চাকরিপ্রার্থী শিক্ষিত অভিবাসীদের জন্য অন্টারিও এখন সবচেয়ে বাজে জায়গা

আনা মেহলার পেপারনি , সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৪: কানাডায় ইকবালের প্রথম কাজ ছিলো বরফ পরিষ্কার করা। কমপিউটার সায়েন্সে গ্রাজুয়েট ইকবাল এবং তার শিক্ষিকা স্ত্রী যখন পাকিস্তান থেকে সদ্য কানাডায় এসেছেন তখন তাদের দক্ষতার পক্ষে কানাডীয় সার্টিফিকেট জোগাড়ের জন্য তাদেরকে খরচ যোগাতে হতো। সুতরাং একটি এজেন্সির পক্ষ থেকে কাজের প্রস্তাব পেয়ে সেটাই লুফে নিতে বাধ্য হন ইকবাল।

চমৎকার প্যান্ট ও জুতা পরে কাজে যাওয়ার আগে ইকবাল তার টাই খুলে রাখতেন। সেটি ছিলো আট বছর আগের ঘটনা। ২০০৬ সালে কানাডায় আসার কয়েক মাস পর ইকবাল আইটি খাতে প্রথম চাকরি পান। এখন তিনি তার নিজের কোম্পানি পরিচালনা করেন; প্রকৃতপক্ষে তার এখন দু’টি কোম্পানি সোলার এবং আইটি ডেভেলপমেন্ট এবং কনসাল্টিংÑ তিনি এখন কানাডায় নতুন আসা অভিবাসী যারা তার ও তার স্ত্রীর মত অবস্থায় পড়েন তাদের জন্য অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন।

তবে বর্তমান সময়ে উচ্চশিক্ষিত নতুন কানাডীয়দের জন্য এখানে সম্ভাবনা অনেক বেশি হতাশাজনক। সাম্প্রতিক সময়ে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী অভিবাসীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২০১০ সালের জুনের পর গত মাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

গ্লোবাল নিউজকে দেয়া স্টেটিস্টিকস কানাডার তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে কানাডায় আসা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অভিবাসীদের ১৪ শতাংশেরই চাকরি নেই। মাধ্যমিক-উত্তর সার্টিফিকেট এবং হাইস্কুল পর্যায়ের ডিপ্লোমাধারীদের বেকারত্বের হারের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীদের বেকারত্বের হার বেশি। অন্যদিকে কানাডায় জন্মগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েটদের মধ্যে বেকার রয়েছেন মাত্র ৩.৩ শতাংশ। আর এক দশক বা তারও চেয়ে বেশি সময় ধরে কানাডায় রয়েছেন এমন অভিবাসী বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েটদের বেকারত্বের হার ৫.৬ শতাংশ।

২০১৩ সালে চাকরিপ্রার্থী উচ্চতর ডিগ্রিধারী সাম্প্রতিক অভিবাসীদের বেকারত্বের হারের দিক থেকে অন্টারিও ছিলো কুইবেকের পর সবচেয়ে বাজে অবস্থায়। গত বছর অন্টারিওতে উচ্চতর ডিগ্রিধারী সাম্প্রতিক অভিবাসীদের বেকারত্বের হার ছিলো ১৪.৭ শতাংশ। অন্যদিকে কুইবেকে এই হার ছিলো ১২.৪ শতাংশ।

(বিশেষ দ্রষ্টব্য: সারা কানাডায় এই পরিসংখ্যান নেয়া হয় প্রতি তিন মাসের গড় হিসাবে এবং তাতে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু প্রাদেশিক পর্যায়ের পরিসংখ্যান হিসাব করা হয় বার্ষিক ভিত্তিতে যা ২০১৩ সালে সম্পন্ন হয়।)

চাকরির জন্য অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থানে রয়েছে আলবার্টা। যদিও এখানেও নবাগত ও কানাডায় জন্মগ্রহণকারীদের চাকরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যাবধান রয়েছে তবু সেটা অন্যান্য স্থানের চেয়ে কম।

এই পরিসংখ্যানে অবশ্য নবাগত সেইসব হাজার হাজার কানাডীয়কে ধরা হয়নি যারা নিজেদের দক্ষতার ক্ষেত্রের বাইরে অন্য খাতে চাকরি পেয়েছেন। যথাযোগ্য কর্মসংস্থান না পাওয়া এসব অভিবাসীর কারণে বছরে অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে শত কোটি ডলার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তাদের

দক্ষতাকে খাটো করা হচ্ছে এবং তাদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অধরাই থেকে যাচ্ছে (এমনকি তারা প্রায়শ একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের চাকরিতে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন)।

ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ মাইক মোফাট উল্লেখ করেন যে, সার্বিকভাবে অন্টারিওর চাকরির বাজার খুবই কুৎসিতÑ সুতরাং এটি প্রথমেই জনসংখ্যার সবচেয়ে নাজুক অংশকে আঘাত করে। (তরুণরাও বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত)

তিনি বলেন, ‘‘গত বছর বা তারও বেশি সময় ধরে অন্টারিওতে কর্মসংস্থানের অন্যান্য সূচকের অনেকগুলোই ছিলো সত্যিই দুর্বল। এর ফলে অভিবাসীরাই অসমানুপাতিক হারে ক্ষতির শিকার হচ্ছে।’’

‘‘কেউ যদি আপনাকে চাকরি না দেয় তাহলে আপনার সার্টিফিকেট কোত্থেকে নেয়া সেটা আর কোন বিষয় থাকে না।’’

তিনি আরও বলেন, যেটি উল্লেখযোগ্য তা হলো কানাডায় জন্মগ্রহণকারী ইউনিভার্সিটি গ্রাজুয়েটরা ভালো করছে। তাদের সঙ্গে নবাগত কানাডীয়দের যে ব্যাবধান তৈরি হয়েছে তা হয়েছে গত দু’চার বছরের মধ্যে। ‘‘সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে, উভয়েই একসঙ্গে এগিয়ে যাবে। কিন্তু এখানে তা হচ্ছে না।’’

টরন্টো রিজিয়ন ইমিগ্রান্ট এমপ্লয়মেন্ট কাউন্সিলের (টিআরআইইসি) চেয়ারপারসন এবং মৈত্রীর সভাপতি রতœা ওমিদভার অভিবাসী ও কানাডায় জন্মগ্রহণকারীদের মধ্যকার ব্যাবধান কমানোর লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। কিন্তু এখন ব্যাবধান যে কোন সময়ের চেয়ে আরও বেড়ে গেছে। বলা যায় পরিস্থিতি ‘‘হতাশাব্যঞ্জক’’।

তিনি বলেন, ‘‘কানাডা, অন্টারিও এবং আমাদের সংগঠনের মত বিভিন্ন সংগঠন সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে… কিন্তু এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আমরা যেসব মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেছি এবং চর্চা করেছি, অভিবাসীদের চাকরির সুযোগ দেয়া এবং উভয় শ্রেণীর মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির সে প্রয়াস সফল হয়নি এ কারণে যে, অভিবাসী ও নিয়োগদাতা এই দুটি শব্দ প্রায়শ এক কাতারে আসেনি।’’

এটি এখন আর কারও কাছে তেমন কোনও খবর নয় যে, কানাডায় নবাগতদেরকে কোনরকম সতর্কতা ছাড়াই অসম সুযোগসুবিধা সম্পন্ন শ্রমবাজারে ঢুকতে হয়। এটি বিস্ময়কর যে, চাকরিদাতা, প্রবক্তা ও নীতি-নির্ধারকদের সবাই এই সমস্যাটি দীর্ঘদিন ধরে স্বীকার করলেও এতদিনেও তার কোনও সমাধান করতে পারেননি।

রতœা ওমিদভার বলেন, ‘‘অভিবাসীদের মেধা ও বৈশ্বিক দক্ষতা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে যাবতীয় বক্তৃতাবাজী সত্বেও কানাডার চাকরিদাতারা উল্লেখযোগ্যভাবে মূলের অনুগামী। আর আমাকে বলতে হবে যে, তারা বাইরে থেকে কিছু গ্রহণ করা, মনোনয়নদান, নিয়োগদান বা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে খুবই ঐতিহ্যানুগ।’’ সমস্যার একটি অংশ হলো নিয়ন্ত্রিত পেশার ক্ষেত্রে অভিবাসীদের যোগ্যতার সনদ এবং অন্য দেশের প্রশিক্ষণের প্রতি স্বীকৃতির অভাব।

‘‘কানাডার চাকরিদাতারা অভিবাসীদের অভিজ্ঞতার প্রায় পুরোটাই নাকচ করে দেয়।’’

সুতরাং তিনি আর কি করবেন? তিনি বলেন, টিআরআইইসি যে কাজ করে সেই একই কাজের জন্য অর্থাৎ অভিবাসীদেরকে নিয়োগদাতাদের এবং অন্যান্য শুভান্যুধ্যায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া এবং নিয়োগদাতাদেরকে আরও বেশি করে অভিবাসীদের নিয়োগ দিতে উদ্বুদ্ধ করা হবে এমন একটি জাতীয় কর্মসূচি হয়ত সহায়ক হতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ে আরও বেশি উৎসাহ যোগানো হলে হয়ত নিয়োগদাতারা তাদের নির্ধারিত ছকের বাইরে গিয়ে নিয়োগ দিতে পারে।

ওমিদভার বলেন, ‘‘তার আগে পর্যন্ত এটি একটি সময়সাপেক্ষ ও যথাসময়ের ব্যাপার হিসাবেই থেকে যাবে। অর্থাৎ আপনি কখন এদেশে এলেন (মন্দার সময়টা খারাপ সময়), আর কতদিন এদেশে অবস্থান করলেন তার ওপরই বিষয়টি নির্ভর করবে।

তিনি বলেন, তাদের যোগ্যতার সঙ্গে মানানসই চাকরি পাওয়ার জন্য ‘‘তারা দিনের পর দিন মই বেয়ে উঠতে থাকবে।’’ ইতিমধ্যে নবাগতরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতে থাকবে এবং তাদের দক্ষতায় জড়তা আসবে।

তবে ইকবাল অনে বেশি আশাবাদী। তার ভাষায় : আমাদের অনেক সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অভিবাসীদের সাফল্যের কাহিনীগুলো তুলে ধরার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। অনেক নবাগত কানাডীয় তাদের দক্ষতা ও পেশাগত যোগাযোগ বাড়ানোর উপযোগী বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে জানে না। ‘‘আমি নবাগত কানাডীয়দেরকে প্রায়ই এই দৃষ্টান্ত উল্লেখ করি যে, তোমরা প্রথমে কয়েক পা পিছিয়ে যাও এবং তারপর সামনের দিকে উঁচু করে লাফ দাও।’’ সৌজন্যে : গ্লোবাল নিউজ