কানাডার নতুন অভিবাসন বিল এক ট্রয়ের ঘোড়া
সি-২৪ শীর্ষক বিলটি রক্ষণশীল সরকারকে কানাডীয়দের নাগরিকত্ব হরণের নজীরবিহীন কর্তৃত্ব দেবে
কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন নাগরিকত্ব আইন একটি ট্রয়ের ঘোড়া
টমাস ওয়ালক , মার্চ ৫, 2014 : প্রতারণার ঘটনা কমিয়ে আনা এবং কানাডার নাগরিক হওয়ার প্রক্রিয়াটি যৌক্তিক করার প্রয়াস হিসাবে এ বিল আনা হয়েছে এবং দুটিই অত্যন্ত বাস্তবসম্মত লক্ষ্য।
কিন্তু এটি প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের রক্ষণশীল সরকারকে এদেশে জন্মগ্রহণকারী হাজার হাজার মানুষসহ কানাডীয়দের নাগরিকত্ব হরণের নজীরবিহীন ক্ষমতা দেবে। এসবই হলো অভিবাসন মন্ত্রী ক্রিস আলেকজান্ডারের সাম্প্রতিক প্রকাশিত বিল সি-২৪-এর সবচেয়ে কট্টর ব্যবস্থা।
বিদেশে জন্মগ্রহণকারীদের জন্য কানাডার নাগরিকত্ব আইন ঐতিহাসিকভাবেই ছিলো কঠিনতর। ১৯২০-এর দশকে সরকার শত শত ন্যাচারালাইজড কানাডিয়ানের মর্যাদা হরণ করে নেয় কারণ সরকার মনে করে তারা কমিউনিস্ট।
১৯৪৭ সালের একটি আইনে (তারপর থেকে অকার্যকর) সরকারকে ক্ষমতা দেয়া হয়, বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত বিদেশে জন্মগ্রহণকারী কানাডীয়র নাগরিকত্ব হরণ করার।
বর্তমান আইন সরকারকে এমন ক্ষমতা দিতে যাচ্ছে যাতে সরকার ন্যাচারালাইজড কানাডীয়র নাগরিকত্ব হরণ করতে পারবে যদি প্রমাণ হয় যে, প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নাগরিকত্ব নেয়া হয়েছে।
তবে সব সময়ই এদেশে জন্মগ্রহণকারী কাানডীয়দের নাগরিকত্ব অপরিবর্তনযোগ্যই ছিলো। এই অবস্থা আর থাকছে না। বিল সি-২৪ সরকারকে এমন ক্ষমতা দিচ্ছে যাতে বিশ্বের যে কোনও দেশে সন্ত্রাসবাদের দায়ে অভিযুক্ত ও কমপক্ষে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে ন্যাচারেলাইজড বা এদেশের মাটিতে জন্মগ্রহণকারী যে কোনও কানাডীয়র নাগরিকত্ব সরকার বাতিল করতে পারেবে।
অন্য যে অপরাধে কানাডীয়দের নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে সেগুলো হলো বিশ্বাসঘাতকতা এবং গুপ্তচরবৃত্তি।
এর যে কোনও ক্ষেত্রে শুধু এতটুকু নিশ্চয়তা থাকবে যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি হিসাবে ঘোষণা করা যাবে না।
এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কোনও আদালতের প্রয়োজন হবে না করতে পারবে মন্ত্রিসভাই এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন এসব ব্যবস্থা শুধুমাত্র দ্বৈত নাগরিকদের ক্ষেত্রে অর্থাৎ যারা কানাডার পাশাপাশি অন্য কোনও দেশের নাগরিক তাদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে। কারিগরি দিক থেকে এটি সত্য। কিন্তু প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে যেটি বলা হয়নি সেটি হলো, এদেশে জন্মগ্রহণকারী হাজার হাজার নাগরিক হয়তো বিষয়টি অনুধাবন না করেই দ্বৈত নাগরিক হতে পারেন।
এর কারণ হলো, যেমনটা সরকারের পররাষ্ট্র দফতরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, অনেক দেশই তাদের নাগরিকদের সন্তান এমনকি নাতি-নাতনিদেরও জন্মস্থানের বিষয়টি ধর্তব্যের মধ্যে না নিয়ে সেদেশের নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করে।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায় মিসরের কথা, দেশটি যে কোন মিসরীয় নাগরিকের সন্তানের জন্ম কোথায় হলো সেটি বিবেচনা না করে তাদেরকে সেদেশের নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করে।
টরন্টোর আইনজীবী লোরনে ওয়াল্ডম্যান বলেন, কানাডার সরকার হয়তো এই বিষয়টিকে সাবেক শিশু সৈনিক এবং গুয়ান্তানামো কারাগারের বন্দী ওমর খাদর-এর কানাডীয় নাগরিকত্ব বাতিলের জন্য ব্যবহার করতে পারে। বৈধতা নিয়ে সন্দেহ আছে যুক্তরাষ্ট্রের এমন একটি সামরিক আদালতে সন্ত্রাসবাদ সংশ্লিষ্ট অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত খাদর এখন আট বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছে। তার জন্ম টরন্টোতে। সে কখনই মিসরে যায়নি। কিন্তু সেখানেই তার মরহুম বাবার জন্ম হয়েছিলো। আর নতুন এই বিল খাদরকে বন্দুকের নলের মুখে ফেলতে যাচ্ছে।
খাদর-এর মতো লোকদের টার্গেট করে প্রণীত আইনকে অনেকেই হয়তো স্বাগত জানাতে পারেন। তবে তারা যেটা আশা করেন সে বিষয়ে তাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। বিল সি-২৪ একটি বি¯তৃত জাল পাততে যাচ্ছে। কারও নাগরিকত্ব বাতিল করার ক্ষেত্রে সরকার প্রমাণ করতে যাবে না লোকটি দ্বৈত নাগরিক কিনা। বরং অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হবে যে সে দ্বৈত নাগরিক নয়।
তারা জানুক আর নাই জানুক এদেশে অনেক দ্বৈত নাগরিক রয়েছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও কানাডীয়দের নাগরিকত্ব দেয় যদি তার বাবা অথবা মায়ের মধ্যে একজন আমেরিকান হন।
যুক্তি দেয়া যেতে পারে যে নাগরিকত্ব কোন অধিকার নয় এটি একটি সুবিধা। বলা যেতে পারে যে, জন্মস্থান নির্বিশেষে যে কোন ব্যক্তি গুরুতর বা ছোটখাট অপরাধ করলে তাকে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হবে। একটি আদর্শ বিশ্বে এই যুক্তির সারবত্তা থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তরের জগতে জনমত পরিবর্তন হতে পারে এবং সরকার অযৌক্তিক হিসাবে পরিগণিত হতে পারে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কানাডা আন্তরিকভাবেই এমনটা মনে করেছে যে এদেশে জন্মগ্রহণকারীসহ সব জাপানিজ-কানাডীয়কে জাপানে স্থানান্তর করা হবে। এটি সম্ভবতঃ সেই সময়ের জন্য একটি জনপ্রিয় পদক্ষেপ হতে পারতো।
বাস্তবের জগতে যেমনটা দেখা গেছে কীংবদন্তীর বর্ণবাদ-বিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনে- গতকালের সন্ত্রাসবাদী আগামীকাল নায়ক হিসাবে বরণীয় হতে পারেন।
আমরা কিছু জন্মগত অধিকার ভোগ করি। এর মধ্যে একটি হলো আমরা যেদেশে জন্মগ্রহণ করি সেই দেশের নাগরিক হই। বর্তমান সরকার এই অধিকারকে এমন একটি বিষয়ে পরিণত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে যাতে এটি পার্লামেন্ট যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে তাদের হুজুকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। আমরা কি সত্যিই তা চাই?
সৌজন্যে : টরন্টো স্টার