কানাডার রাজনীতিকরা নিজেদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের চেয়েও মন্দ ভাবেন

রাজনীতিকদের সম্পর্কে কানাডীয়দের ভাবনা প্রায়শ নেতিবাচক

জেন গার্সেন : (ক্যালগরি) –অক্টোবর ৫, ২০১৪: রাজনীতিকদের সম্পর্কে কানাডীয়দের ভাবনা প্রায়শ নেতিবাচক এতে গোপনীয়তার কিছু নেই। তাদের সম্পর্কে সাধারণভাবে ধারণা পোষণ করা হয় যে রাজনীতিকরা প্রায়ই অসৎ, অযোগ্য এবং সম্ভবত দুর্নীতিপরায়ণ।

গত সপ্তাহে প্রকাশিত ম্যানিং ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী রাজনীতিকরাও নিজেদের সম্পর্কে বা তাদের আভিজাত্য সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করেন এমন নয়।

কার্লেটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আন্দ্রে টারকট বর্তমান ও প্রাক্তন ১৬২জন রাজনীতিকের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন যে, বেশিরভাগ নীতিগত ইস্যুতে তাদের নিজেদের ধারণা অস্পষ্ট।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সমীক্ষায় অংশ নেয়া বেশিরভাগ রাজনীতিক অর্থনীতিকে তাদের সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। অবশ্য অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে সক্ষমতার নিরিখে রাজনীতিকরা প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারকে শুন্য থেকে ১০ স্কেলের মধ্যে মাত্র ৫ নম্বর দিয়েছেন, যেখানে ১৭ শতাংশ রাজনীতিক দিয়েছেন শুন্য নম্বর।

তারা তাদের সহকর্মীদের ব্যাপারে খুব কমই চিন্তা করেন। সাধারণভাবে রাজনীতিকদের সার্বিক পারফরমেন্সের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সমীক্ষায় অংশ নেয়া রাজনীতিকরা তাদের উচ্চশ্রেণীর সহকর্মীদেরকে ১০-এর মধ্যে মাত্র ৩.৯৫ নম্বর দেন। আর যত বেশিদিন ধরে তারা রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকেন ততই তারা পলায়নবাদী হয়ে ওঠেন। যেমন, প্রতি ৫জন রাজনীতিকের মধ্যে এক জনেরও বেশি মনে করেন তাদের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হলো ‘‘নির্বাচিত হওয়া,’’ এটি এমন এক বিশ্বাস যা তারা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করেছেন।

সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ স্কুলের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর মি. টারকট যিনি কানাডীয়দের ওপরও গবেষণা করেছেন, বলেন, ‘‘সার্বিকভাবে কানাডীয়রা রাজনীতিকদের যতটা মূল্যায়ন করেন রাজনীতিকরা নিজেদেরকে প্রকৃতপক্ষে তার চেয়েও নি¤œ পর্যায়ে মূল্যায়ন করেন। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুর বেশিরভাগের সমাধান দিতে তাদের সক্ষমতার বিষয়টিকে রাজনীতিকরা এভাবেই দেখেন।’’

রাজনীতিকরা কেবল একটিমাত্র ইস্যুতে নিজেদেরকে খুব ভালভাবে প্রস্তুত বলে মনে করেন, আর সেটি হলো আন্তর্জাতিক ব্যবসায় ও বাণিজ্য। উদাহরণস্বরূপ, সংখ্যাগুরু ৫৩ শতাংশ রাজনীতিক বাণিজ্য ও শিল্পখাতে নিজেদেরকে ভালো অথবা চমৎকার বলে অভিহিত করেছেন।

কার্যত অন্য প্রায় সব ইস্যুতেÑ স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে পরিবেশ, আদিবাসী ইস্যু, অপরাধ, সামাজিক নীতি, গণতন্ত্র, সংবিধান সবকিছুতেই নির্বাচিত রাজনীতিকরা নিজেদের ধারণা দুর্বল বলে জানিয়েছেন।

তার ওপর তারা এমনও মনে করেন যে, সিদ্ধান্ত-গ্রহণ, আইন ও নীতি-নির্ধারণ, ব্যবস্থাপনা এবং বিশ্লেষণের মত বিষয়গুলোতে তারা একেবারেই যোগ্য নন। যেমন, আইন ও নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতার পরিমাপে রাজনীতিকরা নিজেদেরকে ১০-এর মধ্যে ৪.৭২ নম্বর দিয়েছেন। ব্যবস্থাপনা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে তারা নিজেদেরকে নম্বর দিয়েছেন যথাক্রমে ৪.১৭ ও ৪.৭৮।

যেসব রাজনীতিকদের নিয়ে সমীক্ষা চালানো হয়েছে তাদের সবাই সরকারের তিনটি স্তরের রাজনীতিক। তবে বেশিরভাগই মিউনিসিপ্যালিটির কর্মকর্তা। এদের বেশিরভাগ আবার অন্টারিও এবং ব্রিটিশ কলম্বিয়ার রাজনীতিক।

অবশ্য মিউনিসিফ্যালিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকদের মধ্যে কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকদের যেসব ইস্যুর মোকাবিলা করতে হয় সেই সব বিষয়েই যথেষ্ট জ্ঞান থাকবে এমনটা আশা করা যায় না। মি. টারকট বলেন, এককভাবে কারও জ্ঞানের ঘাটতির ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। যেমন রাজনীতিকরা তাদের প্রধান জানাশোনার বিষয় হিসাবে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় ও বাণিজ্যের কথা বলেছেন। আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে তারা নম্বর পেয়েছেন ১০-এ প্রায় ৬, অথচ নগর ও অবকাঠামোগত বিষয়টি তাদের জানাশোনা কম বলে উল্লেখ করেছেন: এক্ষেত্রে তাদের স্কোর হলো মাত্র ৩.৭৩।

ম্যানিং ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা প্রেস্টন ম্যানিং যিনি তার স্কুল অব প্র্যাকটিক্যাল পলিটিকস-এর মাধ্যমে এই সমীক্ষা পরিচালনা করেন, গত বুধবার বলেন, সমীক্ষার ফলাফল দেখে তিনি বিস্মিত।

অর্থনীতির অবস্থান থেকে এবং সুনির্দিষ্টভাবে পশ্চিম কানাডীয়র দৃষ্টিতে অন্যতম উদ্বেগজনক একটি ক্ষেত্র হলোÑ জ্বালানি, পরিবেশ ও সম্পদ উন্নয়ন খাত যেখানে রাজনীতিকদের জানাশোনা কম বলে তারা নিজেরাই মনে করেন। অথচ অর্থনীতির অবস্থান থেকে এই খাতটি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

একমাত্র যে ক্ষেত্রটিতে তাদের দক্ষতা রয়েছে বলে রাজনীতিকরা আস্থাবান সেটি হলো তাদের আত্মস্বার্থ রক্ষা ও পুননির্বাচিত হওয়ায় সর্বোচ্চ দক্ষতা যেটি ২৫ শতাংশ রাজনীতিক স্বীকার করেছেন।

(বৈদেশিক সম্পর্ক ও ব্যবসায় এসেছে দ্বিতীয় অবস্থানে যেটির কথা উল্লেখ করেছেন ২০ শতাংশ রাজনীতিক।)

মি. টারকট বলেন, ‘‘নির্বাচনী কর্মকান্ডে তারা খুব ভালো। রাজনীতির প্রক্রিয়াতেও তারা ভালো। কিন্তু নির্বাচিত হবার পর তাদের ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয় তা পালনেই তাদের ভালো প্রস্তুতি থাকে না।’’

মি. টারকট এই ফলাফলের সঙ্গে আগের একটি জরিপের ফলাফলের তুলনা করেন। গত ডিসেম্বরে এক জরিপে অনলাইনে দেড় হাজার কানাডীয়কে দেশের অর্থনৈতিক ইস্যুতে রাজনীতিকদের পরফরমেন্স সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। কানাডীয়রা রাজনীতিকদের ১০-এর মধ্যে মাত্র ৪.৪৯ নম্বর দেন। আর একই ইস্যুতে রাজনীতিকরা নিজেরা নিজেদেরকে নম্বর দিয়েছেন ৩.৯৫।

সমীক্ষা অনুযায়ী যেসব ক্ষেত্রে রাজনীতিকরা নিজেদেরকে স্বল্পজ্ঞানী বলে রায় দিয়েছেন সেগুলি হলো জ্বালানি, পরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনীতি।

রাজনীতিকদের কাছে জানতে চাওয়া হয় কোন কোন প্রধান বিষয়গুলোতে তারা সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেন। তাদের ১৩ শতাংশ স্বীকার করেন যে, দারিদ্র্য, স্বল্প আয়ের লোকেদের আবাসন এবং জীবনমানের বিষয়গুলোকে তারা কম গুরুত্ব দেন। তারা জানান, অবহেলিত ইস্যুর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পরিবেশ।

প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রাজনীতিক মনে করেন, একজন রাজনীতিকের দক্ষতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নৈতিকতা ও আন্তরিকতা। যোগাযোগের দক্ষতাকেও গুরুত্বপূর্ণ বলে মত দেন তারা।

রিফর্ম পার্টির নেতা হিসাবে মি. ম্যানিং তার নিজের অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে বলেন, ‘‘আমরা অনেক পেছন থেকে শুরু করেছিলাম।’’ তার দলের সদস্যরা বলতে গেলে আইন বিষয়ক কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই ১৯৮০-র দশকে প্রথমবারের মত পার্লামেন্টে নির্বাচিত হন।

তিনি বলেন, নতুন রাজনীতিকরা প্রায়শই কাজের প্রচন্ড চাপে থাকেন এবং তারা কাজ শিখে ওঠার সময় পান না। তিনি সম্ভাব্য রাজনীতিকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেন যাতে তারা নির্বাচিত হওয়ার আগেই আইন প্রণয়ন ও নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন।

মি. ম্যানিং বলেন, তিনি এটা বলতে চান না যে আগের চেয়ে এখনকার রাজনীতিকরা কম জানেন।

কিন্তু তাদের কাজের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়া এবং তা ক্রমশ জটিল হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জানাশোনার ব্যবধানটাও ক্রমশ চোখে পড়তে শুরু করেছে। তিনি বলেন, ‘‘৫০ বছর আগের সঙ্গে তুলনা করলে বর্তমানে নির্বাচিত ব্যক্তিদেরকে যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে হয় তা অনেক জটিল হয়ে উঠেছে। আর তাদের কাজের চাহিদাও ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে। কিন্তু আমার মনে হয় না আমরা লোকেদেরকে সেভাবে প্রস্তুত করছি কিংবা ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে জ্ঞানের উন্নয়ন সামঞ্জস্য রাখতে পারছে।’’

৬২ শতাংশ রাজনীতিক মনে করেন বর্তমান সম্ভাব্য প্রার্থীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। অবশ্য ৪৮ শতাংশ মনে করেন, রাজনীতিকদেরই এধরণের প্রশিক্ষণের চাহিদা জানাতে হবে।