কানাডায় মানবাধিকার এবং আলোর নিচে অন্ধকার

॥ খুরশিদ আলম ॥

কানাডা মানবাধিকারের দেশ। শুধু নিজ দেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যেখানে মানবাধিকার লংঘিত হয় সেখানেও কানাডা সোচ্চার কন্ঠে প্রতিবাদ করে মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে। কানাডা সম্পর্কে এটাই সর্বসাধারণের ধারণা। এই ধারণার পক্ষে প্রমানও মেলে। সাম্প্রতিক এক খবরে দেখা যায়, অন্টারিওতে বৈষম্যের শিকার ব্যক্তিদের জন্য বিভিন্ন মামলায় মানবাধিকার সম্পর্কিত আইনী সহায়তা কেন্দ্র প্রায় ৩০ লাখ ডলার আর্থিক জরিমানা সংগ্রহ করেছে। কিছুদিন আগে তিনজন বাঙ্গালীও মানবাধিকার সম্পর্কিত আইনী সহায়তা কেন্দ্রের মাধ্যমে এক লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ পেয়েছে নিয়োগকর্তা কর্তৃক বর্ণবৈষম্যের শিকার হওয়াতে। মানবাধিকার ট্রাইব্যুনাল প্রমাণ পেয়েছে যে, টরন্টোর লেসলিভিলি পার্কের জনপ্রিয় লে পাপিলন রেস্টুরেন্টের তিনজন বাংলাদেশী মুসলিম শ্রমিককে শুকরের মাংস খেতে বাধ্য করা হয়েছে, নিজেদের মধ্যে বাংলা বলার জন্য বিদ্রুপ করা হয়েছে এবং চাকরি থেকে অপসারণের হুমকি দেওয়া হয়েছে।

অন্টারিওর মানবাধিকার ট্রাইব্যুনাল লেসলিভিলির পার্কে অবস্থিত লে পাপিলনের মালিক পল ও ড্যানিয়েলি বিগকে তাদের কিচেনের তিন কর্মীকে ১ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেন। দুই মালিককে এখন অবশ্যই মানবাধিকার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হবে এবং এখন থেকে তাদের কিচেন ও রেস্টুরেন্টের প্রবেশপথে মানবাধিকার বিষয়ক নীতিমালা উদ্ধৃতিসহ একটি কার্ড ঝুলিয়ে রাখতে হবে।

অন্য একটি ঘটনায় দেখা যায় মিসিসাগায় এক বাড়িওলা বাংলাদেশ থেকে নতুন আসা একজন অভিবাসীর জন্য সারা বছরের বাড়িভাড়া দাবি করেন, যদিও অন্টারিওর নিয়ম অনুযায়ী কেবল দু’মাসের অগ্রিম নেয়ার বিধান রয়েছে। সেই বাঙ্গালী ভদ্রলোক যার নাম রফিকুল ইসলাম, তিনি এ ঘটনায় ক্ষুব্দ হয়ে অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশনে অভিযোগ দাখিল করেন। কমিশন তার আবেদনটি আমলে নেয়।

কিন্তু আলোর নিচেই যে অন্ধকার থাকে সে কথাটা কানাডার মানবাধিকারের ব্যাপারেও সত্যি। আমরা লক্ষ্য করলে দেখবো, এই মানবাধিকারের দেশে কানাডায়ও লংঘিত হয় মানবাধিকার। শুধু তাই নয়, বহির্বিশ্বেও বহুবার মানবাধিকার লংঘনের রিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পরিবর্তে চুপ করে থাকতে দেখা গেছে কানাডাকে। শুধু চুপ করে থাকতে দেখা গেছে তা বললে সবটা বলা হবে না। চোখের সামনে লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করতে দেখেও কোন প্রতিবাদী ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি কানাডাকে। উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসের এক ভয়াবহ গণহত্যার কথা উললেখ করা যেতে পারে যা ঘটেছিল রুয়ান্ডায়। ১৯৯৪ সালে সেদেশে দাঙ্গা শুরু হলে মাত্র তিন মাসের কিছুটা বেশী সময়ের মধ্যে আট লক্ষ নারী পুরষ ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দাঙ্গা থামাতে বা নিরস্ত্র ঐ মানুষগুলোক বাচাঁতে কানাডা সে সময় কিছুই করেনি। দাঙ্গার সময় রুয়ান্ডায় অবস্থিত জাতিসংঘের পিসকিপিং ফোর্সের কর্তাব্যক্তি ছিলেন কানাডীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল ডালাইয়ার। তিনি জাতিসংঘের হেডকোয়ার্টারের অনুমোদন চেয়েছিলন সাধারণ মানুষদেরকে দাঙ্গার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু তিনি অনুমোদন পাননি। তাকে চুপ করে থাকতে বলা হয়েছিল। ফলে নিরব দর্শকের ভূমিকা ছাড়া তিনি আর কিছুই করতে পারেননি। চোখের সামনে আট লক্ষ নারী-পুরুষ ও শিশুকে নির্মমভাবে খুন হতে দেখলেন। বিষয়টি তাকে খুব বেশী রকমের নাড়া দিয়েছিল। পরে দেশে ফিরে তিনি আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছিলেন। সেদিন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো কানাডাও চুপ করেছিল। কিছুই করেনি ঐ মানুষগুলোকে রক্ষা করার জন্য।

বাইরের কথা থাক, নিজ দেশে মানবাধিকার লংঘনের বিষয়ে কানাডা কতটা সোচ্চার সে বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখা যাক।

মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর সাম্প্রতিক এক রিপোর্টেও বলা হয়েছে কানাডায় মানবাধিকার লংঘন বিশেষ করে আদিবাসী মহিলা-পুরুষদের ক্ষেত্রে মানবাধিকার আশংকাজনকভাবে লংঘিত হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা যায় ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০২ সালের মধে ভেঙ্কুভারে বেশ কিছু মহিলা ও তরুনী নিখোঁজ বা খুন হয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি যতটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল ততটা পায়নি স্থানীয় পুলিশের কাছে।  কিছু কিছু ক্ষেত্রে কানাডায় আশ্রয়প্রার্থী উদ্বাস্তুদের মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগও উঠেছে। যারা দেশে ফিরে গেলে নির্যাতিত হতে পারেন তাদেরকেও দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

এ্যামনেস্টির এই রিপোর্ট ছাড়াও আমরা দেখতে পাই যে, কানাডায় বসবাসরত ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও বিভিন্ন এথনিক গোষ্ঠিও কোন কোন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। প্রস্তাবিত ‘‘কুইবেকের চর্টার অব ভ্যালুস’’ এর অতি সাম্প্রতিক উদাহরণ। এতে বলা হয়েছে সরকারী অফিস-আদালতে কেউ ধর্মীয় পোষাক যেমন হিজাব, ক্রশ, টুপি, টারবান ইত্যাতি পরতে পারবেনা। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, খোদ কুইবেকের পার্লামেন্ট ভবনের অভ্যন্তরেই রয়েছে ক্রশবিদ্ধ যিশুর বিশাল আকরের মুর্তি। কুইবেকের সাধারণ মানুষ অফিস আদালতে ধর্মীয় পোষাক বা সিম্বল ব্যবহার করতে পারবে না। অথচ পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে যিশুর বিশাল আকারের মুর্তি থাকতে পারবে। শুধু তাই নয়, এই মুর্তি সরানো হবে না বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে কুইবেকের ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে যারা ‘‘কুইবেকের চর্টার অব ভ্যালুস’’ এর প্রবর্তক! অর্থাৎ কুইবেকের খোদ আইনপ্রনেতারাই ধর্মীয় সংখ্যালঘূদের মানবাধিকার লংঘন করছে প্রকাশ্যে এবং নির্লজ্বভাবে।

সম্প্রতি এ্যঙ্গাজ রেইড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালিত একটি জরিপেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি ক্রমবর্ধমান বৈরিতা বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে এসেছে। এটি সবচেয়ে বেশি ঘটে কুইবেকে। জরিপের এ ফল এমন সময় প্রকাশ হয় যখন কুইবেকে জনসমক্ষে ধর্মীয় প্রতিক ও পোষাক বিশেষ করে হিজাব পরিধান নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নিয়ে বিতর্ক চলছে।

শুধু কুইবেকে নয়, অন্টারিওসহ অন্যান্য স্থানেও দিন দিন হিজাব পরিহিত নারীদের হয়রানির সংখ্যা বাড়ছে। ওতে দেখা যায়, কুইবেকের প্রায় ৭০ শতাংশ অধিবাসী ইসলামকে অপছন্দ করে। কানাডার বাকি অংশে ৫৪ শতাংশ একই মত পোষণ করে। কুইবেকের বাসিন্দাদের অপছন্দের তালিকায় এরপরই রয়েছে শিখদের অবস্থান। এখানকার ৪৩ শতাংশ বাসিন্দা শিখদের অপছন্দ করে। ৪১ শতাংশ অপছন্দ করে ইহুদিবাদকে। কানাডার অন্যান্য এলাকায় ৩৯ শতাংশ শিখদের প্রতি নেতিবাচক, ২৯ শতাংশ হিন্দুদের আর ২২ শতাংশ মানুষ ইহুদিবাদকে অপছন্দ করে।

কানাডায় মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে প্রফেশনার চাকরীর ক্ষেত্রেও। বিশেষ করে প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টরাই এর বেশী শিকার। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্বেও তথাকথিত ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স” নামক উদ্ভট এক বাধা তৈরী করে রাখা হয়েছে। এশীয়া বা আফ্রিকার কথা বাদ দিলেও দেখা গেছে ইউরোপ আমেরিকা থেকে একাডেমিক ডিগ্রি ও কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে আসা অশ্বেতাঙ্গ ইমিগ্রেন্টদেরকেও বলা হচ্ছে তাদের কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স নেই! ভাবখানা এই যে কানাডা মর্ত্যরে কোন দেশ নয়। এখানে সব ‘স্বর্গীয়’ ব্যাপার-স্যাপার ঘটে। অশ্বেতাঙ্গ ইমিগ্রেন্টরা যতই যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে আসুক তা এই ‘স্বর্গের দেশে’ বেমানান। এই ইমিগ্রেন্টরা বড়জোর ‘অডজব’ করতে পারে। অর্থাৎ যে কাজ কানাডার শ্বেতাঙ্গরা করতে চায় না। যে কাজের জন্য কোন যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন পড়ে না। আর যে কাজের পারিশ্রমিক অতি সামান্য, যা দিয়ে কেবল চরম দারিদ্রের মধ্য দিয়ে কোনরকমে জীবনধারণ করা যায়।

অর্থাৎ একথা স্পষ্ট যে, কানাডার ভিজিবল মাইনরিটি বা দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে দেখা হয় ভিন্ন চোখে, তাঁদের প্রতি আচরণও করা হয় ভিন্নভাবে। শ্বেতাঙ্গ কানাডিয়ানদের প্রতি যে ভাবে আচরণ করা হয় বা তাঁদেরকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় না দৃশ্যমান সংখ্যালঘুদেরকে। এই দৃশ্যমান সংখ্যালঘুদের মধ্যে আছেন এশিয়ান, আফ্রিকান ও সাউথ আমেরিকান বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নগরিক বা ইমিগ্রেন্ট। এসোসিয়েশন ফর কানাডিয়ান স্টাডিজ এর পক্ষে দ্যা লেজার মার্কেটিং পুল কর্তৃক পরিচালিত এক জরীপে এই তথ্য বেরিয়ে এসেছিল একবার।

আর ‘দৃশ্যমান সংখ্যালঘু’ বা ‘ভিজিবল মাইনরিটি’ শব্দ দুটির মধ্যেও বর্ণবাদের গন্ধ আছে। আছে মানবাধিকার লংঘনের সুক্ষ্ম একটি চাল। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এশিয়া বা আফ্রিকা থেকে আসা লোকদেরকেই কানাডার তথাকথিত “মূলধারার’ লোকেরা দৃশ্যমান সংখ্যালঘু বলে থাকে। এটি শুধু মুখেই নয়, সরকারী নথিপত্রেও তার উল্লেখ আছে। এই দৃশ্যমান সংখ্যালঘু শব্দটি ইউরোপ থেকে আসা লোকদের বেলায় ব্যবহার করা হয়না। আমরা জানি ইউরোপের জার্মানী, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া প্রর্ভৃতি কয়েকটি দেশ থেকেও কানাডায় লোকজন এসেছেন ইমিগ্রেন্ট হয়ে। তারা সংখ্যায় অতি অল্প। চীন, ভারত প্রর্ভৃতি দেশ থেকে আসা লোকসংখ্যার তুলনায় তারা একেবারেই নগন্য। কিন্তু কই, তাদেরকে তো দৃশ্যমান সংখ্যালঘু বলা হয়না? এমনকি ইমিগ্রেন্টও বলা হয়না। শ্বেতাঙ্গ বলেই কি এই সুবিধা পাচ্ছেন তারা?

আদিকালে ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স থেকে যারা উত্তর আমেরিকায় এসেছিলেন তারাও ইকোনোমিক ইমিগ্রেন্ট হয়েই এসেছিলেন। বরং তারা অনুমতি না নিয়েই উত্তর আমেরিকায় প্রবেশ করেছিলেন। তারা যদি নিজেদেরকে মূলধারার কানাডিয়ান বা আমেরিকান হিসেবে পরিচয় দিতে পারে তবে এশিয়া বা আফ্রিকার লোকেরা কেন পারবে না? কেন ঐ দুটি মহাদেশ থেকে আসা লোকদেরকে দৃশ্যমান সংখ্যালঘু বলা হবে?

পরিসংখ্যানে আরো দেখা গেছে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের চেয়ে কানাডায় জন্ম নেয়া ঐ দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পুরুষদের বেতন শতকরা ১৮ ভাগ কম। অর্থাৎ একজন শ্বেতাঙ্গ যুবকের বাৎসরিক আয় এক লক্ষ ডলার হলে একজন দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে যুবকের বাৎসরিক আয় হবে ৮২ হাজার ডলার। এই ১৮ ভাগ বেতন বৈষম্যের হিসাবটি কানাডার গড় হিসাব। বিভিন্ন শহরের আলাদা হিসাবে দেখা গেছে মনট্রিয়লে শতকরা ৩০ ভাগ কম, টরন্টোতে শতকরা ১৫ ভাগ কম এবং ভ্যাঙ্কুভারে শতকরা ১০ ভাগ কম। এই পরিসংখ্যানটি তৈরী করেছেন কানাডার সাইমন ফ্রেসার ইউনিভারসিটির প্রফেসর কৃষ্ণ পেন্ডাকুর। এই পরিসংখানেও কানাডায় মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি স্পষ্টই ধরা পড়ে।

এদিকে রেসিয়াল প্রোফাইলিং বা বর্ণের ভিত্তিতে কাউকে চিহ্নিত করে তাঁর প্রতি আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক

আলাদা আচরণ করার ব্যাপারে কানাডার নাগরিকদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ। এসোসিয়েশন ফর কানাডিয়ান স্টাডিজ এর পক্ষে দ্যা লেজার মার্কেটিং পুল কর্তৃক পরিচালিত ঐ জরীপে আরো দেখা গেছে কানাডায় শতকরা ৪৯ ভাগ নাগরিক রেসিয়াল প্রোফাইলিং নিষিদ্ধ করার পক্ষে। অপর দিকে শতকরা ৩৯ ভাগ চান রেসিয়াল প্রোফাইলিং চলতে দেয়া উচিৎ। আমরা জানি এই রেসিয়াল প্রোফাইলিং এক অর্থে বর্ণবাদেরই নামান্তর যার আরেক অর্থ মানবাধিকার লংঘন। কারণ, কারো গাত্রবর্ণ দেখে সে অপরাধী না নির্দোষ তা আগে থেকেই আইনশৃংখলা বাহিনী কর্তৃক নির্ধারণ করাটা বর্ণবাদ ছাড়া আর কি হতে পারে?

অতিতে কানাডার আদিবাসীদের উপর অনেক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে যা ছিল চূড়ান্ত রকমের মানবাধিকার লংঘন । আদিবাসী পরিবারের শিশুদেরকে জোর করে নিয়ে আসা হতো তথাকথিত আবাসিক স্কুলে যেখানে তারা ছিল পরিবার থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। নিজেদের কৃষ্টি, পারিবারিক মায়া মমতা øেহ ইত্যাদি কিছুই তারা শিখতে পারতো না ঐ  সব আবাসিক স্কুলে। চর/পাঁচ পুরষ ধরে চলে এই প্রক্রিয়া। ফলে বড় হয়ে এই সব শিশুরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও পারিবারিক ও মানবিক গুনাবলী শিক্ষা দিতে পারেনি। ঐ সব আবাসিক স্কুলে আদিবাসী শিশুরা যৌন নির্যাতনেরও শিকার হতো। পরবর্তীতে কানাডা সরকার আবাসিক স্কুলে শিশু নির্যাতনের জন্য অনুষ্ঠানিক ভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং ক্ষমাও চেয়েছে।

আদিবাসীদের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলো আজ অনেকেই হয়েতো মনে করতে পারেন অতীতের ঘটনা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আদিবাসীরা আজো কোন না কোন ভাবে মানবাধিকার লংঘনের শিকার হচ্ছেন। হয়তো এর মাত্রা অতীতের মতো ভয়াবহ নয়। কিন্তু তারপরও মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে। এ বিষয়ে আগেই উল্লেখ করেছি এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর রিপোর্টের কথা। অন্য আরেক রিপোর্টে দেখা যায় ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত কানাডার আদিবাসীদের কাছ থেকে তিন শ’রও বেশী মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ পেয়েছে কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন।

মজার বিষয় হলো গত শতকের গোড়ার দিকে এই কানাডায় মহিলাদের ভোটাধিকারও ছিল না! অর্থাৎ কানাডীয় মহিলারা দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক ছিল! অথবা বলা যায় তাদের কোন নাগরিক অধিকার ছিল না! আজকের যুগে ভোটাধিকারকে নাগরিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভোট দেওয়ার নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কানাডিয়ান মহিলাদের মানবাধিকারকে চরম ভাবে লাঞ্চিত করা হয়েছিল। কানাডার মহিলারা প্রথম ভোট দেন ১৯১৭ সালে মেনিটোবার প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনে।

অতিতে কানাডায় আসা চাইনিজদের উপরও অনেক নির্যাতন হয়েছে, লংঘিত হয়েছে তাদের মানবাধিকার। কানাডা সরকার বহু বছর পর আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাও চেয়েছে এর জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পার্ল হারবারে জাপানীরা বোমা হামলা চালালে কানাডায় অবস্থানরত জাপানীদের উপর নেমে আসে একধরণের নির্যাতন। লংঘিত হয় তাদের মানবাধিকার। তাদের অনেকেই তখন আটক করে রাখা হয়। ঐ আটকৃতদের মধ্যে ছিলেন আজকের বিখ্যাত এক বিজ্ঞানী ডেভিড সুজুকী। সেদিন অনেকের সহায় সম্পত্তিও বাতিল করা হয়। অথচ এরা যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। আর জাপান কানাডার ভূখন্ডেও আক্রমন চালায়নি।

৯/১১ এর দুঃখজন ঘটনার পর য্ক্তুরাষ্ট্রের পাশাপাশি কানাডায় মুসলমানদের উপরও নেমে আসে একধরণের অঘোষিত বৈমাত্রীয়সুলভ আচরণ যেটাকে মানবাধিকার লংঘন হিবেসে চিহ্নিত করা যায়। আমরা জানি, নামের সঙ্গে আহমদ বা মোহাম্মাদ যোগ থাকলে সহজেই

কাউকে মুলমান হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আর এভাবে মুসলমানদেরকে চিহ্নিত করে কানাডার চাকরীর বাজারে  তাদেরকে করে রাখা হয় কোনঠাসা। সীমান্তে বা বিমানবন্দরে তাদেরকে চেক করা হয় বিশেষভাবে। আড়ি পাতা হয় তাদের টেলিফোনে,ই-মেইলে, ঘন ঘন চেক করা হয় তাদের ব্যাংক একাউন্ট কার্যক্রম। অথচ এজাতীয় আচরণ কানাডার সাধারণ মুসলমানেরা প্রাপ্য ছিলনা। তাদের দুর্ভাগ্য যে, মুসলমান নামধারী এক শ্রেণীর সন্ত্রাসীরা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে আসেছে। আর তার ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অমুসলিম দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাধারণ মুসলমানদেরকে।

এখন কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, কানাডার মতো এরকম একটি উন্নত দেশে মানবাধিকার কেন লংঘিত হচ্ছে?

আসলে মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে না এমন একটি দেশ পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। মজার বিষয় হলো, প্রাণীজগতে প্রাণীর অধিকার লংঘন শুধু মানুষ নামের প্রাণীরাই করে থাকে। প্রাণীজগতের অন্য অংশ পশু-পক্ষীর মধ্যে এই অধিকার লংঘনের বিষয়টি ঘটে না। মানুষ যখন কোন ভয়ানক অপরাধ করে থাকে তখন বলা হয় পাশবিক (আভিধানিক অর্থ : পশুর ন্যায় ব্যবহার) আচরণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পশু-পক্ষী কখনো ভয়ানক অপরাধ করে না। এমনকি সাধারণ অপরাধও নয়। তারা অপরের অধিকার হরণ করে না। তারা খুন-ধর্ষণ করে না। গণহত্যা, চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি এগুলোর কোনটাই তারা করে না। তাই মানুষের ‘পাশবিক আচরণ’ কথাটি সত্যিকার অর্থে সঠিক নয়। প্রাণীজগতে মানুষই সবচেয়ে ভয়ংকর এবং ঘৃণ্যতম অপরাধগুলো করে থাকে। হত্যা, অন্যের শিকার চুরি বা ডাকাতি যেটুকু পশু-পক্ষীরা করে সেটা নিছকই ক্ষুধা নিবারনের জন্য বা জীবনধারণের জন্য। আর জীবনধারণের জন্য তারা যে  হত্যাকান্ড ঘটায় তার জন্য তারা দায়ী নয়। কারণ, প্রকৃতিই এই নিয়ম তৈরী করে রেখেছে। একটি জীবিত প্রাণীকে বেঁচে থাকতে হলে আরেকটি জীবিত প্রাণীকে প্রাণ দিতে হবে। কি ভয়ংকর প্রকৃতির এই নিয়ম! তবে মানুষের এমনসব ভয়ংকর আচরণ ও কর্মকান্ড আছে যা প্রকৃতির ভয়ংকরতাকেও সময় সময় হার মানায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকবাহিনীর গণহত্যা, ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমায় পারমানবিক বোমা নিক্ষেপসহ আরো বহু মানবসৃষ্ট ভয়াবহ নৃশংসতার ঘটনার নজীর আছে যা প্রকৃতির ভয়াবহতাকেও অনেকসময় হার মানায়।

বস্তুত : কানাডা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কোন দেশ বা রাষ্ট্র নয়। এখানে যারা বসবাস করেন তারাও এই পৃথিবীরই রক্ত-মাংসের মানুষ। ঘৃণা, লোভ, লালসা, বর্ণবাদ, নৃশংসতা এবং একই সাথে মানবতা ও ভালবাসাও আছে এই দেশটির মানুষদের মধ্যে। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় মানবতা ও ভালবাসার পাল্লাটাই বেশী ভাড়ী এই কানাডায়।, সে কারণে অতীতে যে ভুলভ্রান্তি হয়েছে তার জন্য সরকারীভাবে ভুল স্বীকার করা হয়েছে, চাওয়া হয়েছে ক্ষমাও। কিন্তু যদি আমরা এশিয়া ও আফ্রিকার দিকে তাকাই তবে দেখবো চরম ও ভয়াবহসব মানবিক বিপর্যয় ঘটিয়েও ক্ষমা চাওয়াতো দুরের কথা ভুলও স্বীকার করা হয়নি কখনো। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। একাত্তরে বাংলাদেশে এক ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু ৪৩ বছর পার হয়ে গেলেও পাকিস্তান আজো ভুল স্বীকার করেনি। চায়নি ক্ষমা।

অনুন্নত ঐ সব আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতে পদে পদে লংঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। মানবাধিকার লংঘনের শিকার ঐ মানুষদের অধিকার আদায়ে এগিয়ে আসছে না কেউ। এমনকি সরকারও না। কারণ, অনেক সময় সরকার নিজেই নিজ দেশের মানুষের মানবাধিকার লংঘন করে থাকে।

বর্তমান বিশ্বের এই গণতান্ত্রিক যুগে মানুষের মানবাধিকারকে অধিকহারে গুরুত্ব দেয়া হয়। দাসযুগের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে আজকের বিশ্বে মানবাধিকারের পরিস্থিতি অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার লংঘন সত্যিকার অর্থে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। বন্ধ হয়নি কানাডাতেও। ব্যক্তি পর্যায়ে মানবাধিকার লংঘনের হাজারো ঘটনার নজীর রয়েছে কানাডায় যার সিংহভাগই রয়ে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। দুই একজন সাহসী বা সোচ্চার ব্যক্তি এগিয়ে আসলে তবেই তা লোকচক্ষুর গোচর হয়। আর সাধারনত, এই লোকচক্ষুর গোচর হওয়া ঘটনা নিয়েই বিভিন্ন মানাবাধিকার সংগঠন তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাতে আসল বা প্রকৃত ঘটনার সম্পূর্ণ প্রকাশ ঘটে না।

তারপরও মানবাধিকারকে কানাডায় যে পরিমান গুরুত্ব দেয়া হয় এবং তা রক্ষায় সরকার, আদালত ও মিডিয়া যে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে তা পৃথিবীর অনেক উন্নত ও ধনী দেশেও বিরল।

আমরা দেখেছি, কানাডার অন্টারিওতে বৈষম্যের শিকার ব্যক্তিদের জন্য মানবাধিকার সম্পর্কিত আইনী সহায়তা কেন্দ্র সম্প্রতি প্রায় ৩০ লাখ ডলার আর্থিক জরিমানা সংগ্রহ করেছে। মানবাধিকার রক্ষায় কানাডা আন্তরিক বলেই এমনটি হয়েছে। তবে  আলোর নিচে যেমন কিছুটা অন্ধকার থাকে। তেমনি মানবাধিকারের দেশ কানাডাতেও আছে কিছু মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা। সাহসী ও সচেতন মানুষেরা মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত সোচ্চার প্রতিবাদ জানাতে থাকলে আগামীতে কানাডার মানবাধিকার পরিস্থিরি আরো উন্নতী ঘটবে সন্দেহ নেই।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও  প্রকাশক

প্রবাসী কন্ঠ

এপ্রিল ৫, ২০১৪