কানাডায় জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব দেয়া বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহবান

অক্টোবর ৫, ২০১৪: অভিবাসন বিষয়ক কর্মকর্তারা কানাডার নাগরিক নন এবং এদেশের স্থায়ী বাসিন্দা নন এমন লোকেদের কানাডায় জন্মানো শিশুদের নাগরিকত্ব দেয়া বন্ধ করার জন্য অটোয়া সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। যদিও এধরণের ঘটনার সংখ্যা খুব বেশি নয় এবং তা এর ফলাফলকে ন্যায্যতা দেয় না।

‘গোপনীয়’ হিসাবে চিহ্নিত এবং বিভিন্ন কেন্দ্রীয় দফতরের সুপারিশসহ ওই প্রস্তাবে দেখা গেছে যে, প্রতি বছর কানাডায় বিদেশী নাগরিকদের ৫০০জনেরও কম সংখ্যক সন্তান জন্ম নেয়। এটি কানাডায় বছরে জন্ম নেয়া ৩ লাখ ৬০ হাজার শিশুর মাত্র ০.১৪ শতাংশ। কানাডায় জন্মগ্রহণকারী শিশুদেরকে জন্মগত নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়টি বর্তমান সরকারের নীতিগত বিবেচনার সমালোচনাকারীদের মধ্যে আবারও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। বর্তমান সরকারের নীতিগত বিবেচনাকে সাধারণভাবে তথ্যপ্রমাণভিত্তিক এবং মূল্য অনুপাতে সুবিধার বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে বরং আদর্শবাদিতা দিয়ে পরিচালিত বলে মনে করা হয়। কানাডার নাগরিকত্ব ও অভিবাসন মন্ত্রণালয়ের নাগরিকত্ব ও বহুসংস্কৃতিবাদ বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক এবং পলিসি অ্যারোগ্যান্স অর ইনোসেন্ট বায়াস নামে বইয়ের লেখক এন্ড্রু গ্রিফিথ বলেন, ‘‘একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক এই সিদ্ধান্তে পৌঁছবেন যে, খুবই স্বল্পসংখ্যক ঘটনার কারণে বলতে হবে, তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। তারপরও ওই সুপারিশ সরকারের জনসম্মুখে করা বক্তৃতাবাজি এবং পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কিত উদ্ধৃতিকে সমর্থন করে।’’ বর্তমান রক্ষণশীল সরকার চলতি বছরের শুরুর দিকে কানাডার নাগরিকত্ব আইন সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্যতা কঠোরতর করেছে। তবে ‘‘এদেশে জন্মানো’’ শিশুর নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়টি অপরিবর্তিত রেখেছে এবং এ নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনের কথা বলেছে।

তথ্য অধিকার আইনে অনুরোধ করে পাওয়া সাবেক অভিবাসন মন্ত্রী জেসন ক্যানির জন্য তৈরি করা ১৭ পৃষ্ঠার এক রিপোর্টে বলা হয়েছিলো, জন্মগতভাবে নাগরিকত্ব পাওয়া প্রত্যেকেরই কানাডার সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক থাকতে হবে এটি নিশ্চিত করার জন্য জন্মগত নাগরিকত্ব দেয়া বাতিল করা হলে তার জন্য গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।

রিপোর্টে বলা হয়, ‘‘এ ধরণের পরিবর্তনের বিষয়টি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ হলো জনগণকে এব্যাপারে স্বমতে আনা যে কানাডার নাগরিকত্ব পাওয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপের মূল্য ওই পরিবর্তন আনার ফলাফলের সঙ্গে তুলনীয়।’’ কেনীর উত্তরসূরি ক্রিস আলেক্সান্ডারের মন্ত্রণালয় স্টারকে নিশ্চিত করেছে যে, ‘‘শিশু জন্ম দানের জন্য পর্যটন’’ সম্পর্কিত বিষয়টি নিয়ে সরকার এখনও পর্যালোচনা করে যাচ্ছে। ‘‘শিশু জন্ম দানের জন্য পর্যটন’’ হলো একটি পরিভাষা যা ব্যবহার করা হয় কানাডায় শিশুকে ভূমিষ্ট করানোর জন্য বিদেশীদের এদেশে আগমন বোঝানোর জন্য যাতে শিশুটি আপনাআপনি কানাডার নাগরিকত্ব পেতে পারে। ‘‘অ্যাঙ্কর বেবি’’ নামে অভিহিত এসব শিশু ১৮ বছর বয়স হলেই তাদের বাবা-মাকে কানাডায় আনার জন্য স্পন্সর করতে পারে। এধরণের কতজন শিশু তাদের বাবা-মাকে নিয়ে তাদের জন্মের দেশে ফিরে এসেছে সে রকম কোনও পরিসংখ্যান কারও জানা নেই, তবে এ সংখ্যা খুবই কম বলে ধারণা করা হয়।

আলেক্সান্ডারের মুখপাত্র অ্যালেক্স প্যাভলিচ বলেন, ‘‘জন্ম নিবন্ধনের দায়িত্ব যেহেতু প্রদেশ ও টেরিটোরিগুলোর সেহেতু বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা এবং সমন্বয় করার প্রয়োজন রয়েছে। আর কানডার নাগরিকত্ব হলো একটি সম্মান এবং এক ধরণের সুবিধা এবং আমাদের রক্ষণশীল সরকার এর মূল্য বাড়াতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ‘‘শিশু জন্ম দানের জন্য পর্যটন’’ (ইরৎঃয ঃড়ঁৎরংস) আমাদের নাগরিকত্বের কর্মসূচির সংহতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং কানাডার উদারতার সুযোগ গ্রহণ করছে।’’

বর্তমানে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রই হলো এমন দেশ যেখানে জন্মগ্রহণ করলেই শিশুকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়। যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ তাদের ভূখন্ডে জন্মগ্রহণ করলেই শিশুকে নাগরিকত্ব দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তারা কেবল সেইসব শিশুকে নাগরিকত্ব দিচ্ছে যাদের বাবা-মা সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিক অথবা স্থায়ী বাসিন্দা। সরকারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘‘এধরণের ব্যবস্থা কার্যকর করা এবং কানাডায় জন্মগ্রহণকারী শিশুদেরকে দেশবিহীন শিশুতে পরিণত করার যে চ্যালেঞ্জ কিংবা তাদের অবস্থানকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়ার ফলে সম্ভাব্য যে মূল্য দিতে হবে তা এই মাটিতে জন্মগ্রহণকারী শিশুকে নাগরিকত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আরোপের ফলে যে মূল্য দিতে হবে তাকে ছাড়িয়ে যাবে।’’ এতে অভিমত দেয়া হয় যে, এধরণের শিশু জন্মের সংখ্যাকে নগণ্য হিসাবে দেখা যেতে পারে।

রিপোর্টে বলা হয়, ‘‘সিবিএসএ-র ( কানাডা বর্ডার সার্ভিস এজেন্সি) সঙ্গে আলোচনায় এমন আভাস দেয়া হয় যে, এই ভূখন্ডে জ¥গ্রহণকারী শিশুদের নাগরিকত্ব দেয়া সীমিত করা হলে তা পরিবারগুলোকে কানাডা থেকে বের করে দেয়ার কর্মসূচিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে কানাডায় জন্মগ্রহণকারী একটি সন্তান রয়েছে এমন পরিবারকে বের করে দেয়া অধিকতর চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াবে, কারণ শিশুটি রাষ্ট্রবিহীন হোক বা না হোক তার জন্য ট্রাভেল ডকুমেন্টস পাওয়ার বিষয়ে জটিলতার সৃষ্টি হবে।’’

বিচার বিভাগ, পাসপোর্ট দফতর, পররাষ্ট্র দফতর, সিবিএসএ এবং জননিরাপত্তা বিভাগের পরামর্শের ভিত্তিতে রিপোর্টে এই অভিমত দেয়া হয় যে, কানাডার কেন্দ্রীয় সরকার এদেশের মাটিতে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিদের নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র দিতে কিংবা প্রদেশগুলোতে জন্মের সনদে নাগরিকত্বের অবস্থা নির্দেশ করে এমন কোন পরিবর্তন আনতে পারে।

এর পরও রিপোর্টে জন্মগতভাবে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার বিলোপের সুপারিশ করা হয় এই বলে যে, নাগরিকত্ব ও অভিবাসন বিভাগের জন্য পরিচালনা ও মূল্যগত জটিলতা (পড়ংঃ রসঢ়ষরপধঃরড়হ) সৃষ্টি হলেও এই ভূখান্ডে জন্মানোর কারণে নাগরিকত্ব দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে সে ক্ষেত্রে জনসমর্থন পাওয়া যেতে পারে।

১৯৯০-এর দশকে তৎকালীন লিবারেল সরকার এ ধরণের একটি পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হলেও জনগণের বিরোধিতা এবং ওই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে তখনকার অভিবাসন মন্ত্রী লুসিয়েন রোবিলার্ডের কাছে চিঠি লেখার প্রচারণার মুখে সরকার পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়।

২৩০টির বেশি জাতীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে লেখা চিঠিতে বলা হয়, ‘‘কানাডা কাউকে রাষ্ট্রহীন নাগরিকে পরিণত না করা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু প্রস্তাবিত এই পরিবর্তনের ফলে কিছু কিছু শিশুর রাষ্ট্রহীন নাগরিকে পরিণত হওয়ার বাস্তবিক ঝুঁকি রয়েছে।’’ চিঠিতে বলা হয়, ‘‘শিশুদের আপনাআপনি নাগরিকত্ব দেয়া বন্ধের পদক্ষেপ জনগণের মধ্যে অসহিষ্ণুতার বার্তা পৌঁছিয়েছে। এধরণের আইনগত পরিবর্তনের ফলে নবাগতদের কাছে এমন বার্তা পৌঁছবে যে কারও কারও শিশুকে সাগ্রহে বরণ করা হচ্ছে এবং কারও শিশুকে অনাকাঙ্খিত মনে করা হচ্ছে। এর ফলে বাইরে সরিয়ে রাখার এবং প্রান্তিকীকরণের অনুভূতি জোরদার হবে, যা কানাডীয় সমাজের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার বিষয়টিকে আরও কঠিন করে তুলবে।’’

আইনটি পরিবর্তনে অটোয়ার নতুন উদ্যোগের বিষয়ে কানাডার কাউন্সিল ফর রিফিউজির জানেট ডেঞ্চ বলেন, ‘‘কানাডায় জন্মগতভাবে নাগরিকত্ব লাভের বিষয়টি কানাডীয় পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এটি আমাদেরকে একটি অধিকতর উত্তম সমাজে পরিণত করেছে। ১৯৯০-এর দশকে সরকার যখন এই আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয় তখন অনেক কানাডীয় আমাদের এই মতের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন যে, এটি একটি খুবই খারাপ ধারণা।’’ -টরস্টার নিউজ সার্ভিস