কানাডায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে অসবর্ণ বিয়ে
ছোঁয়া লেগেছে বাংলাদেশীদের মধ্যেও
খুরশিদ আলম। জুলাই ২৭, ২০১৪ : ভালবাসায় কোন বর্ণ নেই, জাতি নেই, দেশ নেই, নেই ধর্ম। যে-ই ভালবেসেছে সে-ই মরেছে। মরার আবার জাত কি? এভাবেই নিজের অবস্থান ও পরিনতির কথা জানালেন টরন্টো প্রবাসী বাংলাদেশী কানাডিয়ান মিশুক। মিশুক তার ছদ্ম নাম। ভালবেসেছেন এক শ্বেতাঙ্গিনীকে। কিন্তু বাধ সেধেছেন তার বাবা-মা। কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তাদের এই অসবর্ণ সম্পর্ককে। মিশুকের শ্বেতাঙ্গিনী প্রেমিকা ন্যান্সীর বাবা আর্জেন্টাইন-মা আইরিশ। কানাডায় এসেছেন তারা প্রায় চার দশক আগে। মিশুক কানাডায় এসেছেন সে যখন কোলের শিশু। দুজনের ধর্ম, বর্ণ ও সংস্কৃতির কোন কিছুতেই মিল নেই। কিন্তু তবু তারা ভালবেসেছেন একে অপরকে।
ইয়র্ক ইউনিভারসিটিতে তারা সহপাঠী ছিলেন। সেখান থেকেই পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রেম। এখন অপেক্ষা পরিনয়ের। ন্যান্সীর বাবা-মায়ের কোন আপত্তি নেই। কারণ তারাও অসবর্ণ দম্পত্তি।
বাংলাদেশী মেয়ে মৌসুমীর (ছদ্ম নাম) বয়স ২৭। ইউনিভারসিটির পর্ব শেষ করে এখন কাজ করেন একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে। টরন্টোর ডাউনটাউনে অফিস। বাবা-মা তার জন্য পাত্রও ঠিক করে রেখেছেন দেশে। তাদেরই দূরসম্পর্কের আত্মীয়। কিন্তু মৌসুমী দেশের ছেলে বিয়ে করবে না। তার বক্তব্য হলো, বাংলাদেশে ছেলে মেয়েরা বড় হয় এক সংস্কৃতিতে আর কানাডায় ছেলে মেয়েরা বড় হয় আরেক সংস্কৃতিতে। ফলে আচার আচরণ, চাল চলন ইত্যাদিতে মিলেনা যদিও উভয়েই বাঙ্গালী। ঘটনার শেষ এখানেই নয়। মৌসুমী ইতিমধ্যে প্রেমে পড়েছে তার এক সহকর্মীর। তার এই সহকর্মী এক ইয়েমেনী যুবক। ধর্ম একই। কিন্তু মিল নেই বাঙ্গালী সংস্কৃতির সঙ্গে। মৌসুমীর অবশ্য দাবী- তারা দুজনেই কানাডীয় সংস্কৃতিতে বড় হয়েছে। ফলে সংস্কৃতির মিল নেই একথা সে মানতে রাজী নয়।
মিশুক ও মৌসুমী উভয়ের সম্পর্কই ঝুলে আছে বাবা-মায়ের আপত্তির কারণে।
তবে এর উল্টো চিত্রও আছে। অসবর্ণ ছেলে বা মেয়ের প্রেমে পড়ে পরিনয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন বাঙ্গালী ছেলে-মেয়েরা এরকম অনেক নজীর আছে কানাডায়। তাদের অভিবাকরাও বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। প্রথমে হয়তো আপত্তি করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু একপর্যায়ে পুত্রবধু বা জামাইবাবুকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। পরিস্থিতির বাস্তবতাই তাদেরকে বাধ্য করেছে অসবর্ণ সম্পর্কেকে স্বীকার করে নিতে। আবার কেউ কেউ মেনে নেননি দাদা, দাদী-নানা-নানী হওয়ার পরও।
কানাডায় অসবর্ণ বৃদ্ধি পেলেও এর সবই যে মসৃণ পথে চলছে তা কিন্তুু নয়। অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে অনেককে। এদের মধ্যে কারো কারো ঘরও ভেঙ্গে যাচ্ছে। তখন তারা দুকুলই হারায়। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন তখন বলেন, ‘আমাদের কথা তো শুনিসনি, এখন মজা বুঝ।’
মজা বুঝুক বা নাই বুঝুক, বাস্তবতা হলো, কানাডায় অসবর্ণ বিয়ের হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১০ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস কানাডার সর্বশেষ হিসেবে হিসেবে দেখা যায় ২০০৬ সালে দেশটিতে অসবর্ণ দম্পত্তির সংখ্যা ছিল ২৮৯,৪০০ জন। ২০০১ সালে অসবর্ণ দম্পত্তির সংখ্যা যা ছিল তার তুলনায় এই সংখ্যা শতকরা ৩৩ ভাগ বেশী। হিসেবে আরো দেখা যায় এই সব অসবর্ণ দম্পত্তিদের পরিবারে ৩ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশী সন্তান রয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে অসবর্ণ এই দম্পত্তিদের মধ্যে একজন শ্বেতাঙ্গ অন্যজন অশ্বেতাঙ্গ বা এথনিক গ্র“পের। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে দুইজনই দুই এথনিক গ্র“পের।
স্ট্যাটিসটিকস কানাডার কর্মকর্তা এ্যানি মিলান জানান, কানাডায় ইমিগ্রেন্টদের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে প্রায় সমান তালে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে অসবর্ণ বিয়ে। ২০০১ সাল থেকে শুরু করে ২০০৬ সালের মধ্যে কানাডায় ইমিগ্রেন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ২৭ ভাগ। অন্যদিকে অসবর্ণ বিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৩৩ ভাগ।
বিষয়টি কাকতালীয় নয়। ইমিগ্রেন্টদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে এর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
ইমিগ্রেন্টরা যখন এদেশে আসেন তখন তারা সংখ্যালঘুতে পরিনত হন। ফলে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে গিয়ে তখন তারা দেখতে পান যে পাত্র বা পাত্রীর অভাব রয়েছে। এখানে জন্ম নেয়া বা বড় হওয়া ছেলে মেয়েরা তাদের পছন্দের পাত্র বা পাত্রীটি খুঁজেন এ দেশটিতেই। ফেলে আসা দেশটির ছেলে মেয়েদের সঙ্গে তাদের খাপ খায় না। একই বর্ণ ও ধর্ম হলেও একটা সাংস্কৃতিক ব্যবধান গড়ে উঠে দুই দেশে বড় হওয়ার কারণে। চিন্তা চেতানায়, আচার আচরনে, পোষাক আসাকে এবং অর্থনৈতিক কারনে তাদের মধ্যে মিল ঘটে না। দেশ থেকে যদি কোন ছেলেকে নিয়ে আসা হয় বিয়ে করে তবে তার আয় থাকে অতি সামান্য। কারন দেশী লেখাপড়া ও অভিজ্ঞতার তেমন কোন মূল্য থাকে না এখানে। অপর দিকে এখানে বড় হওয়া মেয়েটির আয় থাকে দেশ থেকে আসা ঐ ছেলেটির ৪/৫ গুন বেশী। তখন দেখা দেয় অধিপত্যের বিবাদ। দেশ থেকে যে আসে সে সাথে করে নিয়ে আসে দেশী মন মানসিকতা, যে মন মানসিকতায় আঘাত লাগে স্ত্রীর শ্রেষ্ঠত্ব। স্ত্রীর সহজ-সাবলিল মেলা মেশা এবং পোষাক-আসাকের ধরণ দেশ থেকে আসা স্বামীর কাছে দৃষ্টিকটু ঠেকে যা একপর্যায়ে সমস্যা সৃষ্টি করে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত স্ত্রীর কাছে ধর্মীয় চেতনা আশানুরূপ না পেয়েও অনেক ক্ষেত্রে দেশ থেকে আসা স্বামীর কাছে সমস্যা বলে মনে হতে থাকে। এর পর আছে ভাষার সমস্যা। স্ত্রী অনর্গল ইংরেজী বলে। বাংলা ভাল বলতে পারে না এবং ভাল করে বুঝেও না। অপর দিকে স্বামী অনর্গল বাংলা বলে যা স্ত্রী সঠিকভাবে বুঝতে অক্ষম। অথচ ইংরেজীও ভাল জানেনা স্বামী। এভাবেই দেশী এবং প্রবাসী স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ব্যবধান তৈরী হয় এবং সমস্যার সৃষ্টি হয়। এসমস্ত কারণে কানাডায় বসবাসকারী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে পাত্র-পাত্রীর সন্ধানের বিষয়টি সীমিত থাকে কানাডার মধ্যেই। আর যখন নিজ কমিউনিটিতে পাত্র-পাত্রীর খোঁজ পাওয়া না যায় তখনই সন্ধান শুরু হয় অন্য কমিউনিটিতে। এভাবেই শুরু হয় অসবর্ণ বিয়ের পক্রিয়া এবং ক্রমশ তা বি¯তৃতি লাভ করে।
অতীতে দেখা গেছে অসবর্ণ বিয়ে হতো প্রধানত শ্বেতাঙ্গ ও ভিজিবল মাইনরিটির সদস্যদের মধ্যে। অসবর্ণ দম্পত্তিদের মধ্যে এর হার ছিল শতকরা ৮৬ ভাগ। অন্যদিকে ভিজিবল মাইনরিটি বা দুটি এথনিক গ্র“পের সদস্যদের মধ্যে বিয়ের হার ছিল একেবারেই নগন্য। কানাডার মোট দম্পত্তির মধ্যে তাদের হার ছিল মাত্র ০.৬ ভাগ। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এর হার অতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার হিসেবে দেখা যায় ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে এটি বৃদ্ধি পেয়েছে ৫০ শতাংশ হারে। আর যারা যত বেশীদিন কানাডায় থাকে তারা তত বেশী অসবর্ণ বিয়ের দিকে ঝুঁকে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় প্রথম প্রজন্মে ইমিগ্রেন্ট বা ভিজিবল মাইনরিটিদের মধ্যে যারা এদেশে এসে বিয়ে করেছেন তাদের মধ্যে শতকরা ১২ ভাগ অসবর্ণ দম্পত্তি। তবে দ্বিতীয় প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টদের (যাদের বাবা অথবা মা যে কোন একজনের জন্ম কানাডার বাইরে) মধ্যে এই হার অনেক বেশী, প্রায় ৫১ ভাগ। আর তৃতীয় প্রজন্ম (যাদের বাবা-মা উভয়ের জন্ম কানাডায়) ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে এর হার ৬৯ ভাগ। এটি একটি সামগ্রিক চিত্র। বাংলাদেশী বা এশিয়ান অন্যান্য এথনিক গ্র“পের মধ্যে এ চিত্র কিছুটা ভিন্ন। তারা অসবর্ণ বিয়ের দিকে এখনো অতটা ঝুঁকেনি। কানাডায় চাইনিজ এথনিক গ্র“প এ অসবর্ণ বিয়ের ব্যাপারে খুবই রক্ষণশীল। বাংলাদেশীরাও মোটামুটি রক্ষণশীল। তবে খুব ধীরে হলেও বাংলাদেশী ছেলে-মেয়েরা অসবর্ণ বিয়ের দিকে ঝুঁকছে। হতে পারে এটি কানাডীয় সংস্কৃতির প্রভাব অথবা নিজ কমিউনিটিতে পাত্র-পাত্রীর সংকট।
অসবর্ণ বিয়ের ব্যাপারে স্ট্যাটিসটিকস কানাডার গবেষণা তথ্য:
এথনিক গ্র“প:
কানাডায় জাপান থেকে আগত ইমিগ্রেন্টরা সবচেয়ে বেশী অসবর্ণ বিয়ে করে থাকেন। তাদের মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগ দম্পত্তিই অসবর্ণ। এর পরের অবস্থানে আছে লেটিন আমেরিকান যাদের মধ্যে শতকরা ৪৭ ভাগই অসবর্ণ দম্পত্তি।
কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে অসবর্ণ দম্পত্তির সংখ্যা শতরা ৪১ ভাগ এবং ফিলিপিনোদের মধ্যে শতকরা ৩৩ ভাগ।
বয়স গ্র“প:
কানাডায় অসবর্ণ দম্পত্তির সংখ্যা সবচেয়ে বেশী ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী নারী-পুরুষের মধ্যে। এদের মধ্যে শতকরা ৬.৮ ভাগই বিয়ে করে থাকেন নিজেদের এথনিক গ্র“প বা বর্ণগ্র“পের বাইরে। যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছরের এর মধ্যে তাদের শতকরা ৫.৮ ভাগই দম্পত্তি অসবর্ণের। আর যাদের বয়স ৫৫ বা তার উর্ধে তাদের মধ্যে এর হার শতকরা মাত্র ১.৯ ভাগ।
শিক্ষা গ্র“প:
যারা যত বেশী শিক্ষিত তারা তত বেশী অসবর্ণ বিয়ে করে থাকেন। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় যারা কেবল হাই স্কুল মানের শিক্ষা সমাপন করেছেন তাদের মধ্যে অসবর্ণ দম্পত্তির সংখ্যা মাত্র ১.৮ ভাগ। যারা পোস্ট সেকেন্ডারী মানের শিক্ষা সমাপন করেছেন তাদের মধ্যে এই হার ৪.৮ ভাগ। আর যারা ইউনিভারসিটি ডিগ্রিধারী তাদের মধ্যে অসবর্ণ দম্পত্তির সংখ্যা শতকরা ৬.৪ ভাগ।
আমরা জানি শিক্ষার সঙ্গে আয় সম্পর্কিত। কিন্তু মজার বিষয় হলো, যারা উচ্চ শিক্ষিত এবং অসবর্ণ দম্পত্তি, তাদের পারিবারিক আয় সাধারণ উচ্চ শিক্ষিত দম্পত্তির চেয়ে বছরে প্রায় ৫ হাজার ডলার বেশী।
অঞ্চল ভিত্তিক চিত্র:
স্ট্যাটিসটিকস কানাডার জরীপে প্রভিন্স ভিত্তিক যে চিত্র ফুটে উঠেছে তাতে দেখা যায় ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় সবচেয়ে বেশী অসবর্ণ দম্পত্তি বাস করেন। সেখানে তাদের সংখ্যা শতকরা ৫.৯ ভাগ। অন্টারিওতে এর হার ৪.৬ ভাগ এবং আলবার্টাতে শতকরা ৪.২ ভাগ। শহর ভিত্তিক চিত্রটি হলো এরকম- ভ্যাংকুভারে ৮.৫ ভাগ অসর্বন দম্পত্তি, টরন্টোতে ৭.১ ভাগ অসবর্ণ দম্পত্তি এবং ক্যালগ্যারীতে ৬.১ ভাগ অসবর্ণ দম্পত্তির বাস।
অসবর্ণ বিয়ে নিয়ে অনেকেরই কৌতুহল রয়েছে। কারো কারো ধারণা এটি এক ধরণের সামাজিক অবক্ষয়। পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিয্যকে ধুলায় লুন্ঠিত করে দেয় এই অসবর্ণ বিয়ে। কিন্তু সত্যি কি তাই?
ইউনিভারসিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ওয়েন্ডি রথ বিষয়টিকে এভাবে দেখেননি। তার মতে কানাডার মত একটি মাল্টিকালচারাল সোসাইটিতে অসবর্ণ বিয়ের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি এটাই প্রমান করে যে এখানে বিভিন্ন এথনিক গ্র“পের মধ্যে যে সামাজিক ও বর্ণগত ব্যবধান রয়েছে তার দ্রুত অবসান ঘটছে।
অধ্যাপক ওয়েন্ডির এই পর্যক্ষেণ সঠিক নয় তা বলা যাবে না। বিভিন্ন এথনিক গ্র“পের মধ্যে সামাজিক ও বর্ণগত ব্যবধান কমছে বলেই অসবর্ণ বিয়ের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার এ কথাও ঠিক যে, বর্ণপ্রথা ও সাম্প্রদায়িকতা এখনো অনেক মানুষের মনের একেবারে গভীরে গ্রথিত হয়ে আছে।
কিন্তু আমরা জানি ইসলাম ধর্ম অসবর্ণ বিয়েকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা যে কোন বর্ণ, গোত্র, দেশ বা জাতের লোকদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন। তবে শর্ত হলো, একজন মুসলমান যাকে বিয়ে করবেন তাকে ইসলাম ধর্মের অনুসারী হতে হবে। অর্থাৎ সব ক্ষেত্রে ছাড় আছে কেবল ধর্মের ক্ষেত্রে নেই। অন্যদিকে হিন্দু ধর্মেও অসবর্ণ বিয়ের ব্যাপারে কোন বাধা নেই। কিন্তু সামাজিকভাবে বাধা রয়েছে প্রচুর। হিন্দু সমাজে এক জাত বা এক বর্ণ না হলে ছেলে-মেয়ের বিয়ে
সাধারণত হয় না। ভারত ও বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে এখনো এই রীতি প্রচলিত আছে। তবে শহরে বা শিক্ষিত সমাজে এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব অনেক কমে এসেছে। কানাডায় হিন্দু সম্প্রদায়ের যারা আছেন তাদের মধ্যেও এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব তেমনটা নেই। এ বিষয়ে কানাডা বাংলাদেশ হিন্দু মন্দিরের বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও কমিউনিটির একজন অতি পরিচিত মুখ নির্মল করকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বিয়ের ব্যাপারে পাত্র-পাত্রীর আন্ডারস্ট্যান্ডিংটাই বড় কথা। তবে কানাডার বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় এনে বলা যায়, অসবর্ণ বিয়ে পরবর্তীতে নানারকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, ছেলে-মেয়েদের অভিবাবকরা সবাইতো আর অসবর্ণ বিয়ে মানতে চান না। যদি মেনে নেন তবে কোন সমস্যা হয় না। আর যদি মেনে না নেন তবে ছেলে-মেয়েদেরকে খুব উচ্চমূল্য দিতে হয় এর জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে অসবর্ণ বিয়ের বিরুদ্ধে নই।
বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল টরন্টোতে বাংলাদেশী কমিউনিটির বিশিষ্ট রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ও বাংলা টেলিভিশন কানাডা এর স্বত্বাধিকারী ও প্রধান নির্বাহী সাজ্জাদ আলীকে। তিনি বলেন, অসবর্ন বিয়ের বিষয়ে আমার ঘোরতর আপত্তি নেই, তবে একান্ত বাধ্য না হলে ওটা এড়িয়ে চলারই পক্ষেই আমি। আমার বিবেচনায় পারিবারিক পরম্পরা রক্ষা করা একটা জরুরী বিষয়, যেমন ধরুন আমার দাদার বংশধারা এগিয়ে নিয়েছেন আমার বাবা, বাবার পরে সে দন্ড আজ আমার হাতে। আমার সন্তানও সে ধারাটি আমার অনুপস্থিতিতে রক্ষা করবে, এতটুকু প্রত্যাশা তো আমি করতেই পারি। এই ‘পরম্পরা রক্ষা’ পক্রিয়া পারিবারিক সংস্কৃতির একটি চলমান প্রবাহ। আমার দাদী, মা ও আমার স্ত্রী সেই প্রবাহকেই বেগবান করেছেন। আমার পুত্র সন্তানের একটি অসবর্ণ বিয়ে পারিবারিক সংস্কৃতির সেই প্রবাহটির চলার পথের গতি বদলে দেবে। তারপরও যদি দেখি আমার সন্তান অসবর্ণ কোন মেয়েকে বিয়ে করতেই চায় সেক্ষেত্রে আমি বলবো, আমি শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তা চাইবো না। তবে বাস্তবতাতো ভিন্ন, জীবনের প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি তো আমাদের ‘ইচ্ছা নিয়ন্ত্রিত’ নয়। শেষ পর্যন্ত যদি অসবর্ণ বিয়ে থেকে সন্তানকে ফেরাতে না পারি, অগত্যা দুর থেকেই তাদের আর্শিবাদ করবো। আর যখন দেখবো নিজ কমিউনিটিতে পাত্রী পাচ্ছি না, সেক্ষেত্রে আমি ব্যক্তিগতভাবে দেশ থেকে পাত্র/পাত্রী খুঁজে আনারই পক্ষে।
সাজ্জাদ আলীর কাছে আরো প্রশ্ন ছিল : ধরা যাক কমিউনিটি ভিন্ন কিন্তু ধর্ম এক, সেই ক্ষেত্রে আপনি কি সিদ্ধান্ত নিবেন? এর উত্তরে তিনি বলেন, সেক্ষেত্রেও আমার উপরে উল্লেখিত চিন্তায় কোন পরিবর্তন আসবে না। ধর্মচিন্তা ব্যক্তির নিজস্ব, একটি সুশিক্ষিত পরিবারে বা সমাজে সেটা কেউ অন্যের উপর চাপিয়ে দেয় না বা তা সম্ভবও নয়। ব্যক্তির ধর্ম বিশ্বাস একটি (আধুনিক) পরিবারের গঠনে ভুমিকা রাখেনা, অন্তত রাখা উচিৎ নয়।
অসবর্ণ বিয়ের বিষয়ে প্রশ্ন ছিল টরন্টোর বাংলাদেশী কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও মর্টগেজ এজেন্ট পারভেজ আহমেদ (মহিদ) এর নিকট। তিনি বলেন, আমি অসবর্ণ বিয়ের পক্ষে নই। কারণ অসবর্ণ বিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলবে। তবে ধর্ম যদি এক হয় সে ক্ষেত্রে হয়তো বিষয়টি মেনে নেয়া যেতে পারে। তবে ধর্ম এক বলেই যে আমি সায় দেওয়ার কথা বলছি তা কিন্তু নয়। আমি গোড়াপন্থী নই। এটি পরের ইস্যু। আমি সার্বিক বিবেচনায়ই কথাটি বলছি।
তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, অসবর্ণ বিয়ের ক্ষেত্রে এমন কিছু সমস্যা দেখা যে সমস্যাগুলো এক বর্ণ, ধর্ম বা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের মধ্যে হলে হয় না। আমরা জানি পৃথিবীতে সব দেশ সব সমাজ এবং সব ধর্মের মানুষদের মধ্যেই দাম্পত্ত্য কলহ বা বিরোধ হয়েই থাকে। কোনটি ক্ষণস্থায়ী আবার কোনটি দীর্ঘস্থায়ী। কিন্তু এক পর্যায়ে তা মিটেও যায়। যখন তা মিটে না যায় তখনই ঘটে ছাড়াছাড়ি বা আলাদা হয়ে যাওয়া। এ কলহ বা বিরোধ নানা কারণে হতে পারে। আর্থিক অনটন, বউ শ্বাশুরীর তেতো সম্পর্ক, একান্নবর্তী পরিবারের চাপ, পরকীয়াসহ আরো নানারকম সমস্যাই দাম্পত্ত কলহকে উসকে দেয়। এগুলো সাধারণ সমস্যা। কিন্তু অসবর্ণ দম্পত্তিরা যে বিশেষ ধরণের সমস্যাগুলো মোকাবেলা করেন তা হলো প্রধানত- সংস্কৃতির ভিন্নতা, ধর্মের ভিন্নতা এবং মূল্যবোধের ভিন্নতা। কানাডায় জন্ম নেয়া বা বড় হওয়া ছেলে-মেয়েদেরকে বলতে শুনা যায় যে তারা কানাডীয় সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বড় হয়েছেন। সুতরাং এথনিসিটি যাই হোক,তাদের সংস্কৃতি এক। কথাটা এক অর্থে সঠিক। বাইরের জগতে তাদের সংস্কৃতি সত্যি এক। অর্থাৎ এথনিসিটি ভিন্ন হলেও স্কুল কলেজ আর ইউনিভারসিটিতে তারা যা শিখেন তাতে করে তাদের চালচলন, পোষাক, দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাকার বিষয়গুলো একই রকম হয়। কিন্তু তারাতো শুধু বাইরেই থাকেন না। ঘরেও আসতে হয়। ঘরে তাদের সংস্কৃতি হলো বাবা-মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির সঙ্গে তো বাইরের সংস্কৃতির মিল নেই। ফলে বিয়ে করে যখন কোন ছেলে তার স্ত্রীকে বা কোন মেয়ে তার স্বামীকে ঘরে নিয়ে আসবেন তখন স্বাভাবিকভাবেই একটা সাংস্কৃতিক বিরোধ দেখা দিবে। এই বিরোধটা যারা মেনে নিতে পারবেন তাদের সমস্যা হবে না। কিন্তু যারা মেনে নিতে পারবেন না তাদের ক্ষেত্রে দেখা দিবে নানান সমস্যা যার অবধারিত পরিনতি হলো – হয় পরিবার থেকে আলাদা হয়ে বসবাস করা অথবা স্বামী-স্ত্রী’তে ছাড়াছাড়ি।
সমস্যা আরো দেখা দেয় ধর্ম পালন নিয়ে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, যারা ধর্মকর্মের ব্যাপারে গোড়াপন্থী তাদের সমস্যাটা তীব্র আকার ধারণ করে বিয়ের পর। কে কার ধর্ম অনুসরন করবে তা নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। অথবা যে যার ধর্ম পালন করলেও ধর্মের বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে না আসলে মনোমালিন্য থেকে শুরু করে পারিবারিক বিরোধও দেখা দিতে পারে। সমস্যা আরো প্রকট হয়ে দেখা দেয় যখন অসবর্ণ ঐ দম্পত্তির সন্তানেরা বড় হয়ে উঠে। ঐ সন্তানেরা বাবার ধর্ম অনুসরণ করবে না মায়ে ধর্ম অনুসরণ করবে তা নিয়ে এক জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়। তবে বাবা -মা উভয়ে যদি ধর্মের বিষয়ে উদার দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ হন অথবা নিরীশ্বরবাদী হন তবে এ বিষয়ে কোন সমস্যা সৃষ্টি হয় না।
পরিশেষে বলা যায় , কানাডায় অসবর্ণ বিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এ কথা সত্যি। তবে এই বৃদ্ধি এখনো জনগণের নির্দিষ্ট কিছু অংশের মধ্যে ঘটছে। বিশেষত যারা উচ্চশিক্ষিত,যারা শহরে বাস করেন এবং বয়সের বিচারে যারা দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের দৃশ্যমান সংখ্যালঘু তাদের মধ্যেই এই অসবর্ণ বিয়ের ঘটনা ঘটছে বেশী। সেই সাথে আছেন শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠিরও একটি অংশ।
একটি সত্যি গল্প দিয়ে শেষ করছি প্রতিবেদনটি। পাত্র চৈনিক, নাম ক্যান সীম। পাত্রী ভারতীয়, নাম টিনা গুপ্তা। তাদের উভয়ের বাস ভ্যাঙ্কুভারে। ক্যান সীম যখন হাইস্কুলের ছাত্র তখন তার এক সহপাঠী ছিল যার না হারমিত। পাঞ্জাবী ছেলে। হারমিতের সঙ্গে ক্যান সীম এর খুব সখ্যতা ছিল। কিন্তু ক্যান সীমের বাবা বিষয়টি পছন্দ করতেন না। ছেলেকে তিনি বলতেন, ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে তোমার মেলামেশা করা উচিৎ নয়।
আজ বহু বছর পর ক্যান এর বাবার ভাগ্যে জুটেছে দুই শ্বেতাঙ্গ জামাইবাবু, থাই বংশোদ্ভূত এক পুত্রবধূ এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক পুত্রবধু। সুখেই আছেন তারা সবাই। ক্যানের বাবা পুত্রবধু টিনা গুপ্তার বাবা মার সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা মাতে যান প্রতি উইক এন্ডে।