অভিবাসী যুবকেরা মূলধারার কর্মশক্তির বাইরে থেকে যায় এবং অর্থনৈতিকভাবে তারা প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করছে না

কানাডা হচ্ছে বিশ্বের এমন এক দেশ যার সবকিছুই আছে শুধু জনসংখ্যার পর্যাপ্ততা নেই। আর এটিই বিশ্বের কাছে আমাদের আলাদা প্রাপ্তি। আমাদের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই বিদেশে জন্মগ্রহণকারী। বৃহত্তর টরন্টোতে বসবাসকারী ১০ লক্ষাধিক মানুষের জন্ম বিদেশে- যাদের মধ্যে ২২টি দেশ থেকে আসা অভিবাসীরা রয়েছেন। এই নবাগতরা আমাদের নাগরিকে পরিণত হচ্ছে যা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যাবে না। গত এক দশকে আমরা প্রতি হাজারে ৭০ জনকে আমাদের নাগরিকত্ব দিয়েছি। আর এই পরিসংখ্যান অন্যান্য পশ্চিমী দেশের তুলনায় দ্বিগুণ। বিদেশে জন্মগ্রহণকারী কানাডীয় জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশই এখানকার নাগরিক। ব্রিটেনে এই সংখ্যা আধা শতাংশেরও কম।

বিশ্বের বৃহৎ অংশ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছে যে, কোনরকম গুরুতর সামাজিক উত্তাপ-উত্তেজনা সৃষ্টির কারণ না ঘটিয়েই আমাদের এই সামাজিক পরীক্ষা চলমান রয়েছে । এটি যে অব্যাহত থাকবে এমনটা আমরা মনে করতে পারি না।

কুইবেক মূল্যবোধের সনদ হলো দেশের একটি অংশ থেকে পাঠানো এমন এক বার্তা যে, আমাদের অধিকার-ভিত্তিক বহু-সংস্কৃতিবাদী ধারণা সবাই গ্রহণ করে না। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের উভয় ক্ষেত্রে সম্ভবত অধিকতর বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ পরিস্থিতি ক্রমবর্ধমান জাতিগত বিভাজনের সৃষ্টি করছে যা এখন থেকে আগামী এক দশক ধরে নেতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে।

শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা পশ্চিম ইউরোপের বিপরীত : অভিবাসীরা আমাদের স্কুলগুলোতে খুবই ভাল করছে। হাইস্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করছে এমন অভিবাসীর হার পাশ্চাত্বের অন্যান্য দেশের হারের সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না। অভিবাসী নয় এমন জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের চেয়েও অভিবাসী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার হার বেশ বেশি।

তবে অভিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান ব্যবধানে সম্ভাব্য দ্বন্দ্ব রয়েছে। যেমন প্রথম প্রজন্মের চিনা অভিবাসীদের মধ্যে মাধ্যমিক উত্তর শিক্ষাক্ষেত্রে অংশগ্রহণের হার ৮৮ শতাংশ। আর আফ্রিকান অভিবাসীদের ক্ষেত্রে এই হার ৬৫ শতাংশ।  যেহেতু  শিক্ষা হলো অর্থনৈতিক সাফল্যের মূল চাবিকাঠি, আর অর্থনৈতিক সাফল্য এলেই শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রসরমানতার হার ক্রমশ বাড়ে, সেহেতু আমরা হয়তো শিগগিরই সাফল্য ও স্থবিরতার নিজস্ব তৈরি একএকটি ছিটমহলে নিজেদেরকে আবিস্কার করবো।

এটি আমাদেরকে বহুত্ববাদী সমাজের জাতীয় ধারণার ক্ষেত্রে অন্য আরেকটি বড় ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবে- আর সেটি হলো- চাকরি ও আয়। চাকরির ক্ষেত্রে নতুন কানাডীয়রা খুবই ভাল করছে এবং ২০০৮ সালের মন্দার পর অনভিবাসী নাগরিকদের তুলনায়ও বেশ ভাল করছে। কিন্তু যারা চাকরি পাচ্ছে তাদের সাফল্য ঢাকা পড়ে যায় বেকারত্বের পরিসংখ্যান দিয়ে। প্রকৃত সত্য হলো, অভিবাসী যুবকেরা বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে- আনুষ্ঠানিক বা মূলধারার কর্মশক্তির বাইরে থেকে যায় এবং তারা অর্থনৈতিকভাবে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করছে না।

অভিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর পরস্পরের মধ্যে বিরাজমান গুরুত্বপূর্ণ বিভেদের বিষয়টিও ঢাকা পড়ে আছে। চাকরি লাভের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ হার হচ্ছে ফিলিপিনোদের মধ্যে। আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী ২৫-৫৪ বছর বয়সী অভিবাসীদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার ২১.৩ ভাগ। অথচ এরা কানাডায় এসেছে মাত্র পাঁচ বছরেরও কম সময় আগে।

এধরণের বিভাজন নিয়ে যারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তাদের কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের দিকে তাকালেই চলবে। তাদের থেকে গ্রহণ করার মতো প্রচুর নীতিগত বিষয় ইতিমধ্যেই আমাদের হাতে রয়েছে। এখানে তার চারটি বিষয় তুলে ধরছি :

১.         সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা যা উদ্ভাবনী বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন : স্বাস্থ্যসেবা হচ্ছে অর্থনৈতিক সাফল্য ও সামাজিক সচলতার এক নম্বর নিয়ামক। উদ্ভাবন ও দক্ষতা প্রদর্শনের যথেষ্ট সুযোগ থাকলে এবং সাশ্রয়ের ব্যবস্থাপনা ভাল হলে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা আমাদের বহুত্ববাদী চেতনার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানসম্মত ও প্রবেশাধিকারমূলক স্বাস্থ্যসেবা ছাড়া আমরা কানাডায় রেকর্ড সংখ্যক দক্ষ অভিবাসী আনা এবং তাদের সমাজের সেরা হয়ে ওঠার বিষয়টি অব্যাহত রাখতে পারবো না।

২.         শিক্ষা যা সমন্বয় ঘটায় : আমাদের মত একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজে বিশেষ করে প্রাথমিক বছরগুলোতে স্কুলে বিভিন্ন সংস্কৃতির শিক্ষার্থীদের জন্য জায়গা করে দিতে হবে। অভিবাসন ও বৈচিত্র্য বিষয়ে পাশ্চাত্বের দেশগুলোর মধ্যে পরিচালিত অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আন্তঃসংস্কৃতি শিক্ষার ক্ষেত্রে মাত্র দুটি বিষয় ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে কানাডা অন্য দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। যে দুটি বিষয়ে পিছিয়ে আছে সেদুটি হলো, পাঠ্যক্রম সমন্বয় ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ এবং শিক্ষার্থীর বিশ্বাস ও সংস্কৃতির অনুকূলে স্কুলের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ঢেলে সাজানো-যাতে তারা নিজেদের পরিচিত পারিপার্শ্বিকের চেয়েও ভালভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।

৩.         এমন একটি শ্রমবাজার প্রতিষ্ঠা করা যা উদ্বুদ্ধ করতে পারে : কানাডিয়ানরা এখন ক্রমবর্ধমান হারে পরিবর্তনশীল এবং এর পেছনে নেতৃত্বের আসনে রয়েছে নতুন কানাডীয়রা। ২০১১ সালে বাইরে থেকে আসা অভিবাসীদের মধ্যে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হারের অর্ধেকই ছিলো তৃণভূমি অঞ্চল (প্রেইরি) ও ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় বসবাসরত নবাগতদের। আমাদের যেটা করতে হবে তা হলো দ্রুত বৈদেশিক পেশাদারিত্বের মান সম্পর্কিত সনদ প্রদানসহ কাঠামোগত অনঢ় অবস্থার অবসান ঘটানো এবং একটি জাতীয় দক্ষতা কর্মসূচি তৈরি করা। এটি করতে হবে অনিচ্ছুক প্রদেশগুলোকে নিয়ে ফেডারেল সরকার বর্তমানে যেমনটা চালু করছে সেই ধারায় বিশেষ করে চাকরি বীমা কর্মসূচি ঢেলে সাজাতে হবে কারণ এটি সামাজিক পরিবর্তনশীলতাকে ক্রমাগত ব্যাহত  করে চলেছে।

৪.         নাগরিকত্ব যা একইসঙ্গে পরিবর্তনকে উৎসাহিত করে এবং ব্যাহতও করে : আমরা অন্য যে কোন দেশের তুলনায় অধিক সংখ্যক নাগরিকত্ব দিই এমনকি দ্বৈত নাগরিকত্বও দিই। এর ফলে সামাজিক উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে এবং অভিবাসীরা বিদ্যালয়, আদালত, হাসপাতাল এবং ভোটদানের মত সুবিধার ক্ষেত্রে অধিকতর প্রবেশাধিকার পাচ্ছে।

আমরা আমাদের ইতিহাসের মধ্য দিয়ে দেখেছি যে, যৌক্তিক অভিযোজন প্রক্রিয়া খোলা দরজা নীতির চেয়ে এমনকি  অধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়ে তৈরি করা যে কোনও সনদের চেয়েও অনেক বেশি কার্যকর। এটি এমন একটি দেশ যা তার নতুন বা পুরনো নাগরিকদেরকে তাদের অঙ্গীকার পূরণের সক্ষমতা দেয়। কানাডার মহত্বম অভিজ্ঞতার প্রাসঙ্গিকতা হলো বিশ্বের জন্য আমাদের দেশের দরজা উন্মুক্ত রাখবো কিনা সেটি নয় বরং ওই দরোজা দিয়ে বাইরের বিশ্ব থেকে যে আশা ও স্বপ্ন এসে পৌঁছায় তা নিয়ে আমরা কী করতে পারি সেটি নিয়ে।

-সৌজন্যে : এষড়নব ্ গধরষ

(১ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে জন স্ট্যাকহাউস কর্তৃক বারনাবি বিসির (ব্রিটিশ কলম্বিয়া) ইসমাইলী সেন্টারে প্রদত্ত ভাষণ থেকে সংক্ষেপিত। জন স্ট্যাকহাউস হলেন কানাডার দৈনিক গ্লোব অ্যান্ড মেইল-এর সাবেক প্রধান সম্পাদক)

ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৪