অবসর মানে আলস্য
মীজান রহমান
‘অবসর’ শব্দটি আমার পছন্দ নয়। ‘অবসর’, ‘কবর’, ‘অলস’ শব্দগুলো খুব কাছাকাছি। অবসর আর ‘কবর’এ তো ছন্দেও মিলে যায়। এবং দুটিতে অর্থের মিলও কম নয়। অবসর শব্দের মানে, আমি যা বুঝি, ‘এখন আর কাজের কথা নয়, আরামের কথা বল’। জওহরলাল নেহরুর একটা বিখ্যাত উক্তি আছেঃ “আরাম হারাম হ্যায়”। অন্তহীন আরাম মানে অন্তহীন হারাম সেবন—-এবং অবসর মানেই সেই অন্তহীন আরাম। পশ্চিমের অপেক্ষাকৃত বিত্তশীল সমাজে তার অর্থঃ হয় সমুদ্রসৈকতের নরম বালিতে শুয়ে মরুভূমির মুষিকদের মত অকারণে গড়াগড়ি করা, নয়ত সিনিয়ার্স হোমের খালি বারান্দায় হুইলচেয়ারে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকা নিরুদ্দেশের পানে। আমাদের দেশে অবসর বলতে সাধারণত বোঝায় টুপি-দাঁড়ি হাঁকিয়ে মসজিদের ঠাণ্ডা সতরঞ্চিতে হাঁটু গেড়ে তসবির গুটি গুণে গুণে কেয়ামতের অপেক্ষায় চোখ বুঁজে থাকা। অথবা পৈতা-চন্দন মর্দনপূর্বক কাশি-বৃন্দাবনে গিয়ে মা-গঙ্গার পবিত্র পঙ্কিল জলে গলা ডুবিয়ে পরজন্মের পরামুক্তির সাধনাতে নিমগ্ন থাকা। এর নাম অবসর!
ইংরেজির রিটায়ারমেন্ট শব্দটি অত খারাপ নয়। আমি রিটায়ার করেছি, সেটা আমি অস্বীকার করব না। তার মানে ‘চাকরিজীবন’ থেকে রিটায়ার করেছি—-একে অবসর বলতে চান বলুন। কিন্তু ‘চাকরিজীবন’ থেকে অবসরগ্রহণ আর ‘কর্মজীবন’ থেকে অবসরগ্রহণ এক নয়। বিরাট তফাৎ। চাকরিজীবন জীবিকার জন্য, কর্মজীবন জীবনের জন্য, নিজের চিত্তমুক্তি বা চিত্তশুদ্ধির জন্য। চাকরিজীবনের মুনিব আর কর্মজীবনের মুনিব সম্পূর্ণ ভিন্ন—–কর্মজীবনে আমিই কর্মী, আবার আমিই মুনিব। আমার শ্রমের পারিশ্রমিক মাসিক বেতন নয়, পারিশ্রমিক আমার কাজের তৃপ্তি।
খৃঃ পূঃ ছয় শতাব্দীতে, অর্থাৎ সক্রেটিসেরও প্রায় দেড়শ বছর আগে, আমার অন্যতম প্রিয় গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাস কতগুলো মূল্যবান কথা বলে গিয়েছিলেন। তার একটি ছিলঃ “ আকাশে প্রতিদিন নতুন সূর্য উদয় হয়”। আরেকটি গভীর বাণী ছিল এরকমঃ একই নদীর জলেতে তুমি দুবার নামতে পার না। এর আংশিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পরে যা বলেছিলেন তার সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে প্রথমবারের অভিজ্ঞতার পর দ্বিতীয়বার যখন সেই একই নদীতে নাম, তখন তুমি ঠিক আগের মানুষটি নও। আবার সেই নদীটিও ঠিক আগের নদীটি নয়।
কথাগুলো ভাববার মত বটে!
সেদিন কে যেন জিজ্ঞেস করেছিল আমাকেঃ ‘অবসর’গ্রহণের পর আমি সময় কাটাই কি করে। আমি এক মুহূর্ত না ভেবেই বললামঃ “ অবসরগ্রহণের আগে আমি ছিলাম পূর্ণ সময়কালীন শিক্ষক, পরে আমি পূর্ণ সময়কালীন ছাত্র ”। ভাবছেন হেঁয়ালি করছি? মোটেও না, বর্ণে বর্ণে সত্য। ছোটবেলায় বাবা বলতেনঃ জীবনই সবচেয়ে বড় শিক্ষক। আজকে তিনি নেই, কিন্তু আমি আছি, এবং সেই ছাত্র। আরো একটা কথা বলতেন তিনিঃ শিক্ষাই জীবনের একমাত্র জিনিস যা কখনো ফুরায় না। অর্থাৎ প্রতিটি দিনই নতুন কিছু শেখার সুযোগ তৈরি করে দেয়। যে মানুষ শিখতে পারগ এবং আগ্রহী, সে জীবিত। যে নয় সে কার্যত মৃত—–তার মরা-বাঁচা দুটিই এক।
আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনেকেরই কৌতূহল। ওরা আমাকে ‘আত্মজীবনী’ লিখতে বলে। সব্বনাশ! শব্দটা শোনামাত্র আমি আঁতকে উঠি। একাজটি কোনদিনই হবে না আমার দ্বারা, সেকথা তো আগেও বলেছি আমার পাঠকদের। প্রথমতঃ জীবনী লিখে বই প্রকাশ করার মত মূল্যবান জীবন আমার নয়। দ্বিতীয়তঃ ‘আত্মজীবনী’তে আত্মকথা সব খোলাখুলি ব্যক্ত করা হয় সেকথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলবেন না দয়া করে। সেখানে দারুণ সেন্সরশীপ হয় ভাই। নিজের সব গোপন কথা অকপটে ফাঁস করে দেবার মত সৎসাহস সংসারে কজনার আছে জানিনা, অন্তত আমার নেই সেটা জানি। তাছাড়া লেখকদের জীবন এমনিতেই বন্ধুহারা, স্বজনহারা। সামান্য লেখালেখি করেই তো একে একে সবাইকে হারালাম আমি। এখন যদি ‘আত্মজীবনী’ লিখে বাকি তথ্যগুলিও ফাঁস করে দিই তাহলে তো জনপ্রাণী একজনও থাকবে না আমার পাশে। অতএব ভাই, ওই অনুরোধটি করবেন না আমাকে।
অবশ্য জীবনী না লিখলেও যে বিপদ আসবে না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তখন হয়ত লোকে বলবে, আমার এমন কোন গোপন বিষয় আছে যা এতই জঘন্য যে লোকের কাছে বলা দূরে থাক, নিজের মনেও ভাবার মত নয়। তাই লিখতে চাইছিনা। অর্থাৎ তখন যেটা হবে সেটা গুজব নয়, কানাঘুষা। যাকে বলে আন্দাজ-অনুমান—-স্পেকুলেশন। তাতেই দারুণ রস পায় অনেকে।
কারো গোপন বিষয় বলতে কি বুঝায়? প্রেম? অবৈধ প্রেম হলে তো কথাই নেই। বৈবাহিক? তাতেও চলে। লেখকের কোনও কেলেঙ্কারির খবরের মত মুখরোচক কিছু নাই—–যত দেবেন ততই বলবে আরো দাও। সুতরাং ভাই, আমার ওসবে দরকার নেই। আমার গোপন কিছু আছে বা নেই, সেটা বিদেশী ভাষায়ঃ (এটা আপনার মাথাব্যথার বিষয় নয়)। শুধু বলতে পারি বিবাহ আর প্রেম বিষয়ে আমার নিজের কি ধ্যানধারণাঃ (বিবাহ মানে প্রেমের গোরস্থান। কখনও কখনও ভালোবাসারও।) কথাটা কাউকে চমক লাগানোর উদ্দেশ্য নিয়ে বলছিনা, জীবন থেকে কঠিন শিক্ষা নিয়েই বলছি। দুটি ভালো-লাগা মানুষের নৈকট্যের চাইতে দূরত্বই বেশি উপকারি। যত সমস্যা, অবশ্য, মরার শরীরটা। এ’ই সব অনিষ্টের মূল। মানুষ ভাবে শরীর আর মন পরস্পর থেকে আলাদা। ভুল। শরীরই ডোবায় মনকে, এবং মন শরীরকে।
আমার ছেলেদের একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে আমার সম্বন্ধে। আমি নাকি খুব বিজ্ঞ লোক। ওরা যখন টিনেজ ছিল তখন অবশ্য ভাবত ঠিক উল্টোটাই। আমি যেভাবে ভাবতাম আমার বাবাকে নিয়ে—-দারুণ অত্যাচারি মনে হত। এটাই টিনেজের ধর্ম। আবার বড় হয়ে ঘরসংসার পাতার পর হঠাৎ করে সেই ‘অত্যাচারি’ বাপটিকে মহাপুরুষের মত মনে হয়। দুটোতেই ভুল আছে। এবং এই ভুলের সমষ্টিই মানবপ্রকৃতি।
আমার ‘বিজ্ঞ’ উপাধিটি খুব কৌতুকপ্রদ মনে হয় আমার কাছে। সারাজীবন ভুল করে করে চুল পাকালাম, দাঁত-চোখ-কান হারালাম, এখন আমার ছেলেরা বলে ‘বিজ্ঞ’। শুনে হাসব না কাঁদব বুঝি না। তবে একটা জিনিস শিখেছি জীবন থেকেঃ কি করে কথা আর কাজের মাঝে দূরত্ব কমাতে হয়। আমরা তো প্রায় সময়ই মুখে বলি এক, কাজে ঠিক তার বিপরীত। রুজগার করি হারাম, মুখে পুরি হালাল। অসঙ্গতিটা ছেলেমেয়েরা দেখে, বোঝে, এবং মুখ টিপে হাসে। ওদের চোখ আমাদের চেয়ে হাজারগুণ খোলা, কান হাজারগুণ খাড়া, মন হাজারগুণ সাফ। সেকারণেই আমার কথা ও কাজের অসঙ্গতিগুলো যথাসম্ভব শুধরাতে চেষ্টা করেছি। আমার স্ত্রীও। ‘বিদেশে ছেলেমেয়ে মানুষ করা বড় শক্ত’, এই বলে অনেক বাবামাই আক্ষেপ করেন। শক্ত, সেটা মানি, যদি বাড়িতে এ-ভুলটা সংশোধন করার চেষ্টা না করা হয়।
আমরা অনেকেই দেশের কথা ভেবে সারা হই সারাক্ষণ। ‘সোনার বাংলা’কে কেমন করে সত্যি সত্যি সোনার বাংলাতেই রূপ দেয়া যেতে পারে সেনিয়ে আমাদের প্রত্যেকেরই চমকলাগানো আইডিয়াতে কিলবিল করে মস্তিষ্ক। দেশ থেকে দীর্ঘকালীন দূরত্বের কারণেই হয়তবা, দেশোদ্ধারের কোনও বড় আইডিয়া কখনোই উদয় হয়না আমার মাথায়। শুধু একটা কথাই আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করিঃ দেশের জন্যে যদি সত্যি সত্যি কিছু করতে চান আপনি তাহলে প্রথমে নিজেকে শুধরান, মানে আপাদমস্তক শোধারানো, তারপর দেখুন কি হয়। গোটা দেশটাই শুধরে গেছে রাতারাতি। কথাটি আমার মুখ থেকে সর্বপ্রথম বেরিয়েছে তা নয়, স্বয়ং সক্রেটিসই বলে গিয়েছিলেন আজ থেকে প্রায় ২৪০০ বছর আগে!
মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ বলতে কি বুঝায়? দেবোত্তর সম্পত্তি? দশটা দামি ফ্ল্যাট বনানী-বারিধারাতে? গ্যরাজের দুটি রল্স্রয়েস আর দুটি মার্সেডিস বেঞ্জ? একশ’ ভরি সোনা ? না, এগুলোর কোনাটাই না। মূল্যবান সম্পদ আপনার চরিত্র। হেরাক্লিটাসের আরেকটি উদ্ধৃতি দিয়ে সেটা আরো ধারালো করা যাকঃ “ অ সধহ’ং পযধৎধপঃবৎ রং যরং ভধঃব.” (মানুষের চরিত্রই তার নিয়তি) যার চরিত্র দুর্বল সে উলংগ অবস্থায় ঘুরে বেড়ায় সর্বত্র, যদিও সে নিজে সেটা বোঝে না। কথা হল, চরিত্র কাকে বলে। আমাদের কালচারে চরিত্র বলতে বোঝায় ‘নৈতিক চরিত্র’ —–নৈতিকতা বিষয়টিও কালচারনিরপেক্ষ নয় যদিও। আমাদের দেশে এর মানেঃ
(১) ছেলে পাঁচ ওক্ত নামাজ পড়ে;
(২) ত্রিশ রোজা পালন করে নিয়মিত;
(৩) ছেলে মদ্যপান করে না; হারাম স্পর্শ করে না;
(৪) ছেলের আদবকায়দা আছে;
(৫) ছেলে পরস্ত্রী বা নিজের -বিবাহিত-স্ত্রী-ব্যতিত অন্য কোনও নারীর প্রতি কুদৃষ্টি নিক্ষেপ করেনা;
(৬) সদা সত্য কথা কহে।
একেবারে শেষের সূত্রটির ওপর আজকাল খুব একটা জোর দেওয়া হয়না। দিনকাল খারাপ—-জানমাল রক্ষার খাতিরেও মাঝে মাঝে সত্যকে একটু বাঁকিয়ে নিতে হয়। অতএব শেষোক্ত সূত্রটি অনেকটা ‘অপশনাল’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে—-নফল—-পারলে ভাল, না পারলে কবিরা গুণা হবে না।
কিন্তু আমি যে-চরিত্রের কথা বলিছি তাতে প্রথম পাঁচটির কোনও স্থান নেই, বরং শেষেরটিই একেবারে অপরিহার্য—-ওতে কোনও ছাড় নাই। হেরাক্লিটাস যে চরিত্রের কথা বলছেন সেটা আভ্যন্তরীন। অনেক পরিশ্রম আর সাধ্যসাধনা করে আয়ত্ত করতে হয়। কিন্তু দ্বিতীয়টি একান্তই বাহ্যিক—-সৈন্যদের কুচকাওয়াজের মত। করলে ভাল, না করলে পরলোকে জবাবদিহি করতে হতে পারে, যদি তুমি পরলোক মানো। হেরাক্লিটাসের চরিত্র কুচকাওয়াজ দিয়ে আদায় হয়না, অনেক কাঠখড়ি পুড়াতে হয় তার জন্যে। তদোপরি সেটা পুরোপুরি দখলে নিয়ে আসা সাধারণত সাধ্যাতীত রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা আর যুদ্ধবিগ্রহের ব্যাপার। এবং যুদ্ধটা প্রধানত নিজেরই সঙ্গে। নিজের দুর্বলতার সঙ্গে, লোভলিপ্সার সঙ্গে, রিপুর সঙ্গে। এ বড় শক্ত কাজ। আমি নিজে কি এ-চরিত্র অর্জন করতে পেরেছি? না, পারিনি। এটা আজীবন সাধনার বিষয়—-একটু একটু করে আসে।
জানি, নীতিবাক্য শুনতে কারুরই ভাল লাগে না। বিশেষ করে কৈশোর আর যৌবনে। এবং ঠিক সেকারণেই বিশেষ করে বলতে হয় কিশোর আর তরুণদেরই। এক কানে ঢুকে আরেক কানে বের হয়ে যায়, জেনেও। কারণ তাদের সচেতন মন শুনতে না চাইলেও অবচেতন মনে সেগুলো জমা হয়ে যায়। পরবর্তী জীবনে সেগুলোই ক্রমে দানা বেঁধে ‘মূল্যবোধ’ নামক একটি মূল্যবান সম্পদে পরিণত হয়। তাই আমি যখনই ক্যালিফোর্নিয়াতে যাই ছেলের বাড়ি বেড়াতে তখন সুযোগ পেলেই নাতি-নাতনিদুটিকে নিয়ে গল্প করতে বসি, এবং গল্পের ফাঁকে ফাঁকে কিছু তত্ব্কথা, কিছু নীতিবাক্যও জুড়ে দিই। মনে মনে হয়ত হাই তোলে দাদুর ‘গল্প’ শুনে, তবুও বেহায়া হয়েই বলি।
যেমন সৃষ্টিশীলতার ব্যাপারটি। কৃষিকর্ম কি সৃষ্টিশীল নয়? অবশ্যই সৃষ্টিশীল। তারা ক্ষেতখামার করে। তাদের সৃষ্টি দৈহিক পরিশ্রমের সাহায্যে। তারা ফসল সৃষ্টি করতে না পারলে আমাদের কারুরই বেঁচে থাকা সম্ভব হত না। ওদিকে যারা চন্দ্রগ্রহ আর মঙ্গলগ্রহে রকেট পাঠিয়েছিলেন তারাও সৃষ্টিশীল। একহিসেবে তারাও কৃষিকর্মী—-তাদের কৃষিক্ষেত্র ভূপৃষ্ঠের ভূমি নয়, মস্তিষ্ক, বুদ্ধি, মেধা। যারা মহৎ কাব্য বা মহৎ চারুশিল্প রচনা করেন, লিখেন অমর সাহিত্য, তারা তো অবশ্যই বড় মাপের স্রষ্টা—-তাদের সৃষ্টির উপকরণ স্বপ্ন, কল্পনা, জ্ঞান, চিন্তা, অভিজ্ঞতা, এবং অসাধারণ মেধা। যে-জীবনে কোনও উৎপাদনই নেই, সৃষ্টি নেই, সে-জীবন একেবারেই নিস্ফল, অর্থহীন। যেমন বিরামবিহীন ভোগের জীবন। উত্তরাধিকারপুষ্ট অলস জীবনের সাথে উদোম শুষ্ক মরুভূমির কোনও তফাৎ নেই। সৃষ্টি হল ত্যাগ, যে-ত্যাগ দ্বারা অন্য মানুষ বা অন্য জীবেদের জীবন সিঞ্চিত হয়, সঞ্জীবিত হয়। ত্যাগ হল মানবতার কৃষিক্ষেত্র।
‘সুখ’ কাকে বলে? সুখের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম। কেউ কেউ মনে করে সুখ মানে স্ফূর্তি। মধ্যযুগের রাজাবাদশাদের কাছে এরই নাম ছিল সুখ। বর্তমান যুগের ধনকুবেরদের জীবনেও তার ব্যতিক্রম নেই। তারই মধ্যে দুচারজন আছেন যারা কুবের হয়েও উর্ধতর সুখের সন্ধান পেয়েছেন। আমেরিকার বিলিওনিয়ার ওয়ারেন বাফে জীবনভর টাকার পাহাড় বানিয়ে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ধনী ব্যক্তিদের কাতারে স্থানলাভ করেছেন। কিন্তু তাতে কি সত্যিকার সুখ এসেছে তার জীবনে? না, আসেনি। সত্যিকার সুখ তখনই পেয়েছিলেন তিনি যখন তার বিরাট অর্থসম্পদের শতকরা নব্বুই ভাগ দান করে দেন বিবিধ দাতব্য প্রতিষ্ঠানে। শুধু তাই নয়। আমেরিকার অন্যান্য ধনকুবেরদের মুখে ছাই দিয়ে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে সরকারি তহবিলে কুবেরোচিত উঁচুহারের আয়কর দিতে তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত নন। ওয়ারেন বাফের মত সুখি ধনকুবের বোধ হয় পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। অনুরূপ ভাবে মাইক্রোসফটের বিল গেটস আর তার স্ত্রীও প্রচুর দান খয়রাত করেছেন পৃথিবীব্যাপী। তাদের মত সুখি শিল্পপতি কজন আছে আমেরিকাতে?
সুখ আসলে দুপ্রকারের। একটা ব্যক্তিগত, আরেকটা সামাজিক। ব্যক্তিগত সুখ পুরোপুরি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সেটা স্বার্থপর। সে-সুখের প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই আমার। আমি বিশ্বাসই করিনা যে মানুষের ব্যক্তিগত সুখের কোনরকম মূল্য আছে। ঢাকা শহরে আজকাল ব্যক্তিগত সুখের ছড়াছড়ি। এক বিয়েবাড়িতে গিয়ে দেখলাম পুরো রাস্তাটিই আলোর ঝালর দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। আমার কাছে মনে হল এ-বেচারার চেয়ে হতভাগা মানুষ বুঝি একজনও নেই সংসারে! এসব মানুষের জন্য আমার খুব কষ্ট লাগে—–আশাহীনদের জীবনও তেমন অন্ধকার নয় যেমন অন্ধকার এদের। অথচ ঢাকা-চট্টগ্রাম-খুলনা-সিলেটের সর্বত্র এদের রাজত্ব। আমি বিশ্বাস করি আমার নিজের সুখ তখনই অর্থময় হয় যখন একই সাথে আমার প্রতিবেশীরাও সুখি হয়। এই সুখ অর্জন করার জন্য নিজের কিছু বিসর্জন করতে হয়না, দরকার কেবল একটা জিনিস—-সামাজিক বিবেক।
সামাজিক বিবেক অনুযায়ী মানুষ কখনো ট্যাক্স ফাঁকি দেবে না—–ধরা পড়ার ভয়ে নয়, নিজেরই ভয়ে। নিজের বিবেকের ভয়ে। এ-ভয় যার আছে সে কখনও মিথ্যা কথা বলে কোনও ফায়দা আদায় করার চেষ্টা করবে না, সুযোগ পেলেও কাউকে ঠকাবে না, এমনকি সরকারকেও না, বিশেষ করে সরকারকে। কারণ সরকারকে ঠকানো মানে গোটা সমাজটাকেই ঠকানো—-অর্থাৎ শুধু তার নিজের প্রতিবেশীকেই নয়, দেশের সব প্রতিবেশীকেই। অনেক মানুষকে আমি দেখেছি যারা শুধু নিজের পরিবারের বেলাতেই বেশ বিবেকবান, কিন্তু ট্যাক্সের প্রসংগ এলেই তাদের এমন মনোভাব যেন সরকারই তা্দরে ঠকাচ্ছে—-এটা সেই সামাজিক বিবেকহীনতারই একটা মুখোশ মাত্র।
আমার ব্যক্তগত জীবনে প্রচুর ঝড়ঝাপটা গেছে, সেটা আমার ছেলের কাছে শুনেছে আমার নাতি-নাতনি। একদিন দুজনে মিলে জিজ্ঞেস করেঃ (সে বিপদ উতরালে কেমন করে দাদু?) আমি হেসে জবাব দিইঃ. (কিছুটা ভাগ্য, কিছু ধৈর্য) জীবনের বিপদাপদ কিভাবে সামাল দিতে হয় সেবিষয়ে আমার নিজের একটা বচন আছে যা আমি সুযোগ পেলেই শোনাই মানুষকেঃ (সঙ্কটকে কিভাবে মিত্রশক্তিতে পরিণত করে ফেলতে হয় তাতেই তার চরিত্রের পরীক্ষা)
উদাহরণ? আমাদের অনুন্নত দেশগুলোতে তার ভুরি ভুরি উদাহরণ। অসম্ভব দুঃখকষ্টের মাঝেও অনেকে মেধা আর মানসিক শক্তির পরিচয় দিয়ে সমাজের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করে দেশেদশের মুখোজ্জ্বল করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের গভর্নর আতিয়ুর রহমান সাহেবের সংক্ষিপ্ত জীবনী পড়েছিলাম একবার—-সে উদাহরণটা আমি অনেকের কাছেই উল্ল্লেখ করেছি। বাল্যকালে তার বড়ভাই নিজের ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে অধিকতর আগ্রহী ও মেধাবী ছোটভাইকে স্কুলে যাবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তারপর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির খরচ যোগাতে তার স্কুলের শিক্ষক হাটবাজারে চাদর পেতে দয়ালু লোকেদের চাঁদা সংগ্রহ করেছিলেন। তার সেই সংগ্রাম ও সাফল্যের কাহিনী, সে-কাহিনীতে অনেককিছুই শিখবার আছে আমাদের। তিনি এডভার্সিটিকে সত্যি সত্যি এডভান্টেজে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, পূর্ণমাত্রায়। চরিত্রের পরীক্ষায় তিনি স্টার পাওয়া ছাত্র।
আমি দেশে থাকি না, থাকি ক্যানাডায়। অতএব ক্যানাডারই গল্প বলি একটা।
মেয়েটার নাম টালি অসবর্ন। বয়স ৩২। জন্ম থেকেই দুটো হাত গোড়া থেকে কাটা। পাদুটো আছে, কিন্তু না থাকারই মত। হাড় নেই, শুধু মরা গাছের খুঁটির মত দুটো মোটা মোটা মাংসপিণ্ড দুদিকে ঝুলছে কিম্ভুতভাবে। সে যদি সারাজীবন সরকারি সহায়তার ওপর ভরসা করে বেঁচে থাকতে চাইত তাহলে তাকে দোষারূপ করা যেত না —–অনেকে তার চেয়ে অনেক কম অক্ষমতা নিয়েও সেভাবেই জীবনযাপন করে। কিন্তু টালি অসবর্নের কাছে সে-জীবন গ্রহণযোগ্য ছিল না। তার যুক্তি, প্রতিবন্ধকতা আমার শরীরে, মনে তো নয়। তাহলে আমি শরীরের দোহাই দিয়ে মনটাকে পরমুখাপেক্ষী করে রাখব কেন? সে গান শেখে। গানের চর্চা করে করে একসময় কন্ঠসঙ্গীতে ঈর্ষণীয় দক্ষতা অর্জন করে ফেলে। একটা সময় এসে যায় যখন একটা স্থানীয় অর্কেস্ট্রাতে সঙ্গীত পরিবেশন করবার সুযোগ পেয়ে যায়। এভাবে স্থানীয় পর্যায় থেকে ধাপে ধাপে এগুতে এগুতে সে এখন সম্মানিত পেশাদার কন্ঠশিল্পী ক্যানাডার শিল্পজগতে। তার গান কোনও
সস্তা আধুনিক সঙ্গীত নয়, উঁচুমানের ধ্রুপদী সঙ্গীত। সেদিন টেলিভিশনে আমার নিজের কানে শুনবার সৌভাগ্য হল। মনে হল মেয়েটাকে যদি না দেখা হত কোনদিন, তাহলে জীবনটা আমার অপূর্ণই থেকে যেত। কেবল গান নয়, অন্যান্য বিষয়েও টালি অসাধারণ নৈপুন্য অর্জন করে ফেলেছে। তার একটা ল্যাপটপ আছে। বলবেন, হাত নেই, আঙ্গুল মেই যার, সে ল্যাপটপ দিয়ে করবে কি? না দেখলে বুঝতে পারবেন না। সে মুখের থুতনি দিয়ে যেরকম গতিতে ল্যাপটপের বোতাম টিপে যেতে থাকল আমি থ হয়ে তাকিয়ে রইলাম—–আমি হাজার চেষ্টা করেও ওই স্পীডে উঠতে পারব না।
আরো শুনতে চান? টালি অসবর্ন একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ বক্তা। সে এখানে-ওখানে প্রেরণা-উদ্দীপক বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়। তার বক্তৃতা শোনার জন্যে শ্রোতাদর্শকদের বসার জায়গা থাকে না হলে, এমন ভিড়। তারা মুহুর্মুহু করতালিতে মুখর করে ফেলে হলকক্ষ—সব আমি টেলিভিশনেই দেখলাম। আমার জন্য সত্যিকার স্মরণীয় ঘটনা একটি।
ব্যক্তিগত জীবনে কয়েকটি নীতি ধর্মের মত পালন করি আমি—-সবসময় পারি তা নয়, তবে আপ্রাণ চেষ্টা করি পালন করতে। জীবনের তিনটে দিন আমার জন্যে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ—-গতকাল, আগামীকাল, এবং আজকের দিনটা। গতকাল ইতিহাসের অন্তর্গত, আর আগামীকাল ভবিষ্যতের, তার মানে স্বপ্নের। একমাত্র আজকের দিনটিই পুরোপুরি আমার দখলে—-এ দিনটাকে আমি কিভাবে ব্যবহার করি সেটা সম্পূর্ণ আমারই ওপর নির্ভর করে। আজকের যে কাজটুকু আমার হালখাতাতে জমা হবে তার ভিত্তিতেই তৈরি হবে কালকের বাস্তবতা। শুধু তাই নয়। আমি আজকের কাজ দিয়ে বিগতদিনের সকল গ্লানি আর হতাশাকেও মুছে দিয়ে তাতে নতুন আলোর মশাল জ্বালাতে পারি। অতএব আজকের দিনটি যেন কোনক্রমেই বিফল না হয়, সে-চেষ্টাটুকু আজীবন চালিয়ে যাবার দায়িত্ব আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করেছি, এবং এখনও, এই বৃদ্ধ বয়সেও, করি।
অটোয়া, ২৭শে মার্চ, ‘১৩ – মুক্তিসন ৪২