কানাডায় দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্য মাতৃভাষার চর্চা বৃদ্ধি পাচ্ছে
দ্বিতীয় প্রজন্মের শতকরা ৭০ ভাগ বাংলাদেশী ছেলে-মেয়ে মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে
খুরশিদ আলম, জুলাই ২৮, ২০১৪: কানাডায় ইমিগ্রেন্টদের দ্বিতীয় প্রজন্মের শতকরা ৫৫ ভাগ ছেলে-মেয়ে তাদের মাতৃভাষায় কথা বলছে। এই হিসাব ২০০৬ সালের। ১৯৮১ সালে এই হার ছিল শতকরা ৪১ ভাগ। এটি সকল এথনিক গ্রুপের একটি সার্বিক চিত্র। এই চিত্র থেকে দেখা যায় ইমিগ্রেন্টদের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের (যাদের বয়স ১৮ বা তার নিচে এবং যাদের জন্ম এখানে) মধ্যে মাতৃভাষা ব্যবহারের মাত্রা শতকরা ১৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে আলাদাভাবে অনুসন্ধান করলে দেখা যায় বিভিন্ন এথনিক গ্রুপের চিত্র ভিন্ন। যারা ইউরোপ থেকে কানাডায় এসেছেন তাদের তুলনায় সাম্প্রতিককালে আসা এশিয় ইমিগ্রেন্টরা তাদের মাতৃভাষাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেন বেশী। এদের মধ্যে আছেন চাইনীজ, পাঞ্জাবী, বাংলাদেশীসহ আরো কয়েকটি এথনিক গোষ্ঠি। স্টাটিসটিকস কানাডার “ঊাড়ষঁঃরড়হ ড়ভ ওসসরমৎধহঃ-ষধহমঁধমব ঞৎধহংসরংংরড়হ রহ ঈধহধফধ.” শিরোনামে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়।
১৯৮০ থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় দুই দশকে কানাডার ফ্যামিলি রিউনিফিকেশন প্রোগ্রামের আওতায় ইমিগ্রেন্টদের অনেক বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী এদেশে এসেছেন যারা এখানে জন্ম নেয়া ছেলে-মেয়েদের মধ্যে মাতৃভাষা চর্চার ধারাটি বজায় রাখতে সাহায্য করেছেন।
হিসেবে দেখা যায় যে সকল ইমিগ্রেন্ট কানাডায় এসেছেন ইউরোপ থেকে তাদের পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের সদস্যরা তাদের মাতৃভাষা প্রায় ভুলতে বসেছে। তাদের মধ্যে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে মাত্র একজন অর্থাৎ শতকরা ২০ ভাগ মাতৃভাষায় কথা বলতে পরে। অন্যদিকে যে সকল ইমিগ্রেন্টদের ভাষা আর্মেনীয়,পাঞ্জাবী, চাইনিজ, পার্শিয়ান, টার্কিশ, বাংলা ও উর্দূ তাদের পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে শতকরা ৭০ ভাগ।
এর কারণও রয়েছে বেশ কয়েকটি। সাম্প্রতিককালে এশিয়া থেকে কানাডায় এসেছেন যে সকল ইমিগ্রেন্ট তারা উচ্চ শিক্ষিত। পারিবারিক ভ্যালুজ বা মূল্যবোধ এদের মধ্যে প্রখর। ধর্মের প্রভাবও রয়েছে এদের মধ্যে কমবেশী। শিক্ষার প্রতি এদের অনুরাগ বেশী। নিজের ভাষা কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি এদের ভালবাসা রয়েছে প্রচুর এবং তারা কখনোই মনে করে না তাদের ভাষা কৃষ্টি ও সংস্কৃতি অন্যদের চেয়ে দুর্বল বা হীন। ফলে কানাডায় এশিয় ইমিগ্রেন্টরা তাদের সন্তানদের মধ্যে নিজের মাতৃভাষা সঞ্চারিত করতে সর্বদা যত্মশীল থাকেন। যার ফলশ্রুতিতে এশিয়ার কয়েকটি এথনিক গ্রুপের মধ্যে দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা অধিকহারে নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে। আর বাংলাদেশীদের বেলায় আরেকটি বাড়তি এবং খুবই আবেগের বিষয় কাজ করে যেটি হলো ৫২’র ভাষা আন্দোলন। যেটি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এই কানাডায়ও পালিত হয়। আর এই কৃতিত্বের অধিকারী একজন কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীর যার নাম রফিক। গত বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমরা জানি, কানাডায় বসবাসকারী প্রথম প্রজন্মের প্রতিটি বাংলাদেশী বাবা-মা’র মনেই ৫২‘র ভাষা আন্দোলনের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে হোক বা পরক্ষোভাবে হোক প্রভাব বিস্তার করে আসছে। আর তার ফলাফলও আমরা দেখতে পেয়েছি স্টাটিসটিকস কানাডার গবেষনা রিপোর্টে। একটি সম্পূর্ণ বিজাতীয় পরিবেশে বড় হয়েও দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশী ছেলে-মেয়েদের ব্যাপক অংশ বাংলায় কথা বলতে পারছে।
তবে কানাডায় জন্ম নেয়া দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশী ছেলে-মেয়েরা বাংলায় কথা বলতে পারলেও সিংহভাগই লিখতে বা পড়তে জানেনা। টরন্টোর কয়েকটি এলিমেন্টারী স্কুলে উইকএন্ডে ফ্রি বাংলা স্কুল চালু রয়েছে। কয়েকটি বাংলাদেশী মালিকানাধীন নাচ ও গানের স্কুলে বাংলা শিক্ষা দেয়া হয়। কিন্তু তারপরও তা পর্যাপ্ত নয়। অন্যদিকে যে সুযোগটুকু রয়েছে সেটুকুও কাজে লাগানো হচ্ছে না।
কানাডায় জন্ম নেয়া দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় অধিক হারে কথা বলতে পারছে যার আরেকটি কারণ হলো, এদের বসবাস একটি নির্দিষ্ট এলাকায়। যদি বাংলাদেশীদের উদাহরন টানা হয় তবে দেখা যাবে, এদের বেশীরভাগই থাকেন টরন্টোর ভিক্টোরিয়া পার্ক ও ড্যানফোর্থ এলাকায়। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় থাকার কারণে পরষ্পরের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পায় অধিকহারে। একই এথনিক গ্রুপের লোকদের মধ্যে যোগাযোগটিও হয়ে থাকে নিজেদের ভাষায়। ফলে খুব ছোট থেকেই ছেলে-মেয়েরা তাদের মাতৃভাষায় কথা শুনতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে এবং তা শিখতেও শুরু করে। আর ঘরে বাবা-মায়ের সঙ্গেতো যোগাযোগটি হয় বাবা-মায়ের ভাষাতেই। এভাবেই তারা মাতৃভাষা শিখে নেয়।
তবে এক জেনারেশন থেকে আরেক জেনারেশনে ভাষার সঞ্চার ঘটানোর ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন চিত্রও লক্ষ্য করা যায়। স্টাটিসটিকস কানাডার আরেক হিসেবে দেখা গেছে ১৯৮১ সালে যেখানে শতকরা ৪১ ভাগ মা তাদের সন্তানদেরকে নিজ ভাষা শিখিয়েছেন সেখানে ২০০৬ সালে মাত্র ২৩ ভাগ মা তাদের সন্তানদেরকে নিজ ভাষা শিখিয়েছেন। ২৫ বছরের ব্যবধানে আমরা একটি ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। তবে এটি ইটালিয়ান, চাইনিজ বা গ্রীকদের মধ্যে লক্ষ্য করা গেলেও পাঞ্জাবীদের মধ্যে দেখা গেছে অন্য চিত্র। তাদের পরিবারে শতকরা ৫১ ভাগ মা নিজেদের সন্তানদেরকে মাতৃভাষা শিখিয়েছেন।
অসবর্ণ বিয়ে এ ক্ষেত্রে একটি প্রভাব বিস্তার করে থাকে। পাত্র বা পাত্রীর যে কোন একজন যদি ইংলিশ বা ফ্রেঞ্চ ভাষী হন তবে তাদের সন্তানেরা ঘরে ঐ ভাষায়ই কথা বলে থাকে। আবার এমনো দেখা গেছে বাবা মা দুই এথনিক গ্রুপের হলে ছেলে-মেয়েরা উভয়ের ভাষাই শিখে নেয়। এখানে নাম পরিচয় গোপন রেখে একটি বাস্তব উদাহরন উল্লেখ করা যেতে পারে। বাবা বাংলাদেশের এবং মা আলজেরিয়ান। তাদের ঘরে চারটি ছেলে -মেয়ে। বাবা মা দুজনেই ইংরেজী ও ফ্রান্স ভাষায় পারদর্শী। অন্যদিকে মা আলজেরিয়ায় জন্ম ও বড় হওয়াতে আরবী ভাষাও জানেন। ফলে দেখা গেছে ছেলে-মেয়েরা বাংলা ইংরেজী ফ্রান্স ও আরবী এই চারটি ভাষায় ঘরে কথা বলে।
তবে কানাডায় সব এথনিক গ্রুপের গড় হিসেবে দেখা গেছে প্রতি দশজন দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে চার জন তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে। কিন্তু তৃতীয় প্রজন্মে গিয়ে এই হার কমে এসে দাড়িয়েছে প্রতি দশজনে একজন।
আর আলাদা হিসেবে দেখা যায়, তৃতীয় প্রজন্মের পাঞ্জাবী ছেলে-মেয়েরা অন্যান্য এথনিক গ্রুপের তৃতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের তুলনায় অনেক এগিয়ে রয়েছে। তাদের হার শতকরা ৩৩ ভাগ। অন্যদিকে হাঙ্গেরীয়ানদের মধ্যে এই হার শতকরা ৩ ভাগ। জার্মানদের মধ্যে শতকরা ৫ ভাগ, পলিশদের মধ্যে শতকরা ৬ ভাগ, পর্তুগীজদের মধ্যে শতকরা ৮ ভাগ, ইটালিয়ানদের মধ্যে শতকরা ১১ ভাগ, স্পেনিশদের মধ্যে শতকরা ১২ ভাগ। অবশ্য তৃতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশীদের হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। কারণ, তাদের যাত্রা এখনো শুরু হয়নি বা শুরু হলেও তারা এখনো ‘হাটি হাটি পা পা’ এর অবস্থানে রয়েছে।
তবে তৃতীয় প্রজন্মের পাঞ্জাবীদের দেখে অন্তত এইটুকু আশা করা যেতে পারে যে কানাডায় তৃতীয় প্রজন্মের সব বাংলাদেশীদের হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আপাতত নেই। অন্তত অর্ধেক হলেও নিজেদের ভাষাকে ধরে রাখবে। চতুর্থ প্রজন্মের কি হবে তা বলার সময় এখনো আসেনি। সময়ই বলে দিবে সেই আগামীতে কি হবে।