-যাওয়া মগজের ভেতর সাঁড়াশী ঢুকিয়ে খোঁজা শুরু করলাম কিছু ক্লু পাওয়া যায় কিনা। নাহ, লাভ হল না। মাথা একেবারেই ভোঁতা হয়ে গেছে। তাছাড়া হলিউডের নামধাম আগের মত এখন আর মনে রাখতে পারিনা, দরকারও পড়ে না। এবয়সে যে নিজের নাম মনে আছে এই যথেষ্ঠ—-তারকাদের নাম মুখস্ত করে কি লাভ আমার।
মজার ব্যাপার যে এবারও বাবু বা নাতি-নাতনি তিনজন ঠিক আমারই মত মাথা চুলকাতে থাকল। বৌমার শেষ তিনটে ক্লু ঘন ঘন বেরিয়ে গেলঃ “ নিউজপেপার”, “কিডন্যাপিং”, “প্যাটি”। দেখলাম, বাবু মুচকি মুচকি হাসতে শুরু করেছে। তাতে মনে হল হয়ত ও বুঝে ফেলেছে। না বোঝার কারণ নেই। ওদের জন্ম এদেশে, লেখাপড়া করেছে এদেশে, বন্ধুবান্ধব সব এদেশে, তারা তরুণ, তাজা মন, ওরা মনে রাখবে না তো কারা রাখবে। আমি হলাম একাধারে বাঙ্গাল, অঙ্কের মাস্টার, আশি-পূর্ণ-হওয়া ত্থুত্থুরে বুড়ো। মগজে যা কিছু ছিল সব পাখিরা খেয়ে ফেলেছে।
যাই হোক, ছেলের বউএর কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হলাম। না মা, আমার মাথা খালি। তুমিই বল কোথায় যাচ্ছি। আমার করুণ অবস্থা দেখে বোধ হয় একটু মায়া হল তার। আরো একটা ক্লু দিল শেষবারের মত—-ঘটনাটা ৭০ দশকের। হঠাৎ করেই যেন একটা সুইচ জ্বলে উঠল। হ্যাঁ হ্যাঁ, প্যাটি হার্স্ট কিডন্যাপ হয়েছিল ১৯৭৪ সালে—-অবশ্যই। এবার সব যোগ করতে পারছি। এবং ওর ঘটনাকে অবলম্বন করে পরে একটা ছবি হয়েছিল হলিউডে। হ্যাঁ, মনে পড়েছে।
সবার হয়ত মনে নেই ঘটনাটা—-আমারও যে ছিল তা নয়। একটু উস্কে দেওয়াতে ছবিটা ভেসে উঠল, এই যা। ১৯৭৪ সালের মে মাসের কোন একদিন সন্ধ্যাবেলা বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্ম থেকে প্যাটি হার্স্ট নামক একটি ১৯ বছরের ছাত্রীকে জোর করে, বন্দুকের মুখে, অপহরণ করে নিয়ে যায় এসএলএ (ঝুসনরড়হবংব খরনবৎধঃরড়হ অৎসু) নামের একদল সশস্ত্র ও দুর্ধষ দস্যুদল। “দস্যু” অবশ্য পুলিশ আর গোয়েন্দাবাহিনীর দৃষ্টিতে। ওদের নিজেদের দৃষ্টিতে, বিশেষ করে ওদের বড় নেতা ডিফ্রিজ নামক এক দাগী জেল-খাটা আসামীর দৃষ্টিতে, ওরা আদর্শবাদী বিপ্ল্লবী। বিশ্বজোড়া যত সর্বহারা, যত শোষিত শাসিত লাঞ্ছিতদল, তাদের হয়ে তাদের এই সংগ্রাম—-এই দুঃসাহসী অভিযান বিশেষ করে আমেরিকারই শ্বেতপাথরনির্মিত প্রাসাদবাসীদের বিরুদ্ধে। অপহরণের জন্যে ১৯ বছরের একটি ছাত্রীকে বাছাই করার কারণ? প্যাটি কোনও সাধারণ ঘরের মেয়ে ছিল না, ছিল আমেরিকার সবচেয়ে ধনী, সবচেয়ে প্রভাব-প্রতিপত্তিশীল এক পরিবারের সন্তান, যার সূত্র ধরে এই বিপ্লবের বিষয়টি গোটা আমেরিকা শুধু নয়, সমস্ত পৃথিবীশুদ্ধ মানুষের কাছে জানাজানি হয়ে যাবে। প্যাটি হার্স্টের পিতামহ ছিলেন উইলিয়াম র্যাণ্ডলফ হার্স্ট, যাঁর পূর্বপুরুষ ক্যালিফোর্নিয়ার গোল্ডরাশ-এর যুগে বিপুল ধনরতেœর মালিক হয়ে উঠেছিলেন। র্যাণ্ডলফ হার্স্টের জন্ম ১৮৬৩ সালে, মৃত্যু ১৯৫১। ভীষণ সৌখিন ও সুখবিলাসী মানুষ ছিলেন তিনি। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অর্থের পরিমান এতই অগাধ ছিল যে ইচ্ছে হলে হয়ত গোটা ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যটিই কিনে ফেলতে পারতেন। সে চেষ্টা অবশ্য তিনি করেননি, তবে আড়াই লক্ষ একর এলাকাজুড়ে একটা র্যাঞ্চ কিনে নিয়েছিলেন প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলঘেঁষা একটি পাহাড়ী অঞ্চলে, যেখানে সেসময় জনমানব প্রায় ছিল না বললেই চলে। সেই জায়গাটিকে তিনি আস্তে আস্তে দালানকোঠা তৈরি করে বাসযোগ্য করে তোলেন। শুধু তাই নয়। সেখানে, ১,৬০০ উচ্চতায় অবস্থিত এক পাহাড়ের চূড়ায় এক আলিশান প্রাসাদ তৈরি করেন, জুলিয়ান মর্গান নামক এক নামকরা স্থপতির সাহায্যে। সেই প্রাসাদেরই নামকরণ হয়েছে হার্স্ট ক্যাসেল। র্যাণ্ডলফ হার্স্টের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার নিজেরা ভোগ করার পরিবর্তে সমস্ত সম্পত্তিটা দান করে দেন ক্যালিফোর্নিয়া সরকারকে—-অর্থাৎ ক্যালিফোর্নিয়াবাসীদের আনন্দ উপভোগের জন্যে। ও হ্যাঁ, আরেকটা বড় বিষয় তো উল্ল্লেখই করা হল না—-উইলিয়াম র্যাণ্ডলফ নিজে কিন্তু স্বর্ণব্যবসায়ী ছিলেন না, ছিলেন সংবাদপত্রের মালিক। একটা-দুটো নয়, অনেকগুলো। তাঁকে সারা আমেরিকাশুদ্ধ মানুষ জানত ‘নিউজপেপার ম্যাগনেট’ হিসেবে। অতএব বুঝতে পারছেন সোফিয়ার ক্লুতে ‘প্যাটি’ ‘নিউজপেপার’ ‘হলিউড’—এগুলোর তাৎপর্য কি। বাকি ক্লুগুলোর মধ্যে ‘কিডন্যাপিং’টা তো প্রথমেই বোঝা গেল। বাকিগুলো সেই ক্যাসেলের ভেতরকার যাবতীয় সরঞ্জামের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
এগুলো আমার জানবার কথা নয়। বড়লোকের সখের প্রাসাদ নিয়ে কৌতূহল আমার কোনদিনই ছিল না। অনেকটা সেকারণেই সোফিয়ার ক্লুগুলোর কোনও মাথামুণ্ডু আমি উদ্ধার করতে পারছিলাম না। তবে প্যাটি হার্স্টের অপহরণের চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলো ৭০ দশকের অনেকটা সময় ধরেই একটা বড় খবর ছিল। ঠিক যা আশা করেছিল সেই দস্যু বা বিপ্ল্লবী দল। কিন্তু আসল মজার ঘটনা ঘটেছিল পরে, যখন একসময় এসএলএর তরফ থেকে একটা টেপ করা ঘোষণা এসে পৌঁছায় পুলিশের দপ্তরে, যাতে প্যাটির পরিষ্কার গলায় প্রচারিত হয় যে সে বিপ্লবী দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, কারণ ওদের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতির সঙ্গে সে সম্পূর্ণ একমত। সেটা রীতিমত একটা বোমাবর্ষণের মত কাজ করে সমস্ত আমেরিকায়। র্যাণ্ডলফ হার্স্টের নাতনি বিপ্ল্লবী দলের সদস্য? যারা তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল কলেজের হোস্টেল থেকে তারাই হয়ে গেল তার সহবিপল্বী? বুঝতেই পারেন খবর-পাগল পত্রিকা-পড়ুয়ারা তখন কোন খবরটা সবচেয়ে আগে পড়তে চাইতেন। সবচেয়ে খুশি তখন কারা? বিপ্লবীরা, স্বভাবতই। ব্যাপক প্রচারণাই তো তাদের প্রধান উদ্দেশ্য।
ভেবেছেন কেচ্ছা শেষ হয়ে গেল? মোটেও না। শুরুমাত্র।
অপহরণ হয়েছিল এপ্রিলের ৩ তারিখে। সেই মাসেরই ১৫ তারিখে সান ফ্রান্সিস্কোর হাইবারনেইয়া নামক এক ব্যাঙ্কে এক চাঞ্চল্যকর ডাকাতি। বন্দুকধারী একদল দস্যু দারোয়ানগুলোকে কাবু করে ব্যাঙ্ক থেকে অনেক টাকা তুলে নিয়ে যায়। ব্যাঙ্কের ক্যামেরাতে সমস্ত ঘটনাটাই সবিস্তারে ধরা পড়েছিল। সারা বিশ্বের কৌতূহলী দর্শকের বিস্ময়বিস্ফারিত চোখের সামনে দেখা গেল আমেরিকার আদরের দুলালি প্যাটি হার্স্ট স্বয়ং বন্দুক উঁচিয়ে রেখেছেন। এর পরের দিনই সেই টেপকৃত স্বীকারোক্তি পুলিশের দপ্তরে এসে হাজির হয়। সেই টেপে প্যাটি নিজেকে প্যাটি হার্স্ট না বলে নতুন নামে ভূষিত করেঃ তানিয়া। এটি তার বিপ্ল্লবী নাম! সে চে গুয়েভারার ভক্ত। ইত্যাদি ইত্যাদি। সমস্ত আমেরিকা হতভম্ব। হতবাক।
এফ বি এ স্বভাবতই এই দলটির পেছনে লেগে ছিলেন বহ আগে থেকেই। প্যাটি হার্স্টের এ-কাণ্ডটির পর তাদের তল্ল্লাশীর মাত্রা অনেকগুণ বেড়ে যায়, এই যা। শেষ পর্যন্ত একটা বাড়িতে পুরো দলটাকেই ঘেরাও করা হয়। দুপক্ষে তখন লেগে যায় তুমুল গেরিলা যুদ্ধের মত গোলাগুলি বর্ষণ। তাতে প্রায় সবগুলো বিপ্ল্লবীই হতাহত হয়, বড়কর্তা ডিফ্রিজসহ। কিন্তু পেছনের দরজা দিয়ে পালাতে সক্ষম হয় প্যাটি ও তার এক সহকর্মী। অনেকদিন পর্যন্তই ওরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। অবশেষে সংসারের সব পালার মত তাদের পালানোর পালাও সাঙ্গ হয়ে যায়, ’৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। হাতকড়া পরানো অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের বীরপ্রতিম ব্যক্তি র্যাণ্ডলফ হার্স্টের নাতনি প্যাটি হার্স্ট সান ফ্রান্সিস্কোর বিচারকের সামনে হাজির হয়। ওর কৌঁসুলী মগজ-ধোলাই, ভয়জনিত সাময়িক মানসিক বৈকল্য ইত্যাদি নানারকমের অজুহাত দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছিলেন, কাজ হয়নি তাতে। এদেশে সাধারণত খাতিরে খালাশ পাওয়ার নজির খুব কম। অপরাধ অপরাধই। তার কোন ছোট বড় কিছু নেই—-বিচার অন্ধ, যা হওয়া উচিত একটা সভ্য দেশে। প্যাটি হার্স্ট সাত বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। সেই সাতবছরের দুবছর জেল খাটার পর ’৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তাকে বেকসুর ক্ষমা করে দেন। আজকে সেই চাঞ্চল্যসৃষ্টিকারী বিপ্ল্লবী মেয়ে প্যাটি হার্স্ট ক্যাম্বেল নামে সমাজের মান্যগণ্য সম্ভ্রান্ত মহলে সুপ্রতিষ্ঠিত।
পাহাড়ী পথ দিয়ে এঁকেবেঁকে যখন গাড়ি এসে পৌঁছালো হার্স্ট ক্যাসেলের টুরিস্ট সেন্টারে বেলা তখন প্রায় ১১ টা। বাথরুম সেরে একটু সাফসুফো হয়ে আমরা সরকারি বাসে করে রওয়ানা হলাম আসল জায়গার দিকে—-পর্বতচূড়ায় অবস্থিত শ্বেতপাথরের মূর্তির মত দেখতে দূর থেকে, র্যাণ্ডলফ হার্স্টের স্বপ্নসৌধ হার্স্ট ক্যাসেল। টুরিস্ট সেন্টারের দুরবীণ দিয়ে মনে হচ্ছিল, বাহ বেশ কাছেই তো, আবার খালি চোখে সেই একই জায়গাকে দেখাচ্ছিল নীলাকাশের এক কোণেতে গালে হাত দিয়ে বসে-থাকা কারো আদরিনী কন্যার মত।
বাসে করে যাত্রী পরিবহণের সুযোগ ছিল বলে রক্ষে—-নইলে ১,৫০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে ওঠার সখ আর যার’ই থাক আমার ছিল না, বয়সে তরুণ হলেও থাকত না। বড়লোকের সখের বাড়ি দেখার জন্যে এত কষ্ট করতে আমি রাজি নই। তবে এটা মানতেই হয় যে ভদ্রলোকের কেবল অঢেল টাকাই ছিল না, দূরদৃষ্টিও ছিল প্রচুর। সাথে সাথে বিস্তর শৈল্পিক সৌন্দর্যবোধ, উঁচুমানের রুচি, কোনকিছুরই অভাব ছিল না। তার স্বাক্ষর প্রতিটি কাজের মধ্যে, এমনকি রাস্তাগুলো যেভাবে আঁকাবাঁকা পথে সেই উঁচু প্রাসাদের দিকে উঠে গেছে সেই পরিকল্পনার মাঝেও। সর্পিল পথ ধরে ধীরে, অতি ধীরে, একরকম কাব্যিক আবেশের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে, অবশেষে যখন ওই স্বপ্নসৌধের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছুলাম তখন মধ্যাহ্নের সূর্য আমাদের অভিবাদন জানিয়ে স্মিতহাস্যে দাঁড়ালো সেখানে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলাম আমরা। এতগুলো সিঁড়ি ভাঙ্গতে পারব আমি আশি বছরের ক্লান্ত পরিশ্রান্ত পায়ের ওপর সে-ভরসা আসলে ছিল না আমার। শেষ সিঁড়িটা পার হয়ে যখন পা বাড়ালাম মূল ভবনের চত্বরে তখন মনে মনে একটা ছোট্ট থ্যাঙ্ক-ইউ জানিয়ে দিলাম আমার ঘুণে-ধরা হার্ট মহাশয়কে। বেচারির ওপর অনেক অত্যাচার হয়ে গেল।
চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী এক টুর গাইড আমাদের দলটাকে একঘর থেকে আরেকঘরে অতীব দক্ষতার সাথে পরিচালিত করে নিচ্ছিলেন। কোন জিনিসটার কি ইতিহাস, ওতে র্যাণ্ডলফ মশাইর অগাধ কল্পনাশক্তির কতখানি ছাপ, সবগুলো গল্পই উনি প্রায় তোতাপাপখির মতই অনর্গল বলে যেতে লাগলেন। কোন্ আসবাবটি আনা হয়েছে কোন্ সালে, স্পেন থেকে না পর্তুগাল থেকে, কোন্ ছবিটা কার আঁকা, কার সংগ্রহ থেকে ক্রয় করা হয়েছিল ওটা, সব খবরই যেন তাঁর নখদর্পণে। আয়তনে হয়ত পৃথিবীর বৃহত্তম অট্টালিকাগুলোর সঙ্গে তুলনায় দাঁড়াবে না, কিন্তু এর শিল্পসম্ভারে, আভ্যন্তরীণ শানশওকতে, আলঙ্করিকতায়, সম্ভবত ইংল্যাণ্ডের বাকিংহাম প্যালেসের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। ভদ্রলোক সৌখিন ছিলেন বটে। ভবনটির একেবারে ওপর তলায় অবস্থিত সেই নেপচুন দিঘি—-বিশাল আকারের নীল জলে ভরা টলটলে সুইমিং পুল। এর একদিকে মহারাজ নেপচুনের শ্বেতশুভ্র মূর্তিকে ঘিরে আছেন দুজন রূপসী সাঁতারসঙ্গীর মূর্তি। উল্টোদিকে রোমান সম্রাটদের মত করে তৈরি করা একটি বিশ্রামাগার। বর্ণে গন্ধে রূপে জায়গাটিতে প্রাচীন রোমানদেরই পায়ের শব্দ যেন জীবন্ত হয়ে আছে। (নেপচুন কেবল একটি গ্রহের নামই নয়, রোমানদের সমুদ্র দেবতারও নাম)। রোমানরা জানতেন কিভাবে জীবনকে উপভোগ করতে হয়। গোড়াতে র্যাণ্ডলফ হার্স্টসাহেব পুরো এলাকাটির নামকরণ করেছিলেন ‘ ঞযব ঊহপযধহঃবফ ঐরষষ’ ( বিমোহিত পর্বত)। যদিও শব্দটা ঠিক ইংরেজিতে ছিল না, ছিল স্প্যানিশ ভাষায় (খধ ঈঁবংঃধ ঊহপধহঃধফধ)। অবশ্য বেশির ভাগ সময় তিনি শুধু ‘র্যাঞ্চ’ ই বলতেন জায়গাটিকে। তার সঙ্গত কারণও ছিল। এই যে বিশাল এলাকাজুড়ে সম্পত্তি তাঁর যেখানে জনবসতি বলতে গেলে একেবারেই ছিল না কিছু, কেবল তাঁরই নিযুক্ত কর্মচারীরা ছাড়া, সেখানে বেশ কয়েক হাজার গরু পালন করতেন তিনি—-পুরোদমে একটা ক্যাটেল-র্যাঞ্চ যাকে বলে। এবং এইসব কর্মচারী ও তাদের পরিবারবর্গের খাওয়াপরার জন্যে প্রয়োজনীয় সব খাদ্যবস্তু এই র্যাঞ্চের উর্বর জমিতেই উৎপন্ন হত, এবং এখনও হয়। এমন কোনও স্থানীয় ফলমূল আর সবজি নেই যা সেখানে উৎপন্ন হয়না, নেই এমন কোনও মাছ বা অন্যান্য জলজ খাদ্য যা সেখানে সুলভ নয়। অর্থাৎ এই আড়াই লক্ষ একর জমির পুরোটাই একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামের মত, যেখানে শুধু একটা পরিবারই থাকে—-হার্স্ট র্যাঞ্চ বা ক্যাসেলের সংগে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীবৃন্দ।
সোফিয়া ক্যালিফোর্নিয়ার মেয়ে—-অতএব এগুলো সে ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছে, হয়তবা দেখেও এসেছে। সে তুলনায় আমি একেবারেই মূর্খ। থাকি ক্যানাডায়, জীবনে কোনও র্যাঞ্চের ধারেকাছে যাইনি, র্যাণ্ডলফ হার্স্টের নাম হয়ত আদৌ জানতাম না যদি তাঁর আদরের নাতনি ওই চাঞ্চল্যকর কাণ্ডটি না করে বসতেন সত্তর দশকে। আমি কেমন করে সোফিয়ার ক্লু আঁচ করতে পারব বলুন।
হার্স্ট ক্যাসেলের আরেকটা বড় আকর্ষণ ছিল—–বিরাট এক চিড়িয়াখানা। শীতকাল ছিল বলে সেটা ভাল করে দেখা সম্ভব নয় ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে, তার ওপর আমাদের সময়ের অভাব। কেবল একটি জিনিসই না-দেখে-যাওয়া-যাবেনা’র তালিকায় ছিল বলে অল্পক্ষণের জন্যে গেলাম সেখানে।
ভাগ্যিস গিয়েছিলাম। সে এক নতুন অভিজ্ঞতা। সময়টা ছিল সীলহস্তীর সন্তানপ্রসবের ঋতু। সীলহস্তী আমি ছায়াছবিতে দেখেছি, বইপত্রেও দেখেছি বিস্তর, কিন্তু নিজের চোখে সামনাসামনি দেখার সুযোগ হয়নি কখনো। এবার হল, সোফিয়ার কল্যানে। এটিও আসলে হার্স্ট সাহেবেরই কীর্তি। ক্যাসেল থেকে রাস্তার ঠিক বিপরীত প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে একটা সুরক্ষিত বীচ, হার্স্ট র্যাঞ্চেরই অন্তর্গত। সেখানে দলে দলে, অসংখ্য, সীলহস্তী এসে রোদ পোহায়, বিশ্রাম নেয়, পোয়াতি মায়েরা আসে বাচ্চা প্রসব করতে। ভাগ্য ভাল হলে চোখের সামনে দেখা যায় বাচ্চা বেরিয়ে আসছে মায়ের পেট থেকে। আমরা ঠিক সেই মুহুর্তে গিয়ে পৌঁছুতে পারিনি, কিন্তু আমরা দেখেছি, সদ্যজাত শিশু তার মায়ের স্তন থেকে দুধ চুষে খাচ্ছে। গাইডকে জিজ্ঞেস করে জানলাম শিশুটির জন্ম এর আগের দিন। বিশাল বিশাল শরীর এদের। দেখতে দারুণ মনোহর হয়ত বলা যাবে না—-রীতিমত কুৎসিৎ বললেও খুব অন্যায় হবে না হয়ত। স্থলহস্তীর সঙ্গে খুব একটা মিল নেই—–সামান্য একটু গনেশ আকারের শূঁড় ব্যতিরেকে। যাই হোক একটা অভিজ্ঞতা হল। গল্প করা যাবে কোথাও।
দেখেটেখে যখন ফিরে এলাম টুরিস্ট সেন্টারে তখন বেলা পড়ে গেছে। সন্ধ্যার দীর্ঘ ছায়া উপত্যকার গায়ে গায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে ছাইভস্ম কিছু মুখে দিয়ে আমাদের গাড়ি আবার পথের ওপর। কোথায় যাচ্ছি এবার? না, বলব না। ওই একই জবাব আমার রহস্যময়ী পুত্রবধূর। ঠিক আছে। চল যাই। তোমরা যদি পাহাড়ে পাহাড়ে হারিয়ে যেতে রাজি থাক রাতের অন্ধকারে, আমি তাতে দ্বিমত করব কেন। হারাতে তো আমারও ভাল লাগে, বয়স যতই হোক।
রীতিমত ঘুটঘুটে অন্ধকার তখন। উঠতি-পড়তি পাহাড়ী পথ। তার ওপর নামলো বৃষ্টি। অচেনা রাস্তা। বৌমা তবুও বলতে নারাজ কোথায় যাচ্ছি। বললেই বা কি। আমি তো এ-অঞ্চলের কিছুই চিনিনা। এদিকে কিঞ্চিৎ ঘুম ঘুমও লাগছিল বটে, অস্বীকার করব না। আমি সামনের সীটে। গাড়ির চালক তখন বাবু। আগের বার ছিল সোফিয়া। আমি নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজে রইলাম। ঘুম যদি আসে, আসুক। জাগবার সময় হলে জাগব। কি আসে যায় তাতে।
জানি না কতক্ষণ চোখ বুঁজে ছিলাম। বিছানা ছাড়া সচরাচর আমি ঘুমুতে পারিনা—-প্লেনে নয়, ঘরে নয়, গাড়িতেও নয়। তন্দ্রা আসে, কুয়াসার মত করে একটা মিহিন অবসাদ আসে, কিন্তু ঘুম আসে না। সেই অবসাদের ঘোর থেকে বেরিয়ে চোখ মেলে দেখি সেই একই অন্ধকার, একই ঝির ঝির বৃষ্টি, একই পাহাড় বেয়ে নিরুদ্দেশের পথে ছোটা। আর কতক্ষণ রে মা? এবার একটু করুণা হয় মেয়ের। বেশি নয় আব্বু, আর ঘন্টাখানেকের মাঝেই পৌঁছে যাব। ঘন্টাখানেক অবশ্য টেনেটুনে পৌণে দুঘন্টাতে দাঁড়িয়ে গেল। তবুও পথের শেষপ্রান্তে অবশেষে পৌঁছেই গেলাম। একটা জমকালো হোটেল—-ভয়ঙ্কর এক নিরালা জায়গায়, যেখানে দিনের বেলায় কি থাকে জানি না, রাতের বেলায় মনে হচ্ছিল বন্য জন্তু ছাড়া আর কারো পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। শুধু হোটেলের অভ্যন্তরকে বাদ দিয়ে। সেখানে সবকিছুই টিপটপ। ভ্যালে পার্কিং, সারি সারি উর্দিধর পরিচারক। কেবল এস্কেলেটার আর এলেভেটার ব্যতিরেকে। বোঝা গেল এটা একটা সমুদ্র উপকূলবর্তী প্রমোদালয়, যাকে বলে রিসর্ট হোটেল। একটা ভবন নয়, ভবনগুচ্ছ—-নাম দিয়েছে ‘ভিলা’। এক থেকে দশ নম্বর ভিলা। এবং তারা একই লেভেলে নয়। যেন একই পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে বসানো হয়েছে কতগুল বাড়ি, স্তরে স্তরে। আমাদের ভিলাটি ছিল চার নম্বর। খাবার ঘর থেকে সেখানে যেতে ঢালু পথ, গড়িয়ে গড়িয়ে অনায়াসে যাওয়া যায়, কিন্তু ওঠার সময়ই কোমর আর হাঁটুর ওপর দারুণ চাপ। হার্টের তো কথাই নেই। যে কোনসময় বাই বাই বলে ছুট দিতে পারত। দেয়নি, সেটাই অবাক।
রুমে মালপত্র রেখে খেতে যাবার সময় বাইরে চাপ চাপ অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখিনি। কিন্তু সকালবেলা যখন নাস্তা খেতে যাই সেখানে তখন সারা বিশ্ব উজাড় করে আমার চোখের সামনে এসে দাঁড়ালো শান্ত, সুশীল প্রশান্ত মহাসাগর। রেস্টুরেন্টের জানালা দিয়ে নিচে তাকালেই দেখতে পাই বিরাট জলাশয় সূর্যের অপেক্ষায় কাজল চোখে চেয়ে আছে। সে এক অসাধারণ অনুভূতি। বুঝলাম পুত্রবধূ কেন আমাকে নিয়ে গেছে সেখানে। ও হ্যাঁ, আসল কথাটা তো বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম। সন্ধ্যাবেলা ঘরে ঢোকার পর ও আমাকে কোণার একটা ছোট টেবিলের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে হোটেল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে একটা খামে-ঢাকা কার্ড। ওটা আমার হাতে দিয়ে সোফিয়া বললঃ আব্বু, এটা খুলে দেখুন। রহস্যটা বেশ জমে উঠল। খুললাম। ওমা! সেকি। আমাকেই লক্ষ করে স্বাগতবাণী—-শুভ জন্মদিন ডক্টর রহমান। চালাকিটা এবার পুরোপুরি খোলসা হল। বাবু-সোফিয়া আমার কোন অনুষ্ঠানেই যোগ দিতে পারে নি। এটা অপারগতা পূরণেরই বিলম্বিত প্রয়াস। এবং এতটা নাটকীয়তার সাথে। মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়, বলুন?
হোটেলটি এতই বড়লোকী কায়দার যে সকালবেলা ঘরে ঘরে পত্রিকা দিয়ে যাওয়া হয়—-রীতিমত নিউ ইয়র্ক টাইমস বা লস এঞ্জেলেস টাইমস। ক্যানাডা থেকে বেরিয়েছি দুসপ্তাহের ওপর। পত্রিকা দেখিনি কোথাও। আমার ছেলেরা পত্রিকার ধার ধারে না। এযুগের ছেলেমেয়েরা মনে করে খবরের কাগজ পড়ে কেবল আশি বছরের বুড়োরা, যারা কম্পিউটারে আঙ্গুল বসাতে ভয় পায়। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা, তা
বলছি না আমি। সেকারণেই তো দশবারো বছর আগেই আমি লিখেছিলাম একজায়গায় যে পত্রিকা বলে কোন জিনিস থাকবে না একসময়, হয়ত কাগজের ব্যবহারও সীমাবদ্ধ থাকবে টয়লেট আর হার্ড কপিতে। যাই হোক হোটেলের দরজাতে খবরের কাগজ পেয়ে তো আমি আনন্দে আত্মহারা। আত্মহারা শুধু পত্রিকার জন্যে বয়, ওতে আমেরিকার বাইরে যে ১৯৫ টা দেশ আছে পৃথিবীতে তাদের সম্বন্ধেও দুচারটে সংবাদ জানা যাবে। আমেরিকার টেলিভিশনে খবর মানে আমেরিকারই খবর—-এর বাইরে যে বৃহত্তর একটা পৃথিবী আছে তা গোণার মধ্যে পড়ে না। অতএব খবরের যোগ্য নয়, যদিনা তাতে কোনও আমেরিকান সরকারি স্বার্থ বা ব্যক্তিগত স্বার্থের ব্যাপার থাকে—-যেমন আফগানিস্তান বা পাকিস্তান। তাই নিউ ইয়র্ক টাইমসের পাতায় যখন মালি নামক একটি আফ্রিকান দেশের খবর পেলাম তখন আমার খুশি দেখে কে। যদিও আমার স্বদেশের খবর পেলে হয়ত একটু বেশি খুশি হতাম, সেটা বাংলাদেশই হোক আর ক্যানাডাই হোক। উভয় দেশের ব্যাপারে আমাদের এই আঙ্কেল স্যাম সমান উদাসীন। বাংলাদেশের খবর না পাওয়া একবারে খারাপ তা অবশ্য নয়। বাংলাদেশের খবর না থাকাই আমি মনে করি ভাল খবর—-অর্থাৎ অসম্ভব গুরুতর কিছু ঘটেনি সেখানে। রক্ষে! তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
রেস্টুরেন্টে নাস্তা শেষ করে, প্রশান্ত মহাসাগরের কাছ থেকে আপাতত বিদায় নিয়ে আমি গোটা জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। ঘড়িতে তখন প্রায় আটটা। ছেলে-বৌমা বা ওদের ছেলেমেয়েদের আরো দুঘন্টা বাকি ‘সকাল’ হতে। সুতরাং একা একা ঘুরে বেড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ। অসাধারণ সুন্দর পরিবেশ, নিঃসন্দেহে। একদিকে মহাসাগরের ঢেউগুলো উপকূলের বালিতে এসে আছড়ে পরছে, আরেকদিকে সারি সারি ওক গাছ কালের সাক্ষী হয়ে স্থির দাঁড়ানো পথের দুধারে। সেখানে নানারঙ্গের পাখিদের আনাগোনা। একটি পাখির পুরো শরীরটা গাঢ় নীল, কেবল পেটের নিচেই একটু সাদা পালক—-যেন বেবি পাউডার লাগিয়েছে সেখানে। কি নাম পাখিটার? ব্লুযে নাতো? নাকি ব্লুবার্ড? কি হবে নাম দিয়ে? রূপে যার জুড়ি নেই তার গায়ে নাম লিখার কি প্রয়োজন?
হোটেল কর্তৃপক্ষ কায়দা করে ছোট্ট একটা গ্রাম্য পথ তৈরি করে রেখেছেন অতিথিদের প্রমোদ বিহারের জন্য। সেখানে ঘন সবুজ ঘাস। এখানে ওখানে বেতের চেয়ার পাতা। উঁচু জায়গা বলে কাঠের বেড়া দেওয়া, যাতে ছোট বাচ্চারা গড়িয়ে পড়ে না যায়। সে এক অবিশ্বাস্যরকম প্রশান্তিময় পরিবেশ। ওপরে গাঢ় নীল আকাশ, নিচে সীসার পাতের মত সীমাহীন সমুদ্র—-দূর দিগন্তে তাদের নিবিড় আলিঙ্গন আমার শিরায় শিরায় শিস দিয়ে যায়। আমি সেই বেড়ার কাঠের ওপর কনুই পেতে দাঁড়িয়ে থাকি মহাবিশ্বের এক তুচ্ছতম বিন্দুর আকার নিয়ে। নিচে, অনেক নিচে সাগর তার ফেনার প্রসাদ ছড়িয়ে যায় বালুর তটে। মন চায় জুতো খুলে সেই ভেজা বালুর মধ্যে পা ডুবিয়ে রাখি।
কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে জানিনা। সম্বিত হল যখন পেছনে কোনও পরিচিত হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম—-আমার ছেলে। বাপকে খুঁজতে এসেছে। ওরা নাস্তা খেয়ে নিয়েছে। শহর দেখতে যাবে। কতদূর রে বাবা? বেশি নয়, মিনিট পনেরোর বেশি লাগবে না। মাইলবিশেক, বড়জোর। ঠিক আছে, চল। শহরের নামটাও জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করিনি। নাম জানা যায় যে-কোন সময়।
পুরো দুটো ঘন্টা আমরা শহরের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত উদ্দেশ্যহীনভাবে, অনর্থক, অকারণে, ঘুরে বেড়ালাম। গাড়ি থাকলে যা হয়—-কারণ ছাড়াই মানুষ কারণ সৃষ্টি করে নেয়। শহরটির নাম সান্টা বারবারা। শহরটি দেখতে ছোটখাটো ছিমছাম, সেতুলনায় তার ইতিহাসটি অনেক লম্বা। ১৩,০০০ বছর আগে থেকেই এখানে থাকত কতগুলো ইণ্ডিয়ান ট্রাইব। তারপর ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু হয় ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যবাদীদের আনাগোনা, একের পর এক। প্রথমে পর্তুগীজ, তারপর স্প্যানিশ, শেষে আমারিকান। (শহরের নামটি দেওয়া হয় ১৬০২ সালে, ক্যাথলিকদের প্রিয় সেইন্ট বারবারার সম্মানার্থে) স্প্যানিশ অর্থাৎ মেক্সিকানদের রাজত্ব টেকে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত, যখন তারা হেরে যায় আমেরিকানদের কাছে, ঐতিহাসিক মেক্সিকান-আমেরিকান যুদ্ধে। এর পর নানা যুগে নানা ভাবে শহরটির বহুবিচিত্র বিবর্তন ঘটে। অবশেষে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এর শেষ মূর্তিটি অনেকটা স্থায়ীভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে—– বড়লোকের লীলাভূমি। পয়সাওয়ালাদের প্রমোদাগার—–ইংরেজিতে যাকে বলে রিসর্ট টাউন। বাবু-সোফিয়া আমাকে সান্টা বারবারার একটা নৌঘাট দেখতে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে দেখলাম বড়লোক কাকে বলে। অন্তত কয়েক হাজার সমুদ্রগামী বজরা নৌকা, ইয়াট, সেখানে পার্ক করা। সেই ঘাটের ওপর টুরিস্টদের সুবিধার জন্য গাড়ি পার্কের সুব্যবস্থা। রেস্টুরেন্ট। ফিস এণ্ড চিপ্স। মৎসশিকারীদের জন্য প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম—-কি নেই সেখানে? সবই ওই ভাসমান ভেলার ওপর। মানে এলাহী কাণ্ড। দূর থেকে দাঁড়িয়ে গোটা শহরটারই একটা মোটামুটি ছবি আন্দাজ করা গেল। পুরো একটা পাহাড়, সমুদ্রের মুখোমুখি, কেটে কেটে খোদাই করে করে, পাখির নীড়ের মত বাড়ি তৈরি করা হয়েছে, স্তরে স্তরে, ওপর থেকে আরো ওপরে। প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা সেই উচ্চতার জন্যে—কে কার চেয়ে কত ওপরে বাড়ি করতে পারে সেই অন্ধ, উন্মাদ, প্রতিযোগিতারই এক নগ্ন চিত্র ফুটে উঠতে দেখলাম সেখানে। সেই একই ছবি আমি দেখেছি স্পেনে, ফ্রান্সে, চট্টগ্রামে, মুম্বাইতে। কতগুলো মৌলিক জায়গাতে পৃথিবীর সব দেশের মানুষই আসলে এক।
সবশেষে দেখা হল সান্টা বারাবারা বিশ্ববিদ্যালয়। সেটাও বিশাল, বিপুল। অন্তত ওপরের খোলশটা। ভেতরের খবর তেমন জানা নয় আমার। তবে ক্যাম্পাস হিসেবে আকর্ষণীয়, নিঃসন্দেহে। উঁচু পাহাড়ের ওপর সমাসীন এক ধ্যানমন্দির যেন। চারদিকে সারি সারি গাছ, বৃক্ষলতায় ছাওয়া এক আদর্শ বিদ্যানিকেতন। এর সঙ্গে যখন মেলানোর চেষ্টা করি ঢাকার গোটা বিশেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে তখন একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস চলে আসে আপনা থেকেই।
পরের দিন দুপুরবেলা আমরা ফিরতি পথে রওয়ানা হয়ে গেলাম। চোখবাঁধা চোখের দেখা সাঙ্গ হয়ে গেল। দুটো দিন যেন স্বপ্নের ঘোর। বাস্তবের মাঝে অবাস্তবকে পাওয়া কাকে বলে তার কিছুটা আভাস পাওয়া গেল। ধন্যবাদ সোফিয়া।
ফ্রিমন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া, ২ জানুয়ারি, ‘১৩