কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভিবাসী ছাত্ররা কেন সফল হচ্ছে
অক্টোবর ৫, ২০১৪: কানাডায় জন্মগ্রহণকারী বাবা-মার সন্তানদের চেয়ে অভিবাসী বাবা-মার সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ
কুইন্স ইউনিভার্সিটির গার্নেট পিকট এবং ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির ফেং হউ লিখেছেন, ‘‘কানাডায় অভিবাসী ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে।’’
দ্বাদশ গ্রেডের গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানে যোগদানকারী বা ভ্যাঙ্কুভার অথবা টরন্টোর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকারী শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই সাফল্যের সাক্ষর রেখেছে।
কিন্তু স্টেটিস্টিকস কানাডার পক্ষে গার্নেট পিকট ও ফেং হউ-এর এক সমীক্ষার ফলাফল কিছু লোককে বিস্মিত করতে পারে। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, কানাডায় জন্মগ্রহণকারী বাবা-মার সন্তানদের চেয়ে অভিবাসী বাবা-মার সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ।
কানাডার প্রধান প্রধান শহরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগ্রহ করা সমীক্ষার পরিসংখ্যানে এটি নিশ্চিত যে, দৃশ্যত সংখ্যালঘু অভিবাসীদের সন্তানেরাই অনার্স ক্লাসে এবং ব্যবসায়, বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের মত বিষয়গুলোতে সাফল্যের পরিচয় দিচ্ছে।
কুইন্স ইউনিভার্সিটির গার্নেট পিকট এবং ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির ফেং হউ লিখেছেন, ‘‘কানাডায় অভিবাসী ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে।’’
ওই সামাজিক নীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন যে, কানাডায় অভিবাসী হিসাবে আসা শিক্ষার্থীদের শতকরা ৫০ জন, বাবা-মায়ের মধ্যে একজন অভিবাসী এমন পরিবারের শিক্ষার্থদের শতকরা ৩১ জন এবং বাবা-মা উভয়েই কানাডীয় এমন পরিবারের মাত্র ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সাফল্যের কাহিনী চীনা বংশোদ্ভূতদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত জোরালো।
ফেং হউ ও তার সহ-লেখক লিখেছেন, ‘‘চীনা বংশোদ্ভূত তরুণ-তরুণীদের, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ‘‘কানাডীয় বাবা-মায়ের সন্তানের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি।
এর অর্থ হলো, চীনা বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থীদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়। এই হার কানাডীয় বাবা-মায়ের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার হারের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি।’’
এই ঘটনার ফলে নীতিগত বিষয়ে কী জটিলতা দেখা দিচ্ছে? পিকট ও হউ-এর সমীক্ষা সরকার ও স্কুল কর্তৃপক্ষের জন্য এক জটিল বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে। এই সমীক্ষাটি পরিচালনায় সহায়তা দিয়েছে ইমার্জিং রিসার্চ অ্যাক্রস কানাডা অ্যান্ড দ্য ইউএস।
কিছু পন্ডিত ব্যক্তি পিকট ও হউ এবং যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেস কেরর পরিচালিত ওই সমীক্ষার আলোকে শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান অগ্রাধিকারের বিষয়ে পরিবর্তন আনার আহবান জানাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, আমেরিকানদের চেয়ে অভিবাসীদের সন্তানেরা চাকরিবাকরির ক্ষেত্রে গড়ে বেশি বেতন পাচ্ছে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রেও তারাই এগিয়ে রয়েছে।
সমীক্ষায় প্রকাশিত অনেক বাস্তব তথ্যের মধ্যে একটি হলো, উত্তর আমেরিকায় যেসব শিক্ষার্থীকে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে ইংরেজি শিখতে হয় তারা একারণে কোনওরকম অসুবিধার
সম্মুখিন হচ্ছে না।
১৫ বছর বয়সে যেসব অভিবাসী পরিবারের শিশু মানসম্মত ভাষা পরীক্ষায় দুর্বলতার পরিচয় দেয় তারাও দ্বাদশ গ্রেডে পৌঁছে ভাষাগত চ্যালেঞ্জে নাটকীয়ভাবে উৎরে যায়। সমীক্ষায় বলা হয়, বিশেষ করে চীনা শিক্ষার্থী এবং এশীয় মেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এটি দেখা গেছে।
মাধ্যমিক পর্যায়ে (১৫ বছর বয়সে) ভাষাগত দুর্বলতা দেখিয়েছে এমন চীনা শিক্ষার্থীদের একই ধরণের কানাডীয় শিশুর চেয়ে সাত গুণ বেশি সংখ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সমীক্ষায় এটাও দেখা গেছে যে, ইউরোপ থেকে আসা অভিবাসী পরিবারের সন্তানেরাও তৃতীয় প্রজন্মের কানাডীয়দের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল করছে না।
এশিয়া থেকে আসা শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন সাফল্যের পেছনে কী কারণ রয়েছে?
দি ট্রিপল প্যাকেজ গ্রন্থের লেখক অ্যামি চুয়া চীনা ও ইহুদি পটভূমি থেকে আসা লোকেদের পাশাপাশি ইরান, কোরিয়া ও দক্ষিণ এশীয়দের সাফল্যের পেছনে তাদের তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেন : দলগতভাবে শ্রেষ্ঠত্বের বোধ (মৎড়ঁঢ় ংঁঢ়বৎরড়ৎরঃু পড়সঢ়ষবী), ব্যক্তিগত উদ্বেগ এবং তাদের অনুপ্রেরণাকে নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক অ্যামি চুয়ার উল্লেখিত এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই আমেরিকায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর জনগণের উত্থান ও পতনের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে।
পিকট এবং হউ অবশ্য অভিবাসী তরুণ-তরুণীদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইতিবাচক ফলাফল করার নিজস্ব ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রথমত, কানাডার স্কুলগুলোতে ইউরোপের মত শিক্ষার্থীদের টিনএজে বৃত্তিমূলক ও একাডেমিক শিক্ষায় ভাগ করে দেয় না। এর ফলে কানাডায় অভিবাসী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করার আগে নতুন ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য সময় পায়। এয়াড়া পিকট ও হউ মনে করেন, কানাডার অভিবাসন নীতিতে দক্ষ ও সম্পদশালী অভিবাসীদের প্রাধান্য দেয়া হয়, যে কারণে অনেক এশীয় অভিবাসী অধিকতর শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং তারা তৃতীয় প্রজন্মের কানাডীয়দের চেয়েও ক্ষেত্রবিশেষে স্বচ্ছল হয়ে উঠেছেন। তারা অনেক বেশি নাগরিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত। ভ্যাঙ্কুভার নগরীর জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ বিদেশী বংশোদ্ভূত। সম্ভবত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, গবেষকরা বিখ্যাত টাইগার মম খ্যাত অ্যামি চুয়ার পথ অনুসরণ করেছেন এবং তারাও উল্লেখ করেন যে, এশীয় অভিবাসী মায়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সন্তানের সাফল্যের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য অনেক বেশি জোর দিয়ে কাজ করেন (তারা কলেজ বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিষয়ে মনোযোগ দেন না)।
গবেষকদ্বয় বলেন, ‘‘কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভিবাসীদের সন্তানদের সাফল্যের পেছনে যেসব উপাদান কাজ করে তার বিরাট অংশই হলো শিক্ষার্থী ও অভিভাবক উভয়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল করার প্রবল আকাঙ্খা।
সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আগে থেকে দেখতে না পাওয়া এই প্রবণতার প্রেক্ষিতে নীতি-নির্ধারকদের কী করা উচিৎ?
এই একই ধরণের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছিলো ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থায় যেখানে অক্সফোর্ডের অর্থনীতিবিদ পল কলিয়ের দেখতে পান যে, অভিবাসীদের সাফল্য ব্রিটেনের স্বল্প-সফল শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপ্রেরণার পরিবর্তে মনোবল ভাঙ্গার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কলিয়ের তার বই ‘গণদেশত্যাগ: অভিবাসন কীভাবে বিশ্বকে পাল্টে দিচ্ছে’তে (ঊীড়ফঁং: ঐড়ি গরমৎধঃরড়হ রং ঈযধহমরহম ঃযব ডড়ৎষফ) লিখেন, ‘‘ দশকের পর দশক ধরে নিজেদের আশা-আকাঙ্খা নিয়ে হতাশার মুখোমুখি হয়ে স্থানীয় অসফল সংখ্যাগুরুদের জন্য ভাগ্যের বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং তারা হতাশা এড়াতে কোনরকম চেষ্টা করা থেকে বিরত থাকছে।’’
এই ভারসাম্যহীনতার বিষয়ে নীতিগত কী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে? পাশ্চাত্যের দেশগুলো চিহ্নিত করার সুযোগ রয়েছে এমন সংখ্যালঘু গ্রুপগুলোর জন্য সার্বজনীন কর্মসূচি অথবা ইতিবাচক অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছে। এসব কর্মসূচি বা পরিকল্পনার কোনওটিতেই স্থানীয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের, যাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মনোবল হারানো, অধিকতর অব্যাখ্যাত চাহিদার প্রতি মনোযোগ দেয়া হয়নি।
কোলিয়ের লিখেছেন, ‘‘মনোবল হারানোর বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে প্রতিযোগিতার কারণে : কর্মজীবী শ্রেণীর সন্তানেরা যারা তাদের ব্যর্থতার সম্ভাবনার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার জন্য চাপ এড়িয়ে যায় তারা কার্যত আশাবাদী অভিবাসী শিশুদের সঙ্গে জায়গা পাওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়।’’
কোলিয়েরের আগের বইয়ের নাম ছিলো দি বটম বিরিয়ন। তিনি বলেন, অধিক সংখ্যক অভিবাসী রয়েছে এমন দেশগুলো যেমন ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা কখনই স্বল্পসফল স্থানীয় লোকেদের সমস্যার সমাধান করা যায় সে সম্পর্কে কোন দিকনির্দেশনা তৈরি করেনি।
শিক্ষা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পল ব্যানেট বলেন, ‘‘সবচেয়ে বড় ও কঠিন প্রশ্ন হলো’’ কানাডার স্বল্প সফল স্থানীয় অধিবাসীদের সহায়তার জন্য কোন ধরণের কর্মকৌশল নিয়ে এগিয়ে আসা।
হ্যালিফ্যাক্সে সেন্ট ম্যারিস ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনারত ব্যানেট কানাডীয় বংশোদ্ভূত সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রেরণার অভাবের কারণে উদ্বিগ্ন। তার গবেষণায় দেখা গেছে, কানাডীয় বংশোদ্ভূত সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকের মধ্যেই শৈথিল্য রয়েছে।
এর পরও সরকার বা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউই কোনরকম সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসেননি। তা সত্বেও এটিকে কোনও নিশ্চিত কৌশল বলে মনে না হলেও কোনও ধরণের জাতিগোষ্ঠীগত-সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মধ্য দিয়ে অন্তত কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার হতে পারে।
চুয়া, পিকট ও হউয়ের মত ব্যানেটও বলেছেন যে, অভিবাসী শিক্ষার্থীদের ভালো করার পেছনে তাদের ‘‘বাবা-মায়েদের সাংস্কৃতিক মনোভাব’’ বহুলাংশে দায়ী।
তবু তিনি চুয়ার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বললেন, পারিবারিক চাপে পরিচালিত হওয়া শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতির কারণ থেকে যেতে পারে। অনেক অভিবাসী শিক্ষার্থী শেষ পর্যন্ত মানসিক রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়।
এজুকেটার (ঊফঁপযধঃঃবৎ) নামে একটি ওয়েবসাইট পরিচালনাকারী ব্যানেট বলেন, অভিবাসী ও কানাডীয় বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থীরা পরস্পরের কাছ থেকে কিছু শিক্ষা নিতে পারে।
তিনি বলেন, গড়পরতা শিশু যারা মাঝারি স্তরের সাফল্য দেখাচ্ছে তারা সেরা সাফল্য অর্জনকারী শিশুদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর মাধ্যমে লাভবান হতে পারে। একইসঙ্গে সেরা ফলাফলকারী অভিবাসী শিশুরা কানাডীয় শিশুদের কাছ থেকে কিছু বিষয় শিখতে পারে যে, ‘‘উচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য লাগামহীন ও অস্বাস্থ্যকর প্রয়াস চালানোর চেয়ে সংযত হওয়া’’ কখনও কখনও অনেক বেশি ভালো।
কানাডায় এই দুই ধরণের প্রবণতাকে কাছাকাছি আনা কি সম্ভব?
-সৌজন্যে : ভেঙ্কুভার সান